-স্বামী বিবেকানন্দ
‘মর্নিং হেরাল্ড’, ২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
গত রাত্রে ভ্রূম্যান ভ্রাতৃমণ্ডলী কর্তৃক আয়োজিত ‘প্রাণবন্ত ধর্ম’ পর্যায়ের দ্বিতীয় বক্তৃতায় লাইসিয়াম থিয়েটার লোকের ভিড়ে পুরাপুরি ভরিয়া গিয়াছিল। শ্রোতাদের সংখ্যা তিন হাজার হইবে … বক্তৃতা করেন রেভারেণ্ড হিরাম ভ্রূম্যান, রেভারেণ্ড ওয়াল্টার ভ্রূম্যান এবং এই শহরে (বাল্টিমোর) সম্প্রতি আগত ব্রাহ্মণ ধর্মযাজক রেভারেণ্ড স্বামী বিবেকানন্দ। বক্তারা সকলেই ষ্টেজের উপর বসিয়াছিলেন। রেভারেণ্ড বিবেকানন্দ সকলেরই বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছিলেন।
তিনি একটি হলুদ রঙের পাগড়ি এবং লাল রঙের আলখাল্লা পরিয়াছিলেন। আলখাল্লার কটিবন্ধটিও লাল রঙের। এই পোষাক তাঁহার প্রাচ্য চেহারার মর্যাদা বাড়াইয়াছিল এবং তাঁহার প্রতি একটি অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করিয়াছিল। তাঁহার ব্যক্তিত্বই গতরাত্রের অনুষ্ঠানটিকে যেন জমাইয়া রাখিয়াছিল। সহজভাবে একটুও বিব্রত বোধ না করিয়া তিনি ভাষণটি বলিয়া গেলেন। উহার ভাষা নিখুঁত, উচ্চারণ-ইংরেজী ভাষা-জানা কোন সুশিক্ষিত ল্যাটিন-জাতীয় ব্যক্তির ন্যায়। তাঁহার বক্তৃতার কিয়দংশ দেওয়া হইতেছেঃ
খ্রীষ্টের জন্মের ৬০০ বৎসর আগে বুদ্ধ তাঁহার ধর্মপ্রচার আরম্ভ করেন। তিনি দেখিলেন, ভারতবর্ষে তখন ধর্ম প্রধানতঃ মানুষের আত্মার প্রকৃতি লইয়া অন্তহীন বাদ-বিতণ্ডায় ব্যাপৃত। ধর্মজীবনের প্রত্যবায়সমূহের অপনোদনের জন্য তদানীন্তন ধর্মের শিক্ষায় প্রাণিহত্যা যাগযজ্ঞ এবং অনুরূপ প্রণালীগুলির উপরই নির্ভর করা হইত।
বৌদ্ধধর্মের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি এইরূপ ধর্মব্যবস্থার মধ্যে একটি অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রথম কথা এই যে, তিনি কোন নূতন ধর্ম প্রচলিত করেন নাই, তাঁহার আন্দোলন ছিল সংস্কারমূলক। সকলের হিত-কামনা ছিল তাঁহার লক্ষ্য। তাঁহার উপদিষ্ট ধর্ম তিনটি আবিষ্কারের মধ্যে নিহিত। প্রথম-অশুভ আছে। দ্বিতীয়-এই অশুভের কারণ কি? বুদ্ধ বলিলেন, অশুভের কারণ মানুষের অপরের উপর প্রাধান্য-লাভের কামনা।
তৃতীয়-নিঃস্বার্থপরতা দ্বারা এই দোষ দূর করা যাইতে পারে। বুদ্ধের মতে-বল প্রকাশ করিয়া ইহার প্রতিরোধ সম্ভবপর নয়। ময়লা দিয়া ময়লা ধোয়া যায় না; ঘৃণার দ্বারা ঘৃণা নিবারিত হয় না।
হিংসা দ্বারা হিংসা জয় করা যায় না। নিঃস্বার্থপরতা দ্বারাই সকল অশুভ নিবারিত হয়। নূতন নূতন নিয়ম না করিয়া মানুষকে পুরাতন নিয়মগুলি পালন করিবার শিক্ষা দিতে হইবে। বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর প্রথম প্রচারশীল ধর্ম, তবে অপর কোন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতা মানবগোষ্ঠীর ভিতর পারস্পরিক সংঘর্ষ আনিয়া কল্যাণশক্তি হারাইয়া ফেলে।
ইহাই হইল বুদ্ধের ধর্মের ভিত্তি। যতক্ষণ সমাজ মানুষের স্বার্থপরতা এমন সব আইন-কানুন ও সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবিধান করিবার চেষ্টা করে, যেগুলির লক্ষ্য হইল জোর করিয়া মানুষকে প্রতিবেশীদের হিতসাধনে প্রযোজিত করা, ততক্ষণ কোন সুফল হইবার নয়। কৌশলের বিরুদ্ধে কৌশলকে, হিংসার বিরুদ্ধে হিংসাকে না লাগানই হইল কার্যকর পন্থা। নিঃস্বার্থ নরনারী সৃষ্টি করাই হইল একমাত্র প্রতীকার। বর্তমানের অশুভগুলি দূর করিবার জন্য আইন চালু করা যাইতে পারে, কিন্তু উহাতে বিশেষ কোন ফল হইবে না।
বুদ্ধ দেখিয়াছিলেন, ভারতে ঈশ্বর এবং তাঁহার স্বরূপ লইয়া অত্যধিক জল্পনা চলে, কিন্তু প্রকৃত কাজ হয় অতি সামান্য। এই মুখ্য সত্যটির উপর তিনি সর্বদা জোর দিতেনঃ আমাদিগকে সৎ এবং পবিত্র হইতে হইবে এবং অপরকে পবিত্র হইবার জন্য সাহায্য করিতে হইবে। তিনি বিশ্বাস করিতেন, মানুষকে উদ্যমশীল হইয়া অপরের উপকার সাধনে লাগিতে হইবে, অন্যের মধ্যে নিজের আত্মাকে, অন্যের ভিতর নিজের জীবনকে খুঁজিয়া পাইতে হইবে।
অপরের কল্যাণ-সাধনের দ্বারাই আমরা নিজেদের মঙ্গল বিধান করি। বুদ্ধ বুঝিয়াছিলেন, জগতে সর্বদাই অত্যধিক পরিমাণে মতবাদ চলিতে থাকে, তদনুপাতে কার্যতঃ অভ্যাস দেখা যায় খুব কম। বর্তমানকালে বুদ্ধের মত ১২ জন লোক যদি ভারতে থাকেন তো ঐ দেশের পক্ষে পর্যাপ্ত। এই দেশে একজন বুদ্ধ পাওয়া গেলে প্রভূত কল্যাণ হইবে।
ধর্মীয় মতবাদ যখন বৃদ্ধি পায়, পিতৃপুরুষের ধর্মে অন্ধবিশ্বাস যখন প্রবল হয় এবং কুসংস্কারকে যখন যুক্তি দ্বারা সমর্থনের চেষ্টা চলে, তখন একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন হইয়া পড়ে। কেননা ঐ-সকলের দ্বারা মানুষের অনিষ্টই বাড়িতে থাকে, উহাদের শোষণ না হইলে মানুষের কল্যাণ নাই।
মিঃ বিবেকানন্দের বক্তৃতার শেষে শ্রোতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্ত হর্ষধ্বনি দ্বারা তাঁহাকে অভিনন্দিত করেন।
‘বাল্টিমোর আমেরিকান’, ২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
‘প্রাণবন্ত ধর্ম’ সম্বন্ধে ভ্রূম্যান ভ্রাতৃমণ্ডলী যে বক্তৃতামালার ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহার দ্বিতীয়টি শুনিবার জন্য গত রাত্রে লাইসিয়াম থিয়েটার গৃহ লোকে সম্পূর্ণ ভরিয়া গিয়াছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন ভারতের স্বামী বিবেকানন্দ।
তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বলেন এবং বুদ্ধের জন্মের সময় ভারতবাসীর মধ্যে যে-সব দোষ ছিল, তাহার উল্লেখ করেন। ঐসময়ে ভারতে সামাজিক অসাম্য পৃথিবীর অন্য যে-কোন অঞ্চল অপেক্ষা হাজার গুণ বেশী ছিল। খ্রীষ্টের জন্মের ছয়শত বৎসর পূর্বে ভারতীয় জনগণের মনে পুরোহিত সম্প্রদায়ের খুব প্রভাব ছিল। বুদ্ধি-বিচার এবং বিদ্যাবত্তা-পেষণযন্ত্রের এই দুই পাথরের মধ্যে পড়িয়া জনসাধারণ নিষ্পিষ্ট হইতেছিল।
বৌদ্ধধর্ম একটি নূতন ধর্মরূপে স্থাপিত হয় নাই; বরং উহার উৎপত্তি হইয়াছিল সেই সময়কার ধর্মের অবনতির সংশোধকরূপে। বুদ্ধই বোধ করি একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি নিজের দিকে বিন্দুমাত্র না তাকাইয়া সকল উদ্যম পরহিতে নিয়োগ করিয়াছিলেন। মানুষের দুঃখকষ্ট-রূপ ভীষণ ব্যাধির ঔষধ অন্বেষণের জন্য তিনি গৃহ এবং জীবনের সকল ভোগসুখ বিসর্জন দিয়াছিলেন।
যে যুগে পণ্ডিত এবং পুরোহিতকুল ঈশ্বরের স্বরূপ লইয়া বৃথা তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত, বুদ্ধ সেই সময়ে মানুষ যাহা খেয়াল করে না, জীবনের সেই একটি বিপুল বাস্তব সত্য আবিষ্কার করিলেন-দুঃখের অস্তিত্ব। আমরা অপরকে ডিঙাইয়া যাইতে চাই এবং আমরা স্বার্থপর বলিয়াই পৃথিবীতে এত অনিষ্ট ঘটে। যে মুহূর্তে জগতের সকলে নিঃস্বার্থ হইতে পারিবে, সেই মুহূর্তে সকল অশুভ তিরোহিত হইবে। সমাজ যতদিন আইন-কানুন এবং সংস্থাসমূহের মাধ্যমে অকল্যাণের প্রতীকার করিতে সচেষ্ট, ততদিন ঐ প্রতিকার অসম্ভব। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া জগৎ ঐ প্রণালী অবলম্বন করিয়া দেখিয়াছে; কোন ফল হয় নাই।
হিংসা দ্বারা হিংসা জয় করা যায় না। নিঃস্বার্থপরতা দ্বারাই সকল অশুভ নিবারিত হয়। নূতন নূতন নিয়ম না করিয়া মানুষকে পুরাতন নিয়মগুলি পালন করিবার শিক্ষা দিতে হইবে। বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর প্রথম প্রচারশীল ধর্ম, তবে অপর কোন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতা মানবগোষ্ঠীর ভিতর পারস্পরিক সংঘর্ষ আনিয়া কল্যাণশক্তি হারাইয়া ফেলে।
সকল ধর্মই ভাল-
‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’, ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৪
‘পীপ্ল্স্ চার্চ’ গীর্জার ধর্মযাজক ডক্টর কেণ্ট-এর আমন্ত্রণে মিঃ কানন্দ গতকল্য সেখানে বক্তৃতা করেন। সকালের বক্তৃতাটি ছিল রীতিমত ধর্মোপদেশ। ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক্ মাত্রই তিনি আলোচনা করেন। প্রাচীনপন্থী সম্প্রদায়গুলির নিকট তাঁহার কথা কিছু অভিনব মনে হইবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক ধর্মের মূলেই ভাল জিনিষ আছে। ভাষাসমূহের ন্যায় বিভিন্ন ধর্মও একটি সাধারণ আকর হইতে উৎপন্ন।
গোঁড়া মতবাদ এবং প্রাণহীন কঙ্কালে পরিণতি-এই দুইটি হইতে যদি ধর্মকে মুক্ত রাখা যায়, তাহা হইলে প্রত্যেক ধর্মই মানুষের লৌকিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে প্রভূত কল্যাণ সাধন করিতে পারে। বিকালের আলোচনাটি ছিল আর্যজাতি সম্বন্ধে। উহা প্রায় একটি বক্তৃতার আকারেই উপস্থাপিত হয়। বক্তা বিভিন্ন জাতির ভাষা, ধর্ম এবং রীতিনীতি বিশ্লেষণ করিয়া একটি সাধারণ সংস্কৃতভাষাগোষ্ঠী হইতে উহাদের সকলের উৎপত্তি প্রমাণ করেন।
সভার পর মিঃ কানন্দ ‘পোষ্ট’-এর জনৈক সংবাদদাতাকে বলেন, আমি কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া দাবী করি না। আমার ভূমিকা একজন পরিদর্শকের এবং যতদূর পারি, আমি মানুষকে শিক্ষা দিবার কার্যে ব্রতী। আমার কাছে সব ধর্মই সুন্দর। জীবন ও জগতের উচ্চতর রহস্য সম্বন্ধে অন্যের মত আমিও কতকগুলি ধারণা উপস্থাপিত করার বেশী আর কিছু করিতে পারি না। আমার মনে হয়, পুনর্জন্মবাদ ধর্মবিষয়ে আমাদের অনেক জিজ্ঞাসার একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যার খুব কাছাকাছি যায়।
কিন্তু ইহাকে আমি একটি ধর্মতত্ত্ব বলিয়া খাড়া করিতে চাই না। বড়জোড় ইহা একটি মতবাদ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া ইহা প্রমাণ করা যায় না। যাঁহার ঐ অভিজ্ঞতা হইয়াছে, তাঁহারই পক্ষে ঐ প্রমাণ কার্যকর। তোমার অভিজ্ঞতা আমার কাছে কিছুই নয়, আমার অভিজ্ঞতাও তোমর নিকট নিষ্ফল। আমি অলৌলিক ঘটনায় বিশ্বাসী নই। ধর্মের ব্যাপারে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আমার নিকট অপ্রীতিকর।
তিনি ইহা অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন-
তবে আমার বর্তমান অস্তিত্বের ব্যাখ্যার জন্য আমাকে একটি অতীত ও ভবিষ্যৎ অবস্থায় অবশ্যই বিশ্বাস করিতে হইবে। আর আমরা যদি এই পৃথিবী হইতে চলিয়া যাই, আমাদিগকে নিশ্চয়ই অন্য কোন আকার ধারণ করিতে হইবে। এই দিক্ দিয়া আমার পুনর্জন্মে বিশ্বাস আসে।
তবে আমি ইহা হাতে-নাতে প্রমাণ করিতে পারি না। পুনর্জন্মবাদের বদলে অন্য সুষ্ঠুতর কিছু যদি কেহ আমাকে দেখাইতে পারেন, তাহা হইলে আমি এই মত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি। এ পর্যন্ত আমি নিজে ঐরূপ সন্তোষজনক কিছু খুঁজিয়া পাই নাই।
মিঃ কানন্দ কলিকাতার অধিবাসী এবং ওখানকার রাজকীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। ইংরেজী যাহাদের মাতৃভাষা, তাহাদের মতই তিনি ইংরেজী বলিতে পারেন। ঐ ভাষার মাধ্যমেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তিনি ইংরেজ জাতির সহিত ভারতবাসীর সংস্পর্শ লক্ষ্য করিবার প্রচুর সুযোগ পাইয়াছিলেন। কোন বৈদেশিক মিশনরী কর্মী কানন্দের কথাবার্তা শুনিলে ভারতবাসীকে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী করা বিষয়ে নৈরাশ্য পোষণ করিবেন।
এই সম্পর্কে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, পাশ্চাত্যের ধর্মশিক্ষা প্রাচ্যের চিন্তাধারার উপর কতদূর কার্যকরী হইয়াছে। কানন্দ উত্তরে বলেন, ‘একটি দেশে নূতন কোন চিন্তাধারা গেলে উহার কিছু না কিছু ফল অবশ্যই ঘটে, তবে প্রাচ্য চিন্তাধারার উপর খ্রীষ্টধর্মের শিক্ষা যে-প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহা এতই সামান্য যে, উহা নজরেই আসে না।’
প্রাচ্য চিন্তাধারা এ দেশে যেমন স্বল্পই দাগ রাখে, পাশ্চাত্য মতবাদসমূহেরও প্রাচ্যে ঐরূপ ফল, বরং অতটাও নয়। অর্থাৎ দেশের চিন্তাশীল লোকের উপর উহার কোনই প্রভাব নাই। সাধারণ লোকের ভিতর মিশনরীদের কাজের ফলও অতি সামান্য। যতগুলি ব্যক্তি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়, দেশীয় ধর্মসম্প্রদায় হইতে ততগুলি লোক অবশ্যই কমিয়া যায়, তবে দেশের সমগ্র জনসংখ্যা এত বিপুল যে, মিশনরীদের এই ধর্মান্তরীকরণের পরিমাপ নজরে আসে না।
যোগীরা জাদুকর-
যোগিগণ বা অপর পারদর্শিগণের অনুষ্ঠিত অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের কথা ও লামাদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধেও তাঁহার মত অনুরূপ। মিঃ কানন্দ বলেন যে, অলৌকিক ঘটনায় তাঁহার কোন ঝোঁক নাই। দেশে অবশ্য বহু জাদুকর দেখা যায়, তবে উহারা যাহা দেখায় তাহা হাতের কৌশল বিশেষ। মিঃ কানন্দ নিজে একবার অল্প মাত্রায় একটি মুসলমান ফকিরের নিকট ‘আমের ম্যাজিক’ দেখিয়াছেন।
লামাদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধেও তাঁহার মত অনুরূপ। মিঃ কানন্দ বলেন, ‘এইসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে সুশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক-দৃষ্টিসম্পন্ন বা পক্ষপাতশূন্য লোকের একান্তই অভাব, অতএব তাহাদের দেওয়া বিবরণের কোন্টি সত্য, কোন্টি মিথ্যা, তাহা বিচার করা কঠিন।’
হিন্দু জীবন দর্শন-
‘ব্রুকলিন টাইমস্’, ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
গত রাত্রে পোচ গ্যালারীতে ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশন কর্তৃক স্বামী বিবেকানন্দকে একটি অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। … অভ্যর্থনার পূর্বে এই বিশিষ্ট অতিথি ‘ভারতের ধর্মসমূহ’ সম্বন্ধে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা দেন। অন্যান্য নানা বিষয়ের আলোচনা ছাড়া তিনি বলেন, ‘আমরা পৃথিবীতে আসিয়াছি শিখিতে’-ইহাই হইল হিন্দুদের জীবনদর্শন। জ্ঞান সঞ্চয়েই জীবনের পূর্ণ সুখ। মানবাত্মা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা-লাভের জন্যই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
তোমার বাইবেলের সহিত পরিচয় থাকিলে আমি আমার শাস্ত্র ভাল করিয়া বুঝিতে পারি। সেইরূপ তুমিও তোমার বাইবেল সুষ্ঠুতরভাবে পড়িতে পারিবে, যদি আমার শাস্ত্রের সহিত তোমার পরিচয় থাকে। একটি ধর্ম সত্য হইলে অন্যান্য ধর্মও নিশ্চয়ই সত্য। একই সত্য বিভিন্ন আকারে অভিব্যক্ত হইয়াছে, আর এই আকারগুলি নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন জাতির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বৈচিত্র্যের উপর।
ভালবাসা রুদ্ধ হইলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রেমই হইল মানব-প্রকৃতি। তুমি উহাকে কিছুতেই এড়াইতে পার না, কেননা উহাই জীবনের একমাত্র নিয়ম। অতএব আমাদের কর্তব্য ভালবাসার জন্যই ভগবানকে ভালবাসা, কর্তব্যের জন্যই কর্তব্য সম্পাদন করা, কাজের জন্যই কাজ করা। অন্য কোন প্রত্যাশা যেন আমাদের না থাকে। জানিতে হইবে যে, মানুষ স্বরূপতঃ শুদ্ধ ও পূর্ণ, মানুষই ভগবানের প্রকৃত মন্দির।
আমাদের যাহা কিছু আছে, তাহা যদি জড়বস্তু বা তাহার পরিণাম দ্বারা ব্যাখ্যা করা চলিত, তাহা হইলে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করিবার কোন প্রয়োজন থাকিত না। কিন্তু চিন্তাশক্তি যে জড়বস্তু হইতে উদ্ভূত হইয়াছে, ইহা প্রমাণ করা যায় না। মানুষের দেহ কতকগুলি প্রবৃত্তি বংশানুক্রমে লাভ করে-তাহা আমরা অস্বীকার করিতে পারি না, কিন্তু এই প্রবৃত্তিগুলির অর্থ হইল সেই উপযুক্ত শারীরিক সংহতি, যাহার মাধ্যমে একটি বিশেষ মন নিজস্ব ধারায় কাজ করিবে।
জীবাত্মা যে বিশেষ মানসিক সংস্কার লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে, উহা তাহার অতীত কর্ম দ্বারা সঞ্জাত। তাহাকে এমন একটি শরীর বাছিয়া লইতে হইবে, যাহা তাহার মানসিক সংস্কারগুলির বিকাশের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী হয়। সাদৃশ্যের নিয়মে ইহা ঘটে। বিজ্ঞানের সহিত ইহার সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে, কেননা বিজ্ঞান ‘অভ্যাস’ দ্বারা সব কিছুর ব্যাখ্যা করিতে চায়।
অভ্যাস সৃষ্ট হয় কোন কিছুর পুনঃপুনঃ ঘটনের ফলে। অতএব নবজাত আত্মার চারিত্রিক সংস্কারগুলি ব্যাখ্যা করিতে হইলে পূর্বে উহাদের পুনঃ- পুনঃ আবৃত্তি স্বীকার করা প্রয়োজন। ঐ সংস্কারগুলি তো এই জন্মে উৎপন্ন নয়, অতএব নিশ্চয়ই অতীত জন্ম হইতে উহারা আসিয়াছে।
মানবজাতির বিভিন্ন ধর্মগুলি বিভিন্ন অবস্থা মাত্র। মানবাত্মা যে-সব ধাপ অতিক্রম করিয়া ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করে, প্রত্যেকটি ধর্ম যেন এক একটি ধাপ। কোন ধাপকেই অবহেলা করা উচিত নয়। কোনটিই খারাপ বা বিপজ্জনক নয়। সবগুলিই কল্যাণপ্রসূ। শিশু যেমন যুবক হয়, যুবক আবার যেমন পরিণত বয়স্কে রূপান্তরিত হয়, মানুষও সেইরূপ একটি সত্য হইতে অপর সত্যে উপনীত হয়।
বিপদ আসে তখনই যখন এই বিভিন্ন অবস্থার সত্যগুলি অনমনীয় হইয়া দাঁড়ায় এবং আর নড়িতে চায় না। তখন মানুষের আধ্যাত্মিক গতি রুদ্ধ হয়। শিশু যদি না বাড়ে তো বুঝিতে হইবে সে ব্যাধিগ্রস্ত। মানুষ ধর্মের পথে যদি ধীরভাবে ধাপে ধাপে আগাইয়া চলে, তাহা হইলে এই ধাপগুলি ক্রমশঃ তাহাকে পূর্ণ সত্যের উপলব্ধি আনিয়া দিবে।
এইজন্য আমরা ঈশ্বরের সগুণ ও নির্গুণ উভয় ভাবই বিশ্বাস করি, আর ঐ সঙ্গে অতীত যে-সকল ধর্ম ছিল, বর্তমানে যেগুলি বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতে যেগুলি আসিবে-সবগুলিই বিশ্বাস করি। আমাদের আরও বিশ্বাস যে, ধর্মসমূহকে শুধু সহ্য করা নয়, আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ করা কতর্ব্য।
স্থূল জড় জগতে আমরা দেখিতে পাই-বিস্তারই জীবন, সঙ্কোচনই মৃত্যু। কোন কিছুর প্রসারণ থামিয়া গেলে উহার জীবনেরও অবসান ঘটে। নৈতিক ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রয়োগ করিলে বলিতে পারা যায়-যদি কেহ বাঁচিতে চায়, তাহাকে ভালবাসিতেই হইবে।
ভালবাসা রুদ্ধ হইলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রেমই হইল মানব-প্রকৃতি। তুমি উহাকে কিছুতেই এড়াইতে পার না, কেননা উহাই জীবনের একমাত্র নিয়ম। অতএব আমাদের কর্তব্য ভালবাসার জন্যই ভগবানকে ভালবাসা, কর্তব্যের জন্যই কর্তব্য সম্পাদন করা, কাজের জন্যই কাজ করা। অন্য কোন প্রত্যাশা যেন আমাদের না থাকে। জানিতে হইবে যে, মানুষ স্বরূপতঃ শুদ্ধ ও পূর্ণ, মানুষই ভগবানের প্রকৃত মন্দির।
‘ব্রুকলিন ডেলী ঈগল্’, ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
মহম্মদীয়, বৌদ্ধ এবং ভারতের অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মতগুলির উল্লেখ করিয়া বক্তা বলেন যে, হিন্দুগণ তাঁহাদের ধর্ম বেদের আপ্তবাণী হইতে লাভ করিয়াছেন। বেদের মতে সৃষ্টি অনাদি ও অনন্ত। মানুষ দেহধারী আত্মা। দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু আত্মা অবিনাশী। দেহ ধ্বংস হইলেও আত্মা থাকিয়া যাইবেন। আত্মা কোন কিছু হইতে উৎপন্ন হন নাই, কেননা উৎপত্তি অর্থে কতকগুলি জিনিষের মিলন, আর যাহা কিছু সম্মিলিত, ভবিষ্যতে তাহার বিশ্লেষও সুনিশ্চিত।
অতএব আত্মার উদ্ভব স্বীকার করিলে উহার লয়ও অবশ্যম্ভাবী। এই জন্য বলা হয়, আত্মার উৎপত্তি নাই। যদি বল, আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের কোন কথা আমরা স্মরণ করিতে পারি না কেন, তাহার ব্যাখ্যা সহজ। আমরা যাহাকে বিষয়ের জ্ঞান বলি, তাহা আমাদের মনঃসমুদ্রের একান্তই উপরকার ব্যাপার। মনের গভীরে আমাদের সকল অভিজ্ঞতা সঞ্চিত রহিয়াছে।
একটা স্থায়ী কিছু অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা মানুষের হৃদয়ে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল। মন, বুদ্ধি-বস্তুতঃ সারা বিশ্বপ্রকৃতিই তো পরিবর্তনশীল। এমন কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় কিনা, যাহা অসীম অনন্ত-এই প্রশ্ন লইয়া বহু আলোচনা হইয়াছে। এক দার্শনিক সম্প্রদায়-বর্তমান বৌদ্ধগণ যাহার প্রতিনিধি-বলিতেন, যাহা কিছু পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাহার কোন অস্তিত্ব নাই। প্রত্যেক বস্তু অপর বস্তুনিচয়ের উপর নির্ভর করে; মানুষ একটি স্বাধীন সত্তা-এই ধারণা ভ্রম।
পক্ষান্তরে ভাববাদীরা বলেন, প্রত্যেকেই এক-একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি। সমস্যাটির প্রকৃত সমাধান এই যে, প্রকৃতি অন্যোন্য-নির্ভরতা ও স্বতন্ত্রতা, বাস্তবতা ও ভাব-সত্তা-এই উভয়ের সংমিশ্রণ। পারস্পরিক নির্ভরতার প্রমাণ এই যে, আমাদের শরীরের গতিসমূহ আমাদের মনের অধীন, মন আবার খ্রীষ্টানরা যাহাকে ‘আত্মা’ বলে, সেই চৈতন্যসত্তা দ্বারা চালিত। মৃত্যু একটি পরিবর্তন মাত্র।
মৃত্যুর পর অন্য লোকে গিয়া যে-আত্মারা উচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন, আর যাঁহারা এই পৃথিবীতে রহিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে চৈতন্য-সত্তার দিক্ দিয়া কোন পার্থক্য নাই। সেইরূপ অপর লোকে নিম্নগতি-প্রাপ্ত আত্মারাও এখানকার অন্যান্য আত্মার সহিত অভিন্ন। প্রত্যেক মানুষই স্বরূপতঃ পূর্ণ সত্তা। অন্ধকারে বসিয়া ‘অন্ধকার, অন্ধকার’ বলিয়া পরিতাপ করিলে কোন লাভ নাই।
কলম্বাস এই মহাদেশ আবিষ্কার করিবার পর দেশে ফিরিয়া গিয়া স্বদেশবাসীকে নূতন পৃথিবীর সংবাদ দিলেন। অনেকে বিশ্বাস করিতে চাহিল না। তিনি তাহাদিগকে বলিলেন, নিজেরা গিয়া খুঁজিয়া দেখ। আমরাও সেইরূপ শাস্ত্রের উপদেশ পড়িবার পর যদি নিজেরা সাধনা করিয়া শাস্ত্রোক্ত সত্য প্রত্যক্ষ করিতে পারি, তাহা হইলে আমরা যে দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করি, তাহা কেহ কাড়িয়া লইতে পারে না।
বরং দেশলাই আনিয়া আলো জ্বালিলে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার দূর হয়। সেইরূপ ‘আমাদের শরীর সীমাবদ্ধ, আমাদের আত্মা মলিন’ বলিয়া বসিয়া বসিয়া অনুশোচনা নিষ্ফল। তত্ত্বজ্ঞানের আলোকে যদি আবাহন করি, সংশয়ের অন্ধকার কাটিয়া যাইবে। জীবনের উদ্দেশ্য জ্ঞানলাভ। খ্রীষ্টানরা হিন্দুদের নিকট শিখিতে পারেন, হিন্দুরাও খ্রীষ্টানদের নিকট।
বক্তা বলেনঃ তোমাদের সন্তানদের শিখাও যে, ধর্ম হইল একটি প্রত্যক্ষ বস্তু, নেতিবাচক কিছু নয়। ইহা মানুষের শিখান বুলি নয়, ইহা হইল জীবনের একটি বিস্তার। মানুষের প্রকৃতির মধ্যে একটি মহৎ সত্য প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে, যাহা অনবরত বিকশিত হইতে চাহিতেছে। এই বিকাশের নামই ধর্ম। প্রত্যেকটি শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে কতকগুলি পূর্বসঞ্চিত অভিজ্ঞতা লইয়া আসে।
আমরা আমাদের মধ্যে যে স্বতন্ত্রতার ভাব অনুভব করি, উহা হইতে বুঝা যায় যে, শরীর ও মন ছাড়া আমাদের মধ্যে অপর একটি সত্য রহিয়াছে। শরীর ও মন পরাধীন। কিন্তু আমাদের আত্মা স্বাধীন সত্তা। উহাই আমাদের ভিতরকার মুক্তির ইচ্ছা সৃষ্টি করিতেছে। আমরা যদি স্বরূপতঃ মুক্ত না হইতাম, তাহা হইলে আমরা জগৎকে সৎ ও পূর্ণ করিয়া তুলিবার আশা পোষণ করিতে পারিতাম কি?
আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ি। আমরা এখন যাহা, তাহা আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। ইচ্ছা করিলে আমরা আমাদিগকে ভাঙিয়া নূতন করিয়া গড়িতে পারি। আমরা বিশ্বপিতা ভগবানকে বিশ্বাস করি। তিনি তাঁহার সন্তানদের জনক ও পালয়িতা-সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান্, তোমরা যেমন ব্যক্তি-ঈশ্বরকে স্বীকার কর, আমরাও ঐরূপ করি।
কিন্তু আমরা ব্যক্তি-ঈশ্বরের পরেও যাইতে চাই, আমরা বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের নির্বিশেষ সত্তার সহিত আমরা স্বরূপতঃ এক। অতীতে যেসব ধর্ম হইয়াছে, বর্তমানে যেগুলি আছে এবং ভবিষ্যতে যে-সকল ধর্ম উদ্ভূত হইবে সবগুলির উপরই আমাদের শ্রদ্ধা। ধর্মের প্রত্যেক অভিব্যক্তির প্রতি হিন্দু মাথা নত করেন, কেননা জগতে কল্যাণকর আদর্শ হইল গ্রহণ-বর্জন নয়।
সকল সুন্দর বর্ণের ফুল দিয়া আমরা তোড়া তৈরী করিয়া বিশ্বস্রষ্টা ভগবানকে উপহার দিব। তিনি যে আমাদের একান্ত আপনার জন। ভালবাসার জন্যই আমরা তাঁহাকে ভালবাসিব, কর্তব্যের জন্যই তাঁহার প্রতি আমাদের কর্তব্য সাধিব, পূজার জন্যই আমরা তাঁহার পূজা করিব।
ধর্মগ্রন্থসমূহ ভালই, তবে ঐগুলি শুধু মানচিত্রের মত। ধর একটি বই-এ লেখা আছে, বৎসরে এত ইঞ্চি বৃষ্টি পড়ে। একজন যদি আমাকে বইটি নিংড়াইতে বলেন, ঐরূপ করিয়া এক ফোঁটাও জল পাইব না। বই শুধু বৃষ্টির ধারণাটি দেয়; ঠিক সেইরূপ শাস্ত্র, মন্দির, গীর্জা প্রভৃতি আমাদিগকে পথের নির্দেশ দেয় মাত্র। যতক্ষণ উহারা আমাদিগকে ধর্মপথে আগাইয়া যাইতে সাহায্য করে, ততক্ষণ উহারা হিতকর।
বলিদান, নতজানু হওয়া, স্তোত্রপাঠ বা মন্ত্রোচ্চারণ-এসব ধর্মের লক্ষ্য নয়। আমরা যখন যীশুখ্রীষ্টকে সামনাসামনি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইব, তখনই আমাদের পূর্ণতার উপলব্ধি হইবে। পূর্বোক্ত ক্রিয়াকলাপ যদি আমাদিগকে সেই পূর্ণতা উপলব্ধি করিতে সাহায্য করে, তবেই উহারা ভাল। শাস্ত্রের কথা বা উপদেশ আমাদের উপকারে আসিতে পারে।
কলম্বাস এই মহাদেশ আবিষ্কার করিবার পর দেশে ফিরিয়া গিয়া স্বদেশবাসীকে নূতন পৃথিবীর সংবাদ দিলেন। অনেকে বিশ্বাস করিতে চাহিল না। তিনি তাহাদিগকে বলিলেন, নিজেরা গিয়া খুঁজিয়া দেখ। আমরাও সেইরূপ শাস্ত্রের উপদেশ পড়িবার পর যদি নিজেরা সাধনা করিয়া শাস্ত্রোক্ত সত্য প্রত্যক্ষ করিতে পারি, তাহা হইলে আমরা যে দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করি, তাহা কেহ কাড়িয়া লইতে পারে না।
বক্তৃতার পর বক্তাকে যে-কোন বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া তাঁহার অভিমত জানিবার সুযোগ উপস্থিত সকলকে দেওয়া হইয়াছিল। অনেকে এই সুযোগ কাজে লাগাইয়াছিলেন।
নারীত্বের আদর্শ-
‘ব্রুকলিন ষ্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ন’, ২১ জানুআরী, ১৮৯৫
‘এথিক্যাল এসোসিয়েশন’-এর সভাপতি ডক্টর জেন্স্ স্বামী বিবেকানন্দকে শ্রোতৃমণ্ডলীর সহিত পরিচিত করিয়া দিলে তিনি তাঁহার বক্তৃতায় অংশতঃ বলেনঃ
কোন জাতির বস্তিতে উৎপন্ন জিনিষ ঐ জাতিকে বিচার করিবার পরিমাপক নয়। পৃথিবীর সকল আপেল গাছের তলা হইতে কেহ পোকায় খাওয়া সমস্ত পচা আপেল সংগ্রহ করিয়া উহাদের প্রত্যেকটিকে লইয়া এক একখানি বই লিখিতে পারে, তবুও আপেল গাছের সৌন্দর্য এবং সম্ভাবনা সম্বন্ধে তাহার কিছুই জানা নাই, এমনও সম্ভব। জাতির মহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারাই জাতিকে যথার্থ বিচার করা চলে।
যাহারা পতিত, তাহারা তো নিজেরাই একটি শ্রেণীবিশেষ। অতএব কোন একটি রীতিকে বিচার করিবার সময় উহার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি এবং আদর্শ দ্বারাই বিচার করা শুধু সমীচীন নয়, ন্যায্য ও নীতিসঙ্গত।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম জাতি-ভারতীয় আর্যগণের নিকট নারীত্বের আদর্শ অতি প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছিল। আর্যজাতিতে পুরুষ এবং নারী উভয়েই ধর্মাচার্য হইতে পারিতেন। বেদের ভাষায় স্ত্রী ছিলেন স্বামীর সহধর্মিণী১০ অর্থাৎ ধর্মসঙ্গিনী। প্রত্যেক পরিবারে একটি যজ্ঞবেদী থাকিত। বিবাহের সময় উহাতে যে হোমাগ্নি প্রজ্বলিত হইত, উহা মৃত্যু পর্যন্ত জাগাইয়া রাখা হইত।
দম্পতির একজন মারা গেলে উহার শিখা হইতে চিতাগ্নি জ্বালা হইত। স্বামী এবং স্ত্রী একত্র গৃহের যজ্ঞাগ্নিতে প্রত্যহ দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দিতেন। পত্নীকে ছাড়িয়া পতির একা যজ্ঞের অধিকার ছিল না, কেননা পত্নীকে স্বামীর অর্ধাঙ্গ মনে করা হইত। অবিবাহিত ব্যক্তি যাজ্ঞিক হইতে পারিতেন না। প্রাচীন রোম ও গ্রীসেও এই নিয়ম প্রচলিত ছিল।
কিন্তু একটি স্বতন্ত্র পৃথক্ পুরোহিত-শ্রেণীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই সকল জাতির ভিতর নারীর ধর্মকৃত্যে সমানাধিকার পিছনে হটিয়া গিয়াছিল। সেমিটিক রক্তসম্ভূত অ্যাসিরীয় জাতির ঘোষণা প্রথমে শোনা গেলঃ কন্যার কোন স্বাধীন মত থাকিবে না, বিবাহের পরও তাহাকে কোন অধিকার দেওয়া হইবে না। পারসীকরা এই মত বিশেষভাবে গ্রহণ করিল, পরে তাহাদের মাধ্যমে উহা রোম ও গ্রীসে পৌঁছিল এবং সর্বত্র নারীজাতির উন্নতি ব্যাহত হইতে লাগিল।
আর একটি ব্যাপারও এই ঘটনার জন্য দায়ী-বিবাহ-পদ্ধতির পরিবর্তন। প্রথমে পারিবারিক নিয়ম ছিল জননীর কর্ত্রীত্ব অর্থাৎ মাতা ছিলেন পরিবারের কেন্দ্র। কন্যারা তাঁহার স্থান অধিকার করিত। ইহা হইতে স্ত্রীলোকের বহুবিবাহরূপ আজব প্রথার উদ্ভব হয়। অনেক সময় পাঁচ বা ছয় ভ্রাতা একই স্ত্রীকে বিবাহ করিত। এমন কি বেদেও ইহার আভাস দেখিতে পাওয়া যায়।
নিঃসন্তান অবস্থায় কোন পুরুষ মারা গেলে তাঁহার বিধবা পত্নী সন্তান না হওয়া পর্যন্ত অপর কোন একজন পুরুষের সহিত বাস করিতে পারিতেন। সন্তানদের দাবী কিন্তু ঐ পুরুষের থাকিত না। বিধবার মৃত স্বামীই সন্তানের পিতা বলিয়া বিবেচিত হইতেন। পরবর্তী কালে বিধবার পুনর্বিবাহের প্রচলন হয়। বর্তমানকালে অবশ্য উহা নিষিদ্ধ।
কিন্তু এই-সকল অস্বাভাবিক অভিব্যক্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত পবিত্রতার একটি প্রগাঢ় ভাব জাতিমানসে দেখা দিতে থাকে। এতৎসম্পর্কিত বিধানগুলি খুবই কঠোর ছিল। প্রত্যেক বালক বা বালিকাকে গুরুগৃহে পাঠান হইত। বিশ বা ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত উহারা সেখানে বিদ্যাচর্চায় ব্যাপৃত থাকিত। চরিত্রে লেশমাত্র অশুচি ভাব দেখা গেলে প্রায় নিষ্ঠুরভাবেই তাহাদিগকে শাস্তি দেওয়া হইত।
ভারতীয় জাতির হৃদয়ে এই ব্যক্তিগত শুচিতার ভাব এত গভীর রেখাপাত করিয়াছে যে, উহা যেন একটি বাতিক বিশেষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মুসলমানগণের চিতো (চিতোর)-অবরোধের সময় ইহার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ দেখা যায়। প্রবল আক্রমণের বিরুদ্ধে পুরুষরা নগরটি অনেকক্ষণ রক্ষা করিয়া চলিয়াছিল, কিন্তু যখন দেখা গেল পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তখন নগরীর নারীগণ বাজারে একটি বিরাট অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করিল।
ভারতে পরিবারের কেন্দ্র হইলেন মা। তিনিই আমাদের উচ্চতম আদর্শ। আমরা ভগবানকে বিশ্বজননী বলি, আর গর্ভধারিণী মাতা হইলেন সেই বিশ্বজননীরই প্রতিনিধি। একজন মহিলা-ঋষিই প্রথম ভগবানের সহিত ঐকাত্ম্য অনুভব করিয়াছিলেন। বেদের একটি প্রধান সূক্তে তাঁহার অনুভূতি লিপিবদ্ধ হইয়াছে। আমাদের ঈশ্বর সগুণ এবং নির্গুণ দুই-ই। নির্গুণ যেন পুরুষ, সগুণ প্রকৃতি।
শত্রুপক্ষ নগর-দ্বার ভাঙিয়া ভিতরে ঢুকিতেই ৭৪,৫০০ কুল-ললনা একসঙ্গে ঐ কুণ্ডে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া আত্মবিসর্জন দিল। এই মহৎ দৃষ্টান্তটি ভারতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনুসৃত হইয়া আসিতেছে। চিঠির খামের উপর ৭৪৷৷০ সংখ্যাটি লিখিয়া দেওয়ার রীতি আছে। ইহার তাৎপর্য এই যে, যদি কেহ বেআইনীভাবে ঐ চিঠিটি পড়ে, তাহা হইলে যে মহাপাপ হইতে বাঁচিবার জন্য চিতোরের মহাপ্রাণা নারীকুলকে অগ্নিতে আত্মাহূতি দিতে হইয়াছিল, ঐরূপ অপরাধে সে অপরাধী হইবে।
ইহার (বৈদিক যুগের) পর হইল সন্ন্যাসীদের যুগ, যাহা আসে বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ের সহিত। বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দিয়াছিল-গৃহত্যাগী যতিরাই শুধু ‘নির্বাণে’র অধিকারী। নির্বাণ হইল কতকটা খ্রীষ্টানদের স্বর্গরাজ্যের মত। এই শিক্ষার ফলে সারা ভারত যেন সন্ন্যাসীদের একটি বিরাট মঠে পরিণত হইল। সকল মনোযোগ নিবদ্ধ রহিল শুধু একটি মাত্র লক্ষ্যে-একটি মাত্র সংগ্রামে-কি করিয়া পবিত্র থাকা যায়।
স্ত্রীলোকের উপর সকল দোষ চাপান হইল। এমন কি চলতি হিতবচনে পর্যন্ত নারী হইতে সতর্কতার কথা ঢুকিয়া গেল। যথাঃ নরকের দ্বার কি? এই প্রশ্নটি সাজাইয়া উত্তরে বলা হইলঃ ‘নারী’। আর একটিঃ এই মাটির সহিত আমাদের বাঁধিয়া রাখে কোন্ শিকল?-‘নারী’। অপর একটিঃ অন্ধ অপেক্ষাও অন্ধ কে?-‘যে নারী দ্বারা প্রবঞ্চিত।’
পাশ্চাত্যের মঠসমূহেও অনুরূপ ধারণা দেখা যায়। সন্ন্যাস-প্রথার পরিবিস্তার সব সময়েই স্ত্রীজাতির অবনতি সূচিত করিয়াছে।
কিন্তু অবশেষে নারীত্বের আর একটি ধারণা উদ্ভূত হইল। পাশ্চাত্যে এই ধারণা রূপ নিল পত্নীর আদর্শে, ভারতে জননীর আদর্শে। এই পরিবর্তন শুধু ধর্মযাজকগণের দ্বারা আসিয়াছিল, এরূপ মনে করিও না। আমি জানি, জগতে যাহা কিছু মহৎ ঘটে, ধর্মযাজকেরা তাহার উদ্যোক্তা বলিয়া দাবী করে, কিন্তু এ-দাবী যে ন্যায্য নয়, নিজে একজন ধর্মপ্রচারক হইয়া এ-কথা বলিতে আমার সঙ্কোচ নাই।
জগতের সকল ধর্মগুরুর উদ্দেশ্যে আমি সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি বলিতে বাধ্য যে, পাশ্চাত্যে নারী-প্রগতি ধর্মের মাধ্যমে আসে নাই। জন স্টুয়ার্ট মিলের ন্যায় ব্যক্তিরা এবং বিপ্লবী ফরাসী দার্শনিকরাই ইহার জনয়িতা। ধর্ম সামান্য কিছু করিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সবটা নয়। বেশী কথা কি, আজিকার দিনেও এশিয়া-মাইনরে খ্রীষ্টান বিশপরা উপপত্নী-গোষ্ঠী রাখেন!
এ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির মধ্যে স্ত্রীলোকের প্রতি যে মনোভাব দেখা যায়, উহাই খ্রীষ্টধর্মের আদর্শানুগ। সামাজিক ও মানসিক উন্নতির বিচারে পাশ্চাত্যদেশীয় ভগিনীগণ হইতে মুসলমান নারীর পার্থক্য বিপুল। কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিও না-মুসলমান নারী অসুখী, কেননা বাস্তবিকই তাহাদের কোন কষ্ট নাই। ভারতে হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া নারী সম্পত্তির মালিকানা ভোগ করিয়া আসিতেছে।
এদেশে কোন ব্যক্তি তাহার পত্নীকে সম্পত্তির অধিকার নাও দিতে পারেন, কিন্তু ভারতবর্ষের স্বামীর মৃত্যুর পর তাহার যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি স্ত্রীর প্রাপ্য-ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো সম্পূর্ণভাবে, স্থাবর সম্পত্তি জীবিতকাল পর্যন্ত।
ভারতে পরিবারের কেন্দ্র হইলেন মা। তিনিই আমাদের উচ্চতম আদর্শ। আমরা ভগবানকে বিশ্বজননী বলি, আর গর্ভধারিণী মাতা হইলেন সেই বিশ্বজননীরই প্রতিনিধি। একজন মহিলা-ঋষিই প্রথম ভগবানের সহিত ঐকাত্ম্য অনুভব করিয়াছিলেন। বেদের একটি প্রধান সূক্তে তাঁহার অনুভূতি লিপিবদ্ধ হইয়াছে। আমাদের ঈশ্বর সগুণ এবং নির্গুণ দুই-ই। নির্গুণ যেন পুরুষ, সগুণ প্রকৃতি।
তাই আমরা বলি ‘যে হস্তদ্বয় শিশুকে দোল দেয়, তাহাতেই ভগবানের প্রথম প্রকাশ।’ যে-জাতক ঈশ্বর আরাধনার ভিতর দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়াছে, সেই হইল আর্য; আর অনার্য সেই, যাহার জন্ম হইয়াছে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার মাধ্যমে।
প্রাগ্জন্ম-প্রভাব-সম্বন্ধীয় মতবাদ বর্তমানকালে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করিতেছে। বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়েই বলিতেছে, ‘নিজেকে শুচি এবং শুদ্ধ রাখ।’ ভারতবর্ষে শুচিতার ধারণা এত গভীর যে, আমরা এমন কি বিবাহকে পর্যন্ত ব্যভিচার বলিয়া থাকি, যদি না বিবাহ ধর্মসাধনায় পরিণত হয়। প্রত্যেক সৎ হিন্দুর সহিত আমিও বিশ্বাস করি যে, আমার জন্মদাত্রী মাতার চরিত্র নির্মল ও নিষ্কলঙ্ক, এবং সেইজন্য আমার মধ্যে আজ যাহা কিছু প্রশংসনীয়, তাহা তাঁহারই নিকট পাওয়া। ভারতীয় জাতির জীবন-রহস্য ইহাই-এই পবিত্রতা।
প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম-
‘ব্রুকলিন ষ্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ন’, ৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
এথিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডক্টর জেন্স্ স্বামী বিবেকানন্দকে বক্তৃতামঞ্চে উপস্থাপিত করিলে তিনি তাঁহার ভাষণ আরম্ভ করেন। উহার কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছেঃ
বৌদ্ধধর্ম-প্রসঙ্গে হিন্দুদের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। যীশুখ্রীষ্ট যেমন প্রচলিত য়াহুদী ধর্মের প্রতিপক্ষতা করিয়াছিলেন, বুদ্ধও সেইরূপ ভারতবর্ষের তৎকালীন ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন। খ্রীষ্টকে তাঁহার দেশবাসীরা অস্বীকার করিয়াছিল, বুদ্ধ কিন্তু স্বদেশে ঈশ্বরাবতার বলিয়া গৃহীত হইয়াছিলেন। যে-সব মন্দিরের দ্বারদেশে বুদ্ধ পৌরোহিত্য-ক্রিয়াকলাপের নিন্দা করিয়াছিলেন, সেই সকল মন্দিরেই আজ তাঁহার পূজা হইতেছে।
কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার নামে যে মতবাদ প্রচলিত হইয়াছিল, উহাতে হিন্দুদের আস্থা নাই। বুদ্ধ যাহা শিক্ষা দিয়াছিলেন হিন্দুরা তাহা শ্রদ্ধা করে, কিন্তু বৌদ্ধরা যাহা প্রচার করে, তাহা গ্রহণ করিতে তাহারা রাজী নয়। কারণ বুদ্ধের বাণী নানা স্থানে ছড়াইয়া পড়িয়া বহু বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত হইয়াছিল। ঐ রঞ্জিত ও বিকৃত বাণীর ভারতীয় ঐতিহ্যের সহিত খাপ খাওয়া সম্ভবপর ছিল না।
বৌদ্ধধর্মকে পুরাপুরি বুঝিতে হইলে উহা যাহা হইতে উদ্ভূত, আমাদিগকে সেই মূল ধর্মটির দিকে অবশ্যই ফিরিয়া দেখিতে হইবে। বৈদিক গ্রন্থগুলির দুটি ভাগ। প্রথম-কর্মকাণ্ড১১, যাহাতে যাগযজ্ঞের কথা আছে, আর দ্বিতীয় হইল বেদান্ত-যাহা যাগযজ্ঞের নিন্দা করে, দান ও প্রেম শিক্ষা দেয়, মৃত্যুকে বড় করিয়া দেখায় না। বেদবিশ্বাসী যে সম্প্রদায়ের বেদের যে অংশে প্রীতি, সেই অংশই তাহারা গ্রহণ করিয়াছে।
অবৈদিকদের মধ্যে চার্বাকপন্থী বা ভারতীয় জড়বাদীরা বিশ্বাস করিত যে, সব কিছু হইল জড়; স্বর্গ, নরক, আত্মা বা ঈশ্বর বলিয়া কিছু নাই। দ্বিতীয় একটি সম্প্রদায়-জৈনগণও নাস্তিক, কিন্তু অত্যন্ত নীতিবাদী। তাহারা ঈশ্বরের ধারণাকে অস্বীকার করিত, কিন্তু আত্মা মানিত। আত্মা অধিকতর পূর্ণতার অভিব্যক্তির জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করিয়া চলিয়াছে।
এই দুই সম্প্রদায়কে অবৈদিক বলা হইত। তৃতীয় একটি সম্প্রদায় বৈদিক হইলেও ব্যক্তি-ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিত না। তাহারা বলিত বিশ্বজগতের সব কিছুর জনক হইল পরমাণু বা প্রকৃতি।
অতএব দেখা যাইতেছে, বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বে ভারতের চিন্তা-জগৎ ছিল বিভক্ত। তাঁহার ধর্মের নির্ভুল ধারণা করিবার জন্য আর একটি বিষয়েরও উল্লেখ প্রয়োজনীয়-উহা হইল সেই সময়কার জাতি-প্রথা। বেদ শিক্ষা দেয় যে, যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রাহ্মণ; যিনি সমাজের সকলকে রক্ষা করেন, তিনি খোক্ত (ক্ষত্রিয়) আর যিনি ব্যবসাবাণিজ্য করিয়া অন্নসংস্থান করেন, তিনি বিশ (বৈশ্য)।
এই সামাজিক বৈচিত্র্যগুলি পরে অত্যন্ত ধরাবাঁধা কঠিন জাতিভেদের ছাঁচে পরিণতি অর্থাৎ অবনতি লাভ করে এবং ক্রমে দৃঢ়-গঠিত সুসম্বদ্ধ একটি পৌরোহিত্য-শাসন সমগ্র জাতির কাঁধে ভর করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন ঠিক এই সময়েই। অতএব তাঁহার ধর্মকে ধর্মবিষয়ক ও সামাজিক সংস্কারের একটি চরম প্রয়াস বলা যাইতে পারে।
সেই সময়ে দেশের আকাশ-বাতাস বাদ-বিতণ্ডায় ভরিয়া আছে। বিশ হাজার অন্ধ পুরোহিত দুই কোটি পরস্পর-বিবদমান অন্ধ মানুষকে পথ দেখাইবার চেষ্টা করিতেছে! এইরূপ সঙ্কটকালে বুদ্ধের ন্যায় একজন জ্ঞানী পুরুষের প্রচার-কার্য অপেক্ষা জাতির পক্ষে বেশী প্রয়োজনীয় আর কি থাকিতে পারে? তিনি সকলকে শুনাইলেন-‘কলহ বন্ধ কর, পুঁথিপত্র তুলিয়া রাখ, নিজের পূর্ণতাকে বিকাশ করিয়া তোল।’
তিব্বত ও তাতার দেশগুলি হইতে আমদানী বিকৃত আচারসমূহের প্রচলন যখন হইল, তখনই জনগণ দলে দলে বৌদ্ধধর্মে ভিড়িয়াছিল। মৌলিক বৌদ্ধধর্ম আদৌ শূন্যবাদ নয়। উহা জাতিভেদ ও পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রাম প্রচেষ্টা মাত্র। বৌদ্ধধর্মই পৃথিবীতে প্রথম মূক ইতর প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি ঘোষণা করে এবং মানুষে মানুষে বিভেদ-সৃষ্টিকারী আভিজাত্য প্রথাকে ভাঙিয়া দেয়।
জাতি-বিভাগের মূল তথ্যটির প্রতিবাদ বুদ্ধ কখনও করেন নাই, কেননা উহা সমাজজীবনের একটি স্বাভাবিক প্রবণতারই অভিব্যক্তি এবং সব সময়েই মূল্যবান্। কিন্তু যাহা বংশগত বিশেষ সুবিধার দাবী করে, বুদ্ধ সেই অবনত জাতিপ্রথার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণগণকে তিনি বলিলেন, ‘প্রকৃত ব্রাহ্মণেরা লোভ, ক্রোধ এবং পাপকে জয় করিয়া থাকেন। তোমরা কি ঐরূপ করিতে পারিয়াছ?
যদি না পারিয়া থাক, তাহা হইলে আর ভণ্ডামি করিও না। জাতি হইল চরিত্রের একটি অবস্থা, উহা কোন কঠোর গণ্ডীবদ্ধ শ্রেণী নয়। যে-কেহ ভগবানকে জানে ও ভালবাসে, সে-ই যথার্থ ব্রাহ্মণ।’ যাগ-যজ্ঞ সম্বন্ধে বুদ্ধ বলিলেন, ‘যাগ-যজ্ঞ আমাদিগকে পবিত্র করে, এমন কথা বেদে কোথায় আছে? উহা হয়তো দেবতাগণকে সুখী করিতে পারে, কিন্তু আমাদের কোন উন্নতি সাধন করে না। অতএব এই-সব নিষ্ফল আড়ম্বরে ক্ষান্তি দিয়া ভগবান্কে ভালবাস এবং পূর্ণতা লাভ করিবার চেষ্টা কর।’
পরবর্তী কালে বুদ্ধের এই সকল শিক্ষা লোকে বিস্মৃত হয়। ভারতের বাহিরে এমন অনেক দেশে উহা প্রচারিত হয়, যেখানকার অধিবাসীদের এই মহান্ সত্যসমূহ গ্রহণের যোগ্যতা ছিল না। এই-সকল জাতির বহুতর কুসংস্কার ও কদাচারের সহিত মিশিয়া বুদ্ধবাণী ভারতে ফিরিয়া আসে এবং কিম্ভূতকিমাকার মতসমূহের জন্ম দিতে থাকে। এইভাবে উঠে শূন্যবাদী সম্প্রদায়, যাহাদের মতে বিশ্বসংসার, ভগবান্ এবং আত্মার কোন মূলভিত্তি নাই।
সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। ক্ষণকালের সম্ভোগ ব্যতীত অন্য কিছুতেই তাহারা বিশ্বাস করিত না। ইহার ফলে এই মত পরে অতি জঘন্য কদাচারসমূহ সৃষ্টি করে। যাহা হউক, উহা তো বুদ্ধের শিক্ষা নয়, বরং তাঁহার শিক্ষার ভয়াবহ অধোগতি মাত্র। হিন্দুজাতি যে ইহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া এই কুশিক্ষাকে দূর করিয়া দিয়াছিল, এজন্য তাহারা অভিনন্দনীয়।
বুদ্ধের প্রত্যেকটি বাণী বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। বেদান্ত-গ্রন্থে এবং অরণ্যের মঠসমূহে লুক্কায়িত সত্যগুলিকে যাঁহারা সকলের গোচরীভূত করিতে চাহিয়াছেন, বুদ্ধ সেই-সকল সন্ন্যাসীর একজন। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি না যে, জগৎ এখনও ঐ-সকল সত্যের জন্য প্রস্তুত। লোকে এখনও ধর্মের নিম্নতর অভিব্যক্তিগুলিই চায়, যেখানে ব্যক্তি-ঈশ্বরের উপদেশ আছে। এই কারণেই মৌলিক বৌদ্ধধর্ম জনগণের চিত্তকে বেশীদিন ধরিয়া রাখিতে পারে নাই।
তিব্বত ও তাতার দেশগুলি হইতে আমদানী বিকৃত আচারসমূহের প্রচলন যখন হইল, তখনই জনগণ দলে দলে বৌদ্ধধর্মে ভিড়িয়াছিল। মৌলিক বৌদ্ধধর্ম আদৌ শূন্যবাদ নয়। উহা জাতিভেদ ও পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রাম প্রচেষ্টা মাত্র। বৌদ্ধধর্মই পৃথিবীতে প্রথম মূক ইতর প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি ঘোষণা করে এবং মানুষে মানুষে বিভেদ-সৃষ্টিকারী আভিজাত্য প্রথাকে ভাঙিয়া দেয়।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার বক্তৃতা শেষ করেন বুদ্ধের জীবনের কয়েকটি চিত্র উপস্থিত করিয়া। তাঁহার ভাষায় বুদ্ধ ছিলেন ‘এমন একজন মহাপুরুষ, যাঁহার মনে একটি মাত্র চিন্তাও উঠে নাই বা যাঁহার দ্বারা একটি মাত্র কাজও সাধিত হয় নাই, যাহা মানুষের হিতসাধন ব্যতীত অপর কোন উদ্দেশ্যে চালিত। তাঁহার মেধা এবং হৃদয় উভয়ই ছিল বিরাট-তিনি সমুদয় মানবজাতি এবং প্রাণিকুলকে প্রেমে আলিঙ্গন করিয়াছিলেন এবং কি উচ্চতম দেবদূত, কি নিম্নতম কীটটির জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করিতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন।’
বুদ্ধ কিভাবে জনৈক রাজার যজ্ঞে বলিদানের উদ্দেশ্যে নীত একটি মেষযূথকে বাঁচাইবার জন্য নিজেকে যূপকাষ্ঠে নিক্ষেপ করিয়া স্বকীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিয়াছিলেন, বক্তা প্রথমে তাহা বর্ণনা করেন।
তারপর তিনি চিত্রিত করেন-দুঃখসন্তপ্ত মানুষের ক্রন্দনে ব্যথিত এই মহাপুরুষ কিভাবে স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ত্যাগ করেন, পরে তাঁহার শিক্ষা ভারতে সর্বজনীনভাবে যখন গৃহীত হইল, তখন কিভাবে তিনি জনৈক নীচকুলোদ্ভব পারিয়ার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তৎপ্রদত্ত শূকর-মাংস আহার করেন এবং উহার ফলে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।
জগতে ভারতের দান-
‘ব্রুকলিন ষ্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ন’, ২৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
সোমবার রাত্রে ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের উদ্যোগে পায়ারপণ্ট এবং ক্লিণ্টন ষ্ট্রীটের সংযোগস্থলে লং আইল্যাণ্ড হিষ্টরিক্যাল সোসাইটি হলে হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ‘জগতে ভারতের দান’ বিষয়ে বক্তৃতা করেন। শ্রোতৃসংখ্যা বেশীই ছিল।
বক্তা তাঁহার স্বদেশের আশ্চর্য সৌন্দর্যের কথা বলেন-যে দেশ নীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের আদিম বিকাশ-ভূমি, যে-দেশের পুত্রদের চরিত্রবত্তা ও কন্যাদের ধর্মনিষ্ঠার কথা বহু বৈদেশিক পর্যটক কীর্তন করিয়া গিয়াছেন। অতঃপর বক্তা বিশ্বজগতে ভারত কি কি দিয়াছে, তাহা দ্রুতগতিতে বিস্তারিতভাবে প্রদর্শন করেন।
ধর্মের ক্ষেত্রে ভারতের দানপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, খ্রীষ্টধর্মের উপর ভারত প্রচুর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। যীশুখ্রীষ্টের উপদেশগুলির মূল উৎসের অনুসন্ধান করিলে দেখান যাইতে পারে, উহা বুদ্ধের বাণীর ভিতর রহিয়াছে।
দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা এখনও পর্যন্ত অপর যে কোন জাতি অপেক্ষা অনেক উপরে রহিয়াছি। প্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। সঙ্গীতে ভারত জগৎকে দিয়াছে প্রধান সাতটি স্বর এবং সুরের তিনটি গ্রাম সহ স্বরলিপি-প্রণালী। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দেও আমরা এইরূপ প্রণালীবদ্ধ সঙ্গীত উপভোগ করিয়াছি। ইওরোপে উহা প্রথম আসে মাত্র একাদশ শতাব্দীতে।
ইওরোপীয় এবং আমেরিকান গবেষকদের গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বক্তা বুদ্ধ এবং খ্রীষ্টের মধ্যে বহু সাদৃশ্য প্রদর্শন করেন। যীশুর জন্ম, গৃহত্যাগান্তে নির্জন বাস, অন্তরঙ্গ শিষ্যসংখ্যা এবং তাঁহার নৈতিক শিক্ষা তাঁহার আবির্ভাবের বহু শত বৎসর পূর্বেকার বুদ্ধের জীবনের ঘটনার মতই। বক্তা জিজ্ঞাসা করেন, এই মিল কি শুধু একটি আকস্মিক ব্যাপার অথবা বুদ্ধের ধর্ম খ্রীষ্টধর্মের একটি পূর্বতন আভাস?
মনে হয়, পাশ্চাত্যের অধিকাংশ মনীষী দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিতেই সন্তুষ্ট, কিন্তু এমনও কোন কোন পণ্ডিত আছেন, যাঁহারা নির্ভীকভাবে বলেন, খ্রীষ্টধর্ম সাক্ষাৎ বৌদ্ধধর্ম হইতে প্রসূত, যেমন খ্রীষ্টধর্মের প্রথম বিরুদ্ধবাদী শাখা মনিকাই-বাদকে (Monecian heresy) এখন সর্বসম্মতভাবে বৌদ্ধধর্মের একটি সম্প্রদায়ের শিক্ষা বলিয়া মনে করা হইয়া থাকে। কিন্তু খ্রীষ্টধর্ম যে বৌদ্ধধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত, এই বিষয়ে আরও অনেক প্রমাণ রহিয়াছে।
ভারত-সম্রাট্ অশোকের সম্প্রতি আবিষ্কৃত শিলালিপিতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। অশোক খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর লোক। তিনি গ্রীক রাজাদের সহিত সন্ধিপত্র সম্পাদন করিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে যে-সব অঞ্চলে খ্রীষ্টধর্ম প্রসার লাভ করে, সম্রাট্ অশোকের প্রেরিত প্রচারকগণ সেই-সকল স্থানে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা বিস্তার করিয়াছিলেন।
ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায়, খ্রীষ্টধর্মে কি করিয়া ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদ, অবতারবাদ এবং ভারতের নীতিতত্ত্ব আসিল এবং কেনই বা আমাদের দেশের মন্দিরের পূজার্চনার সহিত তোমাদের ক্যাথলিক গীর্জার ‘মাস্’১২ আবৃত্তি এবং ‘আশীর্বাদ’১৩ প্রভৃতি ধর্মকৃত্যের এত সাদৃশ্য। খ্রীষ্টধর্মের বহু আগে বৌদ্ধধর্মে এই-সকল জিনিষ প্রচলিত ছিল। এখন এই তথ্যগুলির উপর নিজেদের বিচার-বিবেচনা তোমরা প্রয়োগ করিয়া দেখ।
আমরা হিন্দুরা তোমাদের ধর্ম প্রাচীনতর, ইহা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত আছি, যদি যথেষ্ট প্রমাণ তোমরা উপস্থিত করিতে পার। আমরা তো জানি যে, তোমাদের ধর্ম যখন কল্পনাতেও উদ্ভূত হয় নাই, তাহার অন্ততঃ তিনশত বৎসর আগে আমাদের ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত।
বিজ্ঞান সম্বন্ধেও ইহা প্রযোজ্য। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের আর একটি দান বৈজ্ঞানিক- দৃষ্টিসম্পন্ন চিকিৎসকগণ। সার উইলিয়ম হাণ্টারের মতে বিবিধ রাসায়নিক পদার্থের আবিষ্কার এবং বিকল কর্ণ ও নাসিকার পুনর্গঠনের উপায় নির্ণয়ের দ্বারা ভারতবর্ষ আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করিয়াছে।
অঙ্কশাস্ত্রে ভারতের কৃতিত্ব আরও বেশী। বীজগণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও বর্তমান বিজ্ঞানের বিজয়গৌরবস্বরূপ মিশ্রগণিত-ইহাদের সবগুলিই ভারতবর্ষে উদ্ভাবিত হয়; বর্তমান সভ্যতার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ সংখ্যাদশকও ভারতমনীষার সৃষ্টি। দশটি সংখ্যাবাচক দশমিক (decimal) শব্দ বাস্তবিক সংস্কৃত ভাষার শব্দ।
দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা এখনও পর্যন্ত অপর যে কোন জাতি অপেক্ষা অনেক উপরে রহিয়াছি। প্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। সঙ্গীতে ভারত জগৎকে দিয়াছে প্রধান সাতটি স্বর এবং সুরের তিনটি গ্রাম সহ স্বরলিপি-প্রণালী। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দেও আমরা এইরূপ প্রণালীবদ্ধ সঙ্গীত উপভোগ করিয়াছি। ইওরোপে উহা প্রথম আসে মাত্র একাদশ শতাব্দীতে।
ভাষা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহা এখন সর্ববাদিসম্মত যে, আমাদের সংস্কৃত ভাষা যাবতীয় ইওরোপীয় ভাষার ভিত্তি। এই ভাষাগুলি বিকৃত উচ্চারণ-বিশিষ্ট সংস্কৃত ছাড়া আর কিছু নয়।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের মহাকাব্য, কাব্য ও নাটক অপর যে-কোন ভাষার শ্রেষ্ঠ রচনার সমতুল্য। জার্মানীর শ্রেষ্ঠ কবি আমাদের শকুন্তলা-নাটক সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে বলিয়াছেন, উহাতে ‘স্বর্গ ও পৃথিবী সম্মিলিত।’ ‘ঈসপ্স্ ফেব্ল্স্’ নামক প্রসিদ্ধ গল্পমালা ভারতেরই দান, কেননা ঈসপ্ একটি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে তাঁহার বই-এর উপাদান লইয়াছিলেন। ‘এরেবিয়ান নাইটস্’ নামক বিখ্যাত কথাসাহিত্য এমন কি ‘সিণ্ডারেলা’ ও ‘বরবটির ডাঁটা’ গল্পেরও উৎপত্তি ভারতেই।
বিবাহের পূর্বে নারীর নিজস্ব সম্পত্তি যদি কিছু থাকে, ভারতীয় আইন অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর তাহাতে তাঁহার অধিকার তো বজায় থাকিবেই, তা ছাড়া স্বামীর নিকট হইতে তিনি যাহা কিছু পাইয়াছিলেন এবং মৃত স্বামীর সাক্ষাৎ অপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকিলে তাঁহার সম্পত্তিও বিধবার দখলে আসিবে। পুরুষের সংখ্যা-ন্যূনতার জন্য ভারতে বিধবারা ক্বচিৎ পুনরায় বিবাহ করেন।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারতই প্রথম তুলা ও লাল রঙ উৎপাদন করে এবং সর্বপ্রকার অলঙ্কার-নির্মাণেও প্রভূত দক্ষতা দেখায়। চিনি ভারতে প্রথম প্রস্তুত হইয়াছিল। ইংরেজী ‘সুগার’ কথাটি সংস্কৃত শর্করা হইতে উৎপন্ন। সর্বশেষে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, দাবা তাস ও পাশা খেলা ভারতেই আবিষ্কৃত হয়। বস্তুতঃ সব দিক্ দিয়া ভারতবর্ষের উৎকর্ষ এত বিরাট ছিল যে, দলে দলে বুভুক্ষু ইওরোপীয় ভাগ্যান্বেষীরা ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হইতে থাকে এবং পরোক্ষভাবে এই ঘটনাই পরে আমেরিকা-আবিষ্কারের হেতু হয়।
এখন দেখা যাক-এই-সকলের পরিবর্তে জগৎ ভারতকে কি দিয়াছে। নিন্দা, অভিশাপ ও ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত-সন্তানদের রুধির-স্রোতের মধ্য দিয়া অপরে তাহার সমৃদ্ধির পথ করিয়া লইয়াছে ভারতকে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত করিয়া এবং ভারতের পুত্রকন্যাগণকে দাসত্বে ঠেলিয়া দিয়া। আর এখন আঘাতের উপর অপমান হানা হইতেছে ভারতে এমন একটি ধর্ম প্রচার করিয়া, যাহা পুষ্ট হইতে পারে শুধু অপর সমস্ত ধর্মের ধ্বংসের উপর।
কিন্তু ভারত ভীত নয়। সে কোন জাতির কৃপাভিখারী নয়। আমাদের একমাত্র দোষ এই যে, আমরা অপরকে পদদলিত করিবার জন্য যুদ্ধ করিতে পারি না, আমরা বিশ্বাস করি-সত্যের অনন্ত মহিমায়। বিশ্বের নিকট ভারতের বাণী হইল-প্রথমতঃ তাহার মঙ্গলেচ্ছা। অহিতের প্রতিদানে ভারত দিয়া চলে হিত। এই মহৎ আদর্শের উৎপত্তি ভারতেই। ভারত উহা কার্যে পরিণত করিতে জানে। পরিশেষে ভারতের বাণী হইলঃ প্রশান্তি সাধুতা ধৈর্য ও মৃদুতা আখেরে জয়ী হইবেই।
এক সময়ে যাহাদের পৃথিবীতে ছিল বিপুল অধিকার, সেই পরাক্রান্ত গ্রীক জাতি আজ কোথায়? তাহারা বিলুপ্ত। একদা যাহাদের বিজয়ী সৈন্যদলের পদভরে মেদিনী কম্পিত হইত, সেই রোমান জাতিই বা কোথায়? অতীতের গর্ভে। পঞ্চাশ বৎসরে যাহারা এক সময়ে অতলান্তিক মহাসাগর হইতে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিজয়-পতাকা উড্ডীন করিয়াছিল, সেই আরবরাই বা আজ কোথায়? কোথায় সেই লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষের নিষ্ঠুর হত্যাকারী স্প্যানিয়ার্ডগণ?
উভয় জাতিই আজ প্রায় বিলুপ্ত, তবে তাহাদের পরবর্তী বংশধরগণের ন্যায়পরতা ও দয়াধর্মের গুণে তাহারা সামূহিক বিনাশ হইতে রক্ষা পাইবে, পুনরায় তাহাদের অভ্যুদয়ের ক্ষণ আসিবে। বক্তৃতার শেষে স্বামী বিবেকানন্দকে করতালি দ্বারা সাদরে অভিনন্দিত করা হয়। ভারতের রীতি-নীতি সম্বন্ধে তিনি অনেকগুলি প্রশ্নেরও উত্তর দেন। গতকল্যকার (২৫ ফেব্রুআরী) ‘স্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ান’ পত্রিকায় ভারতবর্ষে বিধবাদের নির্যাতিত হওয়া লইয়া যে উক্তিটি প্রকাশিত হইয়াছে, উহার তিনি স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করেন।
বিবাহের পূর্বে নারীর নিজস্ব সম্পত্তি যদি কিছু থাকে, ভারতীয় আইন অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর তাহাতে তাঁহার অধিকার তো বজায় থাকিবেই, তা ছাড়া স্বামীর নিকট হইতে তিনি যাহা কিছু পাইয়াছিলেন এবং মৃত স্বামীর সাক্ষাৎ অপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকিলে তাঁহার সম্পত্তিও বিধবার দখলে আসিবে। পুরুষের সংখ্যা-ন্যূনতার জন্য ভারতে বিধবারা ক্বচিৎ পুনরায় বিবাহ করেন।
বক্তা আরও উল্লেখ করেন যে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীলোকের সহমরণ-প্রথা এবং জগন্নাথের রথচক্রে আত্মবলিদান সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ইহার প্রমাণের জন্য তিনি শ্রোতৃবৃন্দকে সার উইলিয়াম হাণ্টার প্রণীত ‘ভারত সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ নামক পুস্তিকাটি দেখিতে বলেন।
ভারতের বালবিধবাগণ-
‘ডেলী ঈগ্ল্’, ২৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের উদ্যোগে হিষ্টরিক্যাল হল-এ হিন্দুসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ সোমবার রাত্রে ‘জগতে ভারতবর্ষের দান’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। বক্তা যখন মঞ্চের উপর উঠেন, তখন মঞ্চে প্রায় আড়াই শত ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ব্রুকলিন রমাবাঈ সার্কেল-এর সভাপতি মিসেস জেম্স্ ম্যাক্কীন কয়েকদিন আগে ‘ভারতবর্ষে বালবিধবাদের উপর দুর্ব্যবহার করা হয় না।’-বক্তার এই উক্তিটির প্রতিবাদ করিয়াছিলেন।
ঐ প্রতিষ্ঠানটি ভারতে খ্রীষ্টমতানুগ সেবাকার্য করিয়া থাকে। বক্তার নিকট এই প্রতিবাদের প্রত্যুত্তর শুনিবার জন্য শ্রোতৃবৃন্দের খুব আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার ভাষণে ঐ বিষয়ের কোন উল্লেখ করেন নাই। তাঁহার বক্তৃতা শেষ হইলে একজন শ্রোতা ঐ প্রসঙ্গটি তুলেন এবং জিজ্ঞাসা করেন-ঐ সম্পর্কে তাঁহার কি বলিবার আছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, বালবিধবাদের প্রতি নির্যাতন বা কঠোর ব্যবহার করা হয়-এই সংবাদ সত্য নয়।
তিনি আরও বলেনঃ ইহা ঠিকই যে কোন কোন হিন্দুর বিবাহ হয় খুব অল্প বয়সে। অনেকে কিন্তু বেশ পরিণত বয়সেই বিবাহ করে। কেহ কেহ বা আদৌই বিবাহ করে না। আমার পিতামহের যখন বিবাহ হইয়াছিল, তখন তিনি একেবারেই বালক। আমার পিতা বিবাহ করেন চৌদ্দ বৎসর বয়সে। আমার বয়স ত্রিশ বৎসর, আমি এখনও বিবাহ করি নাই। স্বামী মারা গেলে তাঁহার যাবতীয় সম্পত্তি তাঁহার বিধবা পত্নী পান। দরিদ্রের ঘরে বিধবার কষ্ট অন্যান্য দেশে যেমন, ভারতেও সেইরূপ।
কখনও কখনও বৃদ্ধেরা বালিকা বিবাহ করে। এইরূপ স্বামী ধনী হইলে যত শীঘ্র মারা যায়, তাহার বিধবা স্ত্রীর পক্ষে ততই মঙ্গল। আমি ভারতের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়াছি, কিন্তু বিধবাদের প্রতি যে রূপ নির্যাতনের কথা প্রচার করা হইতেছে, ঐরূপ একটিও দেখিতে পাই নাই। এক সময়ে আমাদের দেশে এক ধরনের ধর্মোন্মত্ততা ছিল। তখন কখনও কখনও বিধবারা মৃত পতির জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করিয়া মৃত্যু বরণ করিতেন।
হিন্দু জনসাধারণ যে এই রীতি পছন্দ করিত, তাহা নয়, তবে উহা বন্ধ করিবার চেষ্টাও ছিল না। অবশেষে ব্রিটিশরা ভারত অধিকার করিলে ইহা নিষিদ্ধ হয়। সহমৃতা নারীকে সাধ্বী বলিয়া খুব সম্মান করা হইত। অনেক সময়ে তাঁহাদের স্মৃতিতে স্তম্ভাদি নির্মিত হইত।
হিন্দুদের কয়েকটি রীতিনীতি-
‘ব্রুকলিন ষ্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ন’, ৮ এপ্রিল, ১৮৯৫
গত রাত্রিতে ক্লিণ্টন এভিনিউ-স্থিত পউচ গ্যালারীতে ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের একটি বিশেষ সভায় হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতাই ছিল প্রধান কর্মসূচী। আলোচ্য বিষয় ছিলঃ ‘হিন্দুদের কয়েকটি রীতিনীতি-ঐগুলির তাৎপর্য ও কদর্থ।’ প্রশস্ত গ্যালারীটি একটি বৃহৎ জনতায় ভরিয়া গিয়াছিল।
পরিধানে প্রাচ্য পোষাক, উজ্জ্বল চক্ষু এবং মুখে প্রতিভার দীপ্তি লইয়া স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার স্বদেশ, উহার অধিবাসী এবং রীতিনীতি সম্বন্ধে বলিতে আরম্ভ করিলেন। বক্তা বলেন, শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট তিনি শুধু চান তাঁহার ও তাঁহার স্বদেশের প্রতি ন্যায়দৃষ্টি। তিনি ভাষণের প্রারম্ভে ভারত সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা উপস্থাপিত করিবেন। ভারত একটি দেশ নয়, মহাদেশ। যে-সব পর্যটক কখনও ভারতবর্ষে যান নাই, তাঁহারা উহার সম্বন্ধে অনেক ভুল মত প্রচার করিয়াছেন।
ভারতে নয়টি পৃথক্ প্রধান ভাষা আছে এবং প্রাদেশিক উপভাষার সংখ্যা একশতেরও বেশী। বক্তা তাঁহার স্বদেশ সম্বন্ধে যাঁহারা বই লিখিয়াছেন, তাঁহাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, এই-সব ব্যক্তির মস্তিষ্ক কুসংস্কার দ্বারা বিকৃত হইয়া গিয়াছে। ইঁহাদের একটি ধারণা যে, ইঁহাদের ধর্মের গণ্ডীর বাহিরে প্রত্যেকটি লোক ভয়ানক শয়তান। হিন্দুদের দন্তধাবন-প্রণালীর অনেক সময়ে কদর্থ করা হইয়া থাকে।
তাহারা মুখে পশুর লোম বা চামড়া ঢুকাইবার পক্ষপাতী নয় বলিয়া বিশেষ কয়েকটি গাছের ছোট ডাল দিয়া দাঁত পরিষ্কার করে। জনৈক পাশ্চাত্য লেখক এই জন্য লিখিয়াছেন, ‘হিন্দুরা প্রত্যূষে শয্যাত্যাগ করিয়া একটি গাছ গিলিয়া ফেলে।’ বক্তা বলেন যে, হিন্দুবিধবাদের জগন্নাথের রথচক্রের নীচে আত্মব
লিদানের রীতি কখনও ছিল না। এই গল্প যে কিভাবে চালু হইল, তাহা বুঝা ভার।
জাতিভেদ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের মন্তব্যগুলি ছিল খুব ব্যাপক এবং চিত্তাকর্ষক। ভারতীয় জাতিপ্রথা উচ্চাবচ শ্রেণীতে বিভক্ত নয়। প্রত্যেকটি জাতি নিজের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ। জাতিপ্রথা কোন ধর্মকৃত্য নয়, উহা হইল বিভিন্ন কারিগরীর বিভাগ-ব্যবস্থা। স্মরণাতীত কাল হইতে উহা মানবসমাজে প্রচলিত রহিয়াছে। বক্তা ব্যাখ্যা করিয়া দেখান-কীভাবে সমাজে প্রথমে কয়েকটি মাত্র নির্দিষ্ট অধিকার বংশানুক্রমিক ছিল। পরে চলিল প্রত্যেকটি শ্রেণীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন এবং বিবাহ ও পানাহারকে সীমাবদ্ধ করা হইল নিজ নিজ শ্রেণীর মধ্যে।
হিন্দুগৃহে খ্রীষ্টান বা মুসলমানের উপস্থিতিতে কি প্রভাব হয়, বক্তা তাহা বর্ণনা করেন। কোন শ্বেতকায় ব্যক্তি হিন্দুদের ঘরে ঢুকিলে ঘর অশুচি হইয়া যায়। বিধর্মী গৃহে আসিলে গৃহস্বামী প্রায়ই পরে স্নান করিয়া থাকেন। অন্ত্যজ জাতিদের প্রসঙ্গে বক্তা বলেন যে, উহারা সমাজে মেথরের কাজ, ঝাড়ুদারি প্রভৃতি কাজ করিয়া থাকে এবং উহারা গলিত মাংসভোজী।
তিনি আরও বলেন যে, ভারত সম্বন্ধে যে-সকল পাশ্চাত্য লেখক বই লিখিয়াছেন, তাঁহারা সমাজের এই-সকল নিম্নস্তরের লোকের সংস্পর্শেই আসিয়াছেন, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জীবনের সহিত তাঁহাদের পরিচয় ঘটে নাই। জাতির নিয়ম-কানুন ভাঙিলে কি শাস্তি হয়, তাহা বক্তা বর্ণনা করেন। শাস্তি শুধু এই যে, নিয়মভঙ্গকারী যে-জাতির অন্তর্ভুক্ত, সেই জাতির মধ্যে বৈবাহিক আদান-প্রদান ও পানাহার তাঁহার ও তাঁহার সন্তানগণের পক্ষে নিষিদ্ধ। এই সম্পর্কে অন্য যে-সব ধারণা পাশ্চাত্যে প্রচারিত, তাহা অতিরঞ্জিত ও ভুল।
জাতিপ্রথার দোষ দেখাইতে গিয়া বক্তা বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না দিয়া এই প্রথা জাতির কর্মজীবনে জড়তার সৃষ্টি করিয়াছে এবং তাহাতে জনগণের অগ্রগতি সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত হইয়াছে। এই প্রথা সমাজকে পাশবিক রেষারেষি হইতে মুক্ত রাখিয়াছে সত্য, কিন্তু অন্যদিকে উহা সামাজিক উন্নতি রুদ্ধ করিয়াছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ করিয়া উহা প্রজাবৃদ্ধি ঘটাইয়াছে। জাতিপ্রথার সপক্ষে বক্তা বলেন যে, উহাই সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের একমাত্র কার্যকর আদর্শ।
কাহারও আর্থিক অবস্থা জাতিতে তাহার উচ্চাবচ স্থানের পরিমাপক নয়। জাতির মধ্যে প্রত্যেকেই সমান। বড় বড় সমাজ সংস্কারকগণের সকলেরই চিন্তায় একটি মস্ত ভুল হইয়াছিল। জাতিপ্রথার যথার্থ উৎপত্তি-সূত্র যে সমাজের একটি বিশিষ্ট পরিবেশ, উহা দেখিতে না পাইয়া তাঁহারা মনে করিয়াছিলেন ধর্মের বিধিনিষেধই ঐ প্রথার জনক। বক্তা ইংরেজ ও মুসলমান শাসকগণের দেশকে বেয়নেট, গোলাবারুদ এবং তরবারির সাহায্যে সুসভ্য করিবার চেষ্টার তীব্র নিন্দা করেন।
তাঁহার মতে জাতিভেদ দূর করিতে হইলে সামাজিক অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন এবং দেশের সমগ্র অর্থনৈতিক প্রণালীর ধ্বংস-সাধন একান্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইহা অপেক্ষা বরং বঙ্গোপসাগরের জলে সকলকে ডুবাইয়া মারা শ্রেয়ঃ। ইংরেজী সভ্যতার উপাদান হইল তিনটি ‘ব’-বাইবেল, বেয়নেট ও ব্রাণ্ডি।
ইহারই নাম সভ্যতা। এই সভ্যতাকে এতদূর পর্যন্ত লইয়া যাওয়া হইয়াছে যে, একজন হিন্দুর গড়ে মাসিক আয় ৫০ সেণ্টে গিয়া দাঁড়াইয়াছে। রাশিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে এবং বলিতেছে, ‘আমরাও একটু সভ্যতা লইয়া আসি।’ ইংলণ্ডের সভ্যতা বিস্তার কিন্তু চলিতেছেই।
সন্ন্যাসী বক্তা মঞ্চের উপর একদিক হইতে অপর দিকে পায়চারি করিতে করিতে হিন্দুদের প্রতি কিভাবে অবিচার করা হয়, ইহা বর্ণনা করিবার সময় খুব উত্তেজিত হইয়া উঠেন। তাঁহার কথাও বেশ দ্রুত গতিতে চলে। বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত হিন্দুদের কটাক্ষ করিয়া তিনি বলেন যে, তাহারা স্বদেশে ফিরিবে শ্যাম্পেন এবং বিজাতীয় নূতন ভাবে পুরাপুরি দীক্ষা লইয়া। বাল্যবিবাহকে নিন্দা করিবার এত ধুম কেন? না-সাহেবরা বলিয়াছে, উহা খারাপ।
হিন্দুগৃহে শাশুড়ী পুত্রবধূকে যদি নিপীড়ন করে তো তাহার কারণ এই যে, পুত্র প্রতিবাদ করে না। বক্তা বলেন, বিদেশীরা যে-কোন সুযোগে হিন্দুদের উপর গালিবর্ষণ করিতে উন্মুখ, কেননা তাঁহাদের নিজেদের এত বেশী দোষ আছে যে, তাঁহারা উহা ঢাকা দিতে চান। তাঁহার মতে প্রত্যেক জাতিকে নিজের মুক্তিসাধন নিজেই করিতে হইবে, অন্য কেহ উহার সমস্যার সমাধান করিয়া দিতে পারে না।
বিদেশী ভারত-বন্ধুদের প্রসঙ্গে বক্তা জিজ্ঞাসা করেন, আমেরিকায় ডেভিড হেয়ারের কথা কেহ কখনও শুনিয়াছেন কিনা? ইনি ভারতে নারীদের জন্য প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের অধিকাংশ শিক্ষা প্রচারের জন্য ব্যয় করেন। বক্তা অনেকগুলি ভারতীয় প্রবাদ-বাক্য শুনান। ঐগুলি আদৌ ইংরেজগণের প্রশংসাসূচক নয়। ভারতের জন্য একটি ব্যাকুল আবেদন প্রকাশ করিয়া তিনি বক্তৃতার সমাপ্তি করেন।
তিনি বলেন, ‘ভারত যতদিন তাহার নিজের প্রতি ও স্বধর্মের প্রতি খাঁটি থাকিবে, ততদিন কোন আশঙ্কার কারণ নাই। কিন্তু ঈশ্বরজ্ঞানহীন এই ভয়ানক পাশ্চাত্য যখন ভারতে ভণ্ডামি ও নাস্তিকতা রপ্তানি করে, তখনই ভারতের বুকে প্রচণ্ড আঘাত হানা হয়। ঝুড়ি ঝুড়ি গালাগালি, গাড়ী-বোঝাই তিরস্কার এবং জাহাজ-ভর্তি নিন্দা না পাঠাইয়া অন্তহীন একটি প্রীতির স্রোত লইয়া আসা হউক। আসুন, আমরা সকলে মানুষ হই।’
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….