-ড সৌরভ মণ্ডল
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন ধরে বহু সাধুসন্তের সান্নিধ্যে এলেও ক্রিয়াযোগ এবং ক্রিয়াযোগীগণের সহিত আজীবন তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আর সেই সকলস্তরের সাক্ষাতের অমূল্য তথ্য তেমনভাবে উন্মোচিত না হওয়ায় অনেকেই জানেন না যে কবিগুরু কেবলমাত্র একজন কবিই নন বিখ্যাত যোগীও ছিলেন।
বিভিন্ন লেখনিতে সেই সব কথাই মূর্ত হয়ে উঠে। তার মাঝে কিছু কিছু তুলে ধরলাম-
বাল্যকাল হতেই তিনি তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশ মতো গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও ধ্যান করিতেন।১
জীবন সায়হ্নে তিনি যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য পরম পূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৯০০ সালের কোনও এক সময় একটি বিশেষ ঘটনার মধ্যদিয়ে বোলপুরে প্রথম সান্যাল মহাশয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয়।২
তখন সান্যাল মহাশয়ের বয়স মাত্র ২৬ বৎসর। সেই সময় তাঁদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা হয়। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের এক নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় ও সান্যাল মহাশয় ঠাকুর পরিবারে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা এবং পরিবারের সকলেই শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন।৩
আবার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সান্যাল মহাশয় ঋষিকল্প মহাত্মা বলে উল্লেখ করেছেন।৪
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ্য পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা হেমলতা ঠাকুর আজীবন শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন এবং নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে পত্রালাভের মাধ্যমে তাদের দুইজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুকালে সান্যাল মহাশয় ভগবৎ কথা শুনিয়েছিলেন।৬
পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত অনুরোধে সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।৭
পরবর্তীকালে ১৯০৩ হতে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগাচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন।৮ (সেই সময়কার বিবরণ শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।)
পরবর্তী সময়ে একান্ত ব্যক্তিগত কারণ সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের দায়িত্ব ভার ছেড়ে দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আজীবন তাঁর নিবিড় অন্তরঙ্গতা অক্ষুন্ন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবার সান্যাল মহাশয়ের গৃহে এসেছেন ও সময়ে বহুক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য ও করেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সান্যাল মহাশয়ের বহু চিঠিতে তা প্রকাশ পায়।৯
পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুইজনে গোপনে ভারতের বহু তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন ও বহু সাধুসঙ্গ করেন। ১৯১২ সালে একবার কাশীর রাণামহল ঘাটে যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অপর এক শিষ্য কৃষ্ণরামজীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও নির্লোভ অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিভূত হয়েছিলেন।১০
এই সময় পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় সাতটি পুস্তক রচনা করেন। প্রত্যেকটি পুস্তক বঙ্গীয় ধার্ম্মিক সাহিত্যে এক অনবদ্য অবদান। তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদগীতার (তিন খণ্ড) ভূমিকা রচনা করেন তৎকালীন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় স্বয়ং। সেই ভূমিকাতে স্বয়ং গোপিনাথ কবিরাজ মহাশয় শ্রীযুক্ত সান্যাল মহাশয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তাঁর রচিত ‘অভ্যাসযোগ’ নামক পুস্তকের প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রবাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিঠি দেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-
এবারকার মেলে আমি দুইখানি বই একসঙ্গে পেলাম একখানি আপনার ‘অভ্যাসযোগ’। দুইখানিই আমার প্রবাসের বন্ধুরূপে দর্শন দিয়াছে। একটিতে আমাদের দেশের সৌন্দর্য আর একটিতে আমাদের দেশের সাধনা আমার সঙ্গ লইয়াছে। উভেয়েতেই আমার প্রয়োজন এবং অনুরাগ।১১
‘দিনচর্য্যা’ পাঠ করে কবিগুরু লেখেন- ‘আপনার দিনচর্য্যা পড়ে উৎসাহ এবং উপকার পেয়েছি। এ বইটি কাজের হয়েছে। এবং এর মধ্যে ভাবের ও অভাব নেই।’১২
যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য স্বামী যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের দুই শিষ্য পরমহংস যোগানন্দ এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ, নোবেলজয় লাভের কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়াযোগের কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত হন।১৩
স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজের (পূর্বেনাম মনোমোহন মজুমদার) কলেজের বন্ধু ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোস্থ বাড়িতে বিচিত্রা ক্লাবে প্রভাত বাবুর সহযোগীতায় স্বামী সত্যানন্দ গিরি বহুবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন এবং অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তাঁর সহিত বহু বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেই সময় স্বামী সত্যানন্দ গিরি একজন উন্নত ক্রিয়াযোগী জেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিকট হতে কিছু প্রাথমিক ক্রিয়া পদ্ধতি শিক্ষা লাভ করেন এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজকে অনুরোধ করেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হতে। কিন্তু কিছু ব্যক্তিগত কারণ স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর সেই অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।১৪
পরমহংস যোগানন্দের ভ্রাতা শ্রীযুক্ত শ্রী সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দণ্ডায়মান অবস্থার চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। কবিগুরু স্বয়ং সেই চিত্র দেখে বিস্ময়ে অভিভূত ও এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একখানি প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়কে। সেখানে তিনি তাঁর দাঁড়ানো ভঙ্গিতে ভালো ছবিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে দিল্লির অ্যাসেমব্লিতে শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়ের আঁকা ছবিটির অনুকরণে কবিগুরুর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় পূজ্যপাদ যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের নিকট ক্রিয়াযোগ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীকালে ক্রিয়াযোগের উচ্চতর সাধন পদ্ধতি লাভ করেন শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট হতে।১৫
অবশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন সায়হ্নে এসে ৭৮ বছর বয়সে পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেন। সান্যাল মহাশয় কবিগুরুকে আত্মসাক্ষাৎ করিয়ে দেন ও ক্রিয়াযোগের অপরাপর সকল কর্মের (দেহের পবিত্রীকরণ, অঙ্গশোধন ইত্যাদি) মধ্যদিয়ে দীক্ষাদান সম্পন্ন করেন। দীক্ষা গ্রহণকালে কবিগুরু এবং সান্যাল মহাশয়কে সাহায্য করেন পরমহংস যোগানন্দজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচরণ ঘোষ মহাশয়ের শিষ্য ও জামাতা বিশিষ্ট ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়।
ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পরই শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের একত্রে একটি ছবি তোলা হয়েছিল তা সংযুক্ত করলাম। সেই সঙ্গে কবিগুরু স্বহস্তে একটি প্রশস্তি পত্রও দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু মহাশয়কে।১৬
ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পর আর মাত্র দুই বৎসর তিনি জীবিত ছিলেন। সেই সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ ও পীড়াগ্রস্ত থাকলেও নিয়মিত রাত্রির শেষভাগে যোগাভ্যাস করতেন এবং অতি অল্প সময়ে আধ্যাত্ম জগতের অতি উচ্চাবস্থা প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে যোগীবর শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় স্বয়ং বলেছেন, ‘সেই সময় কবিগুরু ধ্যানের মধ্যে এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়িতেন যে বাহ্য চেতনা পর্যন্ত লুপ্ত হইতো।’১৭
বয়সে ছোট হলেও কবিগুরু সান্যাল মহাশয়কে গুরবৎ শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন।১৮
আবার কবিগুরুর প্রতি সান্যাল মহাশয়ের শ্রদ্ধার কোনও ঘাটতি ছিল না। কেবলমাত্র সান্যাল মহাশয় নন তাঁর প্রধান শিষ্য শ্রীযুক্ত জ্বালাপ্রসাদ তেওয়ারী মহাশয়ের সহিত কবিগুরুর ছিল অতি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তিনি নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতেন শ্রীযুক্ত জ্বালাপ্রসাদ তেওয়ারী মহাশয়ের।১৯
বলাবাহুল্য, প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় পরমারাধ্য পূজ্যপাদ গুরুদেব যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় হাওড়ার চামাড়িয়া হাউসে শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের কৃপাশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। সান্যাল মহাশয়ের সহিত তাঁহার ক্রিয়াযোগের অতি উচ্চতর সাধন পন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সান্যাল মহাশয় যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের মস্তকের শীর্ষবিন্দুতে স্পর্শ করে আশীর্বাদ করেন।
এছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য রচনা ‘সঞ্চয়িতা’ ও ‘গীতবিতানের’ প্রতি ছিল তাঁর অগাধ প্রেম। তিনি তাঁর অনুগামী ভক্তদের নিকট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু রচনার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন।
যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের সহধর্মিনী শ্রীশ্রী মনিকা চৌধুরী মাতা ঠাকুরানীর মাতুলালয় ছিল বোলপুরে এবং মাতামহ শ্রীযুক্ত অনঙ্গমোহন বাবু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাড়ির চালক। সেই সুবাদে তিনি বাল্যকালে বহুবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর নিকটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু তথ্য শোনা যায়। আমার পরম সৌভাগ্য বহুদিন আমি তাঁর স্নেহাশীর্বাদ পেয়েছি। তাঁর স্নেহাশীর্বাদ আমার জীবনে জীবন পথের পাথেয়।২০
তবে অনেকে প্রশ্ন করেন, পরমহংস যোগানন্দজী তাঁর যোগীকথামৃতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্রিয়াপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেন নি কেন?
উত্তরে আমি বলবো, প্রথমত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়াযোগ প্রাপ্ত হন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। আর পরমহংস যোগানন্দজী তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করেছিলেন এর বহুপূর্বে। সহজেই অনুমেয় কেন উল্লেখ করেননি।
তাছাড়াও যাঁরা বিশ্বাস করেন পরমহংস যোগানন্দজী উল্লেখ না করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়া পাবেন না তাঁদের অবগত করার জন্য বলব পরমহংস যোগানন্দজী অনেক বিষয় উল্লেখ করেননি তাঁর যোগীকথামৃতে। যেমন-
- স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ (পূর্বনাম মনোমোহন মজুমদার) যোগানন্দজীর সাথেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ সময়ে।২১ এই কথা যোগানন্দজী উল্লেখ করেননি। তারমানে কি সত্যানন্দ গিরি মহারাজ ছিলেন না?
- পরমহংস যোগানন্দজী লিখেছেন, লাহিড়ী মহাশয় নিজে কোন পুস্তক লেখেন নি।২২ তাহলে কি সত্যিই লাহিড়ী মহাশয় নিজে কিছু লেখেননি? আসলে যোগানন্দজী সেই সময়ে জানতেন না যে লাহিড়ী মহাশয় কিছু লিখেছেন কিনা। এমনকি তাঁর গুরুদেব পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজও জানতেন না, জেনেছিলেন বহু পরে।২৩
- কারণ লাহিড়ী মহাশয় তাঁর সমস্ত রচনা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁর প্রধান শিষ্য শ্রীশ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয়কে দিয়ে প্রকাশ করাতেন। এমনকি এই সমস্ত পুস্তক বিনামূল্যে ক্রিয়ান্বিতদের দেওয়া হতো। ক্রিয়ান্বিত ভিন্ন অন্য কাউকেই দেওয়া হতো না। পরবর্তীকালে যোগানন্দজী শ্রীশ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয়ের শিষ্য শ্রীযুক্ত সুধাকর কুমারনাথ জীর ভক্ত ও শিষ্য শ্রী রামকিশোর রায় মহাশয়ের নিকট হতে পুস্তকগুলি সংগ্রহ করেন।২৪
- প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো আজও অনেকেই জানেন না যে লাহিড়ী মহাশয় মোট কতগুলি শাস্ত্রের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করেছিলেন। লাহিড়ী মহাশয় মোট ২৭টি শাস্ত্রের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করেছিলেন। ২৬টি প্রকাশিত হয়েছিল। শেষ গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত-এর একাদশ খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সেটি বংশ পরমপরায় শ্রীশ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয়ের পৌত্র শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত শিবময় ভট্টাচার্য মহাশয়ের নিকট গচ্ছিত ছিল। বর্তমানে তা প্রকাশ করা হয়েছে। শ্রদ্ধেয় শিবময় বাবু নিজে আমাকে বলেছিলেন যে তার একটি কপি সান্যাল মহাশয়ের প্রধান শিষ্য শ্রীযুক্ত জ্বালাপ্রসাদ তেওয়ারী মহাশয়কে দেওয়া হয়েছিল।
কেউ কেউ আবার শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের এবং কবিগুরুর লেখার মধ্যে প্রমাণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
- তাঁদের জন্য বলব বৃথা সময় অপব্যায় করে লাভ নেই, পাবেন না। কারণ লাহিড়ী মহাশয়ের আমলে তিনি ক্রিয়াযোগের দীক্ষাদান কালে কয়েকটি শপথ করিয়ে নিতেন, তারমধ্যে একটি অন্যতম হলো- ‘কোন আচরণে ক্রিয়াপ্রাপ্তির সৌভাগ্য প্রকাশ করিতে চেষ্ঠা করিবেন না।’২৫
- এই নিয়ম তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্যদের অধিকাংশই ভীষণ কঠোরভাবে পালন করতেন এবং তাঁদের শিষ্যদেরকেও এই শপথ করিয়ে নিতেন। (যদিও বর্তমানে সেই শপথের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন ও শিথিলতা দেখা গিয়েছে) সেক্ষেত্রে কবিগুরুর লেখার মধ্যে ক্রিয়াপ্রাপ্তির কথা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র।
- আর সান্যাল মহাশয় ছিলেন একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। তিনি নিজে কবিগুরুর গুরু বলে প্রচার করবেন? সে প্রয়োজনও তাঁর ছিল না। শুধু তাই নয়, তিনি একজন প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
- তবুও সেই সকল ব্যক্তিদের অনুরোধ করবো সান্যাল মহাশয়ের লেখা ‘অভ্যাসযোগ’ বইটি পড়তে। সেখানে একাদশ অধ্যায়ে কবিগুরুর সাধনা ও যোগাভ্যাসের কথা পরিস্কার লিখে গেছেন সান্যাল মহাশয় স্বয়ং। এমনকি ক্রিয়া প্রাপ্তির পূর্বে কবিগুরু যে তাঁর পিতার নির্দেশে গায়ত্রী জপ করতেন এবং সেই জপ সম্বন্ধে তিনি সান্যাল মহাশয়কে বলেছিলেন, ‘শুধু শুধু কতকগুলো কথা উচ্চারণ ও তাহার প্রত্যহ অভ্যাস করিয়া লাভ কি, বরং তাহার অর্থ উপলব্ধি করা সংগত।’ ক্রিয়া প্রাপ্তির পর কবিগুরু বলেছেন, ‘খন ইহার উপকারিতা বুঝিতে পারিয়াছি।’২৬
কেউ কেউ আবার বলেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাভ্যাস হাল আমলে বর্তমান ক্রিয়াযোগীদের গবেষণা।
- মার্জনা করবেন, আপনাদের জন্য তথ্যসূত্রে সকল বইয়ের নাম উল্লেখ করলাম। অধিকাংশ বই বহু বৎসর পূর্বে লেখা। এমনকি কিছু বই প্রকাশিত হয়েছিল শতবর্ষ পূর্বে, বর্তমানে দুর্লভ।
- অনুরোধ করবো ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’ গ্রন্থের রচয়িতা শ্রদ্ধেয় শ্রী বিপুল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের প্রস্তবনাটি একটু পড়তে। তিনি কিভাবে, কত বৎসরের সংগ্রহে, কোন কোন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ ধন্য ব্যক্তির সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরেছেন।
অনেকেই মনে করেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র জীবনের গবেষণা হয়ে গেছে।
আমি এই মতামতকে সম্পূর্ণ সম্মান জানিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত জানাই-
- আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন এক মহাসমুদ্র। সেই সমুদ্রের জল যিনি যতটুকু পান করেছেন তিনি ততটুকুই প্রকাশ করেছেন। কেউ হয়তো সেই সমুদ্রে সম্পূর্ণ রূপে অবগাহনও করেছেন। কিন্তু কারও পক্ষেই সেই মহাসমুদ্রের তলাতল বিচার করা সম্ভব নয়।
- তা বিচার একমাত্র আরও একটি রবীঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। তাই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যতই গবেষণা হোক না কেন তা কোন মতেই সম্পূর্ণ বলা যায় না। এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। বিচারের ভার না হয় সুধী পাঠকবৃন্দের উপর ন্যস্ত করলাম। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
……………………………..
আরো পড়ুন:
সব তীর্থ বার বার গঙ্গা সাগর একবার
দোল উৎসব
আম্মার সঙ্গলাভ
ক্রিয়াযোগ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা ও নবকলেবর রহস্য
……………………………..
১. (অভ্যাসযোগ, পৃ-২৭৬)
২. (অভ্যাসযোগ, পৃ-২৭৬)
৩. (স্মরণিকা ও সত্যানুসন্ধান, পৃ-২)
৪. (অভ্যাসযোগ, পৃ-২৮৮)
৫. (অভ্যাসযোগ, পৃ-২৯০)
৬. (সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ, পৃ-৫৫)
৭. (যোগী আচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ-২৬ সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ, পৃ-৫৫)
৮. (Biography of a Yogi, pg no.101/Yoganada Sangha by Swami Satyananda Giri pg n. 111-113)
৯. (সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ পৃ-৫৭/ Sanyal Mahashaya pg no. 112 To 124/ যোগী আচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃ- 113 to 119/বাবাজী ও তাঁর পরম্পরা পৃ-৫৭৩/মহাপীঠ তারাপীঠ ৩য় খণ্ড পৃ-২৬-৩০)
১০. (পুরাণ পুরুষ যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী পৃ-২৮২/যোগী আচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃ-৪১/সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ পৃ-৫৮/মহাপীঠ তারাপীঠ তয় খণ্ড পৃ-২৬-৩০, ২য় খণ্ড পৃ-১৩৭)
১১. (শ্রীমদ্ভগবদগীতা প্রথম খণ্ড পরিশিষ্ঠ পৃ-৪৪৭)
১২. (আশ্রম চতুষ্ঠয় পৃ-১৭২)
১৩. (যোগী কথামৃত, পৃ-২৫৭/Traveler On The Path Of Truth, pg no. 194/Yoganada Sangha by Swami Satyananda Giri pg n. 111 to 113)
১৪. (Biography of a Yogi, pg no.112/A Traveler On The Path Of Truth, pg no. 194 / Kebalananda & Sri Yukteswar pg no. 13)
১৫. (মেজদা, পৃ-১৭৬)
১৬. (সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ পৃ-১০১-১১৪/সাধু সান্নিধ্যে সাধু মনীষী/পৃ-১১৯ যোগী আচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃ-১৮৮-১৯০/মহাপীঠ তারাপীঠ ৩য় খণ্ড পৃ-২৬-৩০/ক্রিয়াযোগের অমল আলোয় শ্রীমদ্ভগবদগীতা পৃষ্ঠা নং ২৭৬)
১৭. (অভ্যাসযোগ, পৃ-২৭৭)
১৮. (স্মরণিকা ও সত্যানুসন্ধান পৃ-২)
১৯. (ক্রিয়াযোগ দীপিকা পৃ-২০)
২০. (ক্রিয়াযোগের অমল আলোয় শ্রীমদ্ভগবদগীতা পৃষ্ঠা নং ২২৫, ২৭৭, ২৭৮)
২১. (Traveler On The Path Of Truth, pg no. 194/Yoganada Sangha by Swami Satyananda Giri pg n. 111 to 113)
২২. (যোগীকথামৃত পৃ-৪৪৮)
২৩. (ধর্মালোচনা ও সঙ্গীতমাল্য পৃ-১৫৮/বাবাজী ও তাঁর পরম্পরা, পৃ-৩৯০)
২৪. (Biography of a Yogi Pg. 70)
২৫. (শ্রীশ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের জীবন কথা, পৃ-১৩৬)
২৬. (অভ্যাসযোগ পৃ-২৭৬)
……………………………..
তথ্যসূত্র
মহাপীঠ তারাপীঠ (তৃতীয় খণ্ড ও পঞ্চম খণ্ড): বিপুল কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
সাধু সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ: বিপুল কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
সাধু সান্নিধ্যে সাধু মনীষী: বিপুল কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
শ্রীমদ্ভগবদগীতা (তিন খণ্ড): শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
দিনর্চয্যা: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
আশ্রম চতুষ্ঠয়: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
বিল্বদল: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
শতদল: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
দীক্ষা ও গুরুতত্ত্ব: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
আত্মানুসন্ধান ও আত্মানুভূতি: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
অভ্যাসযোগ: শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল
স্মরণিকা ও সত্যানুসন্ধান: শ্রী গোপালকৃষ্ণ পাল
যোগী আচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: অধ্যাপক হরপ্রসাদ রায়
রবীন্দ্র জীবনী: শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
পুরাণ পুরুষ যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী: বাচস্পতি অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়
যোগী কথামৃত: শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ
যোগীরাজ শ্রীশ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের প্রামাণ্য জীবনী: শ্রী আনন্দমোহন লাহিড়ী
শ্রীশ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের জীবন কথা: শ্রী অভয়চরণ লাহিড়ী
মেজদা: শ্রী সনন্দলাল ঘোষ
ক্রিয়াযোগের অমল আলোয় শ্রীমদ্ভগবদগীতা: যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী
বাবাজী ও তাঁর পরম্পরা: স্বামী সত্যেশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ
ক্রিয়াযোগ দীপিকা: শ্রী অজিত
আহুতি ও হোমের ফোঁটা: শ্রী অজিত
ধর্মালোচনা ও সঙ্গীতমাল্য: শ্রী বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য
Kebalananda & Sri Yukteswar: Swami Satyeswarananda Giri
Biography of a Yogi: Swami Satyeswarananda Giri
Mahamuni Babaji & His Legacy: Swami Satyeswarananda Giri
Yoganada Sangha: Swami Satyananda Giri
A Traveler On The Path Of Truth: Paramahamsa Prajnanananda
Sanyal Mahashaya A life Of Humility: Paramahamsa Prajnanananda