ভবঘুরেকথা
ভাববাদ আধ্যাত্মবাদ

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

বার্কলি বলছেন : “মানব-জ্ঞানের বিষয়াবলীকে যিনিই প্রেক্ষণ করেছেন, তাঁর কাছেই এ কথা স্পষ্ট যে, সেগুলি হয় ইন্দ্রিয়ের উপর বাস্তব ধারণার ছাপ, না-হয় নিজেদের মনের বাসনা ও ক্রিয়া সম্বন্ধে অনুভূতি, আর না-হয় স্মৃতি ও কল্পনাশক্তির দ্বারা গড়া ধারণামাত্র-

“সকলেই মানবেন, আমাদের মনের চিন্তা, বাসনা বা কাল্পনিক ধারণার কোনোটাই মানস-নিরপেক্ষ হতে পারে। না। এবং সে-কথার চেয়ে আমার কাছে এ-কথা একটুও অস্পষ্ট নয় যে, আমাদের বিভিন্ন অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়ের উপর ছাপা ধারণাগুলিকে যেমনভাবেই একসঙ্গে মিশেল করা হোক না কেন (অর্থাৎ, সেগুলি দিয়ে যে-কোন রকম বিষয়ই গড়া যাক না কেন), এগুলি অভিজ্ঞতাকারী-মন-নিরপেক্ষ হতেই পারে না।” বার্কলির যুক্তি আধুনিক পাঠকের কাছে অতি প্রসিদ্ধ, তাই এর দীর্ঘতর উদ্ধৃতি অবাস্তর হবে।

বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলছেন, জ্ঞান ও বিষয়ের মধ্যে সহোপলম্ভ নিয়ম বর্তমান, অর্থাৎ একটিকে ছাড়া অপরটিকে পাবার কোনো উপায় নেই। জ্ঞান ব্যতীত একেবল বিষয়, বা বিষয় ব্যতীত কেবল জ্ঞান কেউ কখনও অনুভব করতে পারে না।

এই সহোপলম্ভ নিয়ম থেকেই জ্ঞান ও বিষয়ের মধ্যে অভেদ সিদ্ধ হতে বাধ্য, এবং এই অভেদকে মানা মানেই বাহাবস্তুকে অস্বীকার করা-জান এবং জ্ঞানের বিষয় যদি একই হয়, তাহলে বাহুবিস্তুর স্থান আর কোথায়? এই অভেদভাবের প্রতিবন্ধক বা বিরুদ্ধ প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না, এমন দৃষ্টান্ত অসম্ভব যেখানে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে জ্ঞান-নিরপেক্ষ বাহবিস্তু রর্তমান।

বরং বাহবিস্তুকে যারা স্বীকার করেন, যারা বলেন বাহবিস্তু না থাকলে জ্ঞানের বিষয়ই থাকে না, অতএব জ্ঞানই সম্ভব হয় না, তাদের কথার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত মোটেই দুর্লভ নয়। অর্থাৎ, এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেখানে বাহবিস্তু সত্যিই নেই, অথচ তদাকার জ্ঞান হচ্ছে। যেমন স্বপ্নদর্শন, মায়াদর্শন, মরুমরীচিকায় জলদর্শন, আকাশে গন্ধৰ্বনগর দর্শন, এইরকম কতই তো দৃষ্টান্ত!

এখানে জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়, জ্ঞানই পূর্বক্ষণে বাহাবস্তুর আকার ধারণ করে এবং দ্বিতীয়ক্ষণে বিষয়ের গ্রাহকাকার ধারণ করে। অতএব, জ্ঞানের পক্ষে বিষয় ও বিষয়জান উভয়ের আকার ধারণ করা। এমন কিছু অসম্ভব কথা নয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলছেন,-বাহপদার্থকে যদি মানা যায়, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞান কেমন করে পরস্পরের থেকে ভিন্ন হতে পাৱে?

মুর বলছেন, জ্ঞানের বিষয় এবং বিষয়ের জ্ঞান, এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের প্রকৃত ভিত, অথচ এই তফাতকে স্বীকার না করে উপায়ও নেই। চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা যদি বিভিন্ন না হতো, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য সম্ভবপর হতো না। ‘লাল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং ‘নীল রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কীসের? নিছক চেতনা হিসেবে উভয় জ্ঞানই অভিন্ন, ফলে ভেদ নিশ্চয়ই জ্ঞানের বিষয়ে।

কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব এমন কিছু কঠিন নয়; বাহবিস্তু বলে জ্ঞানের কোনো বিষয় না। থাকলেও, জ্ঞান বা ধারণাই জ্ঞানের বিষয় হলেও, বিভিন্ন ধারণার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই; সেই পার্থক্যর দরুনই বিভিন্ন জ্ঞান পরস্পর থেকে পৃথক।

এবং বিভিন্ন ধারণার মধ্যে যে বৈচিত্র্য, তার ব্যাখ্যা করবার জন্যে বাহবিস্তু ও বাহবিস্তুর বৈচিত্র্যকে মানবার কোনো প্রয়োজন পড়ে না; বাসনা-বৈচিত্র্য দিয়েই তার যথেষ্ট ব্যাখ্যা হয়, এবং এই বাসনা জিনিসটা বাহ পদার্থ নয়, মানসপদার্থই।

বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বাসনা-বৈচিত্র্য দিয়ে জ্ঞান-বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করবার যে প্রচেষ্টা করেছেন, তা আমাদের প্রাচীন কালে অনেকটা দার্শনিক সহজ বুদ্ধির মতোই ছিলো, এবং অন্তত স্বপ্নাদির বেলায় এ-কথা যে অসম্ভব নয়, তার সপক্ষে নিশ্চয়ই আধুনিক মনস্তত্ত্বের দোহাই দেওয়া যায়।

বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধের বাকি যুক্তিগুলির কথা। আপাতত অপ্রাসঙ্গিক হবে। তাছাড়া উপরোক্ত যুক্তিই তার প্রধান যুক্তি, এবং বার্কলি প্রমুখ সমস্ত ভাববাদীর যুক্তির সারমর্ম এই একই কথা। এই যুক্তিকে খণ্ডন করতে হলে মাত্র দুটো পথে এগোনো সম্ভব। হয়।

প্রমাণ করতে হবে যে, জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যেই জ্ঞাননিরপেক্ষ বস্তুর সত্তাকে প্রমাণ করা যায়, আর না-হয় তো বলতে হবে, চেতনানিরপেক্ষ বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞানের স্বাক্ষর না থাকলেও অন্য স্বাক্ষর আছে এবং সে স্বাক্ষর অবিসংবাদিত। প্রথম পথে এগোনো অসম্ভব, কেননা-এ পথ আত্মবিরোধের পথ।

দ্বিতীয় পথে এগোতে গেলে বিশুদ্ধ তর্কের দাবি বা বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে চরম বলে মানা যায় না, প্রয়োগের কথা তুলতে হয়। মূর প্রমুখ সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের পক্ষে সে-কথা তোলা কেন সম্ভবপর নয়, এ আলোচনা স্বতন্ত্র। মোটের উপর কথা হলো, তারা সে পথে এগোতে চাননি। চেতনার গণ্ডির মধ্যে থেকে, তর্কের দাবি দেখিয়ে, তঁরা ভাববাদকে খণ্ডন করতে চান।

মুর বলছেন, জ্ঞানের বিষয় এবং বিষয়ের জ্ঞান, এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের প্রকৃত ভিত, অথচ এই তফাতকে স্বীকার না করে উপায়ও নেই। চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা যদি বিভিন্ন না হতো, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য সম্ভবপর হতো না। ‘লাল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং ‘নীল রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কীসের? নিছক চেতনা হিসেবে উভয় জ্ঞানই অভিন্ন, ফলে ভেদ নিশ্চয়ই জ্ঞানের বিষয়ে।

জড়বাদী, অজ্ঞানবাদী, এমন-কী বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী কোনো দার্শনিকের ব্যক্তিগত দুর্বলতা যদি থাকে, তাহলে এইসব অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলি কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের অনুপপত্তি নয়, কোনো কোনো দার্শনিক বিশেষের ব্যক্তিগত দুর্বলতামাত্র।

ভাববাদী বলবেন, এই যুক্তি ছাড়া মুর-এর ভাববাদ খণ্ডনের বাকি সবটুকুই নিছক ঘোষণামাত্র, প্রমাণ নয়। এবং এই যুক্তি দিয়ে, শুধু এই যুক্তি দিয়ে, ভাববাদকে নিশ্চয়ই খণ্ডন করা যায় না। প্রথমত, চেতনার বিষয়কে বিষয়ের চেতনা থেকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে নেহাত অর্থপত্তি হিসাবে, এবং অর্থপত্তির মূল্য বড় জোর সম্ভাবনামূলক।

অর্থাৎ, এই যুক্তি বড় জোর বস্তুর বা বিষয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সম্ভাবনা প্রমাণ করছে, অস্তিত্ব নয়। তাছাড়া, আসল প্রশ্ন হলো, সম্ভাবনা হিসেবে যে-বিষয়কে প্রমাণ করা গেল, তার প্রকৃত স্বরূপ কী রকম? ভাববাদী নিশ্চয়ই এমন কথা বলবেন না যে, জ্ঞানের বিষয় বলে সত্যিই কিছু নেই; মূর যেন ভাববাদীর ঘাড়ে এই কথা অধ্যস্থ করে।

তারপর এই কথাকে খণ্ডন করেছেন। ভাববাদী বলবেন, চেতনার বিষয় নিশ্চয়ই আছে, এবং সেই বিষয়ের দািকনই এক চেতনা অপর চেতনা থেকে ভিন্ন; কিন্তু এই বিষয় জড়বস্তু নয়, অন্তর্বস্তু মাত্র। এ বিষয় যে অন্তর্বস্তু, বহির্বস্তু নয়, তার প্রমাণ হিসেবে ভাববাদী বলবেন, নিছক বহির্বস্তুরূপে, চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিরহিত অবস্থায়, তাকে কখনও জানা যায়নি।

অথচ নিছক অন্তর্বস্তুর বিভিন্নতার দরুন জ্ঞানের বিভিন্নতা যে সম্ভবপর, তার উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন দার্শনিকদের গন্ধৰ্বনগর দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের ব্যাধিত অপচ্ছায়ার উল্লেখ করা যায়। তাই মূর-এর যুক্তি ভাববাদকে সত্যিই খণ্ডন করতে পারে না।

নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের ভাববাদ খণ্ডনের বেলাতেও একই কথা। তঁদের যুক্তির জৌলুশ অনেক কম, কিন্তু মেজাজ অনেক বেশি চড়া। ভাববাদের মূলে অন্তত সাত-সাতটা অনুপপত্তি তারা আবিষ্কার করেছেন। তার মধ্যে তিনটি -অতিসারল্য, দার্শনিক দুরাশা এবং বেহিসেৰী ভাষা ব্যবহারের অপবাদকোন কোন বিশেষ ভাববাদীর বিরুদ্ধে নিয়োগযোগ্য হলেও ভাববাদ মাত্রের বিরুদ্ধেই এইগুলি যে প্রযোজ্য হবে, তার কোনো মানে নেই।

জড়বাদী, অজ্ঞানবাদী, এমন-কী বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী কোনো দার্শনিকের ব্যক্তিগত দুর্বলতা যদি থাকে, তাহলে এইসব অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলি কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের অনুপপত্তি নয়, কোনো কোনো দার্শনিক বিশেষের ব্যক্তিগত দুর্বলতামাত্র।

তাই এগুলিকে বাদ দিতে হবে। নিছক দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ভাববাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চারটি; এবং মজার কথা এই যে, সে চারটি অভিযোগের নামরূপে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, সবগুলির মূলেই বক্তব্য এক।

১. এ পর্যন্ত মানুষ যা জেনেছে, তা সমস্তই জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল বলে সমস্ত বস্তুই যে জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই;

২. জ্ঞানের সময় চেতনার সঙ্গে বিষয়ের সম্পর্ক আছে বলে সে সম্পর্ক যে ত্রৈকালিক হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই,-যে লোক আজ রিপাবলিকান রাজনীতি করছে, আগামীকাল সে যে ডিমোক্রাটুদের ডেরায় ভিড়বে না, এমন কথা কি কেউ জোর করে বলতে পারে?

৩. বিষয়ের প্রাথমিক পরিচয়ে চেতনা-নির্ভরতা থাকলে এই পরিচয় যে তার চিরন্তন পরিচয় হবে, এমন কোনো কথা নেই,-“আগল” “পাগল” “ছাগল” শব্দে “গ” অক্ষর দ্বিতীয় অক্ষর বলে “গ” যে সর্বদাই শব্দের দ্বিতীয় অক্ষর হবে একথা দাবি করা যায় কি?

৪. বিষয়ের পক্ষে জ্ঞাত হওয়া গৌণ লক্ষণ মাত্র, তাকে মুখ্য লক্ষণ মনে করলে চলবে না, – প্রেমিকের সত্তা প্রেমের উপর নির্ভর করে নিশ্চয়ই।

রাজনীতি থেকে শুরু করে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার পর্যন্ত রকমারি দৃষ্টান্ত! একের পর এক অকাট্য যুক্তি। একের পিঠে শূন্য বসালেও দশ হয়, দশের পিঠে শূন্য বসালেও একশো হয়-একটি যুক্তির উপর আর একটি যুক্তি চাপিয়ে খণ্ডন করলে খণ্ডনের গুরুত্ব এইরকম হুড়হুড় করে বেড়ে যেতে পারে, অনুবতী যুক্তি যতই দুর্বল হোক না কেন।

সোনার পাহাড় সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না হলেও তার অস্তিত্ব কল্পনায় স্ববিরোধ নেই, কিন্তু সোনার পাথরবার্টির শুধু অভিজ্ঞতা অসম্ভব নয়, তার অস্তিত্ব-কল্পনায় স্ববিরোধ। অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথাও ওইরকমই স্ববিরোধী-কেননা, বিষয় মানেই অভিজ্ঞতার বিষয়, তা সে বাস্তব অভিজ্ঞতাই হোক, আর কাল্পনিক বা সম্ভব অভিজ্ঞতাই হোক।

কিন্তু শূন্যের পিঠে যাই বসানো যাক, ফল শুধুই শূন্যই, গুরুত্ব এতটুকুও বাড়ে না। নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর প্রথম বা একটি যুক্তির মূল্যও যদি শূন্যর চেয়ে বেশি হতো, তাহলে সত্যিইভাবনা থাকত না, ভাববাদকে যুক্তি দিয়ে ভেঙেচুরে মিসমার করে দেওয়া যেত।

কিন্তু ভাববাদের খণ্ডন হিসেবে কোনো একটি যুক্তিও শূন্যর চেয়ে বেশি সারবান নয়। তাই সাত-সাতটা যুক্তির পরেও ফল দাঁড়িয়েছে শুধু শূন্য দিয়ে শূন্যকে গুণ করার মতো।

ভাববাদী বলবেন, শুধুমাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্তে জ্ঞানের উপর বিষয়কে নির্ভরশীল হতে দেখে আমি যদি বলতুম, জ্ঞানের উপর বিষয় একান্তভাবে নির্ভর করে, তাহলে আমার কথাকে খণ্ডন করবার জন্যে নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর পক্ষে অত বড় অনুপপত্তির ফর্দ দরকার পড়ত না। কিন্তু আসল কথা মোটেই তা নয়।

আসল কথা হলো-এমন কোনো বিষয়ের সন্ধানও মানুষ এখন পায়নি, যার সত্তা চেতনানিরপেক্ষ। অতীতের সমস্ত মানুষ এবং বর্তমানের সমস্ত মানুষ দাড়কাককে কালো বলে চিনেছে বলেই দাঁড়কাকমাত্রকেই কি কালো বলে মানার তাগিদ নেই?

অবশ্য, শুধু এ জাতীয় যুক্তি-স্বদেশী ন্যায়শাস্ত্রে যাকে বলে অন্বয় – সুনিশ্চিত নিগমন স্থাপন করতে পারে না, শুধু অবাধিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে যে নিগমন পাওয়া যায়, তা সম্ভাবনামূলক মাত্র। কেননা, এখানে বিপরীত অভিজ্ঞতার কথা অন্তত কল্পনা তো করা যায়-বিপরীত অভিজ্ঞতা এতদিন পর্যন্ত অবাস্তব হলেও অসম্ভব। মোটেই নয়।

কিন্তু ভাববাদী বলবেন, আমার দর্শনের ভিত্তি এত কাঁচা নয়, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়কে এতদিন যে অভিজ্ঞতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, তাকে পাবার কথা ভাবাই যায় না, এমন-কী কল্পনাতেও নয়।

কেননা, নিছক বিষয় বা বিষয়মাত্রকে পাবার কথা কল্পনা করতে গেলে অন্তত কল্পনার সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বীকার করতে হবে; এবং কল্পনা যে-হেতু মানসক্রিয়ার প্রকারমাত্র, সেইহেতু উক্ত বিষয়কে মানসক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত, অতএব মানসক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, মনে না করে উপায় নেই। তাই মানস-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথা সোনার পাথরবাটির মতো।

সোনার পাহাড় সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না হলেও তার অস্তিত্ব কল্পনায় স্ববিরোধ নেই, কিন্তু সোনার পাথরবার্টির শুধু অভিজ্ঞতা অসম্ভব নয়, তার অস্তিত্ব-কল্পনায় স্ববিরোধ। অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথাও ওইরকমই স্ববিরোধী-কেননা, বিষয় মানেই অভিজ্ঞতার বিষয়, তা সে বাস্তব অভিজ্ঞতাই হোক, আর কাল্পনিক বা সম্ভব অভিজ্ঞতাই হোক।

কেন? কিন্তু শুধু এই কথা বলে থেমে যাওয়া যায় না, জ্ঞান নামক একত্র-সমাবেশের অন্তত একটা কোনো বৈশিষ্ট্য তো মানতেই হয়, কেননা যে-কোনো একত্র-সমাবেশের বেলায় তো জ্ঞান হয় না! আলোকজাণ্ডার বলছেন, এ বৈশিষ্ট্য সমাবেশের বৈশিষ্ট্য নয়, সমাধিত এক উপাদানের বৈশিষ্টা মাত্র। অর্থাৎ অন্যান্য সমাবেশের বেলায় উভয় উপাদানই বহির্বস্তু, জ্ঞানের বেলায় একটি উপাদান হলো মন বা জ্ঞাতা।

মূর একদা বলেছিলেন, ভাববাদীর মতে যে-হেতু অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বস্তুর সত্তা থাকতে পারে না, সেইহেতু মানতে হবে, ট্রেন একবার প্লাটফর্ম ছাড়বার পরই তার চাকা উবে যায়, কেননা চলন্ত ট্রেনে বসে ট্রেনের চাকা তো চোখে দেখা যায় না।

কিন্তু এই বিদ্রুপের ভাববাদী জবাব অতি সরল; চলন্ত ট্রেনের চাকাকে অযথার্থ মনে করা ভুল হবে, কেননা তা অভিজ্ঞতারই বিষয়; কেবল এই অভিজ্ঞতা বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়, ‘সম্ভব’। অভিজ্ঞতা মাত্র। ‘যে টেবিলের উপর আমি এখন লিখছি’।

বার্কলি বলেছিলেন, ‘সে টেবিলের অস্তিত্ব আছে’; অর্থাৎ আমি একে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি; এবং আমি যদি পড়ার ঘরের বাইরে যৌতুম, তাহলেও আমি বলতুম, এর অস্তিত্ব আছে; অর্থাৎ পড়ার ঘরে থাকলে আমি তাকে অনুভব করতে পারতুম; কিংবা অন্য কোন আত্মা বাস্তবিকই তাকে অনুভব করছে।”

সাম্প্রতিক বস্তম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন যে কীরকম পঙ্গু ও অথর্ব, আর একটি দৃষ্টান্ত দেখিয়ে এ আলোচনা শেষ করব। আলেকজাণ্ডার হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের আর একজন দিকপাল দার্শনিক। বিশ্বের সমস্ত সত্তাকে তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন, মন আর বহির্বস্তু।

এক ভাগের একটির সঙ্গে অপর ভাগের আর একটির সংযোগ ঘটলে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। ভেবে দেখতে হবে, এই সংযোগঠিক কোন জাতের। আলেকজাণ্ডার বলেন, এই সংযোগ-বিচারে ভাববাদীর দল মনকে অযথা প্রাধান্য দিয়ে বসে, মনে করে, এই সংযোগের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নির্ভর করে জ্ঞানের উপর।

আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়, এ সংযোগ অতি সাধারণ একত্র-সমাবেশ মাত্র, যে রকম একত্রসমাবেশ ডিশের সঙ্গে টেবিলের ৭ ডিশের উপর টেবিলের সত্তা নির্ভর করে। না, টেবিলের উপর ডিশের সত্তাও নয়। মনের উপর বিষয়ের সত্তা নির্ভর করবে।

কেন? কিন্তু শুধু এই কথা বলে থেমে যাওয়া যায় না, জ্ঞান নামক একত্র-সমাবেশের অন্তত একটা কোনো বৈশিষ্ট্য তো মানতেই হয়, কেননা যে-কোনো একত্র-সমাবেশের বেলায় তো জ্ঞান হয় না! আলোকজাণ্ডার বলছেন, এ বৈশিষ্ট্য সমাবেশের বৈশিষ্ট্য নয়, সমাধিত এক উপাদানের বৈশিষ্টা মাত্র। অর্থাৎ অন্যান্য সমাবেশের বেলায় উভয় উপাদানই বহির্বস্তু, জ্ঞানের বেলায় একটি উপাদান হলো মন বা জ্ঞাতা।

এই কথা শুনে ভাববাদী নিশ্চয়ই বিক্রম করে বলতে পারেন- অর্থাৎ আলেকজাণ্ডারের মতে “জ্ঞান” হলো এমন এক একত্র-সমাবেশ, যার একটি উপাদানের মধ্যে ‘জ্ঞান’ বর্তমান; এবং ন্যায়শাস্ত্রের অতি সাধারণ ছাত্রও জানে, এই জাতীয় সংজ্ঞা petitio principii নামের এক সরল অনুপপত্তি।

(চলবে…)

…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : এক
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : দুই
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : প্রথম পর্ব
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : দ্বিতীয় পর্ব
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব এক
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব দুই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!