ক্রিয়া মানে কর্ম, কর্ম মানে ক্রিয়া। অতএব যা ক্রিয়াযোগ তাই কর্মযোগ। কর্ম না করলে এই পৃথিবীতে আমরা কিছুই পাবো না। অতএব জাগতিক কর্ম ছাড়া কোন উপায় নেই। জাগতিক কর্ম আমাদের কি দেয়?
বেঁচে থাকতে গেলে ক্ষুধার নিবৃত্তি করা প্রয়োজন অতএব অন্ন চাই। পিপাসার জন্য পানীয় জল চাই; রোগের জন্য চিকিৎসা চাই, ঔষধ চাই, পোশাক চাই, বাসস্থান চাই, শিক্ষা চাই, মান চাই, যশ চাই, প্রতিপত্তি চাই, ধনদৌলত চাই, এইভাবে পৃথিবী থেকে পৃথিবীর বস্তুকে নিঙড়ে নিয়ে দেহ ও মনের পুষ্টিসাধন চাই।
পৃথিবী থেকে এতকিছু নিয়েও মানুষ শান্তি পায় না। পৃথিবী অকৃপণভাবে সবকিছু দিয়েই চলেছে, মানুষ নিয়েই চলেছে আফুরন্তভাবে তথাপি মানুষের জীবনে শান্তির বড় অভাব।
পৃথিবী থেকে মানুষ এতকিছু নিয়েও শান্তি পায় না কেন?
এর কারণ এই সব ভোগ্যবস্তু মানুষ নিজে ভোগ করে না। মানুষ পৃথিবী থেকে এত কিছু আহরণ করে কেবল তার নিজের ভিতরে অবস্থিত দেহ, মন এবং ইন্দ্রিয়ের সেবা করে, কিন্তু নিজের সেবা করে না। এই নিজেটাকে তা সাধারণ মানুষ জানে না, তাই দেহ, মন এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজে বলে মনে করে।
একজন হঠাৎ মরে গেল। একটু আগেই সে কথা বলছিল, খাচ্ছিল, সব কিছু করছিল কিন্তু হঠাৎ কিসের অভাব হল যার জন্য ঐ মানুষটির মুখ আর কথা বলে না, চোখে দেখে না, কানে শোনে না, হাত পা চলে না, ক্ষুধা লাগে না, পিপাসা লাগে না, শরীরবোধ নেই, তাই সে মৃত।
কিসের অভাব হল? তার ভেতরে কি নেই?
একের অভাবে সব থেমে গেছে। দেহরূপ রাজ্যের অধীশ্বর এই দেহের সমস্ত কর্ম থামিয়ে দিয়েছেন।
মানুষ আমরা কি তাঁর সন্ধান কখনও করেছি?
অতীতের ফেলে আসা জীবনে এমনকি এই বর্তমান জীবনেও কি তাঁর কথা একবারও ভেবেছি? তাঁর দিকে একবারও দৃষ্টি ফেরানোর প্রয়োজন বোধ করেছি? …করিনি।
কিন্তু কেন করিনি? করিনি এ কারণে যে আমি ছিলাম অজ্ঞানী। আমি জ্ঞানের সন্ধান করিনি, এতদিন কেবল দেহ, মন, ইন্দ্রিয় এদেরই আপনজন ভেবে এদের সেবায় মত্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম আমাকে অনন্ত শান্তি দেবে।
এইভাবে বহু বহু জন্ম পার করতে করতে প্রভু তোমার দিকে দৃষ্টি গেল, ভাবলাম তুমি ছাড়া জগতে কিছু নেই, আমিও নেই। এই তুমিটাই যে আমি এই বোধটাও আমার এতদিন হয়নি।
যখন বোধটা এলো তখন কোথায় পাব, কে পথ দেখাবে এই সন্ধান করতে করতে ইহ জীবনের বেশীর ভাগটাই চলে গেল। তারপর পেলাম পথ প্রদর্শককে।
শুরু করলাম কঠোর তপস্যা, কঠোর তপস্যা করতে করতে যেদিন নিজের দিকে দৃষ্টি এল তখন দেখলাম কেবল তুমিই আছ, বুঝলাম সেই তুমি এবং আমি অভিন্ন। পেছন ফিরে দেখলাম যাদের আপনজন ভেবে এতদিন সেবা করেছিলাম তারা আর কেউ নেই।
সেই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য, শ্রবণশক্তি, মন, বিবেক, বুদ্ধি, অসভ্য ইন্দ্রিয়, রোগ, শোক, জরা ব্যাধি, দেহবোধ, অপনপর জ্ঞান কেউ আর নেই। কেবল আমিই আছি। তখন তুমি আর আমি আমাতেই ফিরে এলাম।
তখন বুঝলাম ক্রিয়াযোগের অনন্ত মহিমা। যে আমাকে পৃথিবীর সবকিছু থেকে, সব আকর্ষণ থেকে এমনকি জন্ম- মৃত্যুর খপ্পর থেকে উদ্ধার করে আমাকে আমার উৎসস্থলে পৌঁছে দিল। ‘ক্রিয়াযোগ’ এটাই দিতে পারে।
……………………………………..
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা
পুনঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন