-আরজ আলী মাতুব্বর
মানুষের আশার শেষ নাই, কিন্তু উহা কোনো সময় কাজে লাগে, হয়তো কোনো সময় লাগে না। জীবজগতের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধানই হইল বাঁচিয়া থাকার আশা। স্বেচ্ছায় কেহই। মরিতে চাহে না, চাহে অমররাজ্য।
আমরা অমররাজ্যের সন্ধান পাই ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যের বেদাদি গ্রন্থে এবং অন্যান্য ধর্মসাহিত্যে। এইখানে আমরা সেই অমরজগত সম্বন্ধে কয়েকটি মতের সামান্য আলোচনা করিব।
বৈদিক মত
হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়। কেননা হিন্দুদের আসল ধর্মগ্রন্থ বেদ। কিন্তু বর্তমান হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রবহুল ধর্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেদের পরে গীতা, পুরাণ, উপপুরাণ ইত্যাদির রচয়িতারা বৈদিক ধর্মের গায়ে রং ফলাইয়াছেন। যে যাহা হউক, অন্যান্য মত আলোচনার পূর্বে দেখা যাক। আলোচ্য বিষয়ে ঋগ্বেদে কি পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের চতুর্থ ঋকে লিখিত আছে, “মানুষ যজ্ঞ দ্বারা স্বর্গলাভে অধিকারী হয়।” যজ্ঞ কি? দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক আগুনে ঘৃত নিক্ষেপ করা। এই কাজটুকু সারিতে পারিলেই স্বর্গ নামক একটি স্থান লাভ হইবে।
ঐ বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের সপ্তচত্বারিংশ সূক্তের সপ্তম ঋকে ইন্দ্রদেবের নিকট প্রার্থনা করা হইতেছে, “হে ইন্দ্রদেব! তুমি আমাদিগকে সেই সুখময় ভয়শূন্য আলোকে অর্থাৎ স্বর্গলোকে লইয়া যাও।” স্বর্গ কি? উহা সুখময় আলোকিত স্থান, যেখানে কোনো বিপদ-আপদ নাই।
ঐ বেদের নবম মণ্ডলের ত্রয়োদশাধিক শততম সূক্তের সপ্তম ঋকে কশ্যপ ঋষি সোম দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাইতেছেন, “যে ভুবনে সর্বদা আলোক, যে স্থানে স্বর্গলোক সংস্থাপিত আছে- হে ক্ষরণশীল! সেই অমৃত অক্ষয় ধামে আমাকে লইয়া চল।”
ঋষি এইখানে এমন একটি স্থানের কামনা করিতেছেন, যেখানে দিবা আছে, রাত্রি নাই; জীবন আছে, মৃত্যু নাই এবং স্থানটির কখনও লয় নাই।
ঐ বেদের পঞ্চম মণ্ডলের পঞ্চষষ্ঠিতম সূক্তের চতুর্থ ঋকে উক্ত হইয়াছে, “মিত্র দেবতা স্তবকারীকে স্বর্গের পথ প্রদর্শন করেন।” এইখানে ঋষি মনে করিতেছেন যে, মিত্র দেব বা ভগবান তোষামোদপ্রিয়। মানুষের স্তব-স্তুতি বা প্রশংসায় তিনি তুষ্ট হন এবং স্তবকারীকে স্বর্গের পথ দেখাইয়া দেন।
ঐ মণ্ডলের ষষ্ঠষষ্ঠিতম সূক্তের ষষ্ঠ ঋকে মিত্র ও বরুণ দেবতার আহ্বানে রাত হব্য ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “তোমাদিগের অনুগ্রহে আমরা যেন স্বর্গধাম প্রাপ্ত হই।” এই ঋকে ঋষি মনে করিতেছেন যে, শুধু স্তব-স্তুতি, হোম-যজ্ঞ অর্থাৎ পুণ্যবলেই স্বর্গ লাভ করা যাইবে না, চাই। দেবতার দয়া।
ঐ বেদের নবম মণ্ডলের ত্রয়োদশশতাধিক শততম সূক্তের অষ্টম ঋকে বলা হইয়াছে, “সেই যে তৃতীয় নাগলোক, তৃতীয় দিব্যলোক, যাহা নভোমণ্ডলের উর্ধে আছে, যথায় ইচ্ছানুসারে বিচরণ করা যায়, যে স্থান সর্বদাই আলোকময়-তথায় আমাকে অমর কর।”
ঐ মণ্ডলের ষষ্ঠপঞ্চাশত সূক্তের তৃতীয় ও চতুর্থ ঋকে লিখিত আছে-“যেরূপ উত্তম স্তব করিয়াছিলে, তদ্রূপ উত্তম স্বর্গে যাও।” এই ঋকে দেখা যায় যে, পুণ্যের তারতম্যের জন্য উত্তম ও অধম, ভিন্ন ভিন্ন স্বর্গ আছে।
ঋষি এইখানে মনে করিতেছেন যে, স্বর্গরাজ্যটি আকাশমণ্ডলের ঊর্ধ্বভাগে অবস্থিত, সেখানে অবাধে চলাফেরা করা যায়, কোনো বাধার সম্মুখীন হইতে হয় না, ঐখানে দিন-রাত্রির বালাই নাই, উহা স্বতঃস্ফুর্ত আলোকে শোভিত। তাঁহার ঐখানে বাস করা যেন স্থায়ী হয়।
ঐ মণ্ডলের নবম ঋকে ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “যথায় সকল কামনা নিঃশেষে পূর্ণ হয়, যথায় প্রধু নামক দেবতার ধাম আছে, যথায় যথেষ্ট আহার ও তৃপ্তিলাভ হয়- তথায় আমাকে অমর কর।”
ঋষি এই ঋকে স্বর্গকে এইরূপ একটি দেশ কল্পনা করিতেছেন যে, সেখানে নৈরাশ্যের কোনো স্থান নাই এবং তৃপ্তিদায়ক প্রচুর খাদ্য পাওয়া যায়। ঋষি আশা করেন সেখানে অমর হইয়া থাকিতে।
ঐ মণ্ডলের দশম ঋকে ঋষি বলিতেছেন, “যথায় বিবিধ প্রকার আমোদ, আাদ, আনন্দ বিরাজ করিতেছে, যেখানে অভিলাষী ব্যক্তির তাবৎ কামনা পূর্ণ হয়, তথায় আমাকে অমর কর।” এই ঋকে ঋষি কল্পনা করিতেছেন যে, স্বর্গে নানাবিধ আমোদ-প্রমোদ, যথা- নাচ, গান, বাজনা ইত্যাদিও আছে এবং সেখানে নৈরাশ্যের স্থান নাই।
ঐ বেদের দশম মণ্ডলের ষোড়শ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে লিখিত আছে-মৃত ব্যক্তির অগ্নিসৎকার শেষ হইয়াছে; তাহার পর তাহার সম্বন্ধে বলা হইতেছে, “যখন ইনি সজীবত্বপ্রাপ্ত হইবেন, তখন দেবতাদিগের বশতাপন্ন হইবেন।” এই ঋকে বলা হইতেছে যে, মানুষ মৃত্যুর পর পুনঃ জীবিত হইবে এবং দেবগণের অধীন হইবে।
ঐ সূক্তের তৃতীয় ঋকে অগ্নি দেবতার আরাধনায় দমন ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “হে জাতবেদা ও বহ্নি! তোমার যে মঙ্গলময়ী মূর্তি আছে, তাহাদিগের দ্বারা এই মৃত ব্যক্তিদিগকে পুণ্যবান লোকদিগের ভবনে বহন করিয়া লইয়া যাও।”
ঋষি এইখানে চিতার আগুনকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, মৃত ব্যক্তিগণকে পুণ্যবান লোকদের ভবনে অর্থাৎ স্বর্গে লইয়া যাইতে। মনে করা হয় যে, স্বৰ্গদেশটি উদ্ধৃদিকে অর্থাৎ আকাশে অবস্থিত এবং চিতার আগুনও ঐ দিকেই যায়।
সুতরাং মৃত ব্যক্তিগণকে ঐখানে পৌঁছানো অগ্নির পক্ষে অসম্ভব নহে। কিন্তু অগ্নিদেবতা পৌঁছান একই জায়গায়-পাপী ও পুণ্যবানকে।
ঐ মণ্ডলের ষষ্ঠপঞ্চাশত সূক্তের তৃতীয় ও চতুর্থ ঋকে লিখিত আছে-“যেরূপ উত্তম স্তব করিয়াছিলে, তদ্রূপ উত্তম স্বর্গে যাও।” এই ঋকে দেখা যায় যে, পুণ্যের তারতম্যের জন্য উত্তম ও অধম, ভিন্ন ভিন্ন স্বর্গ আছে।
বৈদিক মতে এতক্ষণ যে সমস্ত বিষয় আলোচনা করা হইল, তাহাতে ইহাই বুঝা যায় যে, প্রলয়ান্তে পুনর্জীবন লাভ, পাপ-পুণ্যের বিচার, স্বর্গ ও নরক নামক পারলৌকিক রাজ্য, স্বর্গ-নরকের শ্রেণীবিভাগ ও সংখ্যা, শাস্তি বা পুরস্কারের বর্ণনা, স্বর্গপথে নদী পার হওয়া ইত্যাদি বিষয়সমূহ বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষি মুনিগণ প্রচার করিয়াছিলেন।
স্বর্গ ও নরক সম্বন্ধে বৈদিক শিক্ষার কিছু আলোচনা করা হইল। ইহা ভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে আরও অনেক মত দৃষ্ট হয়। তন্মধ্যে এইখানে আমরা আর একটি মতের পরিচয় প্রদান করিব। এই মতে জগত তিনটি। যথা-স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল। অর্থাৎ উর্ধলোক, মধ্যলোক ও অধোলোক। আমাদের এই পৃথিবীটিই মধ্যলোক বা মর্তলোক।
এইখান হইতে উর্ধদিকে উধূলোক বা স্বর্গ। উহা সাত ভাগে বিভক্ত। যথা-ভূলোক, ভূবলোক, স্বলোক, মহর্লোক, জনলোক, তপোলোক ও সত্যলোক। ইহাকে সপ্তস্বর্গ বলা হয়। মর্তলোকের নিম্নদিকে অধোলোক বা পাতাল। ইহাও সাত। ভাগে বিভক্ত। যথা-অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল ও পাতাল।
ইহাকে বলা হয় সপ্তনরক। এই সপ্তনরকের অন্য নামও আছে। যথা-অম্বরীষ, রৌরব, মহারৌরব, কালসূত্র, তামিশ্র, অন্ধতামিশ্র ও অবীচি। মানুষ পুণ্যের তারতম্যানুসারে ক্রমান্বয়ে উর্ধ হইতে উর্ধতন স্বর্গের অধিকারী হয় এবং পাপের তারতম্যানুসারে নিম্ন হইতে নিম্নতম নরকে নিপতিত হয়, ইহাই এই মতের সিদ্ধান্ত।
এই মতে, ত্রিজগত লয় হইবে না, লয় হইবে শুধু জীবকুল। তবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লয় ও পুনঃ সৃষ্টি হইবার মতও আছে।
হিন্দুশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, স্বর্গরাজ্যে যাইবার পথে বৈতরণী নামক একটি নদী পার হইতে হয়। ঐ নদীর জল অগ্নিবৎ গরম, রক্ত-মাংস ও হাড়গোড়ে পরিপূর্ণ, দুর্গন্ধময় এবং কুমিরে ভরা। ঐ নদী নিরাপদে পার হইবার আশায় হিন্দুগণ মৃত্যুর পূর্বে বা পরে গো-দান করিয়া থাকেন।
হিন্দুদের কোনো কোনো শাস্ত্রে পাপ ও পুণ্যকে তুলাদণ্ডে পরিমাপ করার বিষয় বর্ণিত আছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের পঞ্চসপ্ততিতম অধ্যায়ে মহর্ষি ভীষ্ম বলিতেছেন, “সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং একমাত্র সত্য তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হইয়াছিল, কিন্তু সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ হইতে সত্যই ভারি হইল।”
বৈদিক মতে এতক্ষণ যে সমস্ত বিষয় আলোচনা করা হইল, তাহাতে ইহাই বুঝা যায় যে, প্রলয়ান্তে পুনর্জীবন লাভ, পাপ-পুণ্যের বিচার, স্বর্গ ও নরক নামক পারলৌকিক রাজ্য, স্বর্গ-নরকের শ্রেণীবিভাগ ও সংখ্যা, শাস্তি বা পুরস্কারের বর্ণনা, স্বর্গপথে নদী পার হওয়া ইত্যাদি বিষয়সমূহ বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষি মুনিগণ প্রচার করিয়াছিলেন।
মিশরীয় মত
ভারতীয়, মিশরীয় ও ইরানীয় স্বর্গ-নরকের বর্ণনা একরূপ নহে। উহা ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও রুচির পরিচায়ক। ভারতীয় স্বর্গের বর্ণনায় পাওয়া যায় নন্দন কানন, পারিজাত বৃক্ষ, সুরভী গাভী, ঐবারত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও অপ্সরা-কিন্নরী ইত্যাদি; এবং মিশরীয় স্বর্গে নাকি কৃষিকাজের ব্যবস্থাও থাকিবে।
বহুযুগ ধরিয়া প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস বা সমাধিগাত্রে মৃতের জীবন বিষয়ে যে সকল কথা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারই সঙ্কলন আমদুয়াত গ্রন্থ, ফটকের গ্রন্থ ও মৃতের গ্রন্থ। মৃতের গ্রন্থের মতে, প্রত্যেক মৃতকে পরমেশ্বরের কাছে একটি সত্যপাঠ (Affidavit) দিতে হয়।
সত্যপাঠটি এইরূপ- “হে পরম ঈশ্বর, সত্যের ও ন্যায়ের প্রভু! তোমাকে প্রণাম। হে প্রভু! আমি তোমায় কাছে সত্যকে বহন করিয়া আসিয়াছি। আমি কোনো ব্যক্তির প্রতি অবিচার, দরিদ্রের উপর অত্যাচার, কর্তব্যকর্মে ত্রুটি ও দেবতার অনভিপ্রেত কোনো কাজ করি নাই এবং স্বাধীন মানুষকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক কোনো কাজ করাই নাই … আমি পবিত্র, আমি পবিত্র।”
এই সত্যপাঠটিতে প্রাচীন মিশরে প্রজার উপর রাজার, দরিদ্রের উপর ধনীর এবং গোলামের উপর মনিবের অবিচার, অত্যাচার ও জুলুমের ইঙ্গিত পাওয়া যায় (সেকালে বহু দেশেই দাসপ্রথা ছিল, কিন্তু মিশরের দাসেরা ছিল অতি উৎপীড়িত)।
ঐ গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায়ে লিখিত আছে, “এই মৃত ব্যক্তি নিম্নতম স্বর্গে দেবগণের অন্তর্ভুক্ত হইবেন। দেবগণ কখনোই ইহাকে পরিত্যাগ করিবেন না। কারণ ইহার আত্মা মুক্তির পথে অগ্রসর হইয়াছে। নরককীটে ইঁহাকে আর ভক্ষণ করিবে না।”
ঐ সত্যপাঠ সত্য, কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করেন জ্ঞানের দেবতা থৎ এবং হোরাস। মৃতের হৃৎপিণ্ড দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয়, একটি পাল্লায় ন্যায়ের প্রতীককে রাখিয়া। অতঃপর ন্যায় ও অন্যায়ের পরিমাণানুসারে মৃতকে শান্তি বা শাস্তি দেওয়া হয়
(পাপ-পুণ্য পরিমাপের জন্য দাঁড়িপাল্লার ব্যবহারের বিবরণ হিন্দুশাস্ত্রেও আছে। তবে ইহা বলা যায় না যে, এই মতটির প্রথম প্রচারক আর্য ঋষিরা, না মিশরীয়রা)।
মৃতের গ্রন্থে শাস্তি বা পুরস্কারের বর্ণনা বেশি নাই। শাস্তির বিষয়ে এই মাত্র বলা হইয়াছে যে, দুষ্কৃতকারীকে কোনো ভক্ষকের কাছে দেওয়া হয়, তাহাকে ধ্বংস করার জন্য।
ফটকের গ্রন্থে বিচারদিন সম্পর্কে বর্ণনা এইরূপ- পরলোকে নানা ফটকের মধ্য দিয়া বিচার কামরায় ঢুকিতে হয়। এই বিচার কামরার সংলগ্ন দুইটি দ্বার দিয়া স্বর্গ ও নরককুণ্ডে প্রবেশ করা যায়। পুণ্যাত্মাগণ আলু নামক স্বর্গধামে যাইয়া মনের আনন্দে শস্যক্ষেত্র চাষ করে,
আর পাপাত্মাদের নরককুণ্ডে পাঠাইয়া খুঁটির সঙ্গে বাধিয়া রাখা হয়-জ্বলন্ত আগুনে অথবা গভীর সমুদ্রে তাহাদের নিক্ষেপ করা হইবে বলিয়া (ইহা মিশরীয় গোলামের প্রতি মনিবের নির্মম অত্যাচারের প্রতীক)।
মৃতের গ্রন্থখানা বুক অব দি ডেড নামে ইংরাজিতে অনুদিত হইয়াছে। সেই গ্রন্থের সপ্তদশ, একবিংশ ও ষড়বিংশ অধ্যায়ত্রয়ে মৃত ব্যক্তির স্বর্গাদিলাভ সম্বন্ধে যাহা লিখিত আছে, তাহার কিয়দংশের মর্ম এইরূপ- মৃত্যুর পর পবিত্র আত্মা ঈশ্বরের অনুচরবর্গকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন,
“হে ঈশ্বরের পারিষদগণ! তোমাদের বাহু প্রসারিত করিয়া আমাকে গ্রহণ কর, আমি যেন তোমাদের মধ্যে স্থান লাভ করি। হে জ্যোতিঃস্বরূপ ওসিরিস! সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে আপনার প্রতাপ অক্ষুণ্ণ। আমি করজোড়ে আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি।
আপনার পবিত্র আত্মায় আমাকে আশ্রয় দান করুন। আমায় স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিন। মামফিসে আমার প্রতি যেরূপ আদেশ হইয়াছিল, আমি সেই আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি। আমার হৃদয়ে এখন জ্ঞানসঞ্চার হইয়াছে …।”
ঐ গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায়ে লিখিত আছে, “এই মৃত ব্যক্তি নিম্নতম স্বর্গে দেবগণের অন্তর্ভুক্ত হইবেন। দেবগণ কখনোই ইহাকে পরিত্যাগ করিবেন না। কারণ ইহার আত্মা মুক্তির পথে অগ্রসর হইয়াছে। নরককীটে ইঁহাকে আর ভক্ষণ করিবে না।”
উপরোক্ত উদ্ধৃত অংশ পাঠ করিলে মিশরীয় স্বর্গ-নরকের স্বরূপ বুঝা যায়। অধিকন্তু উহাতে উচ্চ-নীচ স্বর্গের আভাস পাওয়া যায়। মিশরীয়গণ বিশ্বাস করিতেন যে, যুগ বিবর্তনান্তে তিন সহস্র বৎসর হইতে দশ সহস্র বৎসর পরে মৃত ব্যক্তির আত্মা দেশে ফিরিয়া আসিবে। এই বিশ্বাসের ফলেই মিশরে মৃতদেহ রক্ষার প্রথা প্রবর্তিত হয়।
ইরানীয় মত
মৃত্যুর পর দণ্ড ও পুরস্কার আছে- ইরানীয়গণ ইহা বিশ্বাস করেন। মৃত্যুর পর মানুষ কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তৎসম্বন্ধে জেন্দ-আভেস্তার ভেন্দিদাদ অংশে ও বুন্দেহেশ গ্রন্থে এইরূপ বর্ণনা আছে, “মৃত্যুর পর মানবদেহ দানবে অধিকার করে। তখন আত্মা অজ্ঞানান্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকে।
তৃতীয় দিবসে আত্মার জ্ঞানসঞ্চার হয়। সেই রাত্রে আত্মাকে ভীষণ চিনাভাদ নামক পুল পার হইতে হয়। যে ব্যক্তি জীবিতকালে পাপকর্ম করিয়াছে, সেতু পার হইবার সময় সে নরকার্ণবে নিপতিত হয়, আর যে ব্যক্তি চিরজীবন ধর্মানুষ্ঠানে ও সৎকাজে অতিবাহিত করিয়াছেন, সে ব্যক্তি অনায়াসে সেতু উত্তীর্ণ হইতে পারেন।
যাজঙ্গণ (এক শ্রেণীর স্বর্গদূত) সৎকর্মকারীগণকে সঙ্গে করিয়া চিরশান্তিময় স্থানে (স্বর্গে) লইয়া যান। সেখানে তাহারা অহুর মজদার সহিত মিলিত হন ও স্বর্ণসিংহাসনে সমাসীন হইয়া হুরান-ই বেহিস্ত নাম্নী পরীগণের সহবাসে সর্বপ্রকার আনন্দ উপভোগ করিতে থাকেন।”
ইহার পর বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থানে বন্ধু-বান্ধব। এবং আত্মীয়-স্বজন পুনরায় মিলিত হইতে পারিবে। সেই আনন্দের সম্মিলন সংঘটিত হইলে সৎ ও অসতের মধ্যে পার্থক্য ঘটিবে। যাহারা অধর্মচারী, তাহারা ভীষণ যন্ত্রণা ভোগ করিবে ইত্যাদি।
জেন্দ-আভেস্তায় স্বর্গ-নরকের শ্রেণীবিভাগ নাই। ইরানীয়দের স্বর্গের নাম গারো-ডে মান। পারস্যভাষায় উহা গাবাৎ মান নামে অভিহিত।
যে সমস্ত পাপী সেতু পার হইতে পারে না, তাহারা দুখ নামক দুঃখার্ণবে নিপতিত হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। তথায় দেবগণ (হিন্দুমতে দৈত্য) তাহাদিগকে অশেষ যন্ত্রণা প্রদান করেন। কোন্ পাপাচারী কতদিন দুঃখার্ণবে কিরূপভাবে যন্ত্রণা ভোগ করিবে, অহুর মজদা তাহা নির্দেশ করিয়া দেন।
উপাসনা দ্বারা এবং বন্ধু-বান্ধবের মধ্যস্থতায় কাহারও কাহারও দুঃখভোগের কাল হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়া থাকে।
ইরানীয়দের মতে, সৃষ্টির অবসানে পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলে সওসন্ত নামক একজন অবতারের আবির্ভাব হইবে। তিনি অত্যাচার-অবিচার হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করিবেন। তখন সেই নূতন। পৃথিবীতে অনন্ত সুখের রাজ্য সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হইবে।
ইহার পর বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থানে বন্ধু-বান্ধব। এবং আত্মীয়-স্বজন পুনরায় মিলিত হইতে পারিবে। সেই আনন্দের সম্মিলন সংঘটিত হইলে সৎ ও অসতের মধ্যে পার্থক্য ঘটিবে। যাহারা অধর্মচারী, তাহারা ভীষণ যন্ত্রণা ভোগ করিবে ইত্যাদি।
ইহুদিদের মত
ইহুদিদিগের জুডাইজম ধর্মমতে মৃত্যুর পর বিচারের একটি শেষদিন নির্দিষ্ট আছে। সেই দিন মৃত ব্যক্তিগণের বা তাহাদের আত্মার পুনর্যুত্থান ঘটিবে। সেই দিন পাপ-পুণ্যের বিচার হইবে। কে পাপী, কে পুণ্যবান-নির্দিষ্ট একটি সেতু পার হইবার সময়েই তাহা স্থির হইয়া যাইবে (ইরানীয় মত গৃহীত)।
ইহুদিগণের ধর্মগ্রন্থে পরীক্ষার দিনের বিষয়টি যেমন আছে, তেমন আছে তুলাদণ্ডে পাপ-পুণ্যের বিচারের কথা, মেশিয়া অর্থাৎ অবতারের আবির্ভাবের কথা এবং পরিশেষে চিরশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গও। ইহুদিগণের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রকাশ-“সূত্রবৎ সূক্ষ্ম সেতুর উপর।
দিয়া মনুষ্যকে শেষদিনে গমন করিতে হইবে। নিম্নে ভীষণ নরক, পাপাত্মাগণ সেই সেতু হইতে নরকার্ণবে নিপতিত হইবে।” তাহাদের ধর্মগ্রন্থমতে, মানুষের পাপ-পুণ্য দুইখানি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে। শেষ বিচারের দিনে সেই দুইখানি গ্রন্থ তুলাদণ্ডের দুই দিকে রাখিয়া প্রতি জনের পাপ ও পুণ্যের পরিমাপ করা হইবে।
সেই পরিমাপে পাপের ভার গুরু হইলে, পাপাত্মা নরকযন্ত্রণা ভোগ করিবে; আর পুণ্যের ভাগ বেশি হইলে, পুণ্যাত্মা স্বর্গ লাভ করিবে।
ইহুদিদিগের স্বর্গের নাম ইডেন। ঐ স্বর্গ বহুমূল্য প্রস্তরে গঠিত। স্বর্গের তিনটি দ্বার। সেখানে চারিটি নদী প্রবহমানা- তাহার একটিতে দুগ্ধ, একটিতে মধু, একটিতে মদ্য এবং একটিতে সুগন্ধি নির্যাস।
স্বৰ্গকে ইহুদিগণ অতি উৎকৃষ্ট উদ্যানরূপে বর্ণনা করিয়া থাকেন। সেই উদ্যান বহু সুমিষ্ট ফলে এবং সুগন্ধ-সুদৃশ্য ফুলে পরিপূর্ণ। সেই উদ্যান হইতে পুণ্যবানগণ ক্রমশ উচ্চ হইতে উচ্চতর স্থানের অধিকার লাভ করেন (ইহা বৈদিক সপ্তস্বর্গের অনুকরণ)।
ইহুদিদিগের ধর্মগ্রন্থ ইশিয়া, এজিকিল, ডেনিয়েল ও যব প্রভৃতিতে পুনরুত্থানের বিষয় বর্ণিত আছে। ঐ সকল গ্রন্থের কোনো কোনো স্থলে লিখিত আছে, শুষ্ক অস্থিখণ্ড পুনর্জীবিত হইয়া আপন কর্মাকর্মের ফল ভোগ করিবে; কোনো কোনো স্থানে দেখা যায়, যাহারা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ধূলিরাশির মধ্যে নিদ্রিত হইয়া আছে, তাহারা জাগরিত হইবে।
তৌরিতে লিখিত নদী চারিটি ঐ অঞ্চল হইতেই উৎপন্ন হইয়া, পীশোন ও গীহোন নামক নদীদ্বয় কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদেকল ও ফরাৎ নামক নদীদ্বয় একত্র হইয়া পারস্য উপসাগরে পতিত হইয়াছে। ঐ ইডেন উদ্যানে বাস করাকেই বলা হয় আদমের স্বর্গবাস।
যব গ্রন্থে প্রকাশ, যেমন শরীর ছিল, সেই শরীরেই অভ্যুত্থান ঘটিবে। ইহুদিগণ বলেন, নরদেহ কবরিত হইলে, দেহের অন্যান্য অংশ ধূলায় পরিণত হয় বটে, কিন্তু লুজ নামক অস্থি বরাবর অবিকৃত থাকে।
বিচারের পূর্বে পুনরুত্থানের সময়ে পৃথিবীতে ভয়ানক শিশিরপাত হইবে। সেই নীহারে সিক্ত হইয়া পূর্বোক্ত অস্থি অঙ্কুরিত অর্থাৎ নরদেহপ্রাপ্ত হইবে।
সুধী পাঠকবৃন্দের স্মরণ থাকিতে পারে যে, পবিত্র বাইবেলের আদিমানব আদমকে সৃষ্টি করিয়া তাহার বসবাসের জন্য ইডেন নামক স্বর্গে ঈশ্বর স্থান দিয়াছিলেন। ঐ স্বর্গটি কোথায় অবস্থিত, তাহার বিশেষ বিবরণ আছে তৌরিত গ্রন্থে।
বিবরণটি এইরূপ- “আর সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বদিকে এদনে (ইডেনে) এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর ভূমি হইতে সর্বজাতীয় সুদৃশ্য ও সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ এবং সেই উদ্যানের মধ্যস্থানে জীবনবৃক্ষ ও সদসদজ্ঞানদায়ক বৃক্ষ উৎপন্ন করিলেন।
আর উদ্যানে জল সেচনার্থে এদন হইতে এক নদী নির্গত হইল। উহা তথা হইতে বিভিন্ন হইয়া চতুর্মুখ হইল। প্রথম নদীর নাম পীশোন, ইহা সমস্ত হবিলাদেশ বেষ্টন করে। তথায় স্বর্ণ পাওয়া যায় আর সেই দেশের স্বর্ণ উত্তম; এবং সেই স্থানে গুগগুলু ও গোমেদক মণি জন্মে।
দ্বিতীয় নদীর নাম গীহোন, ইহা সমস্ত কুশদেশ বেষ্টন করে। তৃতীয় নদীর নাম হিদ্দেকল, ইহা অনূরিয়া দেশের মধ্য দিয়া প্রবাহিত। চতুর্থ নদী ফরাৎ। (আদিপুস্তক ২; ৮-১৪)
উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, পীশোন, গীহোন, হিকেল ও ফরাং এই নদী চারিটির উৎপত্তির এলাকার মধ্যে ঐ সময় ইডেন নামে একটি জায়গা ছিল। ইডেন জায়গাটি বোধ হয় বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বভাগে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
তৌরিতে লিখিত নদী চারিটি ঐ অঞ্চল হইতেই উৎপন্ন হইয়া, পীশোন ও গীহোন নামক নদীদ্বয় কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদেকল ও ফরাৎ নামক নদীদ্বয় একত্র হইয়া পারস্য উপসাগরে পতিত হইয়াছে। ঐ ইডেন উদ্যানে বাস করাকেই বলা হয় আদমের স্বর্গবাস।
আবার প্রলয়ান্তে বিচারের পর যে স্বর্গের বিবরণ পাওয়া যায় এবং তাহাতে যে দুধ, মধু, মদ ও সুগন্ধি নির্যাসে পূর্ণ নদীচতুষ্টয়ের উল্লেখ দেখা যায়, বোধ হয় যে, তাহা পূর্বোক্ত স্বৰ্গই।
খ্রীস্টানদের মত
খ্রস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের (নিউ টেস্টামেন্টের) ম্যাথু, লুক, রিভিলেশন, কোরিন্থিয়ানস ও রোমানস্ প্রভৃতি অংশে পুনরুত্থানের বিষয় বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে। তাহাতে প্রকাশ-আপন পাপকর্ম দ্বারাই মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সকল মানুষই অধিক পাপে রত।
সুতরাং সকলেই মৃত্যুর অধীন। মৃত্যুর পর আত্মা দেহ হইতে বিকারপ্রাপ্ত ও ধূলায় পরিণত হয়। মৃত ব্যক্তিদিগের মধ্যে যাহারা পুণ্যবান, দেহত্যাগের পরেই তাহাদের আত্মা স্বর্গে গমন করে। পাপীর আত্মা শেষ বিচারের দণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয়। শেষে একদিন তাহাদের বিচার হইরে।
পুণ্যবানদিগকে অত্যুজ্জ্বল আলোকমালায় শোভিত প্রাসাদে লইয়া যাওয়া হইবে। সেখানে তাহারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আহারাদি প্রাপ্ত হইবেন এবং সর্বসুখে সুখী থাকিবেন। তাহাদের সেই আনন্দোৎসবে তাহাদের পূর্বপুরুষগণ, অবতারগণ এবং স্বয়ং যীশুখ্রীস্ট তাহাদের সহিত যোগদান করিবেন ইত্যাদি।
সেই দিন পবিত্র আত্মা যীশু খ্রীস্ট স্বর্গ হইতে মর্ত্যে অবতরণ করিবেন। স্বর্গীয় বেশে সুসজ্জিত এবং স্বর্গীয় দূত ও প্রিয় পারিষদসমূহে পরিবৃত হইয়া সেইদিন তিনি বিচারাসনে উপবিষ্ট হইবেন। মৃত ব্যক্তিগণ সেইদিন কবর হইতে উত্থিত হইবে এবং বিচারপতি প্রভু (যীশু) তাহাদের বিচার করিবেন।
পাপাত্মাগণের প্রতি দণ্ডাদেশ প্রদত্ত হইবে। স্বর্গীয় দূতগণ পাপীগণকে দণ্ডদানে প্রস্তুত হইবেন। পাপীদিগকে চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হইবে, তাহারা যন্ত্রণায় ছটফট করিতে থাকিবে। সেই বিচারে অতি অল্প ব্যক্তিই পুণ্যবান বলিয়া নির্দিষ্ট হইবেন।
পুণ্যবানদিগকে অত্যুজ্জ্বল আলোকমালায় শোভিত প্রাসাদে লইয়া যাওয়া হইবে। সেখানে তাহারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আহারাদি প্রাপ্ত হইবেন এবং সর্বসুখে সুখী থাকিবেন। তাহাদের সেই আনন্দোৎসবে তাহাদের পূর্বপুরুষগণ, অবতারগণ এবং স্বয়ং যীশুখ্রীস্ট তাহাদের সহিত যোগদান করিবেন ইত্যাদি।
এই মতে বিচারকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর নহেন, যীশু।
আলোচ্য পুস্তকসমূহে প্রলয়ান্তে পুনরুত্থান সম্বন্ধে যে সকল বিষয় লিপিবদ্ধ আছে, তাহার মর্মমাত্র এই স্থলে প্রদত্ত হইল।
মুসলমানদের মত
ইসলামীয় মতে, প্রলয়ের (কেয়ামতের) চল্লিশ বৎসর (মতান্তরে চল্লিশ দিন) পরে এস্রাফিল ফেরেশতা দ্বিতীয়বার শিঙ্গা বাজাইবেন এবং পুনঃ জগত সৃষ্ট হইবে, হয়তোবা নূতন রূপে। পুনঃ সৃষ্টির পর একদিন মৃতের পুনরুত্থান হইবে। সেই দিন সকলেই আপন আপন পাপ-পুণ্যের ফল ভোগ করিবেন।
কোনো মতে, বিচারের দিনে একমাত্র আত্মাই বিচারের জন্য উপস্থিত হইবে। কিন্তু সাধারণ বিশ্বাস এই যে, সেইদিন দেহ ও আত্মা পূর্বাকারপ্রাপ্ত হইয়া বিচারপতির নিকট উপনীত হইবে। কেননা বলা হইয়া থাকে যে, বিচারক্ষেত্রে (হাশর ময়দানে) পাপীগণের হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি পাপকর্মের সাক্ষ্য প্রদান করিবে।
দোজখের শাস্তির বর্ণনায় বলা হইয়া থাকে যে, পাপীদিগকে পুঁজ-রক্ত ইত্যাদি খাইতে দেওয়া হইবে, অগ্নির উত্তাপে মস্তিষ্ক বিগলিত হইবে, যেই ব্যক্তি পরস্ত্রী দর্শন করিয়াছে, সঁড়াশীর সাহায্যে তাহার চক্ষু উৎপাটন করা হইবে এবং স্বর্গের সুখের বর্ণনায় বলা হইয়া থাকে যে,
পুণ্যবানগণ নানাবিধ সুমিষ্ট ফল আহার করিবেন, নেশাহীন মদিরা পান করিবেন, হুরীসহবাস লাভ করিবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত বর্ণনায় ও অন্যান্য ঘটনার বিবরণে পরজগতে দেহের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হইয়া থাকে।
যে দেহ ধূলায় মিশিয়া যায়, তাহার পুনরুত্থান কিরূপে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হইয়া থাকে যে, সকল শরীর বিলয়প্রাপ্ত হইলেও আল-আজব (মানুষের মেরুদণ্ডের নিম্নভাগের একখানা হাড়) কখনও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। উহ বীজম্বরূপ বিদ্যমান থাকে।
পুনরুত্থানের সময়ে অন্যান্য অংশ আপনিই আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হইবে। বিচারদিনের পূর্বে চল্লিশ দিন ব্যাপী ভীষণ বৃষ্টিপাত হইবে। সেই বৃষ্টির জলে মেরুদণ্ডের অস্থি সিক্ত হইয়া তাহা হইতে অঙ্কুরোদগমের ন্যায় নরদেহ উদগত হইবে।
অতঃপর এসাফিল ফেরেশতা তৃতীয়বার শিঙ্গা ফুঁকিলে শিঙ্গায় রক্ষিত আত্মসমূহ মক্ষিকার ন্যায় ইতস্তত উড়িয়া গিয়া আপন আপন দেহে প্রবেশ করিবে ও মানুষ সজীব হইবে। সমস্ত মানবকুলের মধ্যে এইরূপ সর্বপ্রথম জীবন লাভ করিবেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)।
পুনরুত্থানের সময় মনুষ্য, জ্বীন, ফেরেশতা ও অন্যান্য জীবজন্তু সকলেই পুনর্জীবিত হইবে এবং মানুষ ও জ্বীনগণের বিচার হইবে। কিন্তু ইতর জীবের বিচার হইবে কি না, সেই বিষয়ে মতভেদ আছে।
বিচারক্ষেত্রে তুলাদণ্ড থাকিবে। যে পুস্তকে পাপ-পুণ্যের কথা লিখিত হইতেছে, সেই পুস্তক তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হইবে। যাহার পাপের ভাগ বেশি, সে দণ্ড ভোগ করিবে এবং যাহার পুণ্যের ভাগ বেশি, সে রক্ষা পাইবে। বিচারের পর পুণ্যবানগণ স্বর্গের দিকে দক্ষিণ পথে এবং পাপীগণ নরকের দিকে বাম পথে যাইবে।
মনুষ্যদিগকে কোন্ রূপে বিচারপতির নিকট উপস্থিত করা হইবে, সেই বিষয়েও দ্বিমত দেখা যায়। এক মতে প্রকাশ, মাতৃগর্ভ হইতে যে অবস্থায় তাহারা ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল (নগ্নদেহে), সেই অবস্থায় তাহারা বিচারপতির নিকট উপস্থিত হইবে।
অন্য মতে, যে ব্যক্তি যেরূপ বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল (বিধর্মীদের পোষাকের অনুকরণ করিয়া থাকিলে), সেইরূপ বেশভূষাতেই সে পুনরুত্থিত হইয়া বিচারার্থ প্রস্তুত থাকিবে।
কথিত হয় যে, বিচারের দিনে নানা শ্রেণীর লোক নানা অবস্থায়, কেহ ঘোড়া বা উটে চড়িয়া, কেহ হাঁটিয়া, কেহবা মাটিতে মুখ ঘষিতে ঘষিতে বিচারপতির সম্মুখে উপস্থিত হইবে।
আল্লাহ্ কোথায় বসিয়া বিচার করিবেন, সেই বিষয়ে নানা মত দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ বলেন যে, হজরত বলিয়া গিয়াছেন, “সিরিয়া প্রদেশে বিচারক্ষেত্র নির্দিষ্ট আছে।” কেহ বলেন, এক শ্বেত সমতল ক্ষেত্রে বিচার হইবে, সেখানে অট্টালিকা বা মনুষ্যাদির কোনো চিহ্ন নাই।
অন্য মতে, সেই পৃথিবীর সহিত এই পৃথিবীর কোনো সম্বন্ধ নাই, সে এক নূতন পৃথিবী।
মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন যে, প্রত্যেক মানুষের পাপ-পুণ্যের পরিচয়পূর্ণ একখানি পুস্তক লিখিত থাকে। পরীক্ষার দিনে সেই পুস্তক বিচারার্থীগণের হস্তে প্রদান করা হইবে। পুণ্যবান ব্যক্তিগণ ডান হস্তে সেই পুস্তক গ্রহণ করিয়া আনন্দের সহিত পাঠ করিবেন।
পাপীগণের বাম হস্ত পিঠের সহিত এবং ডান হস্ত গলার সহিত বাঁধা থাকিবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহাদের বাম হস্তে বলপূর্বক সেই পুস্তক দেওয়া হইবে।
বিচারক্ষেত্রে তুলাদণ্ড থাকিবে। যে পুস্তকে পাপ-পুণ্যের কথা লিখিত হইতেছে, সেই পুস্তক তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হইবে। যাহার পাপের ভাগ বেশি, সে দণ্ড ভোগ করিবে এবং যাহার পুণ্যের ভাগ বেশি, সে রক্ষা পাইবে। বিচারের পর পুণ্যবানগণ স্বর্গের দিকে দক্ষিণ পথে এবং পাপীগণ নরকের দিকে বাম পথে যাইবে।
পাপী-পুণ্যবান সকলকেই আল সিরাত নামক একটি সেতু পার হইতে হইবে। সেই সেতু চুলের অপেক্ষা সূক্ষ্ম এবং তরবারির অপেক্ষা তীক্ষ্ণ ধারসম্পন্ন। নিম্নে ভীষণ অগ্নিময় নরককুণ্ড এবং উপরে ক্ষুরধার সূক্ষ্ম সেতু বিরাজমান।
সকল সুখের সারভূত সেখানকার হুরীগণ। অপরূপ রূপ-লাবণ্য সম্পন্ন হুরীগণ স্বর্গবাসীদিগের মনোরঞ্জনের জন্য নিযুক্ত রহিয়াছে। তাহাদের সুবৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ চক্ষু। তজ্জন্য তাহারা হুর-অল-ঐন নামে পরিচিত। মর্ত্যের রমণীগণ মৃত্তিকায় নির্মিত, কিন্তু সেই সুন্দরীবগণ মৃগনাভি দ্বারা গঠিত হইয়াছে।
পুণ্যবানগণ অনায়াসে নিমেষমধ্যে সেতু পার হইয়া স্বর্গে গমন করিবেন এবং পাপীগণ পার হইবার সময়ে নরকার্ণবে পতিত হইবে।
মুসলমানদের মতে, নরকের সাতটি ভাগ এবং স্বর্গের আটটি। সাতটি নরকের (দোজখের) নাম-জাহান্নাম, লাধা, হোতামা, আল-সৈর, সাকা, আল-জাহিম ও আল-হায়াইত (হাবিয়া)। ভিন্ন ভিন্ন ধরণের পাপীগণ ভিন্ন ভিন্ন নরকে নিক্ষিপ্ত হইবে।
সর্বোচ্চ পাপীর জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্নস্থ নরক হাবিয়া। নরকের প্রতি প্রকোষ্ঠে ঊনিশ জন করিয়া প্রহরী (ফেরেশতা) আছে, প্রধান প্রহরীর নাম মালেক।
আটটি স্বর্গের (বেহেশতের) নাম- লদ, দারুস সালাম, দারুল করার, উদন, আল মাওয়া, জান্নাতুল নঈম, জান্নাতুল ইলিন ও জান্নাতুল ফেরদাউস। স্বর্গের প্রধান প্রহরীর নাম। রেজওয়ান। স্বর্গের সর্বোচ্চ স্তরের উধৃভাগে আল্লাহর আসন অবস্থিত। উহারই নিম্নভাগে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্বর্গ ফেরদাউস।
সেখানে সুখের অন্ত নাই। মনোহর উদ্যান, উৎস, নদী প্রভৃতি সেখানে বিরাজমান। সেখানকার নদীর কোনোটিতে পরিশ্রুত জল, কোনোটিতে দুগ্ধ, কোনোটিতে মধু, কোনোটিতে সুগন্ধী নির্যাস বহিয়া যাইতেছে। সেখানকার প্রস্তরসমূহ মুক্তা, প্রবাল ও মরকতময়।
সেখানকার অট্টালিকাসমূহ স্বর্ণে বা রৌপ্যে নির্মিত। সেখানকার বৃক্ষের কাণ্ডসমূহ সুবর্ণময়।
ঐ স্বর্গে তুবা নামক একটি বৃক্ষ আছে। ঐ বৃক্ষটি সর্বসুখের আধার। স্বর্গবাসী সকলের ভবনেই সেই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। যিনি যেই ফলের আশা করিবেন, ঐ বৃক্ষে তিনি সেই ফলই প্রাপ্ত হইবেন।
স্বর্গে আল-কাওসার নামে একটি নদী প্রবাহিত আছে, সেরূপ সুগন্ধ ও সুস্বাদু জলে পূর্ণ নদী দ্বিতীয়টি নাই। একবার তাহার জল পান করিলে আর কখনও তৃষ্ণা পায় না।
সকল সুখের সারভূত সেখানকার হুরীগণ। অপরূপ রূপ-লাবণ্য সম্পন্ন হুরীগণ স্বর্গবাসীদিগের মনোরঞ্জনের জন্য নিযুক্ত রহিয়াছে। তাহাদের সুবৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ চক্ষু। তজ্জন্য তাহারা হুর-অল-ঐন নামে পরিচিত। মর্ত্যের রমণীগণ মৃত্তিকায় নির্মিত, কিন্তু সেই সুন্দরীবগণ মৃগনাভি দ্বারা গঠিত হইয়াছে।
চৈনিক মত
কর্মানুসারে স্বর্গ-নরক লাভের এবং আত্মার অবিনশ্বরত্বের বিষয় চীনাগণও বিশ্বাস করেন। স্বর্গগত পিতৃ-পিতামহের উদ্দেশ্যে অভিবাদন চীন দেশে আবহমান কাল প্রচলিত আছে। পরলোক সম্বন্ধে চীন দেশে যে মত প্রচলিত আছে, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার তাঁহার ‘প্রাচ্যদেশের পবিত্র গ্রন্থসমূহ’ নামক গ্রন্থের অংশবিশেষে উহার একটি পরিচয় প্রদান করিয়াছেন।
খ্রী. পূ. ১৪০১ হইতে ১৩৭৪ অব্দের মধ্যে চীন দেশে পান করং নামক একজন রাজা ছিলেন। তিনি আপনার প্রজাদিগকে যে উপদেশ দেন, উপরোক্ত গ্রন্থে ম্যাক্সমূলার তাহা প্রকাশ করিয়াছেন। রাজার উপদেশের মর্ম এই-
“হে প্রজাবর্গ! তোমাদিগের প্রতিপালন ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনই আমার উদ্দেশ্য। আমার পূর্বপুরুষগণ এক্ষণে আধ্যাত্মরাজ্যের অধীশ্বর। এখন কেবল তাহাদের কথাই আমার স্মৃতিপটে উদিত হইতেছে। আমার রাজ্যশাসনে যদি কোনোরূপ ভ্রম-প্রমাদ, ঘটে, এবং আমি যদি অধিককাল মর্তলোকে বাস করি, আমার এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা সেই স্বর্গীয় নৃপতিগণ আমার দণ্ডবিধান করিবেন।
জনৈক শিষ্য কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইলে, তদুত্তরে কনফুসিয়াস বলিয়াছিলেন, “বর্তমান জীবনের বিষয়ই আমরা অবগত নহি, মৃত্যুর পরে কি হইবে, কে বলিতে পারে?” এতদুক্তিতে কনফুসিয়াস প্রলয়ান্তে পুনঃ সৃষ্টি বা পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না।
আমি প্রজাদিগের প্রতি যদি কোনোরূপ অত্যাচার করি, তাহারা আমার দণ্ডবিধান করিয়া বলিবেন, “আমার প্রজাদিগের প্রতি কেন তুমি অত্যাচার করিয়াছ?” যেমন আমার সম্বন্ধে, তেমন তোমাদের সম্বন্ধে সেই স্বর্গীয় পিতৃপুরুষগণ দৃষ্টি রাখিয়াছেন।
হে আমার অসংখ্য প্রজাপুঞ্জ! তোমরা যদি আমার সহিত একমত না হও, সকলে একমত হইয়া আমার মতের অনুসরণ না কর, তোমাদের জীবন চিরস্মরণীয় করিবার চেষ্টা না কর- আমার সেই স্বর্গীয় পিতৃপুরুষগণ তোমাদের সেই অপরাধের জন্য তোমাদের প্রতি কঠোর দণ্ডের বিধান করিবেন।
তোমাদিগকেও আহ্বান করিয়া বলিবেন, কেন তোমরা আমাদের বংশধরের মতানুবর্তী হইতেছ না? জানিও, ইহাতে তোমাদের সকল পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। রোষপরবশ হইয়া পিতৃপুরুষগণ যখন তোমাদিগের দণ্ডবিধান করিবেন, তখন তোমরা কোনোমতে রক্ষা পাইবে না।
তোমাদেরও পিতৃ-পিতামহ পূর্বপুরুষগণ তখন তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন। তাহারা মৃত্যুযন্ত্রণা হইতে কদাচ তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন না।”
উপরোক্ত বিবরণে বুঝা যায় যে, স্বর্গে পিতৃপুরুষগণ বাস করেন এবং সেইখানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাঁহারাই। সৎকর্মে মৃত্যুযন্ত্রণার ভয় থাকে না, অপকর্মে মৃত্যুযন্ত্রণার আশঙ্কা আছে ইত্যাদি।
সু-কিং নামক গ্রন্থখানা চীনদেশের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাচীন গ্রন্থ বলিয়া পরিচিত। কনফুসিয়াস ঐ গ্রন্থ সকলন করিয়া যান। মৃত্যুর পর মানুষ কি অবস্থাপ্রাপ্ত হয়, ঐ গ্রন্থের নানা স্থানে তাহার উল্লেখ আছে। তবে কনফুসিয়াস মৃত্যুর পরবর্তীকালের অবস্থার বিষয়ে যে কিছু বলিয়া গিয়াছেন, এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না।
জনৈক শিষ্য কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইলে, তদুত্তরে কনফুসিয়াস বলিয়াছিলেন, “বর্তমান জীবনের বিষয়ই আমরা অবগত নহি, মৃত্যুর পরে কি হইবে, কে বলিতে পারে?” এতদুক্তিতে কনফুসিয়াস প্রলয়ান্তে পুনঃ সৃষ্টি বা পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না।
তিনি মৃত্যু স্বীকার করিতেন না। তাহার দর্শনানুসারে দেহাংশ পঞ্চভূত, পঞ্চভূতে মিশিয়া যাইবে এবং অশরীরী আত্মা সংসারের মঙ্গল সাধন করিবে।
বৌদ্ধ মত
খ্রী. পূ. ৫৫৬ অব্দে ভারতের কপিলাবস্তু নগরে বুদ্ধদেব জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার প্রবর্তিত ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধরা পরকাল বা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ মতে, জীব কামনাবশে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মে জন্মে রোগ, শোক ও নানাবিধ দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে।
সংসারের নানান দুঃখভোগের চিরসমাপ্তির উপায় হইল জন্ম না লওয়া। যতদিন মানুষের মনে কোনোরূপ কামনা-বাসনার লেশমাত্র থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষ পুনঃ পুনঃ জন্মলাভ ও সুখ-দুঃখ ভোগ করিতে থাকিবে।
বিত্ত-সম্পদ ও আত্মীয়-পরিজনাদি যাবতীয় বিষয়ের তাবৎ কামনা হইতে মুক্ত হইতে পারিলে, তাহার আর পুনর্জন্ম হয় না। এমতাবস্থাকে বলা হয় মে এবং জন্মরহিতাবস্থাকে বলা হয় নির্বাণ।
সেই ক্ষতই তাহার আয়ু শেষ করিবে না কি? সেইরূপ মৃত্যুর পর কি ঘটিবে জানিতে না পারায়, যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞান লাভে এবং পবিত্র জীবন যাপনে প্রয়াস না পায়, তাহারও সেই দশা ঘটিবে। মলুক্য পুত্ত! তাই বলি, যে তত্ত্ব আজিও প্রকাশ হয় নাই, তাহা অপ্রকাশই থাকুক।”
বৌদ্ধদের ধর্মপদ নামক গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে, “যিনি সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়াছেন, যিনি সুখ দুঃখাদিতে অভিভূত নহেন, যাহার কর্মের শেষ হইয়াছে, ভবিষ্যতে তাহার আর সংসারযন্ত্রণা ভোগের আশঙ্কা নাই। … জীবন রক্ষার এবং সুখ সাধনের অনন্ত তৃষ্ণার পরিতৃপ্তির জন্য মানুষকে জন্মে-জন্মে জরা-মৃত্যুর অধীন হইতে হইতেছে।
সেই তৃষ্ণার নিবৃত্তির নামই নির্বাণ।” বৌদ্ধ মতে নির্বাণই মনুষ্য জীবনের শেষ পরিণতি। উহাতে স্বর্গ-নরক বা বিচারাদির পরিকল্পনা নাই।
মলুক্য পুত্ত নামক জনৈক ব্যক্তি বুদ্ধদেবকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “দেব! যিনি পূর্ণ বুদ্ধ, মৃত্যুর পর তিনি কি পুনর্জীবন লাভ করিবেন?” বুদ্ধদেব তাহাতে উত্তর দিয়াছিলেন, “এস মলুক্য পুত্ত! আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ কর। এই পৃথিবী অনন্তকাল স্থায়ী কি না, আমি তোমাকে তদ্বিষয়ে উপদেশ দিব।”
মলুক্য পুত্ত কহিলেন, “আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না?” গৌতম বুদ্ধ উত্তর দিলেন, “হে মলুক্য পুত্ত! এই বিষয় জানিবার জন্য ব্যাকুল হইও না।
যদি কোনো ব্যক্তি বিষাক্ত তীর দ্বারা বিদ্ধ হয়, আর সে যদি চিকিৎসককে বলে, কে আমার শরীরে এই তীর বিদ্ধ করিল, সে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, কি শূদ্র, তাহা না জানিতে পারিলে আমার ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করিতে দিব না-মনে কর দেখি, সেই ব্যক্তির কি পরিণাম হইবে?
সেই ক্ষতই তাহার আয়ু শেষ করিবে না কি? সেইরূপ মৃত্যুর পর কি ঘটিবে জানিতে না পারায়, যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞান লাভে এবং পবিত্র জীবন যাপনে প্রয়াস না পায়, তাহারও সেই দশা ঘটিবে। মলুক্য পুত্ত! তাই বলি, যে তত্ত্ব আজিও প্রকাশ হয় নাই, তাহা অপ্রকাশই থাকুক।”
চার্বাকীয় মত
চার্বাক বৈদিক যুগের একজন দার্শনিক পণ্ডিত। কথিত আছে যে, তিনি বৃহস্পতির শিষ্য ছিলেন। চার্বাকের দার্শনিক মতটি আসলে বৃহস্পতিরই মত। বৃহস্পতির নিকট এই মত প্রাপ্ত হইয়া চার্বাক উহা সাধারণ্যে প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া ঐ মতটিকে বলা হয় চার্বাক দর্শন।
এই মতে-সচেতন দেহ ভিন্ন স্বতন্ত্র আত্মা নাই, পরলোক নাই, সুখই পরম পুরুষাৰ্থ, প্রত্যক্ষমাত্র প্রমাণ; মৃত্তিকা, জল, বায়ু ও অগ্নি হইতে সমস্ত পদার্থের উদ্ভব হইয়াছে ইত্যাদি।
চার্বাকের দর্শনশাস্ত্রের মূল মন্ত্র এই- “যতদিন জীবন ধারণ করা যায়, ততদিন আপনার সুখের জন্য চেষ্টা করা বিধেয়। কারণ সকলকেই একদিন কালগ্রাসে পতিত হইতে হইবে এবং মৃত্যুর পর এই দেহ ভস্মসাৎ হইয়া গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না।
পরলোক বলিয়া কিছুই নাই, সুতরাং পারলৌকিক সুখলাভের প্রত্যাশায় ধর্মোপার্জনের উদ্দেশ্যে আত্মাকে ক্লেশ প্রদান করা নিতান্ত মূঢ়ের কার্য। যে দেহ একবার ভস্মীভূত হয়, তাহার পুনর্জন্ম অসম্ভব। এই স্থূল দেহই আত্মা, দেহাতিরিক্ত অন্য কোনো আত্মা নাই।
স্বর্গ-নরকাদি ধূর্তের কল্পিত, আর পশুবধ ও মাংসাদি নিবেদনের বিধি রাক্ষসপ্রণীত। ‘অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমানপত্নী অশ্বশিশ্ন (ঘোড়ার লিঙ্গ) গ্রহণ করিবে’ ইত্যাদি ব্যবস্থা ভণ্ডের রচিত। সুতরাং এই বৃথাকল্পিত শাস্ত্রে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বিশ্বাস করিতে পারেন না।
ক্ষিতি, জল, বহ্নি ও বায়ু-এই চারি। ভূতের সম্মিলনে দেহের উৎপত্তি। যেমন পীতবর্ণ হরিদ্রা ও শুভ্রবর্ণ চুনের সম্মিলনে রক্তিমার। উদ্ভব হয়, অথবা যেমন মাদকতাশূন্য গুড়-তণ্ডুলাদি হইতে সুরা প্রস্তুত হইলে উহা মাদক গুণযুক্ত হয়, সেইরূপ দেহের উৎপত্তি হইলেই তাহাতে স্বভাবত চৈতন্যের বিকাশ হয়। প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, অনুমানাদি প্রমাণ বলিয়া গণ্য নহে।
উপাদেয় খাদ্য ভোজন, উত্তম বস্ত্র পরিধান, স্ত্রীসম্ভোগ প্রভৃতি হইতে উৎপন্ন সুখই পরম পুরুষার্থ। এই সকল সুখের সহিত দুঃখ ভোগ করিতে হয় সত্য, কিন্তু সেই দুঃখে আস্থা প্রদর্শন না করিয়া তন্মধ্যস্থ সুখই উপভোগ করা কর্তব্য, দুঃখের ভয়ে সুখ পরিত্যাগ করা অনুচিত।
কণ্টক-শল্কাদিপূর্ণ বলিয়া কে মৎস্যভক্ষণে পরামুখ হয়? তুষ দ্বারা আবৃত বলিয়া কেহ কি ধান্যকে পরিত্যাগ করে?
“প্রতারক ধূর্ত পণ্ডিতগণ আপনাদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে পরলোক ও স্বর্গ-নরকাদির কল্পনা করিয়া জনসমাজকে বৃথা ভীত এবং অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। বেদ অধ্যয়ন, অগ্নিহোত্র, দণ্ডধারণ, ভস্মলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষশূন্য ব্যক্তিবৃন্দের উপজীবিকা মাত্র।
প্রতারক শাস্ত্রকারেরা বলে, যজ্ঞে যে জীবকে বলি প্রদান করা যায়, সেই জীবের স্বর্গলাভ হইয়া থাকে। উত্তম, কিন্তু তবে তাহারা আপন আপন মাতা-পিতাকে বলি প্রদান করিয়া তাহাদিগকে স্বর্গলাভের অধিকারী করে না কেন? তাহা না করিয়া আপনাদের রসনাতৃপ্তির জন্য ছাগাদি অসহায় পশুকে বলি দেয় কেন?
এইরূপে মাতা-পিতাকে স্বর্গগামী করাইতে পারিলে তজ্জন্য আর শ্রাদ্ধাদির প্রয়োজন হয় না। শ্রাদ্ধও ধূর্তদিগের কল্পনা। শ্রাদ্ধ করিলে যদি মৃত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে কোনো ব্যক্তি বিদেশে গমন করিলে তাহাকে পাথেয় না দিয়া, তাহার উদ্দেশে বাটীতে কোনো ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইলেই তো তাহার তৃপ্তি হইতে পারে।
আর প্রাঙ্গণে শ্রাদ্ধ করিলে যখন দ্বিতলোপরিস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি হয় না, তখন শ্রাদ্ধ দ্বারা বহু উচ্চস্থিত স্বর্গবাসীর কিরূপে তৃপ্তি হইবে? সুতরাং স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, শ্রাদ্ধাদিকার্য কেবল অকর্মণ্য ব্রাহ্মণদিগের জীবনোপায় ব্যতীত আর কিছুই নহে। বেদ- ভণ্ড, ধূর্ত ও রাক্ষস -এই ত্রিবিধ লোকের রচিত।
স্বর্গ-নরকাদি ধূর্তের কল্পিত, আর পশুবধ ও মাংসাদি নিবেদনের বিধি রাক্ষসপ্রণীত। ‘অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমানপত্নী অশ্বশিশ্ন (ঘোড়ার লিঙ্গ) গ্রহণ করিবে’ ইত্যাদি ব্যবস্থা ভণ্ডের রচিত। সুতরাং এই বৃথাকল্পিত শাস্ত্রে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বিশ্বাস করিতে পারেন না।
“এই দেহ ভস্মীভূত হইলে তাহার আর পুনরাগমনের সম্ভাবনা নাই। অতএব-
“যাবজ্জীবং সুখং জীবেৎ,
ঋণাং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
“অর্থাৎ যতদিন বাঁচিয়া থাকা যায়, ততদিন সুখে কালহরণ করাই কর্তব্য। এই জন্য ঋণ করিয়াও ঘৃতাদি উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাদ্য, ভোজনে পশ্চাদপদ হইবে না। এই শরীর ব্যতীত আর কোনো আত্মা নাই।
যদি থাকিত এবং যদি তাহার দেহান্তর গ্রহণের ক্ষমতা থাকিত, তবে সে বন্ধু-স্বজনের স্নেহে বাধ্য হইয়া পুনর্বার ঐ দেহেই প্রবেশ করে না কি জন্য? অতএব দেখা যাইতেছে- বেদ-শাস্ত্র সকলই অপ্রমাণ্য; পরলোক, স্বর্গ, মুক্তি সকলই অবান্তর; অগ্নিহোত্র, ব্রহ্মচর্য, শ্রাদ্ধাদিকর্ম সমস্তই নিষ্ফল।”
পূর্বোক্ত আলোচনায় জানা যায় যে, বৈদিক ঋষিদের পূজা-পার্বন, হোম-যজ্ঞ, শ্রাদ্ধাদি ও স্বর্গ-নরক বিষয়ক অলীক কল্পনার বিরুদ্ধে চার্বাক অভিযান চালাইয়াছিলেন সেই বৈদিক যুগেই। তবে চার্বাকের রোপিত অভিযানবৃক্ষ বিশাল আকার ধারণ করিতে পারে নাই।
কিন্তু বৈদিক ধর্মের প্রবল বাত্যায় উহা নির্মূল হইয়াও যায় নাই। বৈদিকরা চার্বাকপন্থীদের বলিতেন ম্লেচ্ছ, যবন, নাস্তিক ইত্যাদি। বস্তুত চার্বাকীয় মতবাদ ছিল অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যাহা পরবর্তীকালে আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ-এর ভিত্তিরূপে স্বীকৃত। বর্তমান জগতের বিশেষত বিজ্ঞান জগতের অনেকেই বাহ্যত না হইলেও কার্যত চার্বাকীয় মতবাদের অনুসারী।
বৈজ্ঞানিক মত
অত্র পুস্তকের ‘প্রলয়’ পরিচ্ছেদে ‘বিজ্ঞানীদের মত’ আলোচনার একস্থানে বলা হইয়াছে, “মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ সূর্য, নক্ষত্র, নীহারিকা ইত্যাদি সকলই অতিশয় উষ্ণ পদার্থ এবং উহারা সকলেই নিয়ত তাপ বিকিরণ করিতেছে।
শক্তি কখনও নিষ্ক্রিয় থাকিতে পারে না। তাই শক্তির সক্রিয়তার ফলে আবার শুরু হইবে (অত্র পুস্তকে লিখিত সৃষ্টির ধারা পরিচ্ছেদের বিবরণমতে) ধাপে ধাপে নূতন সৃষ্টির প্রবাহ। অর্থাৎ আবার সৃষ্টি হইতে থাকিবে ইলেকট্রন-প্রোটন, পরমাণু, নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহাদি বস্তুসমূহ, অবশেষে প্রাণ ও প্রাণী।
জ্যোতিষ্কপুঞ্জ হইতে এইরূপ তাপবিকিরণ হইতে হইতে এককালে এমন অবস্থা আসিতে পারে, যখন মহাবিশ্বের কোথায়ও তাপের ন্যূনাধিক্য থাকিবে না। হয়তো তখন ঘটিবে বিশ্বজোড়া মহাপ্রলয়। কিন্তু ঐরূপ মহাপ্রলয় ঘটিলে তাহা কতকাল পরে ঘটিবে, কোনো বিজ্ঞানীই তাহার নিশ্চয়তা প্রদান করিতে পারেন নাই।”
উপরোক্ত মতে, বিশ্বের যাবতীয় নীহারিকা বা নক্ষত্ররাজ্যের প্রতিটি নক্ষত্র বা সূর্য একদিন না একদিন নিভিয়া যাইবে। তখন বিশ্বের কোথায়ও উত্তাপ বা আলোকের নামগন্ধও থাকিবে না, সর্বত্র বিরাজ করিবে কল্পনাতীত শৈত্য ও অন্ধকার। সেই হিমান্ধকার ব্যোমসমুদ্রে ভাসিতে থাকিবে নক্ষত্র ও গ্রহ-উপগ্রহাদির মৃতদেহগুলি।
শৈত্যে সঙ্কুচিত ও উত্তাপে প্রসারিত হওয়া বস্তুজগতের একটি সাধারণ নিয়ম। সেই কালান্তকালের মহাশৈত্যে তখনকার বস্তুপিণ্ডগুলি সম্ভবত অতিমাত্রায় সকুচিত হইবে এবং উহার ফলে বস্তুপিণ্ডের মধ্যে প্রবল চাপের সৃষ্টি হইবে, যাহার ফলে পদার্থের পরমাণু ভাঙ্গিয়া উহা তেজ বা শক্তিতে রূপান্তরিত হইবে।
শক্তি কখনও নিষ্ক্রিয় থাকিতে পারে না। তাই শক্তির সক্রিয়তার ফলে আবার শুরু হইবে (অত্র পুস্তকে লিখিত সৃষ্টির ধারা পরিচ্ছেদের বিবরণমতে) ধাপে ধাপে নূতন সৃষ্টির প্রবাহ। অর্থাৎ আবার সৃষ্টি হইতে থাকিবে ইলেকট্রন-প্রোটন, পরমাণু, নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহাদি বস্তুসমূহ, অবশেষে প্রাণ ও প্রাণী।
কালান্তে আবার প্রলয় আবার সটি আবার প্রলয়। এইভাবে অনাদিকাল হইতে চলিয়াছে এবং অনন্তকাল চলিবে সৃষ্টি ও প্রলয় কাণ্ড। সুতরাং সৃষ্টি ও প্রলয় একবার-দুইবার নহে, অসংখ্যবার। অর্থাৎ সৃষ্টি ও প্রলয়ের কোনো আরম্ভ বা শেষ কল্পনাতীত।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………
আরও পড়ুন-
আদিম মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব
ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব
দার্শনিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ
বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
সৃষ্টির ধারা
সূর্য
গ্রহমণ্ডলী
বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
আদিম মানবের সাক্ষ্য
বংশগতি
সভ্যতার বিকাশ
সভ্যতা বিকাশের কতিপয় ধাপ
সংস্কার ও কুসংস্কার সৃষ্টি
কতিপয় ধর্মগ্রন্থ সৃষ্টি
প্লাবন ও পুনঃ সৃষ্টি
প্রলয়
প্রলয়ের পর পুনঃ সৃষ্টি
উপসংহার