সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী স্মারক বক্তৃতা ২০১৯
নিশ্চয় আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে যাহারা মিথ্যা আরোপ করে শীঘ্রই আমরা তাহাদিগকে সংশোধনের আগুনে জ্বালাইয়া থাকি। যতবার তাহাদের ত্বক রোদে পুড়িয়া পরিপক্ক হইবে ততবার উহা বদলাইয়া তাহাদিগকে নতুন ত্বক দিব যেন তাহারা শাস্তিভোগ করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিশালী বিজ্ঞানময়বিচারক। সুরানিসা : বাক্য # ৫৬
ব্যাখ্যা : সালাত অর্থাৎ ধ্যানযোগ না করলে নিজের মধ্যে ইন্দ্রিয় দ্বারপথে আগমনকারী বিষয়সমূহের প্রতি যে আসক্তি বা মোহ জন্মায় তারদ্বারা নিজের মধ্যে আল্লাহর বিকাশ আবৃত হয়ে পরাকেই বলা হয়েছে ‘আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা’। এর দ্বারা মানুষ জন্মচক্রে জাহান্নামের আগুনে আবদ্ধ হয়ে যায়। যতবার তাদের নতুন ত্বক রোদের আগুনে পুড়ে পরিপক্ক হবে, মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত ততবার তা বদলে দেওয়া হবে অর্থাৎ বারবার নতুন ত্বক দেওয়া হতে থাকবে শাস্তিভোগের জন্য।
বাক্যটিতে ব্যবহৃত আরবি ‘নুসলি’ শব্দটি লক্ষ্য করার মতো। ‘নুসলী’ অর্থ আগুনে সেঁক দেওয়া অর্থাৎ জাহান্নামের আগুনে সেঁক দেওয়া। জাহান্নামের আগুনে সেঁক দেওয়া মানে সংশোধনের জন্য সেঁক দেওয়া। সংশোধিত না হয়ে কেউ জান্নাতে প্রবেশাধিকার পায় না। এই বাক্যের প্রায় সমার্থক বাক্য হিসেবে নিম্নোক্ত বাক্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে:
অগ্নিউহাদিগের মুখমণ্ডল বা চেহারা দগ্ধ করিবে এবং উহাদিগের মুখমণ্ডল বা চেহারা হইবে বীভৎস। সুরামুমিনুন: বাক্য # ১০৪
তোমাদের মধ্যে যাহারা সাবাত লংঘন করিয়াছিল, তোমরা তো তাহাদের জান। আমি তাহাদের বলিলাম, ‘তোমরা ঘৃণিত বা নর হইয়া যাও। সুরাবাকারা: বাক্য # ৬৫
ব্যাখ্যা: লোহিতসাগর তীরে এলাত নামক স্থানে হযরত দাউদ নবীর (আ) রাজত্বকালে সাব্বাত দিবসে মাছ ধরার অপরাধে একদল ইহুদি বানর হয়ে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। কারও কারও ধারণা ঐ ঘটনাটিই এখানে বিবৃত হয়েছে।
কিন্তু বিষয়টি স্থান ও কালে আবদ্ধ শুধুমাত্র কোনও একটি ঘটনা নয়, বরং বিষয়টি একটি সর্বজনীন ও সর্বকালীন বিষয়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই একটা নিয়মের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ। বিশেষ ক্ষেত্রছাড়া এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। সৃষ্টির বিকাশলীলায় বিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি আবর্তন ঘটেই চলেছে। এখানে ‘ঘৃণিত বানর হইয়া যাও’ মানে এমন মোটেও নয় যে, তাৎক্ষণিকভাবে বানর হয়ে যাও।
বানর অবশ্য ইহবে, তবে তা হবে বিবর্তনের ধারায়, হয়তো পরবর্তী জীবনেই। ‘ঘৃণিত বানর হইয়া যাও’ বলতে তার কৃতকর্মের জন্য পরবর্তী জীবনে তার পদোন্নতি না হয়ে পদাবনতি হবে অর্থাৎ নিম্নস্তর প্রাপ্ত হয়ে বানর হয়ে যাবে। এর সাথে সঙ্গত বিবেচনায় এ বাক্যদুটিও যোগ করা যায়:
বল, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিফল হিসাবে আল্লাহরনিকট হইতে আরও নিকৃষ্ট সংবাদ দিব? আল্লাহযাহাকে অভিসম্পাৎ করিয়াছেন, যাহার উপর তিনি ক্রোধান্বিত তাহাদের কতককে করেন বানর এবং শূকর এবং যাহারা তাগুতের এবাদত করে, মর্যাদায় তারাই হীন এবং সঠিক পথ হইতে অধিকতর পথভ্রষ্ট। সুরামায়েদা : বাক্য # ৬০
এবং তাহারা যখন নিষিদ্ধ কার্যেও বাড়াবাড়ি করিতে লাগিল তখন তাহাদিগকে বলিলাম, ‘ঘৃণিত বানর হও’। সুরাআরাফ : বাক্য # ১৬৬
এবং আমরা তাহাদের অন্তঃকরণ ও দৃষ্টি পাল্টাইয়া দেই প্রথমবার যেমন তাহারা তাঁহার সহিত ঈমানের কাজ করে নাই, এবং আমরা তাহাদিগকে তাহাদের অবাধ্যতায় পরিত্যাগ করি (ফলতঃ) তাহারা উদভ্রান্ত হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। সুরাআনাম: বাক্য # ১১০
ব্যাখ্যা : বাক্যটিতে স্পষ্টতঃই জন্মচক্রের ইঙ্গিত রয়েছে। যারা নিদর্শনের উপর ঈমানের কাজ করে না অর্থাৎ সালাত করে না তাদেরকে মানবজন্মের প্রথমবার যেমন দৃষ্টি ও বোধজ্ঞান পাল্টিয়ে দেয়া হয়েছিল তেমনই প্রতিবার একইরূপে পাল্টে দেয়া হয়। ফলে তারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে সৃষ্টির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, মুক্তির দিশে খুঁজে পায় না। যারা ঈমানের কাজ করেনা আল্লাহ তাদের প্রতি নজর দেন না। আল্লাহর হেদায়েত অগ্রাহ্যকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ মুক্তির পথে সাহায্য করেন না।
সুতরাং ভূমিকম্প তাহাদিগকে ধরিল, তারপর ভোর হইল তাহাদের গৃহের মধ্যে অধোমুখে শায়িত অবস্থায়। সুরাআরাফ : বাক্য # ৭৮
ব্যাখ্যা : এক অবাধ্য জাতির প্রতি ভূমিকম্পদ্বারা শাস্তি দেবার কথা এখানে বলা হয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে বাড়িঘর ভেঙে পড়ল এবং অধিকাংশ লোক মারা গেল। তারপর তাদের ভোর হলো অর্থাৎ নবজীবনের প্রভাত হলো অধোমুখে শায়িত অবস্থায়।
একটা ভূমিকম্পের ফলে যারা মারা যায়, তারা যে সবাই অধোমুখে শায়িত অবস্থায় মরে পড়ে থাকবে এমন কোনও কথা নেই। আসলে বাক্যটিতে ভাষাচাতুর্যে পুনর্জন্মের কথাটাই ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে অধোমুখে শায়িত অবস্থা বলতে-
১. মাতৃগর্ভে শিশুগণ অধোমুখে শায়িত অবস্থায় থাকে এবং যথাসময়ে তারা মাতৃগর্ভ থেকে অধোমুখে বেরিয়ে আসে;
২. অবাধ্য জাতির জন্য এমনতর ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে যে, তারা মন্দ তকদির প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় তাদের নবজীবনের প্রভাত হবে অধোমুখে বা নতজানু অবস্থায় বা দুর্বল অবস্থায়। এ প্রসঙ্গে আল কোরানের আরও যে কালামের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে তাহলো:
অতঃপর আমরা তাকওয়াকারীগণকে উদ্ধার করি (বা করিয়া থাকি) এবং জালেমদিগকে ইহাতেই ফেলিয়া রাখি নতজানু অবস্থায় (বা পতিত অবস্থায়)। সুরামরিয়ম : বাক্য # ৭২
অতঃপর তাহারা তাঁহাকে মিথ্যায়িত করিল। সুতরাং তাহারা আক্রান্ত হইল ভূমিকম্প দ্বারা; ফলে তাহাদের প্রভাত হইল নিজগৃহে অধোমুখে বা নতজানু অবস্থায়। সুরাআনকাবুত: বাক্য # ৩৭
এবং আমরা জাহান্নামকেকরিয়াছি কারাগার কাফেরদের জন্য। সুরাবনি ইসরাইল : বাক্য # ৮
ব্যাখ্যা : জাহান্নাম কারাগার স্বরূপ। কারাগার মানেই সংশোধনাগার। কারাগারের শাস্তি সংশোধনের জন্য। অপরাধী নফস তার কৃতকর্ম দ্বারা ধৃত হয়ে জাহান্নামের বন্দি জীবনে প্রবেশ করে। এই বন্দি জীবনে থেকেও যদি সংশোধিত না হয়, তাহলে পুনরায় তাকে জাহান্নামে তথা কারাগারে পাঠানো হয়; সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তাকে বন্দি জীবন ভোগ করেই যেতে হয় বা যেতে হবে, এটাই বিধান।
প্রচলিত ধারণার জাহান্নাম হলো অনন্তকালের শাস্তির জন্য। অথচ কারাগার হলো বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির জন্য। সুতরাং আল্লাহপাক তাঁর কালামে যেখানে জাহান্নামকে কারাগার বলে উল্লেখ করেছেন সেখানে আমরা এ ধারণাই নিতে পারি যে, জাহান্নাম কখনও অনন্তকালের শাস্তির জন্য নয়। তবে আজীবন পাপীরা তাতে জাঁকিয়ে বসে অর্থাৎ বারবার সৃষ্টির বাঁধনে আটকা পড়ে বারবার বন্দি জীবন ভোগ করতে থাকে। জাহান্নামকে কারাগার বলা বিষয়টি পুনর্জন্মেরই ইঙ্গিতবহ।
উহারা বলে : আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণবিচূর্ণ হইলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরুত্থিত হইব? বল, তোমরা হইয়া যাও পাথর অথবা লৌহ। সুরাবনি ইসরাইল : বাক্য # ৪৯-৫০
ব্যাখ্যা : পাথর অথবা লোহা জড় পদার্থ। জড়জগৎ সৃষ্টির সর্বনিম্ন পর্যায়। নবী-রসুলের সাথে তর্কবিতর্কের ঘোরতর অপরাধের জন্য এমন অধোগতির লানত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে যে, তারা কেবল মনুষ্যকুল থেকে অধোগতি প্রাপ্ত হয়ে পশুকুলে পতিত হবে তা নয়; তারও নিম্নে জীবজগৎ হতে অধোগতি হয়ে বৃক্ষজগতেও নয়, বরং সর্বনিম্ন পর্যায় জড়জগতে তাদের অধোগতি হবে। জড়জগৎ থেকে পুনরায় বহু জন্মচক্র অতিক্রম করতে করতে সৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী হবে, মানবজনমে আসা তার জন্য সুদূর পরাহত।
কোরানের অন্যত্র রসুলের সমক্ষে উচ্চস্বরে কথা বলাকেও শক্তভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে (৪৯:২)। কেবল নবী-রসুল নন, নবী-রসুলদের প্রতিনিধি অলি আল্লাহদের সমক্ষেও বেয়াদবি করার অপরাধে অনেকের উপর আল্লাহর গজব নেমে এসেছে বলে শোনা যায়। আওলিয়ার সাথেও বেয়াদবি আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আলোচ্য বাক্যটিতে ‘পাথর অথবা লোহা হইয়া যাও’ বলতে অবশ্যই অপরাধীরা জড়জগতে প্রবেশ করবে। তবে তা তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বরং তা হবে বিবর্তনের ধারায় হয়তো পরবর্তী জীবনেই।
যে দুনিয়াতে অন্ধ, সে আখেরাতেও অন্ধ এবং সে হয় পথভ্রষ্ট। সুরাবনি ইসরাইল : বাক্য # ৭২
ব্যাখ্যা : প্রকৃতপক্ষে এই অন্ধত্ব দৃষ্টিহীনতা নয়। এই অন্ধত্ব জ্ঞানে অন্ধত্ব। আর এই জ্ঞান দুনিয়াদারির সাংসারিক সামান্য জ্ঞাননয়; এই জ্ঞান বিশেষজ্ঞান বা সৃষ্টিতত্ত্বের স্রষ্টা-ভাবনাজ্ঞান, নিজেকে চেনার জ্ঞান। আলোচ্য বাক্যটিতে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, নিজেকে চেনার জ্ঞানে যারা অন্ধ আখেরাতেও অর্থাৎ পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী জীবনেও তারা অন্ধ থাকবে; তবে সে যদি সদ্গুরুর সন্ধানপায় এবং গুরুময় হয়ে থাকতে পারে তবে তার অন্ধত্ব কেটে যাবে। প্রকৃত অর্থে, ‘আখেরাতে বা পরবর্তী জীবনে অন্ধ’ বলতে বাক্যটির দ্বারা পুনর্জন্মেরই ইঙ্গিতই প্রকাশ পেয়েছে।
এবং তোমাদের কেহ নাই যে ইহাতে না আসিবে; (ইহা) তোমার রবের উপর (ন্যস্ত) জরুরী একটি গৃহিত সিদ্ধান্ত। সুরা মরিয়ম : বাক্য # ৭১
ব্যাখ্যা : জাহান্নাম প্রত্যেকের জীবনে এক অনিবার্য ঘটনা। একে পরিহার করার কোনও উপায় নেই। জাহান্নাম হলো জান্নাতে যাবার কণ্টকময় রাস্তা, জান্নাতে ঢুকতে হলে এ রাস্তার কোনও বিকল্প নেই। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আমাদেরকে এ রাস্তার পথিক হতেই হবে। জন্ম-জন্মান্তরের প্রচেষ্টায় কেউ কেউ এ রাস্তা অতিক্রম করতে পারেন, আবার কেউ হয়তো জনম জনম ধরে হাজারো বছর এ রাস্তাতেই পড়ে থাকে।
(চলবে…)
……………………………………
স্বারক বক্তা : সালেহ আহমেদ শিশির
সভাপতি : অধ্যাপক ড আনিসুজ্জামান
২৫ নভেম্বর ২০১৯
আর সি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়াম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়