ভবঘুরেকথা
অন্নচিন্তা

গ্রামীন সমাজ ও জীবনচর্য

-অতুল সুর

এক

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ জাতিভেদ প্রথার ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। জাতিবিন্যাসের শীর্যদেশ ছিল ব্রাহ্মণ। তার নীচে ছিল নানান জাতি যথা বৈদ্য, কায়স্থ, সাদগোপ, কৈবর্ত, গোয়ালা, তাম্বুলি, উগ্রক্ষেত্রী, কুম্ভকার, তিলি, যুগী, তীৰ্গতি, মালি, মালাকার, কলু, নাপিত, বুজক, দুলে, শাঁখারী, হাড়ি, মুচি, ডোম, চণ্ডাল, বাগদী, স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, কর্মকার, সূত্রধর, গন্ধবেনে, জেলে, পোদ্দার, বারুই ইত্যাদি।

তবে মধ্যযুগের সমাজের ন্যায় ব্রাহ্মণরা সকল জাতির হাত থেকে জল গ্রহণ করতেন না। মাত্র নয়টি জাতি জল আচরণীয় জাতি বলে চিহ্নিত ছিল। এদের ‘নবশাখ’ বলা হত। এরা হচ্ছে তিলি, তাঁতি, মালাকার, সাদগোগ, নাপিত, বারুই, কামার, কুম্ভকার ও ময়রা।

প্রতি জাতিরই এক একটা বিশেষ পেশা বা বৃত্তি ছিল। ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নেই বাঙালী তার কৌলিক বৃত্তি হারাতে আরম্ভ করে। এর আভাস আমরা পাই ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দের এক দলিক থেকে। ইংরেজরা আগে সুতীবস্ত্র সংগ্রহের জন্য দাদন দিত শেঠ-বসাকদের।

শেঠ-বসাকরা ছিল তন্তুবায় গোষ্ঠীর লোক। কিন্তু ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা সূতীবস্ত্রের জন্য কয়েকজন ভিন্ন জাতীয় লোককে দাদন দেয়। তাতে শেঠ-বসাকরা তাদের আপত্তি জানায়। তখন থেকেই ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে নাগরিক সমাজে বাঙালী তার জাতিগতবৃত্তি হারিয়ে ফেলে।

কলকাতা শহরে এসে বাঙালী যে তার জাতিগত বৃত্তি হারিয়ে ফেলছিল তা ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি বিভিন্ন জাতির লোককে নানারকম কারবার করবারু জন্য যে লাইসেন্স দিয়েছিল, তা থেকেই প্রকাশ পায়। নানান জাতির লোক যে নানারকম ব্যবসায়ে লিপ্ত হচ্ছিল, তা আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যবসাদারদের নাম থেকেও বুঝতে পারি।

বস্তুতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরে বাঙলার জাতিসমূহের বৃত্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি ঘটিছিল। তবে এই সময় কায়স্থসমাজের প্রসার ও প্রতিপত্তি লক্ষণীয়। এর কারণ, মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের ‘জাত কাছারী’। কলকাতায় আগন্তুক অপরিচিত ও অজ্ঞাতকুলশীল অনেকেই সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য, ‘জাত কাছারী’-র কাছে আবেদন করে ‘কায়স্থ’ স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এর ফলে, কলকাতার কায়স্থসমাজ বেশ প্রসারিত হয়ে উঠেছিল।

বাঙলার জাতিসমূহের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এগুলো অন্তর্বিবাহের (endogamous) গোষ্ঠী। তার মানে বাঙালীকে তার জাতির মধ্যেই বিবাহ করতে হত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙালী তার বৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য হারালেও, তার এই সামাজিক বৈশিষ্ট্য হারায়নি।

বিবাহ জাতির মধ্যেই হত। জাতির মধ্যে বিবাহ না দিলে, বাঙালীকে ‘এক ঘরে’ হতে হত। এক ঘরে হওয়া সেযুগে এক কঠোর সামাজিক শান্তি ছিল। কেননা, তার নাপিত, ধোবা, পুরোহিত সব বন্ধ হয়ে যেত, এবং তার সঙ্গে কেউ সামাজিক আদানপ্রদান করত না।

দুই

বিবাহ সম্পর্কে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে ছিল কৌলিন্য প্রথা। এটা প্রথমে ব্রাহ্মণ্যসমাজেই প্রবর্তিত হয়েছিল। পরে কায়স্থ, বৈদ্য, সাদগোপ প্রভৃতি সমাজেও প্রবর্তিত হয়। কৌলিন্য প্রথার ফলে নিজ জাতির মধ্যেই পরস্পরের আহার ও বৈবাহিক বিষয়ে নানারকম জটিল রীতিনীতি ও প্রথাপদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল।

সমাজে যাদের একবার কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হত, তারা বংশপরম্পরায় কুলীন বলে আখ্যাত হতেন। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণসমাজে যাদের কুলীন করা হয়েছিল, তারা হচ্ছেন মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়।

অনুরূপভাবে বঙ্গজ কায়স্থসমাজে ঘোষ, বসু, গুহ ও মিত্রদের কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। সাদগোপ সমাজে শূর (সুর), নিয়োগী ও বিশ্বাস-য়া কুলীন বলে পরিগণিত হতেন। সমজাতীয় সমাজে বিভিন্ন বংশকে উচ্চ ও নীচরূপে চিহ্নিত করে, এই -প্রথা যে সমাজকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

সেজন্য গঙ্গাসাগরের মেলায় গিয়ে মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এদেশে একটা প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার আইন দ্বারা এই প্রথা বন্ধ করে দেয়। অনেকে আবার মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে না দিয়ে, মন্দিরের দেবতার নিকট তাদের দান করতেন।

ব্রাহ্মণসমাজে এই প্রথাটি ছিল কন্যাগত। তার মানে, কুলীনের ছেলে কুলীন ছাড়া অকুলীনের মেয়েকেও বিবাহ করতে পারত। কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সঙ্গেই দিতে হত। অকুলীনের সঙ্গে তার বিবাহ দিলে মেয়ের বাপের কৌলীন্য ভঙ্গ হত, এবং সমাজে তাকে হীন বলে মনে করা হত।

স্বতরাং কুলরক্ষার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণ পিতাকে যেনতেনপ্রকারেন কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে নিজের কুলরক্ষা করতে হত। তার কারণ অনুষ্ঠা কন্যা শ্বরে রাখা বিপদের ব্যাপার ছিল। এক দিকে তো সমাজ তাকে একঘরে করত, আর অপর দিকে ছিল যবনের নারী লোলুপতা। অনেক সময় যবনেরা নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে (এমন কি বিবাহমণ্ডপ থেকে) নিকা করতে কুণ্ঠ বোধ করত না।

সাধারণতঃ কুলীন ব্রাহ্মণগণ অগুনতি বিবাহ করত এবং স্ত্রীকে তার পিত্রালয়েই রেখে দিত। এরূপ প্রবাস-ভর্তুক সমাজে কুলীন কন্যাগণ যে সব ক্ষেত্রেই সতীসাবিত্রীর জীবন যাপন করত, সে কথা হলপ করে বলা যায় না। এর ফলে বাঙলার কুলীন সমাজে যে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

তা ছাড়া, নারীর যবন দ্বারা ধর্ষিত হবারও সম্ভাবনা ছিল। যবনদূষিত হবার শঙ্কাতেই বাঙালী সমাজে বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, সতীদাহ প্রভৃতি প্রথা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কৌলিন্য প্রথা বাঙালী সমাজকে ক্রমশ অবনতির পথেই টেনে নিয়ে। গিয়েছিল। যে সমাজে কৌলিন্য প্রথা প্রচলিত ছিল ও মেয়ের বিবাহ কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে সমাজে মেয়েকে অপসরণ। করবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পিতামাতার মনে জেগেছিল।

সেজন্য গঙ্গাসাগরের মেলায় গিয়ে মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এদেশে একটা প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার আইন দ্বারা এই প্রথা বন্ধ করে দেয়। অনেকে আবার মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে না দিয়ে, মন্দিরের দেবতার নিকট তাদের দান করতেন।

মন্দিরের পুরোহিতরা এই সকল মেয়েদের নৃত্যগীতে পটীয়সী করে তুলতেন। এদের দেবদাসী বলা হত। এটাও বিংশ শতাব্দীভে আইন দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তিন

কৌলিন্য প্রথাই অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে একমাত্র অপপ্রথা ছিল না। আরও ছিল সহমরণ ও দাসদাসীর কেনাবেচা। হিন্দুর মেয়েরা তো অনেকে স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হতেনই, এমন কি ধর্মান্তরিত নিম্নশ্রেণীর মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই প্রথা কোথাও কোথাও অনুস্থত হত।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে, কৌলিন্য-কলুষিত সমাজে এটা প্রায় বাধ্যতামূলক প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। সবক্ষেত্রেই যে স্ত্রী স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতেন, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে অহিফেন লেবান করিয়ে তার প্রভাবে বা বলপূর্বক তাকে চিতায় চাপিয়ে পুড়িয়ে মারা হত।

নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতৃজায়া সহমৃতা হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় এরূপ ব্যথিত হয়েছিলেন যে নিষ্ঠাবান সমাজের বিরুদ্ধে একাকী খড়্গহস্ত হয়ে এই প্রথা লোপ করতে তিনি বদ্ধপরিকর হন। তারই চেষ্টায় তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেণ্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে আইন প্রণয়ন দ্বারা এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন।

চার

দাসদাসী কেনাবেচা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। তাদের ওপর গৃহপতির সম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব থাকত। গৃহপতির অধীনে থেকে তারা গৃহপতির ভূমিকর্ষণ ও গৃহস্থালীর কাজকর্ম করত। সাধারণতঃ এদের হাট থেকে কেনা হত। দাসদাসীর ব্যবসাটা বিশেষভাবে চলত দুভিক্ষের সময়।

এটা যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল, তা নয়। চাষাভূষার ঘরেও দাসদাসী থাকত। সাধারণতঃ লোক দাসীদের সঙ্গে মেয়ের মত আচরণ করত। অনেকে আবার নিজের ছেলের সঙ্গে কোন দাসীর বিয়ে দিয়ে তাকে পুত্রবধু করে নিত। তখন সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হত।

অনেকে আবার যৌনলিন্স চরিতার্থ করবার জন্য দাসীদের ব্যবহার করত। এরূপ দাসীদের গর্ভজাত সন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্মৃতিতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আগন্তুক ইংরেজরাও দাসদাসী কিনত ও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বেচিত।

পাঁচ

অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজব্যবস্থায় পরিবার গঠিত হত যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের ভিত্তিতে। এই পরিবারের মধ্যে বাস করত। স্বয়ং ও তার স্ত্রী, স্বয়ং-এর বাবা-মা, খুড়োখুড়ি, জেঠ-জেঠাই, তাদের সকলের ছেলে-মেয়েরা, স্বয়ং-এর ভাইয়েরা ও তাদের স্ত্রীরা ও ছেলেমেয়েরা এবং নিজের ছেলেমেয়েরা।

অনেক সময় পরিবারভুক্ত হয়ে থাকতো কোন বিধবা পিসি বা বোন বা অন্য কোন দুঃস্থ আত্মীয় ও আত্মীয়া। এরূপ পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিই হতেন ‘কর্তা’ এবং পরিবারস্থ সকলেই তাঁর অধীনে থাকত।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিবারস্থ মেয়েদের বিবাহ আট দশ বছর বয়সেই হয়ে যেত। এরূপ বিবাহকে গৌরীদান বলা হত। মেয়েকে গৌরী দান করাই সকলের লক্ষ্য থাকত। আট পার হয়ে গেলে ন’ বছর বয়সে যে বিবাহ হত, তাকে রোহিনী দান বলা হত, আর দশ বছর বয়সে বিবাহকে বলা হত কন্যাদান।

দশ পার হয়ে গেলে (কুলীনকন্যা ছাড়া), মেয়ের ব্যাপকে একঘরে করা হত। সেজন্য সকলেই দশের মধ্যে মেয়ের বিবাহ দিত। বিয়ে সাধারণতঃ ঘটক বা ভাটের মাধ্যমে হত।

ছয়

অষ্টাদশ শতাব্দীর লোকের জীবনচর্যার ওপর দৈব ও অপদেবতার প্রভাব ছিল খুব বেশী। দৈনন্দিন জীবনে আধিব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঝাড়ফুক, মাদুলি, জলপাড়া, গ্রহশান্তি ইত্যাদির আশ্রয় নিত।

তা ছাড়া, জ্যোতিযোিরও প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। এবং যেহেতু সামাজিক জীবনে বিবাহই ছিল সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিক সংস্কার সেজন্য বাঙালী পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময় কোঠি-ঠিকুজিতে সপ্তম ঘরে কোন গ্রহ বা সপ্তমধিপতি কোন ঘরে আছে, তার বিচার করত। যদি সপ্তম ঘরে কোন পাপগ্রহ থাকত, তবে সে বিবাহ বর্জন করত। তারপর গণের মিল ও অমিলও দেখত।

বিবাহের পর আসত দ্বিরাগমন। তারপর মেয়েদের জীবনে পর পর ঘটত গর্ভাধান বা প্রথম রজোদর্শন, পুংসবন, পঞ্চামৃত, সাধ, সীমান্তোয়ন ইত্যাদি। এগুলো সবই ছিল আনন্দময় সামাজিক উৎসব, এবং এসব উৎসবই বাঙালীর লৌকিক জীবনকে সুখময় করে তুলত।

সন্তান প্রসবের পর শুরু হত স্বামী-স্ত্রীর ধর্মীয় জীবন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কুলগুরুর কাছ থেকে ‘মন্তর’ নিত। কেননা, মেয়েদের বিশ্বাস ছিল যে ‘মন্তর’ না নিলে দেহ পবিত্র হয় না। যারা ‘মন্তর’ নিত, তাদের প্রতিদিনই ইষ্টমন্ত্র জপ করতে হত। যাদের ‘মন্তর’ হত না, তাদের ঠাকুরঘরে যেতে দেওয়া হত না। এমন কি শ্বশুর-শাশুড়ীও তাদের হাতের জল শুদ্ধ বলে মনে করত না।

মেয়ের সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই পঞ্চকন্যার নাম স্মরণ করত। পঞ্চকন্যা হচ্ছে অহল্যা, দ্ৰৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী। তারপর সদর দরজা থেকে শুরু করে বাড়ীর অন্দরমহল পর্যন্ত সর্বত্র গোবর স্কুলের ছিটা দিত। এ ছাড়া, প্রতি বাড়ীতেই তুলসী, মঞ্চ থাকত এবং সন্ধ্যাবেলা তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বেল শিশুকাল থেকে নানারকম ব্রত পালনের ভিতর দিয়েই মেয়েদের ধর্মীয় জীবন গড়ে উঠত।

পাঁচ থেকে আট বছরের মেয়েরা নানারকম ব্রত করত। যেমন বৈশাখ মাসে শিবপূজা, পুণ্যিপুকুর ও গোকুল, কার্তিক মাসে কুলকুলতি, পৌষমাসে সোদর, মাঘ মাসে মাঘমণ্ডল ইত্যাদি। আর সধবা মেয়েদের তো ব্রতের অন্ত ছিল না। সারা বছর ধরে দু-এক দিন অন্তর একটা না একটা ব্রত লেগেই থাকত।

যেমন সাবিত্রী ব্রত, ফলহারিণী ব্রত, জয়মঙ্গলবারের ব্রত, বিপত্তারিণী ব্রত, নাগপঞ্চমী, ইতু পূজা, নীলের উপবাস, লুণ্ঠন ষষ্ঠী, চর্পট যষ্ঠ, রাধা অষ্টমী, তাল নবমী, অনন্ত চতুর্দশী, কাত্যায়নী ব্রত, শীতল ষষ্ঠী, অশোক যষ্ঠ, অরণ্য ষষ্ঠী ইত্যাদি। এ ছাড়া, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কলসী উৎসর্গ করত।

এছাড়া গ্রহণাদির দিনও ছুটি থাকত। গ্রহণের দিন লোক হাঁড়ি ফেলে দিত। রান্নার জন্য আবার নূতন হাড়ি ব্যবহার করত। তা ছাড়া গ্রহণের পর সাতদিন অযাত্রা বলে গণ্য হত। এই সকল পূজাপার্বণ উপলক্ষে বাঙালী মেয়োরা সুযোগ পেত, তাদের শিল্পমননকে ক্রীয়াশীল করত নানারকম বিচিত্র আলপনা অঙ্কনে। বিবাহ উপলক্ষে বরকনের পিঁড়ের ওপর অঙ্কিত আলপনাগুলোও দেখবার মত হত।

বৈশাখ মাসে তুলসী মঞ্চে তুলসী গাছের ওপর জলের ‘ঝারা বাধত। কার্তিক মাসে ‘আকাশ প্রদীপ’ দিত। পৌষ সংক্রান্তিতে ‘বাউনি’ বাঁধত। ভাদ্র মাসের সংক্ৰাস্তিতে ঘটা করে ‘অরন্ধন’ করত। পৌষ মাসের সংক্রাস্তিতে ‘পৌষপার্বণ’ ও ফান্তন মাসের সংক্রাস্তিতে ঘণ্টাকর্ণ পূজা করত।

নূতন শস্য উঠলে ‘নবান্ন’ করত। শীতল যষ্ঠীর দিন আগের দিনে সিদ্ধকরা কড়াই সিদ্ধ খেত। চৈত্র সংক্রান্তিতে যবের ছাতু খেত। ডান্দ্র মাস, পৌষ মাস ও চৈত্র মাসে লক্ষ্মীপূজা করত। অনেকে শিবের গাজন উপলক্ষে চৈত্র মাসে সন্ন্যাস গ্রহণ করত।

আঠারো শতকে বাঙালীর অসংখ্য পরব ছিল। অনেক পরবের নাম আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। ১১৯৪ বঙ্গাব্দের (১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক বিজ্ঞপ্তি থেকে আমরা জানতে পারি যে নিম্নলিখিত পর্বের দিনসমূহে সরকারী কার্যালয়সমূহ বন্ধ থাকত–

অক্ষয় তৃতীয়া ১দিন, নৃসিংহ চতুর্দশী ২দিন, জ্যৈষ্ঠ মাসের দশমী-একাদশী ২দিন, স্নানযাত্রা ১দিন, রথযাত্রা ১দিন, পূর্ণধাত্রা ১দিন, জন্মাষ্টমী ২দিন, শয়ন একাদশী ১দিন, রাখীপূর্ণিমা ১দিন, উত্থান একাদশী ২দিন, অরন্ধন ১দিন, দূর্গাপূজা ৮দিন, তিলওয়া সংক্রান্তি ১দিন, বসন্ত পঞ্চমী ১দিন, গণেশ পূজা ১দিন,

অনন্ত ব্রত ১দিন, বুধনবমী ১দিন, নবরাত্রি ১দিন, লক্ষ্মীপূজা ১দিন, অন্নকুট ১দিন, কার্তিক পূজা ১দিন, জগদ্ধাত্রী পূজা ১দিন, রাসযাত্রা ১দিন, অগ্রহায়ণ নবমী ১দিন, রটন্তী অমাবস্যা ২দিন, মৌনী সপ্তমী ১দিন, ভীমাষ্টমী ১দিন, বাসন্তী পূজা ৪দিন, শিবরাত্রি ২দিন, দোলযাত্রা ৫দিন, বারুণী ১দিন, চড়কপূজা ১দিন, ও রামনবমী ১দিন।

এছাড়া গ্রহণাদির দিনও ছুটি থাকত। গ্রহণের দিন লোক হাঁড়ি ফেলে দিত। রান্নার জন্য আবার নূতন হাড়ি ব্যবহার করত। তা ছাড়া গ্রহণের পর সাতদিন অযাত্রা বলে গণ্য হত। এই সকল পূজাপার্বণ উপলক্ষে বাঙালী মেয়োরা সুযোগ পেত, তাদের শিল্পমননকে ক্রীয়াশীল করত নানারকম বিচিত্র আলপনা অঙ্কনে। বিবাহ উপলক্ষে বরকনের পিঁড়ের ওপর অঙ্কিত আলপনাগুলোও দেখবার মত হত।

পরবের দিনসমূহে লোক গঙ্গাস্নান বা নিকটস্থ কোন পবিত্র পুষ্করিণীতে স্নান করত। বড় বড় পরব উপলক্ষে এই সব জায়গায় মেলা বসত। ভদ্রসম্প্রদায়ের মেয়েরা ওই সব মেলায় সুযোগ পেত নিজেদের মনোমত গৃহস্থালীর জিনিষপত্তর কেনবার।

সাত

পুরুষরা মাঠে-ঘাটে, হাটে ব্যস্ত থাকত। আর মেয়ের ঘরকান্নার কাজ করত। ঘরকন্নার কাজের মধ্যে একটা প্রধান কাজ ছিল রান্নাবান্না করা ও অবসর সময়ে সুতাকাটা ও প্রদীপের সলতে পাকানো। তা ছাড়া তারা পান। সাজত ও নানারকম নকসাওয়ালা কঁথা সেলাই করত। ডালের বড়ি দিত। মুড়ি ভাজিত ও মুড়কি তৈরী করত।

নারিকেল দিয়ে নানারকম মিষ্টান্ন তৈরী করত। এ সব জলখাবার হিসাবে ব্যবহৃত হত। রান্নাবান্না হত কাঠের আগুনে, কেননা কয়লা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওঠেনি। মাটির ইড়িতেই ভাত ডাল রান্না হত। খাওয়া-দাওয়া হত। পাথরের ও র্কাসার থাল-বাসনে। লোক কাঠের পিড়া বা আসনের ওপর বসে খাওয়া-দাওয়া করত।

বিধবাদের জন্য আলাদা রান্না হত, হয় ভিন্ন উনুনে নয় অন্য উনুন ন্যাতা-গোবর বুলিয়ে শুদ্ধ করে। এ সম্বন্ধে শুচিতা খুব কঠোর ছিল। খাদ্যাখ্যান্য সম্বন্ধে আগেকার দিনের রঘুনন্দনের বিধান অনেকটা হালকা হয়ে গিয়েছিল।

কেননা, ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা আসবার পর বাঙালী তার গৃহস্থালীতে পর্তুগীজদের আনীত অনেক আনাজ-তরকারী ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীকে স্থান দিয়েছিল। সেগুলো বাংলা ভাষায় পর্তুগীজ শব্দের প্রাচুর্য থেকে বুঝতে পারা যায়।

সে সব দ্রব্যসামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে-আলু, তামাক, বজরা, সাগু, কাজু বাদাম, আনারস, আতা, আমড়া, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আচার, আরক, ভাঙ, বৃঙ্খল, চা, কোকো, কাবাব, বাসন, বিস্কুট, জোলাপ ইত্যাদি। আরিষ্ণু যে সব পর্তুগীজ শব্দ অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী ব্যবহার করত, সেগুলো হচ্ছে—

আয়, আলমিরা, বালতি, বাট্ট, বুটিক, কামরা, কামিজ, চাবি, গুদাম, ঝিলমিলি, লঙ্কর, নিলাম, মিন্ত্রি, পাদরী, পালকি, পমফ্রেট, পিওন, রসিদ, বারাগু, আলকাতরা, ভাপ, বিয়া, বোতাম, বোতল, কেদাবা, কফি, কাফ্রি, কাকাতুয়া, কামান, ছাপ, কোঁচ, কম্পাস, ইস্পাত, ইঙ্গি, ফিতা, ফর্ম, গরাদ, জানালা, লাণ্টাৰ্ণ, মাস্তুল, মেজ, পিপা, পিরিচ, পিস্তল, পেরেক, রেস্ত, সাবান, টোকা, তুফান, তোয়ালে, বরগা, বেহালা ইত্যাদি।

আট

অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে আর্থিক সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ছিল কৃষি, শিল্প ও লাণিজ্যের ওপর। নদীমাতৃক বঙ্গভূমি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য। এই সকল কৃষিজাত পণ্য বাঙলার নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বিক্রীত হত দেশ-দেশান্তরের হাটে।

কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চাউল, তুলা, ইক্ষু, তৈলবীজ, সুপারি, আদা, লঙ্কা, কলা ও অন্যান্য নানাবিধ ফল। পরে পাট ও নীলের চাষও প্রভূত পরিমাণে হত। শতকরা ৯৯ জন লোক কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। কৃষিকে হীনকর্ম বলে কেউ মনে করত না।

বাঙলার মৃৎশিল্পেরও যথেষ্ট উৎকর্ষতা ছিল। মৃৎশিল্পীরা হাঁড়িকলসী, পুতুল, প্রতিমা ও মন্দিরগাত্রের মৃৎফলকসমূহ তৈরী করত। মৃৎশিল্পে নাটোরের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। পরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাটোর থেকে কয়েকজন মৃৎশিল্পী এনে কৃষ্ণনগর ঘরানার পত্তন করেছিলেন।

এমন কি ব্রাহ্মণরাও ক্লষিকৰ্ম করতে লজ্জাবোধ করত না। তবে দুর্ভিক্ষ মাঝে মাঝে সুজলা, সুফলা বাঙলার জনজীবনকে বিপন্ন করত। এরূপ বিপর্যয় চরমে উঠেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়।

শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল কার্পাস ও রেশমজাত বস্ত্র। সুক্ষ্মবন্ত্র প্রস্তুতের জন্য বাঙলার প্রসিদ্ধি ছিল৷ একাপ বস্ত্র বয়নের জন্য প্রতি ঘরে ঘরে মেয়েরা সুতা কাটিত। দেশবিদেশে বাঙলার বস্ত্রের চাহিদা ছিল। বাঙলার শর্করার প্রসিদ্ধিও সর্বত্র ছিল।

এছাড়া বাঙলায় প্রস্তুত হত শঙ্খজাত নানারূপ পদার্থ, লৌহ, কাগজ, কালি, লাক্ষা, কৃষিকর্মের জন্য নানারূপ যন্ত্রপাতি, বারুদ ও ও বরফ। বীরভূমের নানাস্থানে ছিল লৌহপিণ্ডের আকর। তা থেকে লৌহ ও ইস্পাত তৈরী হত।

বীরভূমের যে সকল স্থানে লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা ছিল, সেগুলি হচ্ছে দামরা, ময়সার, দেওচা ও মহম্মদনগর। এই সকল লোহা দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত কলকাতা ও কাশিমবাজারের কামান তৈরী হত। লোহা ও ইস্পাত প্রস্তুতের জন্য বীরভূমের কারিগরগণ নিজস্ব প্রণালী অবলম্বন করত।

বরফ তৈরীর জন্যৎবাঙলার নিজস্ব প্রণালী ছিল। শীতকালে মাটিতে গর্ত করে, তার মধ্যে গরম জল ভরতি করে সমস্ত রাত্রি রাখা হত। প্রভাতে তা বরফে পরিণত হত। এছাড়া, চিনি তৈরীর জন্যও বাঙলার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যে চিনি তৈরী হত তা ধবধবে সাদা।

এই চিনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হত। এছাড়া, বাঙলার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল পালকি ও নৌকা নির্মাণে। এই সকল নৌকা দেশের মধ্যে নদীপথে পরিবহণের কাজে ও সমুদ্রপথে বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত। তা ছাড়া মৎসজীবীরা এই সকল নৌকার সাহায্যে সুন্দরবন প্রভৃতি অঞ্চলে মাছ ধরত।

বাঙলার মৃৎশিল্পেরও যথেষ্ট উৎকর্ষতা ছিল। মৃৎশিল্পীরা হাঁড়িকলসী, পুতুল, প্রতিমা ও মন্দিরগাত্রের মৃৎফলকসমূহ তৈরী করত। মৃৎশিল্পে নাটোরের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। পরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাটোর থেকে কয়েকজন মৃৎশিল্পী এনে কৃষ্ণনগর ঘরানার পত্তন করেছিলেন।

খাগড়া, নলহাটি ও দাঁইহাটা কাঁসার বাসন শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলের কাঁসিারিরা ছাঁচে ঢালা বা চাদর পেটাই করে কুঁদে নানারকম বসন তৈরী করত, যথা ধান মাপবার কুনকে, পিতলের প্রদীপ, পিলসুজ, ইত্যাদি।

নয়

বাণিজ্য বাঙালীর সমৃদ্ধির একটা প্রধান সুত্র ছিল। এজন্য বণিক সমাজের ধনাঢ্যতা প্রবাদবাক্যে দাঁড়িয়েছিল। এই বণিকসমাজই কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন করেছিল। মাত্র নবাগত বিদেশীরাই যে বাঙলার হাট থেকে মাল কিনাত, তা নয়। ভারতের নানা স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙলার হাটে মাল কিনতে আসত।

তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাশ্মীরী, মুলতানী, আফঘান, পাঠান, শেখ, পগেয়া, ভুটিয়া ও সন্ন্যাসীরা। সন্ন্যাসীরা যে কারা, তা আমরা সঠিক জানি না। মনে হয় তারা হিমালয়ের সানু দেশ থেকে চন্দন কাষ্ঠ, মালার গুটি ও ভেষজ গাছগাছড়া বাঙলায় বেচতে আসত।

তার বিনিময়ে তারা বাঙলা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেত। হলওয়েলের এক বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে দিল্পী ও আগর থেকে পগোয়ারা বর্ধমানে এসে প্রচুর পরিমাণ বন্ধ, সীসা, তামা, টিন ও লঙ্কা কিনে নিয়ে যেত। আর ভার পরিবর্তে তারা বাঙলায় বেচে যেত আফিম, ঘোড়া ও সোরা।

অনুরূপভাবে কাশ্মীরের লোকেরা বাঙলা থেকে কিনে মিয়ে যেত লবণ, চামড়া, নীল, তামাক, চিনি, মালদার সাটন কাপড় ও বহুমূল্য রত্নসমূহ। এগুলি তারা বেচত নেপাল ও তিব্বতের লোকদের কাছে। বাঙলার বাহিরের ব্যবসায়ীরা যেমন বাঙলায় আসত, বাঙলার ব্যবসায়ীরাও তেমনই বাঙলার বাহিরো যেত। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে জয়নারায়ণ কর্তৃক রচিত ‘হরিলীলা’ নামক এক বাংলা বই থেকে আমরা জানতে পারি।

যে বাঙলার একজন বণিক ব্যবসা উপলক্ষে হস্তিনাপুর, কর্নট, কলিঙ্গ, গুর্জর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, ভোজ, পঞ্চাল, কম্বোজ, মগধ, জয়ন্তী, দ্রাবিড়, নেপাল, কাকী, অযোধ্যা, অবস্তী, মথুরা, কাম্পিলা, মায়াপুরী, দ্বারাবতী, চীন, মহাচীন ও কামরূপ প্রভৃতি দেশে গিয়েছিলেন।

তার ওপর ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যগণের অত্যাচার ও বাঙলার দক্ষিণ অংশের উপকূলভাগে মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের উপদ্রব। তারা যে মাত্র লুটপাট করত ও গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, তা নয়, মেয়েদের ধর্ষণ করত ও অসংখ্য নরনারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশের দাসদাসীর হাটে বেচে দিত।

যারা বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত, তারা বেশ দু’পয়সা রোজগার করে বড়লোক হত। তাদের ধনদৌলত প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। ধনীলোকদের জীবনযাত্রা প্রণালী সাধারণ লোকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তাদের পোশাকআশাক ও অলঙ্কার দেখে বিদেশীরা আশ্চর্য হয়ে যেত।

গৌড় ও পূর্ববাঙলার ধনীলোকেরা সোনার থাল-বাটিতে আহার করত। মাত্র এক শতাব্দী আগে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিস্তা মন্তব্য করেছে যে কোনও বড়লোকের ঘরে কতসংখ্যক সোনার থাল-বাসন আছে, সেটাই ছিল তার ধনাঢ্যতার মাপকাটি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে জিনিষপত্তরের দাম খুব সুলভ ছিল। ১৭২৯ খ্রীস্টাব্দের এক মূল্য তালিকায় আমরা মুরশিদাবাদে প্রচলিত যে দাম পাই, তা থেকে জানতে পারি যে প্রতি টাকায় মুরশিদাবাদে পাওয়া যেত সরু চাল এক মন দশ সের থেকে এক মন পনেরো সেরা পর্যন্ত, দেশী চাল চার মন পচিশ সের থেকে সাত মন কুড়ি সেরা পর্যন্ত, গম তিন মন ৩০ সের, তেল ২১ সেরা থেকে ২৪ সের, ধি দশ সের আট ছটাক থেকে ১১ সের ৪ ছটাক, ও তুলা দুই মন থেকে দুই মন ৩০ সের।

কিন্তু এই সুলভতা সত্বেও ছিল নিম্নকোটির লোকদের দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণ ছিল সরকারী কর্মচারীদের অত্যাচার ও জুলুম। রাজত্ব দিতে না পারলে যে কোন হিন্দুর স্ত্রী ও ছেলেগুলোকে নীলাম করে বেচে দেওয়া হত। এছাড়া, সরকারী কর্মচারীরা যখন তখন কৃষক রমণীদের ধর্ষণ করত। এর কোন প্রতিকার ছিল না।

তার ওপর ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যগণের অত্যাচার ও বাঙলার দক্ষিণ অংশের উপকূলভাগে মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের উপদ্রব। তারা যে মাত্র লুটপাট করত ও গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, তা নয়, মেয়েদের ধর্ষণ করত ও অসংখ্য নরনারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশের দাসদাসীর হাটে বেচে দিত।

আরও ছিল বিদেশী বণিকদের অত্যাচার। ভারতচন্দ্র তার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন-‘উদাসীন ব্যাপারী বিদেশী যারে পায়। লুটে লৈয়ে বেড়ি দিয়া ফাটকে ফেলায়।’ এটা ছিল শতাব্দীর মধ্যাহের পরিস্থিতি।

দশ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে ইংরেজ গ্রাম-বাঙলার আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করেছিল। ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৭ মার্চ তারিখে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত ডিরেকটররা এখানকার কর্মচারীদের আদেশ দেন-বাঙলার রেশম বয়ন-শিল্পকে নিরুৎসাহ করে মাত্র রেশম উৎপাদনের ব্যবসায়কে উৎসাহিত করা হউক।’

শীঘ্রই অনুরূপ নীতি তুলাজাত বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা হয়। ইংরেজ এখান থেকে কাঁচামাল কিনে বিলাতে পাঠাতে লাগল, আর সেই কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত দ্রব্য বাঙলায় এনে বেচিতে লাগল। বাঙলা ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ল।

১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সাহেবরা নীলচাষে লিপ্ত হল। দরিদ্র কৃষকদের ওপর অত্যাচারের এটা এক যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। Percival Spear বলেছেন– “Bengal sank from a state of fabled prosperity to rural misery”.

ইংরেজ একদিকে যেমন বাঙলার গ্রামগুলিকে হীন ও দীন করে তুলল, অপর দিকে তেমনই শহরে ও তার আশপাশে গড়ে তুলল এক নূতন সমাজ। সে সমাজের অঙ্গ ছিল ব্যবসাদার, ঠিকাদার, দালাল, মহাজন, দোকানদার, মুনসী, কেরানী প্রভৃতি শ্রেণী।

বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙলার সমাজ জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। এর ফলে গ্রামীন সমাজজীবন (যেখানে শতকরা ৯৯ জন বাস করত) সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ল। তারপর বামালোতী সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের দল এনে দিল গ্রামীন জীবনে এক ন্যাঙ্কার জনক নৈতিক শৈথিল্য।

এগারো

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙলা দেশে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য দেব-দেউল। এগুলির মধ্যে সংখ্যায়। সবচেয়ে বেশী ছিল শিবমন্দির। শিবমন্দিরগুলি সাধারণতঃ ‘আটচালা’ মন্দিরের আকারেই তৈরী হত। তবে স্থানে স্থানে শিবমন্দির ‘রত্ন’ মন্দিরের আকারেও নির্মিত হত।

অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির ‘রত্ন’ ও ‘দালান’ রীতিতেই তৈরী হত। এসব মন্দিরের দেবদেবীর মধ্যে ছিল কালী, দুর্গা, সিংহবাহিনী, অন্নপূর্ণা, বিশালাক্ষী, রাধাকৃষ্ণ, গোপাল, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি। এসব দেবদেবীর মন্দিরগাত্র শোভিত করা হত পোড়ামাটির অলঙ্করণ দ্বারা। (পরবর্তী মঠ, মন্দির ও মসজিদ’ অধ্যায় দেখুন)।

এ সব দেবদেবী থেকে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর লোকের উপাসনা পদ্ধতির একটা পরিচয় পাই। শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে ‘কর্তাভজা’ নামে এক নূতন ধর্মসম্প্রদায়েরও উদ্ভব ঘটেছিল। এঁরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যুক্তসাধনার বাণী প্রচার করেছিলেন। এঁদের ধর্মের নাম ছিল ‘সত্যধর্ম’।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিল আইলচাঁদ। আউলচাঁদের মৃত্যুর পর দল ভাঙতে শুরু করে। প্রধান দলের কর্তা রামশরণ পালই সত্যধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তী উনিশ শতকে কলকাতার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অভিজাত পরিবার রামশরণ পাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সত্যধর্ম’-এর অনুগামী ছিল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরও দুটা ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। একটা হচ্ছে নদীয়া মেহেরপুরের ‘বলরাম ভজা৷’ সম্প্রদায়, ও অপরটি কুসঙ্গ পরগনার বাউলধর্মী ‘পাগলপন্থী’ সম্প্রদায়। বলরামের শিষ্যরা তাকে রামচন্দ্রের অবতার বলত। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মত এ সম্প্রদায়ের মধ্যেও জাতিভেদ প্রথা ছিল না।

সম্প্রদায়টি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- ১. গৃহী, ও ২. ভিক্ষোপজীবী। পাগলপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে ফকির করম শা। গারো ও হাজংদের তিনি সাম্যভাবমূলক ও সত্যসন্ধ্যানী বাউলধর্মে দীক্ষিত করেন। ‘পাগলপন্থী’ নামটা ইংরেজদের দেওয়া। এ সম্প্রদায় পরে জমিদারশ্রেণীয় শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

বাঙলা ও বাঙালী>>

……………………….
আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫৭) – অতুল সুর

…………….
আরও পড়ুন-
মঠ, মন্দির ও মসজিদ
গ্রামীন সমাজ ও জীবনচর্য
বাঙলা ও বাঙালী
হিন্দু সভ্যতার শিকর আবিষ্কার

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!