ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

[প্রথমবার আমেরিকায় অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নে লিখিত]

আমাদের সর্ববিধ জ্ঞানের ভিতর অনুস্যূত রহিয়াছে সেই প্রাচীন সমস্যা-বীজ বৃক্ষের পূর্বে, না বৃক্ষ বীজের পূর্বে, সত্তার অভিব্যক্তির ক্রমে চৈতন্য প্রথম, না জড় প্রথম; ভাব প্রথম, না বাহ্য প্রকাশ প্রথম; মুক্তি আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, না নিয়মের বন্ধন; চিন্তা জড়ের স্রষ্টা, না জড় চিন্তার স্রষ্টা; প্রকৃতিতে নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন স্থিতির পূর্বের অবস্থা, না স্থিতির ভাবটি পরিবর্তনের পূর্বের অবস্থা-এই-সব প্রশ্নের সমাধান সমভাবেই দুরূহ।

তরঙ্গমালার পর্যায়ক্রমে উত্থান ও পতনের মত উপরি-উক্ত প্রশ্নগুলিও অনিবার্য পরম্পরায় একটি আর একটিকে অনুসরণ করে এবং মানুষ তাহার রুচি, শিক্ষা বা মানসিক গঠনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোন-না-কোন একটি পক্ষ সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা যায় যে, প্রকৃতির বিভিন্ন অংশগুলির ভিতর যে-সঙ্গতি রহিয়াছে, তাহা দেখিয়া স্পষ্ট মনে হয়-উহা চেতনাত্মক কার্যেরই ফল।

পক্ষান্তরে তর্ক করা যাইতে পারে, চৈতন্যের অস্তিত্ব জগৎ সৃষ্টির পূর্বে থাকা সম্ভব নয়, কারণ বিবর্তনের ফলে উহা জড় এবং শক্তির দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে। যদি বলা যায়, প্রতিটি রূপের পশ্চাতে মনে একটি ভাবাদর্শ অবশ্যই থাকিবে, তাহা হইলে সমান জোর দিয়া বলিতে পারা যায়, ভাবাদর্শের সৃষ্টিই হইয়াছিল বহুবিধ বাহ্য অভিজ্ঞতার দ্বারা। একদিকে মুক্তি সম্বন্ধে আমাদের চিরন্তন ধারণার প্রতি আবেদ।

অপরদিকে এ ধারণাও রহিয়াছে যে, জগতে কোন কিছুই কারণহীন নয় বলিয়া কি স্থূল, কি মানসিক-সব কিছুই কার্য-কারণ-নিয়মের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। শক্তির দ্বারা উৎপন্ন শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করিবার পর যদি স্বীকার করা যায়, চিন্তাই স্পষ্টতঃ এই শরীরের স্রষ্টা, তাহা হইলে ইহাও স্পষ্ট যে, শরীরের পরিবর্তনে চিন্তার পরিবর্তন হয় বলিয়া শরীর নিশ্চয়ই মনের স্রষ্টা।

যদি যুক্তি প্রদর্শন করা যায়, সর্বজনীন পরিবর্তন নিশ্চয়ই একটি পূর্ববর্তী স্থিতির ফলস্বরূপ, তাহা হইলে সমান যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা যাইবে যে, অপরিবর্তনীয়তার ভাব একটি বিভ্রমজনক আপেক্ষিক ধারণা মাত্র, গতির তুলনামূলক প্রভেদের দ্বারা ইহার উদ্ভব হইয়াছে।

এইরূপে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সমস্ত জ্ঞানই এই বিষচক্রে পর্যবসিত হয়; কার্য ও কারণের অনির্দিষ্ট পরস্পর নির্ভরশীলতাই এই চক্র-ইহার ভিতর কোন্‌টি আগে, কোন্‌টি পরে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। যুক্তির নিয়মে বিচার করিলে এই জ্ঞান ভুল; এবং সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত কথা এই যে, এই জ্ঞান ভুল প্রমাণিত হয়, যথার্থ জ্ঞানের সহিত তুলনা করিয়া নয়, পরন্তু সেই একই বিষচক্রের উপর নির্ভরশীল নিয়মগুলিরই দ্বারা।

সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যায়, আমাদের সমস্ত জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহা নিজেই নিজের অপরিপূর্ণতা প্রমাণ করে। আবার আমরা ইহাও বলিতে পারি না যে, এই জ্ঞান মিথ্যা, কারণ যে-সব সত্য আমরা জানি বা চিন্তা করি, সেগুলি এই জ্ঞানের ভিতর রহিয়াছে। আবার ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সব কিছুর জন্যই এই জ্ঞান যে যথেষ্ট, এ-কথা অস্বীকার করিতেও পারা যায় না।

মানুষের সম্মুখে একটি মুক্তির আদর্শ থাকিলে তবেই চারিত্র-নীতির সার্থকতা। পূর্ণ মুক্তিলাভের সম্ভাবনার প্রশ্ন ছাড়িয়া দিলেও ইহা স্পষ্ট যে, সমগ্র বিশ্বই হইতেছে বিস্তারের জন্য সংগ্রামের, বা অন্য ভাষায় বলিতে গেলে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা; একটি পরমাণুর জন্যও এই অনন্ত বিশ্ব যথেষ্ট স্থান নয়। বিস্তারের জন্য এই সংগ্রাম অনন্তকাল ধরিয়া চলিবেই, যতদিন না মুক্তিলাভ হয়।

অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ-মানবিক জ্ঞানের এই অবস্থার অন্তর্গত এবং ইহাকেই বলা হয় ‘মায়া’। ইহা মিথ্যা, কারণ ইহা নিজেই নিজের অশুদ্ধতা প্রমাণ করে। আর এই অর্থে ইহা সত্য যে, ইহা পশু-মানবের সকল প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট।

বহির্জগতে ক্রিয়াকালে মায়া নিজেকে প্রকাশ করে আকর্ষণী ও বিকর্ষণী শক্তিরূপে এবং অন্তর্জগতে-প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি-রূপে। সমগ্র জগৎ বাহিরের দিকে ধাবিত হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। প্রতিটি পরমাণু উহার কেন্দ্র হইতে দূরে সরিয়া যাইবার জন্য সচেষ্ট। অন্তর্জগতে প্রতিটি চিন্তা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। আবার বহির্জগতে প্রতিটি কণা আর একটি শক্তি-কেন্দ্রাভিগ শক্তি দ্বারা নিরুদ্ধ হইতেছে; এই শক্তি কণাটিকে কেন্দ্রের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।

সেইরূপ চিন্তাজগতে সংযম-শক্তি এই-সব বহির্মুখী প্রবৃত্তিগুলিকে সংযত করিতেছে। জড়ের দিকে অগ্রসর হইবার প্রবৃত্তি অর্থাৎ যন্ত্রবৎ চালিত হইবার দিকে ক্রমশঃ নামিয়া যাইবার প্রবৃত্তি পশু-মানবের ধর্ম। যখন ইন্দ্রিয়ের বন্ধন রোধ করিবার ইচ্ছা মানুষের হয়, শুধু তখনই তাহার মনে ধর্মের উদয় হয়। এইরূপে আমরা দেখি যে, ধর্মের কার্যক্ষেত্র হইতেছে মানুষকে ইন্দ্রিয়ের বন্ধনে পড়িতে না দেওয়া এবং মুক্তিলাভের জন্য তাহাকে সাহায্য করা।

সেই উদ্দেশ্যে নিবৃত্তিশক্তির প্রথম প্রয়াসকে বলা হয় নীতি। সকল নীতির উদ্দেশ্য হইতেছে এই অধঃপতনকে রোধ করা ও এই বন্ধনকে ভাঙিয়া ফেলা। সকল চারিত্র-নীতিকে ‘বিধি’ ও ‘নিষেধ’-এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এই নীতি বলে, ‘ইহা কর’, না হয় বলে, ‘ইহা করিও না’।

যখন ইহা বলে, ‘করিও না’, তখন স্পষ্টই বুঝিয়া লইতে হইবে যে, একটি বাসনাকে সংযত করিতে বলা হইতেছে, যে-বাসনা মানুষকে ক্রীতদাস করিয়া ফেলিবে। আর যখন ইহা বলে, ‘কর’, তখন ইহার উদ্দেশ্য হইতেছে-মানুষকে মুক্তির পথ দেখান এবং যে-কোন অধঃপতন মানুষের হৃদয়কে পূর্বেই অধিকার করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা নষ্ট করিয়া দেওয়া।

মানুষের সম্মুখে একটি মুক্তির আদর্শ থাকিলে তবেই চারিত্র-নীতির সার্থকতা। পূর্ণ মুক্তিলাভের সম্ভাবনার প্রশ্ন ছাড়িয়া দিলেও ইহা স্পষ্ট যে, সমগ্র বিশ্বই হইতেছে বিস্তারের জন্য সংগ্রামের, বা অন্য ভাষায় বলিতে গেলে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা; একটি পরমাণুর জন্যও এই অনন্ত বিশ্ব যথেষ্ট স্থান নয়। বিস্তারের জন্য এই সংগ্রাম অনন্তকাল ধরিয়া চলিবেই, যতদিন না মুক্তিলাভ হয়।

ইহা বলা যাইতে পারে না যে, সন্তাপ এড়ান বা আনন্দলাভই এই মুক্তি-সংগ্রামের উদ্দেশ্য। যাহাদের ভিতর এইরূপ বোধশক্তি নাই, সেই নিম্নতম পর্যায়ের প্রাণীরাও বিস্তারের অন্য প্রয়াস করিতেছে এবং অনেকের মতে মানুষ নিজেই এই-সকল প্রাণীর বিস্তার।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!