ভবঘুরেকথা
হুমায়ুন সাধু গুরুদক্ষিণা সাধুসঙ্গ

-দ্বীনো দাস

গুরু হলো পথ প্রদর্শক, যিনি অন্তরের অন্ধকার দূর করেন, সর্ব সংশয় দূ করেন, পূর্ব সংস্কার কাটিয়ে দেন তিনিই গুরু বা মুর্শিদ। ‘গু’ মানে অন্ধকার, ‘রু’ মানে আলো। অন্ধকারে যিনি আলো দেন তিনিই গুরু।

সদগুরুকে চেনা বড় কঠিন। তবে তিনি যদি ধরা দেন তাহলেই তাকে চেনা যায় সহজে। গুরু পথ দেখিয়ে দেয় ঠিক সেই পথে চলতে হবে ভক্তকে নিজ দৃষ্টি দিয়ে। যে ভক্তের স্বাধীন বিচার শক্তি নাই সে ভক্ত গুরুবাক্য ঠিকমতো পালন করতে পারে না।

ভক্তের ভক্তি শ্রদ্ধা, প্রেমময়-স্বভাব, গুরুর শুদ্ধ বাক্যের আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, দৃষ্টান্ত ও ইঙ্গিতসমূহকে বিনা বিচারে ও বিনা যুক্তিতেই বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া গ্রহণ করতে হয়।

যতদিন ভক্ত উন্নত সংস্কারের অধিকারী না হবে, ততদিন তাকে উন্নত তত্ত্ব দান করা গুরুর সাধ্যাতীত। আবার যতদিন গুরু না হইবে সম্যক প্রকারে নিঃস্বার্থ চেতা, ততক্ষণ পর্যন্ত হীন সংস্কারাচ্ছন্ন ভক্তের মনে উন্নত সংস্কারের জাগরণও অসম্ভব।

তাই সদগুরু তার অন্তরে ভক্তকে আদ্য শক্তি রূপে আরাধনা করে। লোকশিক্ষার জন্য বাহ্যিক ভাবে ভক্তের ভক্তি নিয়ে থাকে, আর অন্তরে তৃপ্তির জন্য ভক্তকে ঈশ্বরীয় জ্ঞানে অর্চনা করে। বায়াত বা দীক্ষা দিয়ে প্রকৃত সদগুরু কখনো শিষ্যের স্বধীনতা হরণ করে না। প্রকৃত সদগুরু ভক্তকে ধ্যান করে।

নিঃস্বার্থচেতা গুরু যদি কোন ভক্তকে জগৎ কল্যাণের সংকল্প দেন, তবে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তাকে জগৎ কল্যাণ করতেই হবে। আর জগৎ বা সৃষ্টিকুলের কল্যাণ সেবাই যখন ভক্ত হৃদয়ে প্রেমে আকুল হবে। তখন বিশ্ব প্রকৃতি, মহাশক্তি, আদ্যশক্তি যত দূরেই থাকুক, যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেনো ভক্তের কাছে ধরা দিবে ও তার সেবা গ্রহণ করবে।

সদগুরু বা সম্যক গুরু দিক্ষা বা বায়াত দিয়ে গুরুকর্ম বা উপদেশ দিয়েই কি খালাস? সদগুরু জানেন, একই পরমসত্তা সম্যক গুরুর মধ্যে দিয়ে ভক্তকে উপদেশ দেওয়াচ্ছে। আবার সেই পরমসত্তা ভক্তের মধ্যে অবস্থান করে উপদেশ পালন করছে।

তাই সদগুরু তার অন্তরে ভক্তকে আদ্য শক্তি রূপে আরাধনা করে। লোকশিক্ষার জন্য বাহ্যিক ভাবে ভক্তের ভক্তি নিয়ে থাকে, আর অন্তরে তৃপ্তির জন্য ভক্তকে ঈশ্বরীয় জ্ঞানে অর্চনা করে। বায়াত বা দীক্ষা দিয়ে প্রকৃত সদগুরু কখনো শিষ্যের স্বধীনতা হরণ করে না। প্রকৃত সদগুরু ভক্তকে ধ্যান করে।

ভক্তের জীবনের মুক্তি, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতা, আলোকময় সত্তায় রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যেই সদগুরুর জীবনের সকল সার্থকতা লুকিয়ে থাকে।

ভক্তের আলোকময় প্রভাব বিশ্বমানবতার উপর যখন নিপতিত হয়, তাহাই সদগুরু নিজ জীবনের দীপ্তি বলিয়া জানে। সম্যক গুরু যে অমর তাহা ভক্ত দ্বারা প্রমাণিত হয়, গুরু দ্বারা নয়।

অসৎ গুরুরা ভক্তের স্বাধীনতা দেয় না। বরং অন্ধ মূক করে রাখে। এদের পায়ে মাথা লুটান বিড়ম্বনা। তাদেরকে মুক্তিদাতা ভাবে গ্রহণ করাও এক অশান্তি। ভক্তের স্বাধীন চেতনার সম্মান রেখে যিনি পরমাত্মা বা পরমার্থের পথ দেখাতে পারবেন না। তাকে দূর থেকে সালাম দিয়ে বিদায় হওয়া ভাল। তার শাসনকে জীবনের উপর চাপতে না দেওয়ায় ভাল।

ভক্তের অমানুষিক পরিশ্রম, কষ্ট, দুঃখ ও তার অলৌকিক জীবনের দিব্য প্রতিভাই প্রত্যক্ষ পরিচয় দিবে যে, সদগুরু মানবজাতির কতখানি সেবা করিতে চলিয়াছিলেন।

সদগুরু জগৎ কল্যাণের জন্য তাহার হৃদপিণ্ডের কতখানি রক্ত ঢালিয়া দিতে প্রস্তুত। তাহা ভক্তের মনুষ্যত্ব, মানবতা, নিঃস্বার্থ কর্ম ও পবিত্র মনসিকতার মধ্য দিয়া জগতে প্রকাশ হয়। এই জন্য ভক্ত গুরুর নয়নের মনি।

যেমন প্রভু মোহাম্মদ (স) জগৎ কল্যাণ ও উম্মতের জন্য এক জ্বলন্ত প্রমাণ। উম্মতের জন্য তিনি অহরহ কেঁদে গেলেন আর হায় উম্মত… হায় উম্মত… করে গেলেন। তাঁর ধ্যানে-মনে শুধুই উম্মতের চিন্তা ছিল। দুনিয়াদারীর কোন বাসনাই তার ছিল না।

সদগুরুরা ঠিক এমনই হয়। নিজের চিন্তা করে না শুধু ভক্তের মঙ্গল চিন্তায় রত থাকে।

সদগুরু বা মুর্শিদের কাজ ভক্তের বা মুরিদের অনন্ত মুক্তির দিকে প্রেরণা দেওয়া। চাল, কলা, আলু, পটল জোগাড়ে তার মন নেই। মুরিদের দেওয়া ছাগল, গরু, হাস, মুরগি, ডিম, দুধ কলা বা হাজার হাজার টাকা লাখ টাকা নজরানা, দক্ষিণায় ও তার মন নেই।

ধর্মিম বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানে তার পুজাপ্রাপ্তিতেও মন নেই। ভক্ত বা মুরিদের আত্ম উন্নতিতেই তার আনন্দ, ভক্তের কল্যাণেই তিনি খুশি।

সুতরাং গুরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে, প্রাণপণে আত্মগঠন আর প্রাণপণে অগ্রগমন। ভক্ত যদি পথ এগিয়ে না যায়। তবে গুরুর মহৎ প্রাণের মহৎ উদ্দেশ্যটি সফল হয় না। বা তিনি ব্যার্থকাম হন। আর এতে ভক্তের অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ হয়।

টাকা অর্থ কড়ি ছাগল, গরু ফুল ফল নানান জিনিস দিয়ে গুরুর পায়ে ভক্তি সেজদা, পাদপদ্ম পুজা করলেই গুরুকে খুশি করা বা কৃতজ্ঞতা করা হলো না। গুরুকে অবতার বলে প্রচার করলেও না। বা তার নামে গান বেধে ঢাক, ঢোল বা নানা ভাবে তার প্রচার করলেও সদগুরু খুশি হন না। তার খুশি ভক্তের আত্মিক উন্নয়নে।

এই সবে খুশি হন অসৎ গুরুরা। যারা লেবাস বা বেশ নিয়ে বসে আছেন। তারা ভক্তের অর্থ ও বিষয়বস্তুর আশায় বসে থাকেন। তাদের কাছে নিয়ে আসা গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি তারা আরামসে কেটে কুটে তমসাছন্ন হয়ে তামসিক খাদ্য মনের সুখে দরবারের সবাই মিলে খেয়ে যাচ্ছেন প্রতি নিয়ত।

অসৎ গুরুরা ভক্তের স্বাধীনতা দেয় না। বরং অন্ধ মূক করে রাখে। এদের পায়ে মাথা লুটান বিড়ম্বনা। তাদেরকে মুক্তিদাতা ভাবে গ্রহণ করাও এক অশান্তি। ভক্তের স্বাধীন চেতনার সম্মান রেখে যিনি পরমাত্মা বা পরমার্থের পথ দেখাতে পারবেন না। তাকে দূর থেকে সালাম দিয়ে বিদায় হওয়া ভাল। তার শাসনকে জীবনের উপর চাপতে না দেওয়ায় ভাল।

এখন যা গুরুবাদ চলছে, তা পুরাই জোচ্চুরির দূর্গ। ধর্ম প্রচারকরা, উপদেষ্টারা চাচ্ছে, দুনিয়ার সব লোককে অন্ধ করে রেখে নিজেদের খেয়াল মত চালিয়ে নিতে। কেউ তার শিষ্যকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়। আনুগত্যের নাম করে গুরুরা ভক্তের চোখে ঠুসি বেধে দিচ্ছে।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরো পড়ুন:
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ১
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ২

গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ৩

…………………………
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। তাই নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

জয়হোক সত্যের জয়হোক মানবতার।। আলেক সাঁই।।

……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়

গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!