-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
অনেক নামকরা দার্শনিক, অনেক রকম যুক্তি-তর্ক দিয়ে ভাববাদকে অপ্রমাণ করতে চেয়েছেন। তবু ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি। বরং একে খণ্ডন করবার জন্য বুদ্ধির জৌলুশে দীপ্ত যে-সব দার্শনিক প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, শেষপর্যন্ত র্তারা ভাববাদের স্নিগ্ধচ্ছায়াতেই ক্লান্ত দার্শনিক চেতনা এলিয়ে দিলেন।
যেন ভাববাদই একমাত্র আর অনিবার্য দার্শনিক মতবাদ, যেন মানুষের বুদ্ধি এই চূড়ান্ত অসম্ভবের পায়ে যুগ যুগ ধরে মাথা কুটেছে, তবু মুক্তি পায়নি। তার দাসত্ব থেকে।
আসলে, একদিক থেকে বাস্তবিকই তাই। শুধু বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না-যে-দর্শন বুদ্ধির দাবিকে, বিশুদ্ধ চেতনার দাবিকে চরম দাবি বলে দেখতে চায়, সে-দর্শন শেষ-পর্যন্ত ভাববাদেই পরিসমাপ্তি পেতে বাধ্য। তাই শুধু তর্ক-বলে ভাববাদকে অস্বীকার করতে গেলে শেষ-পর্যন্ত তর্কের খাতিরেই ভাববাদকে স্বীকার করতে হয়। একথা নৈয়ায়িকভাবে অনিবার্য, এবং এর সামাজিক কারণটুকুও স্পষ্ট।
নৈয়ায়িকভাবে কেন যে অনিবার্য, প্রথমে তা-ই আলোচনা করা যাক। সামাজিক ভিত্তির কথা প্রথমেই তোলা উচিত; তবুও পরে তোলাই ভালো। কেননা পণ্ডিতমহলের এতদিনকার একটানা প্রচারের ফলে দর্শনের সাধারণ ছাত্রের পক্ষে দার্শনিক বিচারে নিছক নৈয়ায়িক সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া আজ প্রায় অভ্যাসে পরিণত।
নানানভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা বা চেতনা বা বুদ্ধি বা মন,- বা অমাজিত মানুষের কাছে খটকা লাগে, এই ভয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছে ভগবান-যে-কোন শব্দ দিয়েই একে বর্ণনা করা যাক না কেন, তাকেই পরমসত্তা বলে মানতে হবে, তার দাবিই চরম দাবি, তার উপর নির্ভর করে। বলেই বাস্তব হলো বাস্তব, তার উপর যা নির্ভর করে না তার নাম অলীক।
তাই শুরুতেই সামাজিক উৎসের কথা প্রতিবন্ধ হয়ে দাড়াতে পারে। আমাদের প্রাচীনেরা বলতেন। “শাখা চন্দ্র-স্যায়”-চাদ যদি গাছের আড়ালে থাকে, তাহলে প্রথম চেষ্টাতেই সে চাদ কাউকে দেখানো হয়তো কঠিন; তাই গাছের সেই শাখার দিকেই প্রথমে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়।
দার্শনিক আলোচনাতেও তাঁরা এইভাবে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিয়েছেন। যে-কথা শুনতে শ্রোতার অভ্যাস আছে, সেই কথাতেই আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত, পরে যে-কথায় তিনি অনভ্যস্ত, সেই কথার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া ভালো।
কেবল মনে রাখতে হবে, লোকায়তিক দৃষ্টিতে নিছক নৈয়ায়িক আলোচনা অর্থহীন ও অবাস্তর; মূর্ত সামাজিক পরিপ্রেক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, লৌকিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োগ থেকে বিচুত হলে, দার্শনিক আলোচনা-তা সে যতই যুক্তিকণ্টকিত ও আপাতপাণ্ডিত্যপূর্ণ হোক না কেন-কাকদন্ত পরীক্ষার মতো বৃথা হতে বাধ্য।
কেননা দর্শন শুধু শৌখিন মানুষের অবসর বিনোদন নয়, শ্রেণীসংগ্রামের অস্ত্রও। এতদিন পর্যন্ত পরোক্ষভাবে তাই হয়ে এসেছে, আজকে প্রত্যক্ষভাবে হবার দিন এসেছে। কিন্তু শুরুতেই এসব কথা প্রতিবন্ধ সৃষ্টি করবে। আপাতত শাখাকে চন্দ্র মনে করেই অগ্রসর হওয়া যাক, আলোচনা করা যাক, তর্ক-বলে কেন যে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব নয়, তার নৈয়ায়িক অনিবার্যতা নিয়ে।
তর্ক বলে, শুধু বুদ্ধি দিয়ে, ভাববাদকে খণ্ডন করা অসম্ভব; এ প্রচেষ্টা স্ববিরোধী, অতএব আত্মঘাতী। বুদ্ধি দিয়ে খণ্ডন করতে গেলে মেনে নিতে হবে বুদ্ধির দাবি-তর্কের দাবি, চেতনার দাবি-চরম দাবি; মানতে হবে, এ দাবি মেটাতে পারে না বলেই আলোচ্য মতবাদ সমর্থনের অযোগ্য। তর্কমূলক খণ্ডনের আর কী মানে হওয়া সম্ভব?
কিন্তু ওটুকুকে স্বীকার করা মানেই ভাববাদকে স্বীকার করা। কেননা, ভাববাদের মূল কথাও ওই একই; চেতনার দাবিই চরম দাবি; চেতনাই প্রাথমিক ও পরম সত্য। এ-কথাকে।
নানানভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা বা চেতনা বা বুদ্ধি বা মন,- বা অমাজিত মানুষের কাছে খটকা লাগে, এই ভয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছে ভগবান-যে-কোন শব্দ দিয়েই একে বর্ণনা করা যাক না কেন, তাকেই পরমসত্তা বলে মানতে হবে, তার দাবিই চরম দাবি, তার উপর নির্ভর করে। বলেই বাস্তব হলো বাস্তব, তার উপর যা নির্ভর করে না তার নাম অলীক।
রাসেল বলছেন (মনে রাখতে হবে, রাসেল হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন প্রধান, আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে একজন প্রধান বর্ণচোরা ভাববাদী) : “একদিক থেকে মানতেই হয় যে, আমরা নিছক নিজেদের সত্তা এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর সত্তা প্রমাণ করতে পারি না।
তাই মানা চলবে না চেতনা-নিরপেক্ষ কোনো জড়পদার্থকে, বলতে হবে বস্তুর ধারণা নেহাতই নামমাত্র সত্য (বার্কলির নামমাত্রবাদ)।
দর্শনের মূল প্রশ্ন হলো- বুদ্ধির কাছে যে দাবি প্রাথমিক ও মৌলিক, পরমসত্তা কি সেই দাবি মেটাতে বাধ্য? ভাববাদী বলবেন- নিশ্চয়ই; সেটুকুই তো আমাদের দর্শনের সচেতন ভিত্তি; এবং শুধু আমার দর্শনের কেন, যারা আমার কথা মানেনও না, তারাও এই ভিত্তিটুকুকে অচেতনভাবে স্বীকার করে নেন।
তাই ভাববাদকে খণ্ডন করতে গিয়ে যদি কেউ ভাববাদের এই মূল কথাটুকুই মেনে নেন, যদি আশা করেন তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব হবে, – অর্থাৎ, দেখানো যাবে, তর্কের দাধি মেটাতে পারে না বলেই ভাববাদ ভ্রান্ত-তাহলে ভাববাদীর পক্ষে এতটুকুও বিচলিত বোধ করবার কারণ নেই।
ভাববাদী জানেন, যে-পূর্বপক্ষ বুদ্ধির দাবিকে চরম দাবি বলে মেনে নিয়েছে, সে-পূর্বপক্ষ সাপও নয়, সাপিনীও নয়, শুধু ফোঁস-ফোঁস; নেহাতই পোষা সাপ, যে-সাপ কখনো ছোবল দেবে না।
তর্কের উপর বিরূপ হয়েছেন অনেক দার্শনিক, বুদ্ধি সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ হয়েছেন অনেকে। তাঁরা কেউবা ধরেছেন নিবুদ্ধির পথ, কেউবা অতিবুদ্ধির। এঁদের কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে, শ্রেণীর দাবি আর যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে বুদ্ধির যেটুকু আসল অবদান, সেটুকুকেই এরা কেমনভাবে অস্বীকার করেন, আর কেমনভাবে মেনে নেন, শুদ্ধবুদ্ধির যেটা আসল গ্লানি, তাকেই।
আপাতত দেখা, যাক কোনো কোনো দার্শনিক কী রকম স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে অনুভব করেছেন, শুধু তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে ফরাসী দার্শনিক দিদারো এবং ইংরেজ দার্শনিক রাসেল-এর উল্লেখ করা যায়…
রাসেল বলছেন (মনে রাখতে হবে, রাসেল হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন প্রধান, আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে একজন প্রধান বর্ণচোরা ভাববাদী) : “একদিক থেকে মানতেই হয় যে, আমরা নিছক নিজেদের সত্তা এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর সত্তা প্রমাণ করতে পারি না।
পৃথিবীতে শুধু আমরা এবং আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়বেদনা ছাড়া আর যে কিছুই সত্য নয়, বাকি সবই যে আমাদের কল্পনামাত্র, এই অর্থপত্তি থেকে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা হয়তো ঘনায় না। -সমস্ত জীবনটাই যে একটা স্বপ্ন, সে স্বপ্নে আমাদের সামনে যা কিছু ঘটছে তা আমাদেরই সৃষ্টি, এ কথা ভাবার মধ্যে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা নেই। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের দিক থেকে যদিও এ কথা অসম্ভব নয়, তবুও একে সত্যি বলে মানবার কোনো রকম কারণ নেই।”
“যে-সব দার্শনিকেরা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব এবং নিজেদের মনের মধ্যে ইন্দ্রিয়-পরম্পরার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তঁদেরই নাম ভাববাদী! এ হলো এক রকমের দার্শনিক নবাবিয়ানা, আমার তো মনে হয় শুধুমাত্র অন্ধ মানুষ এরকম দর্শনের জন্ম দিতে পারে; তবুও মানুষের বুদ্ধির আর দর্শনের গলায় দড়ি, এ মতবাদ সবচেয়ে আজগুবি হলেও একে খণ্ডন করা সবচেয়ে দুরূহ।”
যদিও নৈয়ায়িকভাবে অসম্ভব নয়, তবুও একে মানবার কোনো তাগিদ। নেই-কথাটা একদিক থেকে ঠিক। অধিবিদ্যার বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা না গেলেও ভাববাদকে মানবার কোনো তাগিদ বাস্তবিকই নেই, কেননা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভাববাদের অন্তঃসারশূন্যতা একেবারে প্রকট হয়ে পড়ে।
কিন্তু রাসেল তো আর সে-দিকে এগোননি। বরং তিনি আগে থাকতে উলটো সুর গেয়ে উলটোভাবে গোড়া বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, আগে থাকতে তিনি বলে রেখেছেন-দার্শনিক হবার বাসনা থাকলে আজগুবিকে ভয় করলে চলবে না (দার্শনিক হবার বাসনা, না ভাববাদী হবার বাসনা?)।
তাই আমাদের দেশের ন্যায়-সূত্রকার রাসেল-এর মুখে এমনতর কথা শুনলে নিশ্চয়ই উৎসাহিত হয়ে উঠতেন। কেননা, তিনি যে অনুপপত্তির নাম দিয়েছেন ‘বিরুদ্ধ, তার দৃষ্টান্ত অপেক্ষাকৃত বিরল, এবং রাসেল-এর এই উক্তি সেই অনুপপত্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সিদ্ধান্তমত্যুপেত্য তৎবিরোধী বিরুদ্ধ- রাসেল-এর অজস্র অস্থিরমতিত্ব সত্ত্বেও সমস্ত দর্শন ধরে তিনি শুদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের দাবিকে, প্রয়োগ-জীবনের সঙ্গে লেশ সম্পর্কহীন বিশ্লেষণের দাবিকে চরম দাবি বলে ঘোষণা করেছেন; আর তা সত্ত্বেও কিনা হঠাৎ বলে বসেছেন, ভাববাদ খণ্ডন এ দাবিকে মেটাতে না পারলেও অস্বীকার্য নয়!
তর্কবলে ভাববাদকে যে অপ্রমাণ করা যায় না, এ কথায় রাসেল-এর অবশ্য তেমন কোনো বিক্ষোভ নেই, হাজার হোক রাসেল হলেন ম্যাক-আভেনেরিয়সের দার্শনিক বংশধর, প্রচ্ছন্ন ভাববাদীই। কিন্তু ফরাসী দার্শনিক দিদারো-র পক্ষে অত সহজে এই কথা স্বীকার করা কঠিন।
তিনি মনেপ্রাণে বস্তুবাদী, ভাববাদের কবল থেকে তাঁর মুক্তি-প্রয়াসের মধ্যে ফাকি নেই। তাই, তর্কবলে ভাববাদের অসম্ভাবনাকে অপ্রমাণ করা যাচ্ছে না দেখে তার যে আক্ষেপ ও অসহিষ্ণুতা, সেটা লক্ষ করবার মতো :
“যে-সব দার্শনিকেরা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব এবং নিজেদের মনের মধ্যে ইন্দ্রিয়-পরম্পরার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তঁদেরই নাম ভাববাদী! এ হলো এক রকমের দার্শনিক নবাবিয়ানা, আমার তো মনে হয় শুধুমাত্র অন্ধ মানুষ এরকম দর্শনের জন্ম দিতে পারে; তবুও মানুষের বুদ্ধির আর দর্শনের গলায় দড়ি, এ মতবাদ সবচেয়ে আজগুবি হলেও একে খণ্ডন করা সবচেয়ে দুরূহ।”
‘লালরঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং ‘নীল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান,-এ দুয়ের মধ্যে প্রভেদ স্পষ্ট, এবং এ প্রভেদের কারণ বিষয়ের বিভিন্নতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আবার জ্ঞান হিসেবে দুটির মধ্যে সাদৃশ্য, সে সাদৃশ্যের কারণ উভয়ের মধ্যে চেতনার বিদ্যমানতা।
দিদারো-র এই উক্তি উদ্ধৃত করে লেনিন বলছেন, দিদারোই সাম্প্রতিক বস্তুবাদের খুব বেশি কাছ ঘোষতে পারেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, শুধু তর্ক বা শুধু যুক্তি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না, কেননা এখানে আসল কথা তর্কাতর্কির কথাই নয়।
নিছক তর্কবলে ভাববাদকে যে খণ্ডন করা যায় না, এ কথা প্রমাণ করবার জন্যে শুধু দুচারজন দার্শনিকের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করবার দরকার নেই। সাম্প্রতিক দর্শনে বুদ্ধিমূলক ভাববাদ খণ্ডনের চরম দৃষ্টান্তকে বিশ্লেষণ করা যাক; দেখা যাবে, বিপক্ষের অনেক বাকময় শরের শয্যায় শুয়েও ভাববাদ কী-রকম অক্ষত দেহে কী অক্ষুন্ন আয়াস উপভোগ করতে পারে।
স্থানাভাবের দরুন এখানে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত তুলব। সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের ভাববাদ খণ্ডন। সাম্প্রতিক দর্শনে সেইটিই প্রধান দৃষ্টান্ত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের প্রাচীনেরা বলেছেন, ‘প্রধান-মল্প-নিবর্হিণ ন্যায়’। মল্পক্ষেত্রে বিপক্ষ হিসেবে প্রধান মল্লকে যদি পরাভূত করা যায়, তাহলে ছোটখাট মল্পের সঙ্গে আর আলাদাভাবে লড়বার দরকার পড়ে না। দার্শনিক দ্বন্দ্বের বেলাতেও সেই রকম।
সাম্প্রতিক দর্শনে বস্তুম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন নিয়েই শোরগোল সবচেয়ে বেশি। এবং বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে প্রধান হলেন শ্রীযুক্ত মূর-ভাববাদের বিরুদ্ধে তিনি যে সুর শুরু করেছেন, বাকি সব বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী মোটামুটি তারই ধুয়ো ধরেন,-যদিও নানান ভাবে, নানান ভঙ্গিমায়।
তাই মুর-এর যুক্তিটাই প্রথমে ধরা যাক। মূর বলেন, ভাববাদ-তা সে যে-জাতেরই হোক না কেন, -প্রেরণা পেয়েছে বার্কলির সেই সরল উক্তি থেকে-সত্তার সার-পরিচয় তার অভিজ্ঞতায়। কিংবা, যা একই কথা, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুর সত্তা অভাবনীয়।
মূর বলেন, অতি সরল এক অনুপপত্তির উপর এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা। যে-কোনো অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি স্বতন্ত্র উপাদান পাওয়া যাবে। -এক হলো চেতনা, যার সঙ্গে সমস্ত ইন্দ্রিয়বেদনার সম্পর্ক; আর এক হলো চেতনার বিষয়, যার দরুন। এক অভিজ্ঞতা অন্য অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন।
‘লালরঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং ‘নীল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান,-এ দুয়ের মধ্যে প্রভেদ স্পষ্ট, এবং এ প্রভেদের কারণ বিষয়ের বিভিন্নতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আবার জ্ঞান হিসেবে দুটির মধ্যে সাদৃশ্য, সে সাদৃশ্যের কারণ উভয়ের মধ্যে চেতনার বিদ্যমানতা।
ভাববাদীর মূল যুক্তিকে উপরোক্তভাবে বর্ণনা করায় হয়তো অতি-সারল্যের অপবাদ জুটবে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে, আসল যুক্তিটা এ ছাড়া কিছুই নয়। উদাহরণ হিসেবে বার্কলি এবং বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধর কথা ধরা যায়; এঁদের যুক্তিই ভাববাদের প্রাঞ্জলতম নিদর্শন।
তাই, চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা, এ দুয়ের মধ্যে তফাত করতেই হবে; অথচ সেই প্রভেদকে অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের আসল ভিত্তি। চেতনার বিষয় ও বিষয়ের চেতনা-এ দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক, তারই নাম ‘জ্ঞান’ বা ‘সচেতন হওয়া’।
এ সম্পর্ক আদি ও অপূর্ব, এর জুড়ি আর কোথাও মিলবে না। তাই, নীল রঙ সম্বন্ধে যখন জ্ঞান হচ্ছে, তখন এ কথা বলা চলবে না যে, আমাদের চেতনায় নীল-রঙ-এর প্রতিবিম্ব পড়ছে, কেননা এখানে আসলে জ্ঞান হচ্ছে নীল-রঙ-এর জ্ঞান সম্বন্ধেই।
মূর এর ছোট প্রবন্ধ ‘ভাববাদ খণ্ডন’, তাতে যুক্তির জৌলুশকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু কথা হলো, সে-যুক্তির গভীরতা কতটুকু? সে-যুক্তি কি সত্যিই ভাববাদের যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারে? ভাববাদীর যুক্তি অত্যন্ত সরল ও অত্যন্ত স্পষ্ট; চেতনার বা জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে পড়ছে না। এমনতর।
কোনো বস্তু বা বিষয়কে আমরা কি জেনেছি? এ প্রশ্নের রকম থেকেই উত্তরটুকু সহজ হয়ে পড়ে – জানা মানেই চেতনার বা জ্ঞানের গণ্ডীভূত হওয়া; তাই যা চেতনার গণ্ডীভূত নয়, তাকে জানিবার কথাই ওঠে না। ভাববাদী বলবেন, যা কিছু আমরা জানি, তা সমস্তই চেতনার উপর নির্ভরশীল, কেননা তা অনিবার্যভাবেই চেতনার গণ্ডীভূত, চেতনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য-সম্বন্ধযুক্ত। চেতনার উপর নির্ভরশীল হওয়া মানেই মানসিক”।
অর্থাৎ, আমরা যা কিছু জানি, তা সমস্তই মানসিক। এবং দর্শনে এমন কোনো কিছুকে নিশ্চয়ই বাস্তব বলে মানা চলবে না, যার সম্বন্ধে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। এ কথাও তো অত্যন্ত সহজ কথা; যাকে জানা যায়নি, তাকে সত্যি বলে স্বীকার করবার অধিকার দার্শনিকেরও থাকতে পারে না।
তাই, দার্শনিক বিচারে শুধু চেতনানির্ভর বস্তুকে, শুধু মানসিক সত্তাকে একমাত্র সত্য বলে মানতে হবে। অর্থাৎ পরমসত্তা মানসিক, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ নয়।
ভাববাদীর মূল যুক্তিকে উপরোক্তভাবে বর্ণনা করায় হয়তো অতি-সারল্যের অপবাদ জুটবে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে, আসল যুক্তিটা এ ছাড়া কিছুই নয়। উদাহরণ হিসেবে বার্কলি এবং বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধর কথা ধরা যায়; এঁদের যুক্তিই ভাববাদের প্রাঞ্জলতম নিদর্শন।
(চলবে…)
…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : এক
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : দুই
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : প্রথম পর্ব
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : দ্বিতীয় পর্ব
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব এক
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব দুই