দর্শন : অথর্ববেদ সংহিতা
-সুকুমারী ভট্টাচার্য
অথর্ববেদের বিষয়বস্তুর মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্বমূলক ও আধ্যাত্মিক সূক্তের উপস্থিতি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ঋগ্বেদের প্রথম ও দশম মণ্ডলের অপেক্ষাকৃত নবীনতর অংশে এই ধরনের সূক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তঃশায়ী পরমাত্মার ধারণা পরবর্তী কালেরই সৃষ্টি; সম্ভবত, ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠী বহির্ভুত সেই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকেই তা অধিগৃহীত, যাদের একাংশ হয়তো একেশ্বরবাদী ছিল এবং এরই পরবর্তী স্তরে বিমূর্তায়নের প্রবণতা থেকে অদ্বৈতবাদ জন্ম নিয়েছিল।
ব্রহ্মা বা আত্মা বিষয়ক জ্ঞান বহু সূক্তে আলোচিত হয়েছে। ঋগ্বেদের অন্তর্গত বৃহস্পতি, ব্রহ্মা, প্রজাপতি, বিরাট ও আত্মার মতো প্রাচীন নামগুলি যেমন এখানে পুনর্বার উপস্থিত হয়েছে, তেমনি বেন, রোহিত ও স্কম্ভের মতো নতুন কিছু অধ্যাত্মতত্ত্বের ও তদ্বাচক দেবতার নামও দেখা যাচ্ছে, এতে বিমূর্তায়নের বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ক্ৰমিক কিছু স্তর প্রতিফলিত।
সৃষ্টির অন্তর্গত রহস্য যে অর্থবেদের বিভিন্ন কবিকে গভীরভাবে উদ্ধৃদ্ধ করেছে, তার বহু প্রমাণ আমরা পাই। অন্তিম পর্যায়ের কিছু সূক্তে পরমাত্মার বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের ব্যাকুলতা ও সংজ্ঞা প্রদানের প্রয়াস অভিব্যক্ত হয়েছে। জ্ঞান ও উপলব্ধির জন্যে ব্যাকুল প্রার্থনায় বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ের স্বভাববৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত–ঋগ্বেদের সর্বশেষ পর্বে তার শুরু এবং উপনিষদের মধ্যে তার সমাপ্তি।
স্কম্ভ ও কাল সম্পর্কিত ধারণা- বর্ষ, ঋতু, মাস, পক্ষ, মহাশূন্য ইত্যাদির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পূক্ত। সৃষ্টির আদিকারণ বিষয়ে বিমূর্ত ভাবনার অভিব্যক্তি ঘটেছে “জৈষ্ঠব্রহ্মের’র উদ্দেশে রচিত একটি সূক্তে।
প্রাচীনতম কাল থেকে বৈদিক আর্যরা ‘ব্রহ্মণ্’ শব্দে সেই ঐন্দ্রজালিক অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাটি বুঝতেন, যা বিশ্বজগতের অন্ত্রর্নিহিত। তারা বিশ্বাস করতেন যে, যথাযথ মন্ত্রের সাহায্যে উপযুক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে আহূত হয়ে, প্রত্নকথা ও অনুষ্ঠানসমূহে নিহিত ব্রহ্মের সুপ্তশক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
পরবর্তীকালে এই শক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন সৃষ্টিরহস্য ভেদ করার উৎসাহে নিজস্ব পথে ক্রমশ গুরুত্ব অর্জন করল, তখন ব্রহ্মাণ শব্দের অর্থগৌরবও সুপ্রতিষ্ঠিত হ’ল। অথর্ববেদের পুরোহিতদের যজ্ঞে কোন প্রত্যক্ষ আবশ্যিক ভূমিকা ছিল না ব’লে তারা আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনায় ব্যাপৃত ছিলেন, এবং তাদের ‘ব্রহ্মা’ বা শ্রেষ্ঠ তত্ত্ববিদ বলেই অভিহিত করা হত; অর্থবেদকেও বলা হ’ল ব্রহ্মা বেদ।
‘কালে’-এর উদ্দেশে নিবেদিত দুটি সুপ্রসিদ্ধ সূক্তে মোট পনেরোটি শ্লোক গ্রথিত হয়েছে। কাব্যগুণে উৎকৃষ্ট, এই দুটি সূক্তে কালের যে আধ্যাত্মিক ভাবমূর্তি পরিস্ফুট হয়েছে, তাতে কাল অদৃশ্য, সৃজনশীল এবং ব্রহ্মাণ্ডধারণকারী চিরন্তন পরমসত্তা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দেবকল্পনাতেও কালের দেবায়ন ঘটেছে। ভারতে কালের দেবায়নের সঙ্গে স্রষ্টারাপী সময়ের প্রতীকায়িত দেবরােপ ‘প্রজাপতি’র উত্থান একই সূত্রে গ্রথিত।
সভা ও সমিতিকে যজ্ঞের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত করে দেখানো হয়েছে। অথর্ববেদে আরো কিছু অতীন্দ্রিয় ধারণা মাঝেমাঝেই অভিব্যক্তি হয়েছে। যেমন, সৃষ্টিশীল প্রেরণারূপে বিরাট। বাস্তব জগতে বিরাটকে যে দুগ্ধবতী গাভীর সঙ্গে, আধ্যাত্মিক স্তরে যে রহস্যগুঢ় বাক-এর সঙ্গে এবং অতিজাগতিক স্তরে যে রক্ষাকারী শক্তির সঙ্গে সমন্বিত করা হয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
পঞ্চৌদন আজও তেমনি হঠাৎ অতিজাগতিক তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে অনন্ত যজ্ঞের প্রতিরোপ হয়ে উঠেছে। স্কম্ভের মধ্যেও আমরা বিমূর্ত অতীন্দ্রিয় ভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করি; সমগ্র সৃষ্টির উপগঠনরূপে তারই বিভিন্ন অংশ থেকে বিশ্বজগতের উপাদানসমূহ আবির্ভূত।
স্কম্ভ ও কাল সম্পর্কিত ধারণা- বর্ষ, ঋতু, মাস, পক্ষ, মহাশূন্য ইত্যাদির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পূক্ত। সৃষ্টির আদিকারণ বিষয়ে বিমূর্ত ভাবনার অভিব্যক্তি ঘটেছে “জৈষ্ঠব্রহ্মের’র উদ্দেশে রচিত একটি সূক্তে।
প্রত্নকথা ও অনুষ্ঠানপরায়ণ যুগের ফসলরাপে এরা অনিবার্যভাবে অর্ধসাংকেতিক প্রতুপৌরাণিক ভাষায় বাস্তবতা সম্পর্কিত নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করেছে। কয়েক শতাব্দী পরে দেবকল্পনা ও অনুষ্ঠানচর্যার সঙ্গে নাড়ীর বন্ধন যখন প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তখন আমরা যথার্থ বিমূর্ত তাবনার প্রথম সার্থক অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি উপনিষদের প্রত্নপৌরাণিক পরিমণ্ডল-বহির্ভূত অধ্যাত্মবাদী চিন্তার মধ্যে।
ব্রহ্মৌন্দন, প্রাণ, ব্রহ্মচর্য ও কিছু কিছু বস্তু ও ধারণা বিমূর্ত ভাব-রূপে বন্দিত হয়েছে। সৃষ্টির অন্যতম প্রেরণা রূপে রোহিতের বন্দনা থেকে মনে হয়। সূর্যদেবই সেখানে বিমূর্তায়িত, আবার অন্য একটি অনুপুঙ্খ থেকে অনুমান করা যায় যে, রোহিত ও অদিতির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে পার্থিব রাজা ও তার সঙ্গিনী নারীরা গৌরবান্বিত হয়েছেন।
একটি দ্ব্যর্থবোধক সূক্ত একই সঙ্গে পুরুষ ও অদ্বৈত তত্ত্বের প্রতি প্রযোজ্য। এইসব অসংখ্য আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় ভাববস্তুকে নিছক একই বিমূর্ত ভাবনার বিভিন্ন নামান্তর বলে মনে করা যায় না; তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম ভাবগত পার্থক্য বয়েছে। সম্ভবত, ভিন্ন ভিন্ন ঋষির দ্বারা এবং বিভিন্ন অঞ্চল ও যুগে এদের উৎপত্তি হয়ে কালক্রমে বিভিন্ন চিস্তাবিদদের মধ্যেও বিশ্বাসের নানা শাখায় এগুলি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অথর্ববেদের সৃষ্টিতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যার যে পৃথক চরিত্র রয়েছে, তার সঙ্গে ঋগ্বেদের শেষতম আধ্যাত্মিক সূক্তের সাযুজ্য লক্ষণীয় : উভয়ের ভাষাই সাংকেতিক, অতীন্দ্রিয় গৃঢ়বিদ্যার উপযোগী,–সম্ভবত সমাজের কয়েকটি গোষ্ঠী বিশেষ যত্নের সঙ্গে সেই গোপন রহস্যবিদ্যাকে লোকচক্ষুর আড়ালে সংরক্ষণ করত, উপনিষদে এসে আমরা এ তথ্যের প্রমাণ পাই।
প্রত্নকথা ও অনুষ্ঠানপরায়ণ যুগের ফসলরাপে এরা অনিবার্যভাবে অর্ধসাংকেতিক প্রতুপৌরাণিক ভাষায় বাস্তবতা সম্পর্কিত নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করেছে। কয়েক শতাব্দী পরে দেবকল্পনা ও অনুষ্ঠানচর্যার সঙ্গে নাড়ীর বন্ধন যখন প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তখন আমরা যথার্থ বিমূর্ত তাবনার প্রথম সার্থক অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি উপনিষদের প্রত্নপৌরাণিক পরিমণ্ডল-বহির্ভূত অধ্যাত্মবাদী চিন্তার মধ্যে।
কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন মূল্যবোধের কাঠামো প্রয়োজনীয় বলে উপস্থাপিত না করছে ততক্ষণ নতুন অধ্যাত্মবিদ্যার ক্ষেত্র আবিষ্কারের প্রয়াস শুরু হবে না এবং সৃষ্টিতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যা অনিবার্যভাবেই প্রত্নকথা, অনুষ্ঠানচর্যাঁ, ইন্দ্রজাল ও রহস্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সংযোগ রক্ষা করে চলবে।
…………………
ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………..
আরও পড়ুন-
বেদ রচনার গোড়ার দিক : এক
বেদ রচনার গোড়ার দিক : দুই
……………
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : এক
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : দুই
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : তিন
জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্ব
অথর্ববেদ সংহিতা