-দ্বীনো দাস
আগে ভক্তকে নিজের আত্মপরীক্ষা করে দেখতে হবে বায়াত বা দীক্ষার জন্য প্রকৃত আগ্রহ অন্তরে এসেছে কিনা? বায়াত বা দীক্ষা নেয়ার পর গুরু হতে প্রাপ্ত কর্ম ঠিকঠাক করতে পারবে কিনা? দু’দিন পরেই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে কিনা?
তারপর ভক্তকে পরীক্ষা করতে হবে যার কাছে বায়াত বা দীক্ষা নিচ্ছে। তার মধ্যে বায়াত বা দীক্ষাদানের যোগ্যতা আছে কিনা? তিনি ভক্তের প্রাণের পিপাসা মিটাতে পারবে কিনা। তিনি ত্যাগী কিনা, জ্ঞানী কিনা, সৃষ্টিকর্তার প্রেমিক কিনা।
তিনি ভয়ের সময়ে অভয় দিতে পারবে কিনা। দুর্বলতার সময়ে হৃদয়ে বলসঞ্চার করতে পারবে কিনা। দেখতে হবে ভেতরে প্রকৃত নুরিবীর্য্য বা ব্রক্ষবীর্য্য আছে কিনা?
তার বাক্য অনুভূতির ফল কিনা। আর সেই অনুভূতি তীব্র সাধনার ফল কিনা? তার বাহ্যিক প্রতিষ্ঠার লোভ আছে কিনা। না তিনি নিষ্কাম প্রেমরই প্রেরণায় ভক্তকে বুকে তুলে নিবেন।
কিন্তু আয়াতের, কিতাবের, শাস্ত্রার্থের প্রত্যক্ষ অনুভূতি তার নিজ জীবনের মধ্যে এক কনিকাও নাই। তিনি কি প্রকৃত গুরু বা মুর্শিদ তারা শুধুই চালাকি করে চলে। বর্তমান গুরুবাদকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
ভক্ত, গুরু পরিচয় কোথায় পাবে? পাবে ভক্তের ইন্দ্রিয় দমনের ক্ষমতার ভেতর। গুরু সঙ্গ ভক্তকে নারীজাতির প্রতি মাতৃ বুদ্ধি আরোপ করতে সামর্থ্য দেবে। নরীর প্রতি ভোগ বুদ্ধি বর্জন করে ভক্তি বা পুজাবুদ্ধি আরোপ করবার শক্তি দেবে।
ভক্তের অন্তরের সমস্ত কামনা, বাসনা অন্ধকার দূর করে সত্যের আলোয় এনে দেবে। অন্ধকার যিনি দূর করেন তিনিই গুরু বা মুর্শিদ। যিনি অন্ধকার দূর করতে পারে না। তিনি কি করিয়া গুরুর গুরুতর পদবী দাবী করবে?
যাহারা বর্তমানে দেশ প্রচলিত গুরুবাদ সমর্থন করেন, তাদের আগে এই প্রশ্নের উত্তর পাইয়া নিতে হবে।
পীর/গুরু হতে বা অনেকের নিজ পিতা পীর। তাদের নিকট হতে কিছু কিতাব প্রাপ্ত হয়ে। আয়াত, শাস্ত্র যার অধ্যায়ন করা আছে। কথায় কথায় যিনি ঝুড়ি ঝুড়ি আয়াত, শ্লোক, তালিম তত্ত্ব, মাকাম তত্ত্ব, ষট্ চক্রতত্ত্ব, লতিফা তত্ত্ব, ব্যোম তত্ত্ব, বায়ু তত্ত্ব কতো রকমের তত্ত্ব উদগার করতে পারে।
কিন্তু আয়াতের, কিতাবের, শাস্ত্রার্থের প্রত্যক্ষ অনুভূতি তার নিজ জীবনের মধ্যে এক কনিকাও নাই। তিনি কি প্রকৃত গুরু বা মুর্শিদ তারা শুধুই চালাকি করে চলে। বর্তমান গুরুবাদকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
আবার উপযুক্ত ভক্তকেও গুরু মান্য, সেবা করা দরকার। ভক্তের অধীন ভগবান বা গুরু। কি ভাবে ভক্তের ভক্তির অধীন, শ্রদ্ধার অধীন, প্রেমের অধীন ভক্তের কল্যাণের অধীন, পূর্ণতার অধীন, মুক্তির অধীন। কিন্তু গুরু যদি হয় ভক্তের অর্থের অধীন। ভক্ত প্রদত্ত অন্ন বস্ত্রের অধীন। আর তাতে গুরুর ধর্ম কিছুই থাকতে পারেনা।
প্রকৃত গুরু বা মুর্শিদ ভক্তের প্রাণের সুপ্ত শক্তিকে নিজের জাগ্রত শক্তির অদৃশ্য স্পর্শ দিয়া নিদ্রোত্থিত করেন। যিনি স্বার্থ সেবায় সাময়িক সুখ অপেক্ষা ধর্মার্থে সর্বস্ব ত্যাগের আনন্দকে। যিনি অধিকতর কাম্য বলিয়া ভক্তের মনের উপর চিহ্ন আঁকিয়া দিতে পারে তিনিই সদগুরু।
যাহার সংস্পর্শে আসিলে আত্ম সুখের তৃষ্ণা লজ্জায় মাথা লুকায়। ভোগ লিপ্সা পালায়। তিনিই গুরু যিনি ছোটকে করেন বড়। আর বড়কে করেন বৃহত্তর। যিনি ভক্তকে প্রেমের শাসনের অধীন করেন এবং কামের বন্ধন, মোহের ও মিথ্যার বন্ধন হতে মুক্ত করেন। তিনিই গুরু, যিনি পরাধীনতার লৌহ শৃঙ্খল চূর্ণ করিয়া দেন।
এক কথায় গুরু একটি ভক্তের সেবা করিয়াই সমগ্র জগতের সেবা করিতে পারেন।
যদি কোন ভক্তের মন কু-প্রবৃত্তির পথে চলে। গুরু কি তাকে জোর করে নিবৃত্তির পথে টেনে আনবে? সে চায় স্বেচ্ছাচার করতে। চায় উচ্ছৃঙ্খল হতে। গুরু কি তখন যুক্তির জ্বালে নিষেধের দেয়াল গাঁথিয়া তাকে আটকাবে?
নিশ্চয় না। কেন না তা হলে উপায়টা হবে কৃত্রিম, ক্ষণ ভঙ্গুর। স্বভাবেরই শক্তিতে যাহাতে ভক্তের মন সংযমের পথে, সন্নীতির পথে, সদাচারের পথে ফিরিয়া আসে, আদেশ নিষেধের মুখ চাহিয়া নয়, পরন্তু নিজ স্বাধীন ইচ্ছায়, স্বাধীন রুচিতে, স্বাধীন বুদ্ধিতে যাহাতে তাহার মন মঙ্গলের দিকে আবর্তিত হয়।
শুধু সেই ব্যবস্থাটুকুই করে গুরু। নিষেধ আদেশ করতে পারলেই গুরু হয় না। এই জন্যই গুরু সবাই হতে পারে না। অতি অল্পসংখ্যক লোকই জগতে যথার্থ গুরুর জগৎমান্য স্থান অধিকার করেন।
আবার উপযুক্ত ভক্তকেও গুরু মান্য, সেবা করা দরকার। ভক্তের অধীন ভগবান বা গুরু। কি ভাবে ভক্তের ভক্তির অধীন, শ্রদ্ধার অধীন, প্রেমের অধীন ভক্তের কল্যাণের অধীন, পূর্ণতার অধীন, মুক্তির অধীন। কিন্তু গুরু যদি হয় ভক্তের অর্থের অধীন। ভক্ত প্রদত্ত অন্ন বস্ত্রের অধীন। আর তাতে গুরুর ধর্ম কিছুই থাকতে পারেনা।
আবার এটাও ঠিক কোন ভক্ত গুরুকে অর্থদান, অন্ন দান বা ভূমি দান করলে অপরাধী হয় না। সদগুরু যারা- গুরু ব্যবসা করে না, নিভৃতে থাকে তাদেরকে এ দানে অপরাধ নাই। কিন্তু যারা গুরুগিরি করে অট্টালিকার পর অট্টালিকা প্রাসাদ গড়ছে, দামি গাড়িতে চলে বেড়াচ্ছে। তারা সদগুরু নয় তাদেরকে দান করা অনর্থক বা অনুচিত।
তখন তিনি নামেই গুরু, তিনি পরাধীন। যে পরাধীন, সে না পারে নিজেকে কল্যাণ করতে, না পারে ভক্তকে কল্যাণ করতে। এবার একটু নারী প্রসঙ্গে আসবো।
গুরুতে সর্বস্ব সমর্পণ সর্বশাস্ত্রের বিধান। নারী সর্বগ্রে তার নারী ধর্মকে বজায় রাখবে। কেন না, সতীত্ব না থাকলে কারো শিষ্যত্ব সত্য হয় না। আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, গুরুতে সর্বস্ব সমর্পণ মানে এই নয় যে, গুরুর ইন্দ্রিয় পরিতপর্ণের জন্য নিজেকে ব্যবহার করতে হবে।
গুরুকে ইন্দ্রিয় সেবার নামে রতি কর্মে গুরুকে দেহ দিতে হবে। আজকাল এইটাই চলছে বেশি। রতি সুখ যাকে বলে। গুরুতে সর্বস্ব সমর্পণের মানে গুরুর চরণে সকল স্বার্থ-বুদ্ধি বিসর্জন দেওয়া। গুরুকে করুনাময়ী কৃপাসিন্ধু জেনে তার আদেশ পালনের জন্য মরণপণ করা।
পরমাত্মা বা মুক্তি লাভ করার জন্য তিনি যে সু-পবিত্র পন্থা নির্দেশ করে দেয়, তা দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে থাকা আর মেনে চলা। গুরু যে সাধন দান করেন, তার উপরে পূর্ণ নির্ভরেরই নাম গুরুতে আত্ম-সমর্পণ।
ভক্তরা একটা জাগায় গোল বাঁধিয়ে ফেলে। অনেক ভক্তই মনে করে থাকে, গুরু একটা মাংসপিণ্ড। ক্ষুধা-তৃষ্ণাদির আধার ও প্রবৃত্তিনিচয়ের করণের একটা মানুষ। গুরুকে মানুষ ভাবতে গিয়েই মানুষের যার যা প্রবৃত্তি। তার দিক থেকেই সেই রকমের গুরু-সেবার চেষ্টা করছে।
কেউ গুরু সেবা করছে অর্থ দিয়ে, কেউ আহার্য দিয়ে, কেউ বা দেহ পরিশ্রম দিয়ে। এতে কিন্তু গুরু সেবা হয়নি আদৌতেও। গুরুর প্রকৃত সেবা, তা হয় শুধু সাধনের একনিষ্ঠা দিয়ে। অন্য কোনও বস্তুই গুরুসেবার জন্য অপরিহার্য নয়।
আবার এটাও ঠিক কোন ভক্ত গুরুকে অর্থদান, অন্ন দান বা ভূমি দান করলে অপরাধী হয় না। সদগুরু যারা- গুরু ব্যবসা করে না, নিভৃতে থাকে তাদেরকে এ দানে অপরাধ নাই। কিন্তু যারা গুরুগিরি করে অট্টালিকার পর অট্টালিকা প্রাসাদ গড়ছে, দামি গাড়িতে চলে বেড়াচ্ছে। তারা সদগুরু নয় তাদেরকে দান করা অনর্থক বা অনুচিত।
একথা বলার তাৎপর্য এই, গুরু ও ভক্তের মধ্যে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ দৈহিক বা মানসিক ভাবে স্থাপিত হলে উভয়ের গুরুত্ব ও শিষ্যত্ব গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একের জন্য অপরের যে স্বাভাবিক কল্যাণকারিণী শক্তি, তা অচেতন হয়ে পড়ে।
(সমাপ্ত)
…………………
আরো পড়ুন:
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ১
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ২
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ৩
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। তাই নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
জয়হোক সত্যের জয়হোক মানবতার।। আলেক সাঁই।।