কমলকুটিরে শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত কেশব সেন
শ্রীরামকৃষ্ণ কাপ্তেনের বাটী হইয়া শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ‘কমলকুটির’ নামক বাটীতে আসিয়াছেন। সঙ্গে রাম, মনোমোহন, সুরেন্দ্র, মাস্টার প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত। সকলে দ্বিতল হলঘরে উপবেশন করিয়াছেন। শ্রীযুক্ত প্রতাপ মজুমদার, শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তগণও উপস্থিত আছেন।
ঠাকুর শ্রীযুক্ত কেশবকে বড় ভালবাসেন। যখন বেলঘরের বাগানে সশিষ্য তিনি সাধন-ভজন করিতেছিলেন, অর্থাৎ ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে মাঘোৎসবের পর – কিছুদিনের মধ্যে ঠাকুর একদিন বাগানে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন। সঙ্গে ভাগিনেয় হৃদয়রাম। বেলঘরের এই বাগানে তাঁহাকে বলেছিলেন, তোমারই ল্যাজ খসেছে, অর্থাৎ তুমি সব ত্যাগ করে সংসারের বাহিরেও থাকতে পার আবার সংসারেও থাকতে পার; যেমন বেঙাচির ল্যাজ খসলে জলেও থাকতে পারে, আবার ডাঙাতেও থাকতে পারে।
পরে দক্ষিণেশ্বরে, কমলকুটিরে, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাদি স্থানে অনেকবার ঠাকুর কথাচ্ছলে তাঁহাকে উপদেশ দিয়াছিলেন, “নানা পথ দিয়া, নানা ধর্মের ভিতর দিয়া ঈশ্বরলাভ হতে পারে। মাঝে মাঝে নির্জনে সাধন-ভজন করে ভক্তিলাভ করে সংসারে থাকা যায়; জনকাদি ব্রহ্মজ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিলেন; ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়, তবে দেখা দেন; তোমরা যা কর, নিরাকার সাধন, সে খুব ভাল। ব্রহ্মজ্ঞান হলে ঠিক বোধ করবে – ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য; ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।
সনাতন হিন্দুধর্মে সাকার নিরাকার দুই মানে; নানাভাবে ঈশ্বরের পূজা করে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর। রোশনচৌকিওয়ালারা একজন শুধু পোঁ ধরে বাজায় অথচ তার বাঁশীর সাত ফোকর আছে; কিন্তু আর একজন তারও সাত ফোকর আছে, সে নানা রাগরাগিণী বাজায়।
“তোমরা সাকার মানো না, তাতে কিছু ক্ষতি নাই; নিরাকারের নিষ্ঠা থাকলেই হল। তবে সাকারবাদীদের টানটুকু নেবে। মা বলে তাঁকে ডাকলে ভক্তি-প্রেম আরও বাড়বে। কখন দাস্য, কখন বাৎসল্য, কখন মধুর ভাব। কোন কামনা নাই তাঁকে ভালবাসি, এটি বেশ। এর নাম অহেতুকী ভক্তি। বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে এক ঈশ্বরেরই কথা আছে ও তাঁহার লীলার কথা; জ্ঞান ভক্তি দুইই আছে।
সংসারে দাসীর মতো থাকবে; দাসী সব কাজ করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে আছে। মনিবের ছেলেদের মানুষ করে; বলে, ‘আমার হরি’ ‘আমার রাম’ কিন্তু জানে, ছেলে আমার নয়। তোমরা যে নির্জনে সাধন করছ, এ খুব ভাল, তাঁর কৃপা হবে। জনক রাজা নির্জনে কত সাধন করেছিলেন, সাধন করলে তবে তো সংসারে নির্লিপ্ত হওয়া যায়।
“তোমরা বক্তৃতা দাও সকলের উপকারের জন্য, কিন্তু ঈশ্বরদর্শন করে বক্তৃতা দিলে উপকার হয়। তাঁর আদেশ না পেয়ে লোকশিক্ষা দিলে উপকার হয় না। ঈশ্বরলাভ না করলে তাঁর আদেশ পাওয়া যায় না। ঈশ্বরলাভ যে হয়েছে, তার লক্ষণ আছে। বালকবৎ, জড়বৎ, উন্মাদবৎ, পিশাচবৎ হয়ে যায়; যেমন শুকদেবাদি। চৈতন্যদেব কখন বালকবৎ, কখন উন্মাদের ন্যায় নৃত্য করিতেন। হাসে, কাঁদে, নাচে, গায়। পুরীধামে যখন ছিলেন, তখন অনেক সময় জড় সমাধিতে থাকতেন।”
[শ্রীযুক্ত কেশবের হিন্দুধর্মের উপর উত্তরোত্তর শ্রদ্ধা ]
এইরূপ নানাস্থানে শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনকে শ্রীরামকৃষ্ণ কথাচ্ছলে নানা উপদেশ দিয়াছিলেন। বেলঘরের বাগানে প্রথম দর্শনের পর কেশব ২৮শে মার্চ, ১৮৭৫ রবিবার ‘মিরার’ সংবাদপত্রে লিখিয়াছিলেন,১ “আমরা অল্প দিন হইল, দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস রামকৃষ্ণকে বেলঘরের বাগানে দর্শন করিয়াছি। তাঁহার গভীরতা, অর্ন্তদৃষ্টি, বালকস্বভাব দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হইয়াছি। তিনি শান্তস্বভাব, কোমল প্রকৃতি, আর দেখিলে বোধ হয়, সর্বদা যোগেতে আছেন।
এখন আমাদের বোধ হইতেছে যে, হিন্দুধর্মের গভীরতম প্রদেশ অনুসন্ধান করিলে কত সৌন্দর্য, সত্য ও সাধুতা দেখিতে পাওয়া যায়। তা না হইলে পরমহংসের ন্যায় ঈশ্বরীয়ভাবে ভাবিত যোগীপুরুষ কিরূপে দেখা যাইতেছে?” ১৮৭৬ জানুয়ারি আবার মাঘোৎসব আসিল, তিনি টাউন হলে বক্তৃতা দিলেন; বিষয় – ব্রাহ্মধর্ম ও আমরা কি শিখিয়াছি – (‘Our Faith and Experiences’) – তাহাতেও হিন্দুধর্মের সৌন্দর্যের কথা অনেক বলিয়াছেন।২
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে যেমন ভালবাসিয়াছিলেন, কেশবও তাঁহাকে তদ্রূপ ভক্তি করিতেন। প্রায় প্রতি বৎসর ব্রাহ্মোৎসবের সময়েও কেশব দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন ও তাঁহাকে কমলকুটিরে লইয়া আসিতেন। কখন কখন একাকী কমলকুটিরের দ্বিতলস্থ উপাসনাকক্ষে পরম অন্তরঙ্গজ্ঞানে ভক্তিভরে লইয়া যাইতেন ও একান্তে ঈশ্বরের পূজা ও আনন্দ করিতেন।
১৮৭৯ ভাদ্রোৎসবের সময় আবার কেশব শ্রীরামকৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ করিয়া বেলঘরের তপোবনে লইয়া যান। ১৫ই সেপ্টেম্বর সোমবার (৩১শে ভাদ্র, ১২৮৬, কৃষ্ণা চর্তুদশী)। আবার ২১শে সেপ্টেম্বর কমলকুটিরে উৎসবে যোগদান করিতে লইয়া যান। এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হইলে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে তাঁহার ফোটো লওয়া হয়। ঠাকুর দণ্ডায়মান, সমাধিস্থ। হৃদয় ধরিয়া আছেন। ২২শে অক্টোবর (৬ই কার্তিক, ১২৮৬, বুধবার), মহাষ্টমী – নবমীর দিন কেশব দক্ষিণেশ্বরে গিয়া তাঁহাকে দর্শন করিলেন।
১৮৭৯, ২৯শে অক্টোবর বুধবার (১৩ই কার্তিক, ১২৮৬), কোজাগর পূর্ণিমায় বেলা ১টার সময় কেশব আবার ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করিতে যান। স্টীমারের সঙ্গে একখানি বজরা, ছয়খানি নৌকা, দুইখানি ডিঙ্গি, প্রায় ৮০ জন ভক্ত। সঙ্গে পতাকা পুষ্পপল্লব খোল করতাল ভেরী। হৃদয় অভ্যর্থনা করিয়া কেশবকে স্টীমার হইতে আনেন – গান গাইতে গাইতে “সুরধুনীর তীরে হরি বলে কে, বুঝি প্রেমাদতা নিতাই এসেছে!”
কেশবকে যখন সংবাদ দেওয়া হয়, তখন তিনি ভাই অঘোরনাথের শোকে অশৌচ গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রচারক ভাই অঘোর ২৪শে অগ্রহায়ণ, ৮ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবারে লক্ষ্ণৌ নগরে দেহত্যাগ করেন। সকলে মনে করিলেন, কেশব বুঝি আসিতে পারিবেন না। কেশব সংবাদ পাইয়া বলিলেন, “সে কি! পরমহংস মহাশয় আসিবেন আর আমি যাইব না। অবশ্য যাইব। অশৌচ তাই আমি আলাদা জায়গায় খাব।”
ব্রাহ্মভক্তগণও পঞ্চবটী হইতে কীর্তন করিতে করিতে তাঁহার সঙ্গে আসিতে লাগিলেন: “সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ রূপানন্দ ঘন!” তাহাদের মধ্যে ঠাকুর মাঝে মাঝে সমাধিস্থ। এই দিনে সন্ধ্যার পর বাঁধাঘাটে পূর্ণচন্দ্রের আলোকে কেশব উপাসনা করিয়াছিলেন।
উপাসনার পর ঠাকুর বলিতেছেন, তোমরা বল “ব্রহ্ম আত্মা ভগবান” “ব্রহ্ম মায়া জীব জগৎ” “ভগবত ভক্ত ভগবান”। কেশবাদি ব্রাহ্মভক্তগণ সেই চন্দ্রালোকে ভাগীরথীতীরে সমস্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে ওই সকল মন্ত্র ভক্তিভরে উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আবার যখন বলিলেন, বল “গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব”।
তখন কেশব আনন্দে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, মহাশয়, এখন অতদূর নয়; “গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব” আমরা যদি বলি লোকে বলিবে ‘গোঁড়া’! শ্রীরামকৃষ্ণও হাসিতে লাগিলেন ও বলিলেন, বেশ তোমরা (ব্রাহ্মরা) যতদূর পার তাহাই বল।
কিছুদিন পরে ১৩ই নভেম্বর (২৮শে কার্তিক), ১৮৭৯ ৺কালীপূজার পরে রাম, মনোমোহন, গোপাল মিত্র দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন।
১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে একদিন গ্রীষ্মমকালে রাম ও মনোমোহন কমলকুটিরে কেশবের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। তাঁহাদের ভারী জানিতে ইচ্ছা, কেশববাবু ঠাকুরকে কিরূপ মনে করেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, কেশববাবুকে জিজ্ঞাসা করাতে বলিলেন, “দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস সামান্য নহেন, এক্ষণে পৃথিবীর মধ্যে এত বড় লোক কেহ নাই। ইনি এত সুন্দর, এত সাধারণ ব্যক্তি, ইঁহাকে অতি সাবধানে সন্তর্পণে রাখতে হয়; অযত্ন করলে এঁর দেহ থাকবে না; যেমন সুন্দর মূল্যবান জিনিস গ্লাসকেসে রাখতে হয়।”৩
ইহার কিছুদিন পরে ১৮৮১ মাঘোৎসবের সময় জানুয়ারি মাসে কেশব শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বরে যান। তখন রাম, মনোমহন, জয়গোপাল সেন প্রভৃতি অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
১৮০৩ শক, ১লা শ্রাবণ (কৃষ্ণা চতুর্থী, ১২৮৮), শুক্রবার, ১৫ই জুলাই, ১৮৮১, কেশব আবার শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর হইতে স্টীমারে তুলিয়া লন।
১৮৮১ নভেম্বর মাসে মনোমোহনের বাটীতে যখন ঠাকুর শুভাগমন করেন ও উৎসব হয়, তখনও কেশব নিমন্ত্রিত হইয়া উৎসবে জোগদান করেন। শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য প্রভৃতি গান করিয়াছিলেন।
১৮৮১ ডিসেম্বর মাসে রাজেন্দ্র মিত্রের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ নিমন্ত্রিত হইয়া যান। শ্রীযুক্ত কেশবও গিয়াছিলেন। বাটীটি ঠন্ঠনে বেচু চাটুজ্যের স্ট্রীটে। রাজেন্দ্র রাম ও মনোমোহনের মেসোমহাশয়। রাম, মনোমোহন, ব্রাহ্মভক্ত রাজমোহন, রাজেন্দ্র, কেশবকেও সংবাদ দেন ও নিমন্ত্রণ করেন।
কেশবকে যখন সংবাদ দেওয়া হয়, তখন তিনি ভাই অঘোরনাথের শোকে অশৌচ গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রচারক ভাই অঘোর ২৪শে অগ্রহায়ণ, ৮ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবারে লক্ষ্ণৌ নগরে দেহত্যাগ করেন। সকলে মনে করিলেন, কেশব বুঝি আসিতে পারিবেন না। কেশব সংবাদ পাইয়া বলিলেন, “সে কি! পরমহংস মহাশয় আসিবেন আর আমি যাইব না। অবশ্য যাইব। অশৌচ তাই আমি আলাদা জায়গায় খাব।”
শ্রীযুক্ত প্রতাপাদি ব্রাহ্মভক্তদের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক কথা কহিতেছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন দেখিয়া তিনি কেশবকে বলিতেছেন, “ইনি কেন ওখানে (দক্ষিণেশ্বরে) যান না; জিজ্ঞাসা করত গা; এত ইনি বলেন, ‘মাগছেলেদের উপর মন নাই’!” মাস্টার সবে এক মাস ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেছেন। শেষে যাইতে কয়দিন বিলম্ব হইয়াছে তাই ঠাকুর এইরূপ কথা বলিতেছেন। ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন, আসতে দেরি হলে আমায় পত্র দেবে।
মনোমোহনের মাতাঠাকুরানী পরম ভক্তিমতী ৺শ্যামাসুন্দরী দেবী ঠাকুরকে পরিবেশন করিয়াছিলেন। রাম খাবার সময় দাঁড়াইয়াছিলেন। যেদিন রাজেন্দ্রের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ শুভাগমন করেন, সেইদিন অপরাহ্নে সুরেন্দ্র তাঁহাকে লইয়া চীনাবাজারে তাঁহার ফোটোগ্রাফ লইয়াছিলেন। ঠাকুর দণ্ডায়মান সমাধিস্থ।
উৎসবের দিবসে মহেন্দ্র গোস্বামী ভাগবত পাঠ করিলেন।
১৮৮২ জানুয়ারি মাঘোৎসবের সময় সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজের উৎসব হয়। জ্ঞান চৌধুরির বাটীতে, দালানে ও উঠানে উপাসনা ও কীর্তন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ ও কেশব নিমন্ত্রিত হইয়া উপস্থিত ছিলেন। এই স্থানে নরেন্দ্রের গান ঠাকুর প্রথমে শুনেন ও তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে যাইতে বলেন।
১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১২ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার কেশব শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে আবার দর্শন করিতে আসেন। সঙ্গে জোসেফ কুক্, আমেরিকান পাদরী মিস পিগট। ব্রাহ্মভক্তগণসহ কেশব ঠাকুরকে স্টীমারে তুলিয়া লইলেন। কুক্ সাহেব শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি অবস্থা দেখিলেন। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্র এই জাহাজে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার মুখে সমস্ত শুনিয়া মাস্টার দশ-পনেরো দিনের মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন।
তিন মাস পরে এপ্রিল মাসে শ্রীরামকৃষ্ণ কমলকুটিরে কেশবকে দেখিতে আসেন। তাহারই একটু বিবরণ এই পরিচ্ছেদে দেওয়া হইল।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কেশবের প্রতি স্নেহ – জগন্মাতার কাছে ডাব-চিনি মানা ]
আজ কমলকুটিরে সেই বৈঠকখানাঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে উপবিষ্ট। ২রা এপ্রিল, ১৮৮২, বেলা ৫টা। কেশব ভিতরের ঘরে ছিলেন, তাঁহাকে সংবাদ দেওয়া হইল। তিনি জামা-চাদর পরিয়া আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহার ভক্তবন্ধু কালীনাথ বসু পীড়িত, তাঁহাকে দেখিতে যাইতেছেন। ঠাকুর আসিয়াছেন, কেশবের আর যাওয়া হইল না। ঠাকুর বলিতেছেন, তোমার অনেক কাজ, আবার খপরের কাগজে লিখতে হয়; সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) যাবার অবসর নাই; তাই আমিই তোমায় দেখতে এসেছি।
তোমার অসুখ শুনে ঢাব-চিনি মেনেছিলুম; মাকে বললুম, “মা! কেশবের যদি কিছু হয়, তাহলে কলিকাতায় গেলে কার সঙ্গে কথা কইব।”
শ্রীযুক্ত প্রতাপাদি ব্রাহ্মভক্তদের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক কথা কহিতেছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন দেখিয়া তিনি কেশবকে বলিতেছেন, “ইনি কেন ওখানে (দক্ষিণেশ্বরে) যান না; জিজ্ঞাসা করত গা; এত ইনি বলেন, ‘মাগছেলেদের উপর মন নাই’!” মাস্টার সবে এক মাস ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেছেন। শেষে যাইতে কয়দিন বিলম্ব হইয়াছে তাই ঠাকুর এইরূপ কথা বলিতেছেন। ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন, আসতে দেরি হলে আমায় পত্র দেবে।
ব্রাহ্মভক্তেরা শ্রীযুক্ত সামাধ্যায়ীকে দেখাইয়া ঠাকুরকে বলিতেছেন, ইনি পণ্ডিত, বেদাদি শাস্ত্র বেশ পড়িয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, হাঁ, এঁর চক্ষু দিয়া এঁর ভিতরটি দেখা যাচ্ছে, যেমন সার্সীর দরজার ভিতর দিয়া ঘরের ভিতরকার জিনিস দেখা যায়।
শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য গান গাইতেছেন। গান গাইতে গাইতে সন্ধ্যার বাতি জ্বালা হইল, গান চলিতে লাগিল। গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর হঠাৎ দণ্ডায়মান – আর মার নাম করিতে করিতে সমাধিস্থ। কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া নিজেই নৃত্য করিতে করিতে গান ধরিলেন-
সুরা পান করি না আমি সুধা খাই জয় কালী বলে,
মন-মাতালে মাতাল করে মদ-মাতালে মাতাল বলে।
গুরুদত্ত গুড় লয়ে, প্রবৃত্তি তায় মশলা দিয়ে;
জ্ঞান শুঁড়িতে চোঁয়ায় ভাঁটী পান করে মোর মন-মাতালে।
মূল মন্ত্র যন্ত্রভরা, শোধন করি বলে তারা;
প্রসাদ বলে এমন সুরা খেলে চতুর্বর্গ মেলে।
শ্রীযুক্ত কেশবকে ঠাকুর স্নেহপূর্ণ নয়নে দেখিতেছেন। যেন কত আপনার লোক; আর যেন ভয় করিতেছেন, কেশব পাছে অন্য কারু, অর্থাৎ সংসারে হয়েন! তাঁহার দিকে তাকাইয়া আবার গান ধরিলেন-
কথা বলতে ডরাই; না বললেও ডরাই ৷
মনের সন্দ হয়; পাছে তোমা ধনে হারাই হারাই ৷৷
আমরা জানি যে মন-তোর; দিলাম তোরে সেই মন্তোর ৷
এমন মন তোর; যে মন্ত্রে বিপদেতে তরী তরাই ৷৷
“আমরা জানি যে মন-তোর; দিলাম তোরে সেই মন্তোর; এখন মন তোর।” অর্থাৎ সব ত্যাগ করে ভগবানকে ডাক, – তিনিই সত্য, আর সব অনিত্য; তাঁকে না লাভ করলে কিছুই হল না! এই মহামন্ত্র।
আবার উপবেশন করিয়া ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
তাঁহাকে জল খাওয়াইবার জন্য উদ্যোগ হইতেছে। হলঘরের একপাশে একটি ব্রাহ্মভক্ত পিয়ানো বাজাইতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হাস্যবদন, বালকের ন্যায় পিয়ানোর কাছে গিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছেন। একটু পরেই অন্তঃপুরে তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হইল। জল খাইবেন। আর মেয়েরাও প্রণাম করিবেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জলসেবা হইল। এইবারে তিনি গাড়িতে উঠিলেন। ব্রাহ্মভক্তেরা সকলেই গাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। কমলকুটির হইতে গাড়ি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরাভিমুখে যাত্রা করিল।
…………………………………………
১ We met not long ago Paramhansa of Dakshineswar, and were charmed by the depth, penetration and simplicity of his spirit. The never-ceasing metaphors and analogies in which he indulged, and most of them as apt as they are beautiful. The characteristics of his mind are the very opposite to those of Pandit Dayananda Saraswati, the former being so gentle, tender and comtemplative, as the latter is sturdy, masculine and polemical.
- Indian Mirror, 28th March, 1875.
Hinduism must have in it a deep source of beauty, truth and goodness to inspire such men as these. - Sunday Mirror, 28th March, 1875.
২ “If the ancient Vedic Aryan is gratefully honoured today for having taught us the deep truth of the Nirakar or the bodiless Spirit, the same loyal homage is due to the later Puranic Hindu for having taught us religious feelings in all their breadth and depth.
“In the days of the Vedas and the Vedanta, India was all Communion (Joga). In the days of the Puranas, India was all emotion (Bhakti). The highest and best feelings of religion have been cultivated under the guardianship of specific divinities.”
- ‘Our Faith & Experiences’ – lecture delivered in January, 1876.
৩ ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪ই মে, ১৮৭৫, শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বেলঘরের বাগানে আসেন। Bharat Asram Libel Suit শেষ হয় ৩০শে এপ্রিল, ১৮৭৫, ১৮ই বৈশাখ, (১২৮২)। কেশব ঐ বাগানে তখনও ছিলেন।
১৮৮০, শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুরে ৮ মাস ছিলেন, ৩রা মার্চ, বুধবার (২১শে ফাল্গুন) হইতে ১০ই অক্টোবর, ১৮৮০, (২৫শে আশ্বিন) পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সিওড়, শ্যামবাজার, কয়াপাঠে কীর্তনান্দ। ফিরবার সময় কোতলপুরে ভদ্রদের বাড়ি সপ্তমী পূজায় আরতি দেখেছিলেন। রাস্তায় কেশবের প্রেরিত ব্রাহ্মভক্তের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কেশব চিন্তিত, ঠাকুরকে কয় মাস দেখেন নাই। কামারপুকুরে থাকিবার সময় ৺রঘুবীরের জমি ক্রয়।
–১৮৮২, ২রা এপ্রিল-
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….