-মূর্শেদূল মেরাজ
‘যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে’ -এই প্রবাদটা সেই শৈশব থেকে শুনে আসছি। প্রবাদ বিষটাই এমন। এ শুধু শুনবার বা জানবার নয়। জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণও করে নিতে হয়। নইলে ঠিকঠাক মতো মনে থাকে না। মননে ঠাঁই পায় না।
এই প্রবাদটি শুনতে শুনতে বড় হলেও এর যথাযথ প্রমাণ পেতে অনেকটা সময় লেগেছে। আসলে মনের মাঝে স্থান করে না নিলে কোনো কিছু তেমন স্মরণে থাকে না। হতে পারে এর প্রমাণ জীবনে বহুবারই পেয়েছি। কিন্তু যে কারণে প্রবাদটি স্মরণীয় হয়ে আছে সেই কাহিনীটাই বরং বলি-
যদিও ছবি তুলতে পারি না। তারপরও ক্যামেরাখানা বহুদিন বয়ে বেড়িয়েছি। প্রথম প্রথম যখন সদ্য কুষ্টিয়া যাতায়াত শুরু করেছি। সেই সময় ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজির ধামের অনুষ্ঠানে মঞ্চের ছবি তুলতে গেলে ব্যাপক ‘হ য ব র ল’-র মধ্যে পরতে হতো।
আসলে তখন আমার ভাবনাও ছিল আমার মতোই ছেলেমানুষী। শহুরে নাক উঁচু ভাবধারা। মতের সাথে না মিললে বিরক্ত হওয়া। অহং ছিল আগাগোড়া। প্রথম বা দ্বিতীয়বার গেছি সাঁইজির আখড়ায়। সম্ভবত দোলের উৎসব চলছে।
আর ফটোসাংবাদিক দুইজন মঞ্চের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে যে, তাদের এড়িয়ে ছবি তোলার কায়দা করা যাচ্ছে না। অগত্যা আমরা দুইজন নিরুপায় হয়ে সামনে বসা মানুষদের সাথে একটু জায়গা করে নিয়ে সেখানে বসে পরলাম।
মঞ্চের সামনে গেলাম ছবি তুলতে। কিছুতেই ছবি তুলতে পারি না। যখন কোনো ফ্রেম নিতে চাই। তখনই অযাচিত লোকজন ঢুকে পরে ফ্রেমে। বিবৃতকর এক পরিস্থিতি। সেই সময় এখনকার মতো এতো বাঁধা নিষেধ। পাহারার ব্যবস্থাও ছিল না।
দেখা যেত না আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর বহর। আমন্ত্রিত অতিথিরা চলে গেলে তাদের দায়িত্বও ফুরাতো। তারা তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যেত। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মানুষজনই মঞ্চ সহ সকল কিছু পরিচালনা করতো। আমি রাতের যে সময়টায় ছবি তুলতে মঞ্চের সামনে গেলাম। সেসময় আরো দুই তিনজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম।
একজন স্থানীয় ফটোগ্রাফার। উনার সাথে সারাদিনে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে দূর থেকে। কথা হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে মাত্র। তিনি আমাকে দেখে মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করলেন। আর দুইজন রাজধানী থেকে যাওয়া এক স্বনামধন্য পত্রিকার ফটো সাংবাদিক।
তারা বিশেষ পাত্তাটাত্তা দিলেন না আমাদের। আমরা দুইজন নিরীহ মানুষ ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। তাদের ফাঁকে ফাঁকে। একে সামনে যারা বসেছেন ঘাসের উপর আসন নিয়ে তারা সামনে দাঁড়াতে গেলেই চিৎকার করে উঠে। আবার সামনে গেলে অন্যের ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
আর সাউন্ডের দিকে তো তীব্র শব্দের কারণে দাঁড়ানোই মুশকিল। ফটো সাংবাদিক ভদ্রলোক দুইজন বেশ ধমকাধমকির সুরে মঞ্চের সামনে যারা আসা-যাওয়া করছে তাদের উপর চোটপাট শুরু করেছে। এতে ছবি তোলার পরিবেশে আরো ব্যাঘাত ঘটছে।
কারণ শিল্পী-যন্ত্রীরা এই আচরণে ঠিকঠাক মতো মনোযোগ রাখতে পারছে না। তাদের চোখ বারবার চলে যাচ্ছে মঞ্চের সামনে কি ঘটছে তার দিকে। যাই হোক, তার মাঝেই ছবি তুলবার চেষ্টা করছি। যদিও সুবিধা হচ্ছে না তেমন কিছুই।
এর মাঝে উঠে বের হওয়াও মুশকিল। সামনে জায়গাও বেশ কম। না যাচ্ছে বসে থাকা। না যাচ্ছে উঠে চলে যাওয়া। ছবি তোলার কথা নাই বা বললাম। আরো মানুষ জড়ো হয়েছে এর মাঝেই মঞ্চের সামনে নাচবে বলে। বিচিত্র ভঙ্গিতে কিছু মানুষ একটানা নেচে চলেছে।
আর ফটোসাংবাদিক দুইজন মঞ্চের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে যে, তাদের এড়িয়ে ছবি তোলার কায়দা করা যাচ্ছে না। অগত্যা আমরা দুইজন নিরুপায় হয়ে সামনে বসা মানুষদের সাথে একটু জায়গা করে নিয়ে সেখানে বসে পরলাম।
অপরিচিত এক বাউল শিল্পী গান গেয়ে চলে যাওয়ার পর মঞ্চে উঠলেন অসীম বাউল। অল্পতেই মাতিয়ে দিলেন সকলকে। এমন সময় একজন বিশাল একখানা পাখা নিয়ে মঞ্চের সামনে চলে আসলেন। তিনি সমানে বাতাস করে যাচ্ছেন, শিল্পী-যন্ত্রীদের।
তার পিছু পিছু এসে আরো দুই তিনজন মঞ্চের সামনে উত্তাল গতিতে নাচতে শুরু করে দিলো। এরই মাঝে কোথা থেকে এক জালালী পাগল এসে উপস্থিত। তিনি তার দুই হাতের বিশাল বিশাল দুই লাঠি ঘুড়াতে ঘুড়াতে গানের তালে তালে মঞ্চের এপাশ ওপাশ করতে শুরু করলেন।
যারা দুইপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গান শুনছিল। আমরা যারা সামনে বসে আছি। সকলেই আতঙ্কে অস্থির। পাগলের লাঠি কখন কার গায়ে পরে সেই ভাবনায় শান্তি মত গানও শুনতে পারছি না। তার উপর অসীম বাউলের গান জমে যাওয়ায় মানুষের উপচে পড়া ভীড় হতে শুরু করেছে।
এর মাঝে উঠে বের হওয়াও মুশকিল। সামনে জায়গাও বেশ কম। না যাচ্ছে বসে থাকা। না যাচ্ছে উঠে চলে যাওয়া। ছবি তোলার কথা নাই বা বললাম। আরো মানুষ জড়ো হয়েছে এর মাঝেই মঞ্চের সামনে নাচবে বলে। বিচিত্র ভঙ্গিতে কিছু মানুষ একটানা নেচে চলেছে।
চরম বিরক্তি নিয়ে ক্যামেরা হাতে বসে আছি। ক্যামেরা তুলে ধরতেও ভয় করছে। কখন লাঠির আঘাতে সাধের ক্যামেরাখানা না চূড়মার হয়ে যায়। ফটোসাংবাদিকের দুইজনের মাঝে যিনি বয়সে বড়। তিনি কিছুটা এগিয়ে পাগলকে ধমকামে লাগলেন।
কিন্তু পাগলের সেসব শোনার সময় কই। তিনি একই ভঙ্গিতে দুই হাতে তার বিশাল লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে মঞ্চের এমাথা ওমাথা করেই যাচ্ছে। ততক্ষণে মঞ্চে গান জমে ক্ষীর। সারা প্রান্তরের মানুষ ততক্ষণে মাতোয়ারা। পাগলা তার আপন খেয়ালে দুর্দান্ত গতিতে লাঠি ঘুড়াতে ঘুরতে এ মাথা ও মাথা করছে।
পাগলও লাঠিতে কি লেগেছে দেখতে ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে মাঝ পথে। ফলে লাঠির অপর প্রান্ত গিয়ে লাগলো দাঁড়িয়ে থাকা ফটো সাংবাদিকের পায়ে। পায়ে জড়িয়ে তিনি পরতে পরতে শেষ পর্যন্ত সামলে নিলেন বটে। তবে পায়ে যে জোরদার ব্যাথা পেয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
কাঠি-ঢোল আর খমক সঙ্গত করছে। মাঝে মাঝে বাঁশি। দোতারা। আহ্। মহাভাবের মধ্যে সবাই। পুরো প্রান্তর জোড়া দর্শক মাতোয়ারা হয়ে ভাবে দুলছে। এমন পরিস্থিতির মাঝেই বয়সে বড় ফটোসাংবাদিক ছবি তোলার জন্য পজিসন নিয়েছেন বেশ কিছুটা এগিয়ে।
দেখে মনে হলো, পাগলা মঞ্চের অন্য মাথা থেকে এই মাথায় ঘুরে আসতে আসতে তিনি ছবি তুলে নিরাপদে আগের জায়গায় ফিরতে পারবেন। দ্বিতীয় ফটোসাংবাদিকও তাকে দেখে ছবি তুলতে ক্যামেরা তাক করলো।
কিন্তু সে পাগলের স্থিতি বুঝতে কিঞ্চিৎ ভুল করে ফেলেছে ততক্ষণে। পাগলের ঘুর্ণয়ণরত লাঠির কোণা লেগে নবীন ফটোসাংবাদিকের কাঁধের উপর লাগলো। ক্যামেরা বাঁচাতে গিয়ে তিনি আছড়ে পরলেন মাটির উপর। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
হাতের ক্যামেরা ছুটে গিয়ে সাউন্ড স্ট্যান্ডের সাথে বাড়ি খেয়ে কয়েক খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পরলো। মঞ্চে গানের শেষ অন্তরা চলছে। যন্ত্রীরা দাঁড়িয়ে গেছে বাজাতে বাজাতে। বাজনা উত্তাল। শিল্পী ঘেমে নেয়ে দরদী কণ্ঠে গেছে চলেছে।
কিন্তু অনেক পরে আমি সেই মানুষগুলোই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছি। জানতে শুরু করেছি তাদের মাঝে যে গভীর প্রেম আছে সেই কথা। বুঝবার চেষ্টা করে চলেছি তাদের প্রেম-ভক্তিকে। এখন যতবার তাদের কথা ভাবি। তাদের দেখি। ততবার নতজানু হয়ে মনে মনে বলি, ক্ষম অপরাধ, ক্ষম অপরাধ।
মাটি থেকে কিছুটা উঠে সাংবাদিক ভদ্রলোক ভাঙ্গা ক্যামেরার দিকে ছুটছে। অন্যদিকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে প্রবীন সাংবাদিক ছবি তোলার পর তার স্থান পরিবর্তন করার কথা বেমালুম ভুলে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে গেছে।
পাগলও লাঠিতে কি লেগেছে দেখতে ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে মাঝ পথে। ফলে লাঠির অপর প্রান্ত গিয়ে লাগলো দাঁড়িয়ে থাকা ফটো সাংবাদিকের পায়ে। পায়ে জড়িয়ে তিনি পরতে পরতে শেষ পর্যন্ত সামলে নিলেন বটে। তবে পায়ে যে জোরদার ব্যাথা পেয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
যাক সে যাত্রায় ফটোসাংবাদিক দুইজন ছাড়া আরো দুই একজন কিঞ্চিৎ আহত হলেও মারাত্মক কিছু ঘটে নি। প্রথমবারই মঞ্চের সামনে ছবি তুলতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ায়। পরবর্তীতে এমন পরিবেশ হলে আগেই মানে মানে কেটে পরতাম।
বিরক্ত হতাম মাঝে মাঝে। মনে মনে ভাবতাম। এই বিষয়গুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আরে ভাই গান শুনবি শোন। নাচবি নাচ। তাই বলে মঞ্চের সামনে গিয়েই নাচতে হবে। নিজের অজ্ঞাতেই সেই মানুষগুলো প্রতি একটা বিরক্তি বয়ে চলছিলাম মনের মাঝে।
তার পরনে বেশভূষায় ধুলা-বালি ময়লা থাকতে পারে। মনে তারা রাজা। আচরণে তারা স্বাধীন। প্রচলিত সমাজের কোনো বিধিতে তাদের আটকে রাখা যায় না। প্রথা মানি না বলে তারা প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে কোনো কিছু রাষ্ট্র করে না।
আপন অহংকে চিনতে না পারায় সেই মানুষগুলোর সাথে মেশা হয়ে উঠেনি কখনো। ভালো করে গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয়নি। তাদের নিয়ে ভাববার অবকাশ হয়নি কখনো। তারা যেন অচ্ছুৎ হয়েই রয়ে গিয়েছিল মনের গহ্বীনে।
কিন্তু অনেক পরে আমি সেই মানুষগুলোই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছি। জানতে শুরু করেছি তাদের মাঝে যে গভীর প্রেম আছে সেই কথা। বুঝবার চেষ্টা করে চলেছি তাদের প্রেম-ভক্তিকে। এখন যতবার তাদের কথা ভাবি। তাদের দেখি। ততবার নতজানু হয়ে মনে মনে বলি, ক্ষম অপরাধ, ক্ষম অপরাধ।
সেই মানুষগুলো গভীর ভাবে ভালোবাসে সুর-সঙ্গীতকে। ভক্তি-প্রেমে তাদের তুলনা মেলা ভার। তাদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখেছি, তারা মূলত প্রেমিক শ্রেণী। ইশকে দেওয়ানা। প্রেমে মাতোয়ারা।
যদিও কোনো প্রকার সংজ্ঞা দিয়ে তাদের তুলনা করা চলে না। তারপরও আমি তাদেরকে দেখতে গিয়ে দেখেছি। তাদের মাঝেও আছে অনেক পদের মানুষ। হ্যা মানুষ বলছি। যে নিজেকে উজার করে দিতে পারে ভক্তি-প্রেমে সেই তো মানুষ। সেই আমার চোখে প্রেমিক।
তার পরনে বেশভূষায় ধুলা-বালি ময়লা থাকতে পারে। মনে তারা রাজা। আচরণে তারা স্বাধীন। প্রচলিত সমাজের কোনো বিধিতে তাদের আটকে রাখা যায় না। প্রথা মানি না বলে তারা প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে কোনো কিছু রাষ্ট্র করে না।
(চলবে…)
…………………….
আরো পড়ুন-
যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে: পর্ব এক
যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে: পর্ব দুই