সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী স্মারক বক্তৃতা ২০১৯
কোনও কোনও তফসিরকারী এ রাস্তাকে ‘পুলছেরাত’ বলে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে যা বাধ্যতামূলকভাবে অতিক্রম করতেই হয় তা পুলছেরাতের পুল নয়, তা হলো জাহান্নাম। জাহান্নাম না ডিঙিয়ে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না-এটাই বিধান। মুক্তি-জান্নাতে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সবাইকে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়েই থাকতে হয়।
জাহান্নাম হলো সংশোধনাগার। এখান থেকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকা অবস্থায় নিজেকে শুদ্ধ করতে পারলেই জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ ঘটে। জন্ম-জন্মান্তরের প্রচেষ্টায় আত্মিক ক্রমোন্নতির দ্বারা এক সময় শুদ্ধ হলে পরে জান্নাতে প্রবেশাধিকারঅর্জিত হয়।
যখনই যন্ত্রণাকাতর হইয়া জাহান্নামহইতে বাহির হইতে চাহিবে তখনই তাহাদিগকে ফিরাইয়া দেওয়া হইবে উহাতে; উহাদিগকে বলা হইবে আস্বাদন কর দহনযন্ত্রণা। সুরা হজ্ব : বাক্য # ২২
ব্যাখ্যা : প্রকৃতপক্ষে কল্পিত জাহান্নাম থেকে পালানোর কোনও কথা এখানে বলা হয়নি। এখানে যা বলা হয়েছে তা হলো জাহান্নাম থেকে নয় বরং জাহান্নামী জীবনচক্র থেকে বেরিয়ে যাওয়া। বাক্যটি পাপীদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে এখানে উল্লিখিত হয়েছে।
অপরাধী মানুষ যখনই জাহান্নামের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে যেতে চায় তখনই তাকে তার কর্মফল অনুযায়ী তাতেই ফিরিয়ে দেয়া হয়। মরার আগে মরে যেতে না পারলে এই মৃত্যু ও জাহান্নামের যন্ত্রণায় কাতর হতে হবে-এটাই বিধান।
এবং তিনিই জীবনদান করেন এবং তিনি মৃত্যু ঘটান এবং তাঁরই বিধানে আবর্তন ঘটে দিনরাত্রির। তবু কি তোমরা বুঝিবে না? সুরা মুমিনুন : বাক্য # ৮০
ব্যাখ্যা : আলোচ্য বাক্যে জীবনমৃত্যুর সাথে দিনরাত্রির আবর্তনের বিষয়টি জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, তবুও কি তোমরা বুঝবে না? মৃত্যুই যে অস্তিত্বের শেষ অঙ্ক নয়, মৃত্যু যে কেবল এক একটি দৃশ্যের যবনিকাপাত মাত্র-একথাই এখানে বোঝানো হয়েছে। দিনের পর রাত এবং রাতের পর দিনের যেমনভাবে আবর্তন ঘটে, তেমনই মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জন্মমৃত্যুরও আবর্তনক্রিয়া ঘটে থাকে। এত পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার পরও যারা বোঝে না, তাদের প্রতি প্রশ্ন রাখা হচ্ছে, “তবু কি তোমরা বুঝবে না”?
আহাদজগতের তথা প্রকৃতির সবকিছুই নশ্বর, এখানে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। প্রতিটি অস্তিত্বকে এখানে বহুবার মরতে হয় কিন্তু কোনও কিছুই শেষ হয়ে যায় না। সবই থাকে, কেবল রূপান্তর হয়ে নতুন নতুন রূপে তাদের আগমন ঘটে থাকে। মৃতের দেশ থেকে অনন্তজীবনের দেশে তথা মুক্তির দেশে প্রবেশাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত দিনরাত্রির আবর্তনের মতো করে প্রত্যেকের জীবনে জন্মমৃত্যুর আবর্তনক্রিয়া ঘটেই চলেছে।
আর ইহারা যখন শৃঙ্খলিত অবস্থায় উহার কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষিপ্ত হইবে, তখন সেখানেই নিজেদের মৃত্যু ও ধ্বংসকে ডাকিতে শুরু করিবে, উহাদিগকে বলা হইবে আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা করিও না, বহুবার ধ্বংস হইবার কামনা করিতে থাক। সুরা ফুরকান : বাক্য # ১৩-১৪
ব্যাখ্যা : মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থায় দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত স্বরূপ দেখা ও বোঝার পর যখন দেখতে পায়, আবার তাকে সংকীর্ণ গণ্ডির একটি জীবনের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে, তখন সে আর একটি ধ্বংসকেই ডাকতে থাকে। মনুষ্য স্বভাবের এ অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে: তুমি মনে ভেবেছ, আর একটি ধ্বংস অর্থাৎ আর একবার মরে গেলেই সকল বিপদ-আপদ বা জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে-এ তোমাদের ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার সংকীর্ণ গণ্ডির জীবনের মধ্যে বহুবার ধ্বংস হবার বীজ নিহিত থাকে।
জাহান্নাম কোনও সংকীর্ণ স্থান নয়। এখানে সংকীর্ণ স্থান বলতে সংকীর্ণ গণ্ডির জীবনের কথা বলা হয়েছে। ‘সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ’ কথার দ্বারা পুনর্জন্মের বিষয়টি এখানে ফুটে ওঠে। শুধু একবার নয়, আল্লাহর রঙে রঞ্জিত না হওয়া পর্যন্ত বারবার সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে-এটাই বিধান।
এবং তাহাদের জন্য আর এক নিদর্শন এই যে, আমরা তাহাদের বংশধরগণকে পরিপূর্ণ তরণীতে আরোহণ করাইয়াছিলাম এবং তাহাদের জন্য আমরা অনুরূপ আরও (ফুলক) সৃষ্টি করিয়াছি যাহাতে তাহারা আরোহণ করে। এবং যদি আমরা ইচ্ছা করি, তাহাদিগকে নিমজ্জিত করিয়া দিতে পারি (বা নিমজ্জিত করি) সে অবস্থায় তাহারা কোনও সাহায্যকারী পাইবে না (বা পায় না) এবং তাহারা পরিত্রাণও পাইবে না (পায় না) যদি না আমাদের অনুগ্রহ হয়। এবং কিছুকালের জন্য তাহাদিগকে জীবন উপভোগ করিতে দেওয়া হয়। সুরা ইয়াসিন : বাক্য # ৪১-৪৪
ব্যাখ্যা : ‘ফুলক’ অর্থ পাত্রবা নৌকা। ‘মাশহুন’ অর্থ পরিপূর্ণ, ভরা বা সম্পূর্ণ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান বিষয়ে আলোচ্য বাক্যসমূহে একটি রূপক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ বাক্যে ‘ফুলকিল মাশহুনি’ অর্থাৎ ভরা তরী বলতে গর্ভাবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। মানব সন্তানেরা এতে আরোহণ করেই সংসারে আগমন করে। মাতৃগর্ভরূপ তরী তাকে পরপার থেকে এপারে বহন করে নিয়ে আসে।
ভরাতরী বলতে আমরা যাত্রীতে ঠাসা তরী বুঝে থাকি। সুতরাং ভরাতরী বলতে মাতৃগর্ভের ভ্রুণ ব্যতীত অন্য কিছু বোঝায় বলে মনে হয় না। এমন জীবন তরণীতে আরোহণ করলে এ থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত এটা ভরাই থাকে। সন্তান ছোট থাকা অবস্থায় ভ্রুণ পরিপূর্ণ থাকে, ভ্রুণ পূর্ণ দশ মাসের হলেও তা পরিপূর্ণই থাকে। কারণ বাচ্চা বর্ধিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভথলিও আয়তনে বাড়তে থাকে। এটাকেই ভরাতরীতে আরোহণ বলা হয়েছে।
ভরাতরীতে আরোহণ করেই মানুষ নবজন্মে আসে। পাপীদের ভরাতরী কোনোদিনই কূলের নাগাল পায় না, বারবার তাদেরকে ভরাতরীতে করে এপারেই ফিরে আসতে হয়। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত বাক্যটিও প্রণিধানযোগ্য: এবং তিনিই যিনি সকলকে যুগল করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তোমাদের জন্য বানাইয়াছেন ফুলক ও পশু যাহাতে তোমরা আরোহন কর। সুরা জুখরুখ : বাক্য # ১২
তারপর নিশ্চয় তাহাদের জন্য ইহার উপর রহিয়াছে ঈষৎ উষ্ণ জলের মিশ্রণ। তারপর নিশ্চয় তাহাদের প্রত্যাবর্তন জাহান্নামের আগুনের দিকেই হয়। সুরা সাফফাত : বাক্য # ৬৭-৬৮
ব্যাখ্যা : বাক্য দুটিতে পাপীদের জন্মান্তরের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। বিধান মোতাবেক পাপীদেরকে পুনরায় সৃষ্টির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয় হামীমের সাহায্যে। ‘হামীম’ অর্থ ঈষদুষ্ণ পানি; এই ঈষদুষ্ণ পানি হলো নরকের ঘোলাপানি যা ঈষদুষ্ণও বটে। এই পানি বীর্য ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
এই ঈষদুষ্ণ পানির মিশ্রণে শুক্র মিশ্রিত হয়ে থাকে এবং এরই মাধ্যমে আবার তার প্রত্যাবর্তন হয় জাহান্নামে। জাহিম হলো নরকের আগুন অর্থাৎ নরকের জ্বালাযন্ত্রণাকে জাহিম বলে। মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত মানুষ ‘হামিম-হাবিয়া-জাহিম’ এ চক্রাকারে ঘুরছে। একই রকম উক্তি পাওয়া যায় নিচের বাক্যটিতেও-
ইহার (অর্থাৎ জাহান্নামের) চারিদিকে তাহারা তোয়াফকরে এবং (তোয়াফ করে) বেগবান গরম পানির চারিদিকে। সুরা আর রহমান : বাক্য # ৪৪
তাহারা বলে: আমাদের রব দুইবার আমাদিগকে মৃত্যু দিয়াছেন এবং দুইবার বাহির হইয়া যাওয়ার একটা পথ আছে কি? সুরা মোমিন : বাক্য # ১১
ব্যাখ্যা : প্রচলিত ধারণা মতে মানুষ একবারই মরে। কিন্তু কোরান আলোচ্য বাক্যে দুই দফা জন্ম ও মৃত্যুর কথা বলছেন। কোরানের দর্শন জনগণের শিক্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরার জন্যই এ বাক্যের অবতারণা করা হয়েছে।
প্রতিদিন জীবজগতের অসংখ্য জীব মৃত্যুবরণ করছে আবার নতুন করে জন্মও নিচ্ছে। মৃত্যুর পর এদের নবজন্মে পাঠানোর পূর্বে মানসিক সাদৃশ্য বহন করে এমন পর্যায়ভুক্ত করে হাসর করা হয়। তেমনই সমমনা একাধিক কাফের যখন মৃত্যুর পর জীবনরহস্যের বিষয়জ্ঞাত হয়েছে তখন তারা রবের কাছে এই বলে আবেদন রাখছে যে, মানব জনমে আসার পর দুবার তাদেরকে জন্ম দেয়া হয়েছে এবং দুবার মৃত্যু দেয়া হয়েছে।
এরপরও কি তারা মুক্তিপথের যাত্রী হতে পারবে? পাপের কারণেই পুনর্জন্ম হয়ে থাকে। পার্থিব জগৎ কারাগার স্বরূপ। আপন নফসের প্রতি জুলুমকারী উল্লিখিত অপরাধীগণ পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়ে দুই জীবনকাল কাটানোর পর এখন মুক্তির সন্ধান করছে। এখানে লক্ষণীয় যে, উল্লিখিত ব্যক্তিরা জান্নাতে প্রবেশের পথ খুঁজছে না, তারা মুক্তিপথের সন্ধান করছে।
তাই আলোচ্য বাক্যটিতে দু দফা জন্ম ও দু দফা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিতভাবে পুনর্জন্মবাদেরই ইঙ্গিত বহন করছে। এবং যাহারা রবের ঘরকে ভয় পায় তাহাদের জন্য দুই জান্নাত। সুরা আর রহমান : বাক্য # ৪৬
ব্যাখ্যা : মানুষের জন্য ভয়ের বস্তু হলো তার আপন দেহ। দেহ হলো তার কারাগার। দেহ দুঃখময়। জন্ম-জন্মান্তরে জীবদেহে আবদ্ধ হয়ে কত দুঃখকষ্টইনা সে ভোগ করে আসছে। মুক্তপুরুষ না হওয়া পর্যন্ত বারবার তাকে দেহ কারাগারে আবদ্ধ থাকতেই হবে।
গুরুর শিক্ষাদীক্ষার অনুসারী হয়ে সালাতের সাহায্যে যে ব্যক্তি তার দেহকে অসীম দুঃখরূপে দর্শন করে এবং এ কারাগারকে ভয় পায় তার জন্য দুটি জান্নাত অর্থাৎ আর মাত্র দুটি জীবনকাল গুরুর আশ্রয়ে কাটাতে হবে। এই জান্নাত সপ্তস্তরের শেষ দুটি স্তর। তারপর মুক্তিলাভ করে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে যাবেন। তাকে আর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে না, তিনি হবেন মুক্ত ও স্বাধীন, কোনও কিছুতেই তার আর বন্ধন নেই।
সেইক্ষণে মানুষকে জানাইয়া দেওয়া হয় যাহা (অর্থাৎ যে কর্ম বা আমল) আগে সে পাঠাইয়াছিল এবং (এখন) সে যাহা ফেলিয়া আসিল। সুরা কিয়ামত : বাক্য # ১৩
ব্যাখ্যা : দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষ তার পুনর্জন্মের উপার্জিত ফল অনুযায়ী অবস্থানপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরপারে প্রত্যেককে জানিয়ে দেয়া হয় যে, তার আগের জনমের আমল অনুযায়ী বর্তমান জীবনের যে কর্মবৃত্ত দেয়া হয়েছিলএবং এই কর্মবৃত্তে অবস্থান করে এখন যে আমল সে ফেলে এসেছে। জন্ম নিয়ে দুনিয়াতে আসাটাই পাপের কারণে হয়ে থাকে। অবশ্য এর ব্যতিক্রম কেবলমাত্র মাসুমগণ। তাঁরা মানুষের কল্যাণার্থে পথপ্রদর্শক হবার জন্য ইচ্ছা করেই জন্ম নিয়ে থাকেন এবং এখানকার দুঃখজ্বালা ভোগ করে যান।
(চলবে…)
……………………………………
স্বারক বক্তা : সালেহ আহমেদ শিশির
সভাপতি : অধ্যাপক ড আনিসুজ্জামান
২৫ নভেম্বর ২০১৯
আর সি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়াম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়