-স্বামী বিবেকানন্দ
যা প্রীতিরবিবেকানাং বিষয়েষ্বনপায়িনী।
ত্বামনুস্মরতঃ সা মে হৃদয়ান্মাপসর্পতু॥১
বিবেকহীন ব্যক্তিগণের ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়সমূহের প্রতি যেরূপ প্রগাঢ় প্রীতি, তোমার জন্য ব্যাকুল আমার এই হৃদয় হইতে সেইরূপ প্রীতি যেন কখনও দূর না হয়।
প্রহ্লাদের এই উক্তিটিই ভক্তির সর্বোকৃষ্ট সংজ্ঞা বলিয়া মনে হয়।
আমরা দেখিতে পাই, যাহারা উচ্চতর কিছু জানে না, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে—টাকাকড়ি, বেশভূষা, স্ত্রীপুত্র, বন্ধুবান্ধব ও সম্পত্তিতে—তাহাদের কি দারুণ প্রীতি, কি প্রচণ্ড আসক্তি! তাই ভক্তরাজ প্রহ্লাদ পূর্বোক্ত শ্লোকে বলিতেছেন, ‘আমি কেবল তোমার প্রতি ঐরূপ প্রবলভাবে অনুরক্ত হইব, কেবল তোমাকে ঐরূপ প্রাণের সহিত ভালবাসিব, আর কাহাকেও নয়।’ এই প্রীতি, এই আসক্তি ঈশ্বরে প্রযুক্ত হইলেই তাহা ‘ভক্তি’ আখ্যা লাভ করে।
ভক্তিতে কিছুই ধ্বংস করিতে হয় না। ভক্তিযোগে বলা হয়, আমাদের কোন প্রবৃত্তিই বৃথা নয়, বরং ঐগুলির সাহায্যেই আমরা স্বাভাবিক উপায়ে মুক্তিলাভ করিয়া থাকি। ভক্তি কোন প্রবৃত্তিকে জোর করিয়া নষ্ট করে না,—ভক্তি প্রকৃতির বিরোধী হয় না, শুধু মোড় ফিরাইয়া উহাকে উচ্চতর পথে বেগে চালিত করিয়া দেয়।
আমরা কত স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়গুলি ভালবাসি, ঐগুলিকে না ভালবাসিয়া আমরা থাকিতে পারি না, কারণ ঐগুলি আমাদের নিকট পরম সত্য বলিয়া প্রতীত হয়। আমরা সাধারণতঃ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় অপেক্ষা উচ্চতর বস্তুর সত্যতা বুঝিতে পারি না। যখন মানুষ ইন্দ্রিয়াতীত—পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাহিরে অবস্থিত—কোন সত্য অনুভব করে, তখনও তাহার আসক্তি থাকিতে পারে, তবে উহাকে বিষয়ে আবদ্ধ না রাখিয়া সেই ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু—ঈশ্বরের প্রতি প্রয়োগ করিতে হইবে।
আর পূর্বে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে যে প্রীতি বা অনুরাগ ছিল, তাহা যখন ঈশ্বরের প্রতি প্রযুক্ত হয়, তখন তাহাকেই ‘ভক্তি’ বলে। রামানুজাচার্যের মতে এই প্রবল অনুরাগ বা ভক্তিলাভের জন্য নিম্নলিখিত সাধন-প্রণালী অর্থাৎ উপায়গুলি অনুষ্ঠান করিতে হয়।
কতকগুলি খাদ্য উত্তেজক—সেইগুলি খাইলে দেখিবেন, মনকে সংযত করিতে পারিতেছেন না। অধিক পরিমাণে সুরা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য পান করিলে মানুষ বুঝিতে পারে, মনকে আর সংযত রাখা যাইবে না। মন তাহার আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়।
প্রথমতঃ ‘বিবেক’। এই বিবেক-সাধনটি বিশেষতঃ পাশ্চাত্যবাসীদের নিকট একটি অদ্ভুত জিনিষ। রামানুজের মতে ইহার অর্থ ‘খাদ্যাখাদ্যের বিচার।’ যে-সকল উপাদানে দেহ ও মনের বিভিন্ন শক্তি গঠিত হয়, খাদ্যের মধ্যে সেইগুলি বিদ্যমান; আমি এখন যেরূপ শক্তি প্রকাশ করিতেছি, তাহার সবই আমার ভুক্ত খাদ্যের মধ্যে ছিল; আমার দেহমনের ভিতর উহা পরিবর্তিত, সঞ্চিত ও নূতনদিকে চালিত হইয়াছে মাত্র, কিন্তু ভুক্ত খাদ্যদ্রব্যের সহিত আমার দেহমনের স্বরূপতঃ কোন প্রভেদ নাই।
বহির্জগতে জড়বস্তু ও শক্তি আমাদের ভিতর দেহ ও মনের আকার ধারণ করে, দেহ মন এবং খাদ্যের মধ্যে প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে। তাই যদি হইল, অর্থাৎ যদি আমাদের খাদ্যের জড়কণাগুলি হইতে আমরা চিন্তাশক্তির যন্ত্র প্রস্তুত করি, আর ঐ কণাগুলির মধ্যবর্তী সূক্ষ্মতর শক্তিসমূহ হইতে আমরা চিন্তাও উৎপন্ন করি, তবে ইহাও সহজেই প্রমাণিত হইবে যে, এই চিন্তাশক্তি ও তাহার যন্ত্র উভয়ই আমাদের ভুক্ত খাদ্যদ্রব্যের দ্বারা প্রভাবিত হইবে, বিশেষ প্রকার খাদ্য মনে বিশেষ প্রকার পরিবর্তন উৎপাদন করিবে; প্রতিদিনই আমরা ইহা দেখিয়া থাকি।
আরও কত প্রকার খাদ্য আছে, সেগুলি শরীরে পরিবর্তন সাধন করে, পরিণামে মনকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ইহা একটি বিশেষ শিক্ষণীয় তত্ত্ব; আমরা যত দুঃখভোগ করিয়া থাকি, তাহার অধিকাংশই আমাদের আহার হইতে জাত।
আপনারা দেখিয়াছেন, অতিরিক্ত ও গুরুপাক ভোজনের পর মনকে সংযত করা বড়ই কঠিন, তখন মন অবিরত ছুটিতে থাকে! কতকগুলি খাদ্য উত্তেজক—সেইগুলি খাইলে দেখিবেন, মনকে সংযত করিতে পারিতেছেন না। অধিক পরিমাণে সুরা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য পান করিলে মানুষ বুঝিতে পারে, মনকে আর সংযত রাখা যাইবে না। মন তাহার আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়।
রামানুজাচার্যের মতে খাদ্যসম্বন্ধীয় ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য। প্রথমতঃ ‘জাতিদোষ’। জাতিদোষ-অর্থে সেই খাদ্যবিশেষের প্রকৃতিগত দোষ বুঝায়। সর্বপ্রকার উত্তেজক খাদ্য পরিত্যাগ করিতে হইবে, যথা—মাংস। মাংসাহার ত্যাগ করিতে হইবে, কারণ উহা স্বভাবতই অপবিত্র। অন্যের প্রাণনাশ করিয়া তবে মাংস পাইতে পারি। মাংস খাইয়া আমরা ক্ষণিক সুখ পাই, আর আমাদের সেইটুকু সুখের জন্য একটি প্রাণীকে তাহার প্রাণ দিতে হয়।
শুধু তাই নয়, এজন্য আমরা মানুষেরও অবনতির কারণ হইয়া থাকি। মাংসাশী প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজে সেই প্রাণীটি হত্যা করিত, তাহা হইলে বরং ভাল হইত। তাহা না করিয়া সমাজ একদল লোক সৃষ্টি করিয়া তাহাদের দ্বারা এই কাজ করাইয়া লয়, আবার সেই হত্যাকার্যের জন্য সমাজ তাহাদিগকে ঘৃণা করে। এখানকার আইন জানি না, কিন্তু ইংলণ্ডে কসাই কখনও জুরির আসন গ্রহণ করিতে পারে না—ভাবটা এই যে, কসাই স্বভাবতঃ নিষ্ঠুর।
তাহাকে নিষ্ঠুর করিয়াছে কে?—সমাজ। আমরা যদি মাংস ভক্ষণ না করিতাম, তবে কেহ কখনই কসাই হইত না। মাংসভক্ষণ কেবল তাহারাই করিতে পারে, যাহাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিতে হয়, এবং যাহারা ভক্তিযোগ-সাধনে প্রবৃত্ত হইতেছে না। কিন্তু ভক্ত হইতে গেলে মাংসভোজন পরিত্যাগ করিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য উত্তেজক খাদ্য, যথা—পেঁয়াজ, রসুন, সাওয়ারক্রট (Sauerkraut)২ প্রভৃতি দুর্গন্ধ খাদ্য ত্যাগ করিতে হইবে। আরও পূতি, পর্যুষিত এবং যাহার স্বাভাবিক রস প্রায় শুকাইয়া গিয়াছে, এরূপ খাদ্যও বর্জন করিতে হইবে।৩
খাদ্য সম্বন্ধে দ্বিতীয় দোষের নাম ‘আশ্রয়দোষ’। পাশ্চাত্যগণের পক্ষে এটি বুঝা আরও কঠিন। ‘আশ্রয়দোষ’ অর্থে বুঝিতে হইবে, যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য আসিতেছে, তাহার সংস্পর্শে খাদ্যে যে দোষ জন্মে। এটি হিন্দুদের একটি রহস্যপূর্ণ মতবাদ। ইহার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির দেহের চতুর্দিকে এক প্রকার জ্যোতি রহিয়াছে। ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাতেই যেন তাহার প্রভাব, তাহার মনের—তাহার চরিত্রের বা ভাবের কিছু অংশ লাগিয়া থাকে।
প্রত্যেক ব্যক্তির দেহ হইতে তাহার শক্তির মত চরিত্রবৈশিষ্ট্যও যেন বহির্গত হইতেছে, আর ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাই তাহা দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতএব রন্ধনের সময় কে আমাদের খাদ্য স্পর্শ করিল, সে-দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কোন দুশ্চরিত্র বা মন্দ ব্যক্তি যেন উহা স্পর্শ না করে। যিনি ভক্ত হইতে চান, তিনি যাহাদিগকে অসচ্চরিত্র বলিয়া জানেন, তাহাদের সহিত একসঙ্গে খাইতে বসিবেন না, কারণ খাদ্যের মধ্য দিয়া তাঁহার ভিতর অসদ্ভাব সংক্রামিত হইবে।
তৃতীয় ‘নিমিত্তদোষ’। এটি বুঝা খুব সহজ। খাদ্যে ধূলি প্রভৃতি সংস্পর্শ যেন কখনও না হয়। বাজার হইতে রাজ্যের ধূলিযুক্ত খাবার আনিয়া, উত্তমরূপে পরিষ্কার না করিয়া টেবিলের উপর রাখা ঠিক নয়। থুতু, লালা প্রভৃতি হইতেও সাবধান হইতে হইবে। ঈশ্বর আমাদিগকে সব জিনিষ ধুইবার জন্য যথেষ্ট জল দিয়াছেন!
অতএব ঠোঁটে আঙুল ঠেকাইয়া লালা দ্বারা সব জিনিষ স্পর্শ করার মত কদর্য অভ্যাস আর কিছুই নাই। শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী (mucous membrane) শরীরের মধ্যে অতি কোমলাংশ, এগুলি হইতে নিঃসৃত লালা দ্বারা অতি সহজে সমুদয় ভাব সংক্রামিত হয়। কোন দ্রব্যে লালার স্পর্শ—শুধু দোষাবহ নয়, বিপজ্জনক। তারপর একজন যে জিনিষের আধখানা কামড়াইয়া খাইয়াছে, তাহা খাওয়া উচিত নয়; যথা, একজন একটা আপেল এক কামড় খাইয়া বাকীটা অপরকে খাইতে দেয়, এরূপ করা উচিত নয়।
খাদ্য সম্বন্ধে পূর্বোক্ত দোষগুলি বর্জন করিলে খাদ্য শুদ্ধ হয়। আহারশুদ্ধি হইলে মনও শুদ্ধ হয়, মন শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ মনে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে—‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।’৪
রামানুজাচার্যের উপনিষদের ঐ শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আর একজন ভাষ্যকার—শঙ্করাচার্য ঐ বাক্যের অন্যপ্রকার অর্থ করিয়াছেন। ‘আহ্রিয়তে ইতি আহারঃ’—যাহা কিছু গ্রহণ করা হয়, তাহাই আহার, সুতরাং তাঁহার মতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহই আহার। তিনি কিভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন? ‘আহারশুদ্ধি’র প্রকৃত অর্থ—ইন্দ্রিয়-বিষয়ে আসক্ত না হওয়ার জন্য আমাদের এই দোষগুলি বর্জন করিতে হইবেঃ প্রথমতঃ আসক্তিরূপ দোষ ত্যাগ করিতে হইবে; ঈশ্বর ব্যতীত আর কোন বিষয়ে প্রবল আসক্তি থাকিবে না।
সব দেখুন, সবকিছু করুন, সব স্পর্শ করুন, কিন্তু আসক্ত হইবেন না। যখনই মানুষের কোন বিষয়ে তীব্র আসক্তি হয়, তখনই সে নিজেকে হারাইয়া ফেলে, নিজের উপর তাহার কোন প্রভুত্ব থাকে না, সে দাস হইয়া যায়। যদি কোন নারী কোন পুরুষের প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত হয়, তবে সে ঐ পুরুষের দাসী হইয়া পড়ে; পুরুষও তেমনি নারীর প্রতি আসক্ত হইলে তাহার দাসবৎ হইয়া যায়। কিন্তু দাস হইবার তো কোন প্রয়োজন নাই।
একজনের দাস হওয়া অপেক্ষা এই জগতে অনেক বড় বড় কাজ আছে। সকলকেই ভালবাসুন, সকলেরই কল্যাণ সাধন করুন, কিন্তু কাহারও দাস হইবেন না। প্রথমতঃ উহা তো আমাদিগকে অধঃপতিত করিয়া দেয়; দ্বিতীয়তঃ উহাতে অপরের প্রতি ব্যবহারে আমাদিগকে ঘোর স্বার্থপর করিয়া তুলে, এই দুর্বলতার দরুন আমরা যাহাদিগকে ভালবাসি, তাহাদের ভাল করিবার জন্য অপরের অনিষ্ট সাধন করিতে চাই। জগতে যত কিছু অন্যায় কার্য অনুষ্ঠিত হয়, তাহার অধিকাংশ প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আসক্তিবশতঃ ঘটিয়া থাকে।
অতএব এইরূপ সমুদয় আসক্তি ত্যাগ করিতে হইবে, কেবল সৎকর্মে আসক্তি রাখিতে হইবে, এবং সকলকেই ভালবাসিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ কোন ইন্দ্রিয়-বিষয় লইয়া যেন আমাদের দ্বেষ উৎপন্ন না হয়। ঈর্ষা বা দ্বেষ সমুদয় অনিষ্টের মূল, আর উহা জয় করা বড়ই কঠিন। তৃতীয়তঃ মোহ। আমরা সর্বদাই এক বস্তুকে অন্য বস্তু বলিয়া ভ্রম করিতেছি ও তদনুসারে কার্য করিতেছি, আর তাহার ফল এই হইতেছে যে, আমরা নিজেদের দুঃখকষ্ট নিজেরাই সৃষ্টি করিতেছি।
আমরা মন্দকে ভাল বলিয়া গ্রহণ করিতেছি। যাহা কিছু ক্ষণকালের জন্য আমাদের স্নায়ুমণ্ডলীকে উত্তেজিত করে, তাহাকে সর্বোত্তম বস্তু মনে করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা লইয়া মাতিয়া যাইতেছি; কিছু পরেই দেখিলাম, তাহা হইতে একটা খুব আঘাত পাইয়াছি, কিন্তু তখন আর ফিরিবার পথ নাই। প্রতিদিনই আমরা এই ভ্রমে পড়িতেছি, এবং অনেক সময় সারা জীবনটাই আমরা ঐ ভুল লইয়া থাকি।
শঙ্করাচার্যের মতে এই পূর্বোক্ত রাগদ্বেষমোহরূপ ত্রিবিধদোষ-বর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়-বিষয়সমূহ গ্রহণ করাকেই ‘আহারশুদ্ধি’ বলে। এই আহারশুদ্ধি হইলেই সত্ত্বশুদ্ধি হয়, অর্থাৎ তখন মন ইন্দ্রিয়বিষয়সমূহ গ্রহণ করিয়া, রাগদ্বেষমোহ-বর্জিত হইয়া চিন্তা করিতে পারে। এইরূপে সত্ত্বশুদ্ধি হইলে সেই শুদ্ধ মনে সর্বদা ঈশ্বরের স্মরণ-মনন চলিতে থাকে।
স্বভাবতই আপনারা সকলে বলিবেন যে, শঙ্করাচার্যকৃত এই ব্যাখ্যাই উৎকৃষ্ট। তাহা হইলেও বলিতেছি, রামানুজকৃত ব্যাখ্যাটিকে অবহেলা করা চলিবে না। স্থূল খাদ্য শুদ্ধ হইলে বাকীগুলিও শুদ্ধ হইবে। ইহা অতি সত্য কথা যে, মনই সকলের মূল, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব অল্প লোকই আছেন যাঁহারা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বদ্ধ নন। জড়পদার্থের শক্তি দ্বারা আমরা সকলেই চালিত হই, এবং যতদিন আমরা এইভাবে চালিত হইব, ততদিন আমাদিগকে জড়ের সাহায্য লইতেই হইবে; তারপর যখন আমরা যথেষ্ট শক্তি অর্জন করিব তখন যাহা খুশী পানাহার করিতে পারি।
আমাদিগকে রামানুজের মত অনুসরণ করিয়া পানাহার সম্বন্ধে সাবধান হইতে হইবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে ‘মানসিক আহার’-এর দিকেও দৃষ্টি রাখিতে হইবে।, শরীরের স্থূলখাদ্য সম্বন্ধে সাবধান হওয়া তো অতি সহজ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ব্যাপারের দিকেও দৃষ্টি রাখিতে হইবে; তাহা হইলে আমাদের আত্মচেতনা ক্রমশঃ সবল হইতে থাকিবে, এবং শরীরচেতনার দাবী ক্রমশঃ কমিয়া যাইবে। তখন আর কোন খাদ্যই আমাদের কিছু অনিষ্ট করিতে পারিবে না।
সকলেই এক লাফে উচ্চতম আদর্শ ধরিতে চায়, কিন্তু লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া তো কিছু হইবে না! তাহাতে পড়িয়া গিয়া শেষ পর্যন্ত পা খোঁড়া হইয়া যাইবে। আমরা এই জগতে বদ্ধ অবস্থায় রহিয়াছি, আমাদিগকে ধীরে ধীরে শিকল ভাঙিতে হইবে। রামানুজের মতে এই ‘বিবেক’ অর্থাৎ খাদ্যাখাদ্য-বিচারই ভক্তির প্রথম সাধন।
ভক্তির দ্বিতীয় সাধনের নাম ‘বিমোক’। বিমোক-শব্দের অর্থ বাসনার দাসত্ব-মোচন। যিনি ভগবৎপ্রেম লাভ করিতে চান, তাঁহাকে সর্বপ্রকার প্রবল বাসনা ত্যাগ করিতে হইবে। ঈশ্বর ব্যতীত আর কিছুই কামনা করিও না। এই জগৎ আমাদিগকে সেই উচ্চতর জীবনে লইয়া যাইবার জন্য যতটুকু সাহায্য করে, ততটুকুই ভাল। ইন্দ্রিয়-বিষয়সকল উচ্চতর উদ্দেশ্যলাভে যতটুকু সাহায্য করে, ততটুকুই ভাল।
আমরা সর্বদাই ভুলিয়া যাই যে, এই জগৎ আমাদের উদ্দেশ্য নয়, একটি উদ্দেশ্য লাভের উপায় মাত্র। যদি এই জগৎ আমাদের চরম লক্ষ্য হইত, তবে আমরা এই স্থূলদেহেই অমরত্ব লাভ করিতাম, আমরা কখনই মরিতাম না। কিন্তু দেখিতেছি, প্রতি মুহূর্তে আমাদের চতুর্দিকে লোক মরিতেছে, তথাপি মূর্খতাবশতঃ ভাবিতেছি, আমরা কখনও মরিব না।৫ ঐ ধারণা হইতে আমরা ভাবিয়া থাকি, এই জীবন আমাদের চরম লক্ষ্য—আমাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জনের এই অবস্থা।
এই ভাব এখনই পরিত্যাগ করিতে হইবে। এই জগৎ যতক্ষণ আমাদের পূর্ণতা লাভের উপায়স্বরূপ হয়, ততক্ষণই ভাল; আর যখন ইহা দ্বারা সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, তখন ইহা মন্দ—মন্দ বৈ আর কিছুই নয়। এইরূপে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, টাকা-কড়ি বা বিদ্যা আমাদের ভগবৎপথে উন্নতির সহায়ক হইলে ভাল, কিন্তু যখনই তাহা না হয়, তখন সেগুলি মন্দ বৈ আর কিছুই নয়। স্ত্রী যদি ঈশ্বরলাভের সহায়তা করে, তবেই তাহাকে সাধ্বী স্ত্রী বলা যায়—
এইরূপ পতিপুত্রাদি সম্বন্ধেও। অর্থ যদি মানুষকে অপরের কল্যান-সাধনে সহায়তা করে, তবেই তাহার মূল্য আছে বলিয়া স্বীকার করা যায়। নতুবা উহা কেবল অনিষ্টের মূল, আর যত শীঘ্র আমরা অর্থের সংস্রব হইতে নিষ্কৃতি পাই, ততই মঙ্গল।
ইন্দ্রিয়গুলিকেও এই অভ্যাসে নিযুক্ত করিতে হইবে। বাজে কথা না শুনিয়া, আমাদিগকে ঈশ্বরের কথা শুনিতে হইবে; বাজে কথা না বলিয়া ঈশ্বর-বিষয়ক কথা বলিতে হইবে; বাজে পুস্তক না পড়িয়া ঈশ্বর-বিষয়ক সদ্গ্রন্থ পড়িতে হইবে
পরবর্তী সাধন ‘অভ্যাস’। আমাদের কর্তব্য-মন যেন সর্বদাই ঈশ্বরাভি-মুখে গমন করে, অন্য কোন বস্তুর আমাদের মনকে বাধা দিবার কোন অধিকার নাই। মন যেন সর্বদা অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় ঈশ্বরচিন্তা করে। ইহা বড় কঠিন কাজ, কিন্তু বারংবার অভ্যাসের দ্বারা ইহা সম্ভব। আমরা এখন যাহা হইয়াছি, তাহা অতীত অভ্যাসের ফলস্বরূপ। আবার এখন যেরূপ অভ্যাস করিব, ভবিষ্যতে সেইরূপ হইবে। অতএব আপনাদের যেরূপ অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, তাহার বিপরীত অভ্যাস করুন।
একদিকে মোড় ফিরিয়া আমাদের অবস্থা এই দাঁড়াইয়াছে, অন্যদিকে ফিরুন, এবং যত শীঘ্র পারেন, ইহার বাহিরে চলিয়া যান। ইন্দ্রিয়বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে আমরা এমন এক অবস্থায় আসিয়া পড়িয়াছি যে, আমরা এই মুহূর্তে হাসিতেছি, পরক্ষণেই কাঁদিতেছি, সামান্য বায়ুপ্রবাহেই আমরা বিচলিত হইতেছি-সামান্য একটা বাক্যের দাস, সামান্য এক টুকরা খাদ্যের দাস হইয়াছি। ইহা অতি লজ্জার বিষয়-ইহার উপর আমরা আবার নিজদিগকে ‘আত্মা’ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকি এবং অনেক বড় বড় বাজে কথা বলিয়া থাকি।
আমরা সংসারের দাস-ইন্দ্রিয়াভিমুখে ধাবিত হইয়া নিজেদের এই অবস্থায় আনিয়াছি। এখন বিপরীত দিকে চল, ঈশ্বরের চিন্তা কর-মন কোন শারীরিক বা মানসিক ভোগের চিন্তা না করিয়া যেন শুধু ঈশ্বরের চিন্তা করে। যখন মন অন্য কোন বিষয়ের চিন্তা করিতে উদ্যত হইবে, তখন উহাকে এমন ধাক্কা দাও, যেন উহা ফিরিয়া আসিয়া ঈশ্বরের চিন্তায় প্রবৃত্ত হয়। ‘যেমন তৈল এক পাত্র হইতে অপর পাত্রে অবিচ্ছিন্ন ধারায় পড়িতে থাকে,
যেমন দূরে ঘণ্টাধ্বনি হইলে উহার শব্দ কর্ণে এক অবিচ্ছিন্ন ধারায় আসিতে থাকে, সেইরূপ এই মনও এক অবিচ্ছিন্ন ধারায় যেন ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হয়।’ এই অভ্যাস আবার শুধু মনের দ্বারা করিলেই হইবে না, ইন্দ্রিয়গুলিকেও এই অভ্যাসে নিযুক্ত করিতে হইবে। বাজে কথা না শুনিয়া, আমাদিগকে ঈশ্বরের কথা শুনিতে হইবে; বাজে কথা না বলিয়া ঈশ্বর-বিষয়ক কথা বলিতে হইবে; বাজে পুস্তক না পড়িয়া ঈশ্বর-বিষয়ক সদ্গ্রন্থ পড়িতে হইবে।
ঈশ্বরকে স্মৃতিপথে রাখিবার এই ‘অভ্যাস’-এর সর্বোৎকৃষ্ট সহায়ক সম্ভবতঃ—সঙ্গীত। ভক্তির শ্রেষ্ঠ আচার্য নারদকে ভগবান্ বলিতেছেনঃ
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে ন চ।
মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ॥
হে নারদ, আমি বৈকুণ্ঠে বাস করি না, যোগীদিগের হৃদয়েও বাস করি না, যেখানে আমার ভক্তগণ ভজন গান করে, আমি সেখানেই অবস্থান করি।
মনুষ্য-মনের উপর সঙ্গীতের প্রচণ্ড প্রভাব—উহা মুহূর্তে মনকে একাগ্র করিয়া দেয়। দেখিবেন, অতিশয় তামসিক জড়প্রকৃতি ব্যক্তিগণ—যাহারা এক মুহূর্তও মন স্থির করিতে পারে না, তাহারাও উত্তম সঙ্গীত শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়া যায়, একাগ্র হইয়া যায়। এমন কি কুকুর, বিড়াল, সর্প, সিংহ প্রভৃতি জন্তুগণও সঙ্গীত শ্রবণে মোহিত হইয়া থাকে।
পরবর্তী সাধন ‘ক্রিয়া’—পরের হিতসাধন। স্বার্থপর ব্যক্তির হৃদয়ে ঈশ্বরচিন্তা আসিবে না। যতই আমরা পরের কল্যাণ-সাধনে চেষ্টা করিব, ততই আমাদের হৃদয় শুদ্ধ হইবে, এবং সেই হৃদয়ে ঈশ্বর বাস করিবেন। আমাদের শাস্ত্রমতে ক্রিয়া বা কর্ম পঞ্চবিধ—উহাদিগকে ‘পঞ্চ-মহাযজ্ঞ’ বলে। প্রথমঃ ব্রহ্মযজ্ঞ অর্থাৎ স্বাধ্যায়—প্রত্যহ শুভ ও পবিত্র-ভাবোদ্দীপক কিছু কিছু পাঠ করিতে হইবে। দ্বিতীয়ঃ দেবযজ্ঞ-ঈশ্বর, দেবতা বা সাধুগণের পূজা বা উপাসনা। তৃতীয়ঃ পিতৃযজ্ঞ-আমাদের পূর্বপুরুষগণ সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য।
চতুর্থঃ নৃযজ্ঞ-মনুষ্যজাতির প্রতি আমাদের কর্তব্য। মানুষ যদি দরিদ্র বা অভাবগ্রস্তদের জন্য গৃহ নির্মাণ না করে, তবে তাহার নিজের গৃহে বাস করিবার অধিকার নাই। যে কেহ দরিদ্র ও দুঃখী, তাহারই জন্য যেন গৃহীর গৃহ উন্মুক্ত থাকে, তবেই সে যথার্থ গৃহী। যদি কেহ কেবল নিজের ও নিজের স্ত্রীর ভোগের জন্য গৃহ নির্মাণ করে, তবে উহা অতি ঘোর স্বার্থপর কাজ। এরূপ ব্যক্তি কখনও ভগবদ্ভক্ত হইতে পারিবে না। কোন ব্যক্তির নিজের জন্য কিছু রন্ধন করিবার অধিকার নাই, পরের জন্যই তাহাকে রন্ধন করিতে হইবে—
পরের সেবার পর যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহাতেই তাহার অধিকার।৬ ভারতে সাধারণতঃ এইরূপই ঘটিয়া থাকে যে, যখন বাজারে নূতন নূতন জিনিষ, যথা—আম, কুল প্রভৃতি উঠে, তখন কোন ব্যক্তি কিছু কিনিয়া উহা গরীবদের মধ্যে বিলাইয়া দেন। তারপর তিনি নিজে খাইয়া থাকেন। আর এদেশে (আমেরিকায়) অনুসরণ করিবার পক্ষে এটি একটি খুবই ভাল দৃষ্টান্ত। এইরূপ ভাবে জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতে থাকিলে মানুষ ক্রমশঃ নিঃস্বার্থ হইবে, আবার স্ত্রীপুত্রাদিও ইহা হইতে শিক্ষা লাভ করিবে।
প্রাচীনকালে হিব্রূরা প্রথমজাত ফল ভগবানকে নিবেদন করিত, কিন্তু আজকাল আর বোধ হয় তাহা করে না। সকল বস্তুর অগ্রভাগ দরিদ্রগণের প্রাপ্য—অবশিষ্ট অংশে আমাদের অধিকার। দরিদ্রগণ ঈশ্বরের প্রতিনিধি—যাহারাই কোনরূপ দুঃখকষ্ট পাইতেছে, তাহারাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। পরকে না দিয়া যে ব্যক্তি নিজ রসনার তৃপ্তিসাধন করে, সে পাপ ভোজন করে।৭
পঞ্চমঃ ভূতযজ্ঞ অর্থাৎ নিম্নতর প্রাণীদের প্রতি আমাদের কর্তব্য। সকল জীবজন্তুকে মানুষ মারিয়া ফেলিবে, তাহাদিগকে লইয়া যাহা খুশী করিবে, এইজন্যই তাহাদের সৃষ্টি হইয়াছে-এ-কথা বলা মহাপাপ। যে শাস্ত্রে এই কথা বলে, তাহা শয়তানের শাস্ত্র, ঈশ্বরের নয়। শরীরের কোন অংশে স্নায়ুবিশেষ নড়িতেছে কিনা দেখিবার জন্য একটি প্রাণীকে কাটিয়া দেখা-কি বীভৎস ব্যাপার ভাবুন দেখি!
এমন সময় আসিবে, যখন সকল দেশেই-যে ব্যক্তি এরূপ করিবে, সে দণ্ডনীয় হইবে। আমাদের দেশে বৈদেশিক সরকার এরূপ কার্যে যতই উৎসাহ দিক্ না কেন, হিন্দুরা যে এ-বিষয়ে সহানুভূতি করেন না, তাহাতে আমি খুশী। যাহা হউক, গৃহে রান্না-করা আহারের একভাগ পশুগণেরও প্রাপ্য। তাহাদিগকে প্রত্যহ খাদ্য দিতে হইবে। এদেশের প্রত্যেক শহরে অন্ধ খঞ্জ বা আতুর, ঘোড়া, গরু, কুকুর, বিড়ালের জন্যও হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন-তাহাদিগকে খাওয়াইতে হইবে এবং যত্ন করিতে হইবে।
তারপর ‘কল্যাণ’ অর্থাৎ পবিত্রতা। নিম্নলিখিত গুণগুলি কল্যাণ-শব্দবাচ্যঃ ১ম, সত্য; যিনি সত্যনিষ্ঠ, তাঁহার নিকট সত্যের ঈশ্বর প্রকাশিত হন-কায়মনোবাক্যে সম্পূর্ণরূপে সত্যসাধন করিতে হইবে। ২য়, আর্জব-অকপটভাব, সরলতা-হৃদয়ের মধ্যে কোনরূপ কুটিলতা থাকিবে না, মন মুখ এক করিতে হইবে; যদিও একটু কর্কশ ব্যবহার করিতে হয়, তথাপি কুটিলতা ছাড়িয়া সহজ সরল পথে চলা উচিত। ৩য়, দয়া। ৪র্থ, অহিংসা অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে কোন প্রাণীর অনিষ্টাচরণ না করা। ৫ম, দান। দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠধর্ম আর নাই।
সে-ই হীনতম ব্যক্তি, যে নিজের দিকে হাত ফিরাইয়া আছে; সে প্রতিগ্রহ করিতে—পরের নিকট দান লইতে ব্যস্ত। আর সে-ই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যাহার হাত পরের দিকে ফিরানো রহিয়াছে-যে পরকে দিতেই ব্যাপৃত। হস্ত নির্মিত হইয়াছে-কেবল দিবার জন্য। উপবাসে মরিতে হয় তাহাও শ্রেয়ঃ, রুটির শেষ টুকরাটি পর্যন্ত দান করুন; পরকে খাদ্য দিতে গিয়া যদি তোমার অনাহারে মৃত্যু হয়, তবে আপনি এক মুহূর্তেই মুক্ত হইয়া যাইবেন, তৎক্ষণাৎ আপনি পূর্ণ হইয়া যাইবেন, তৎক্ষণাৎ আপনি ঈশ্বর হইয়া যাইবেন।
যাহাদের সন্তান-সন্ততি আছে, তাহারা তো পূর্ব হইতেই বদ্ধ। তাহারা সব দান করিয়া দিতে পারে না। তাহারা সন্তানগুলিকে উপভোগ করিতে চায়, তাহাদিগকে সেই ভোগের মূল্য দিতে হইবে। জগতে কি যথেষ্ট ছেলেমেয়ে নাই?স্বার্থপরতাবশেই লোকে বলিয়া থাকে, আমার নিজের একটি সন্তান চাই। ৬ষ্ঠ, অনভিধ্যা-পরের দ্রব্যে লোভ পরিত্যাগ বা নিষ্ফল চিন্তা পরিত্যাগ বা পরকৃত অপরাধ সম্বন্ধে চিন্তা পরিত্যাগ।
মানুষ একবার একদিকে ঝুঁকিয়া আবার তাহার চূড়ান্ত বিপরীত দিকে গিয়া থাকে। মনকে প্রফুল্ল অথচ শান্ত রাখিতে হইবে। মন যেন কখনও কোন কিছুর বাড়াবাড়ি না করে, কারণ বাড়াবাড়ি করিলেই পরিণামে তাহার প্রতিক্রিয়া হইবে।
পরবর্তী সাধন ‘অনবসাদ’, ইহার ঠিক অর্থ-চুপ করিয়া বসিয়া না থাকা, নৈরাশ্যগ্রস্ত না হওয়া, অর্থাৎ প্রফুল্লতা; নৈরাশ্য আর যাহাই হউক, ধর্ম নয়। সর্বদা হাসিমুখে প্রফুল্ল থাকিলে কোন স্তবস্তুতি বা প্রার্থনা অপেক্ষা শীঘ্র ঈশ্বরের নিকট যাওয়া যায়। যাহাদের মন সর্বদা বিষণ্ণ ও তমোভাবে আচ্ছন্ন, তাহারা আবার ভালবাসিবে কি করিয়া? তাহারা যদি ভালবাসার কথা বলে, তবে জানিবেন-উহা মিথ্যা; তাহারা প্রকৃতপক্ষে অপরকে আঘাত করিতে চায়।
গোঁড়াদের বিষয় ভাবিয়া দেখুন, তাহাদের মুখ সর্বদা ভার হইয়াই আছে-তাহাদের সমুদয় ধর্মটাই যেন বাক্যে ও কার্যে পরের বিরোধিতা করা। অতীতে তাহারা কি করিয়াছে, তাহা ভাবিয়া দেখুন এবং অবাধে কিছু করিবার সুযোগ পাইলে এখনও কী করিতে পারে, তাহাও ভাবুন। ক্ষমতা করায়ত্ত হইবে জানিলে তাহারা আগামী কালই সমগ্র জগৎকে রক্তস্রোতে প্লাবিত করিতে পারে, কারণ বিষণ্ণভাবই তাহাদের ঈশ্বর।
ক্ষমতাপন্ন এক ভয়ঙ্কর ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়া, সর্বদা বিষণ্ণ থাকিয়া তাহাদের হৃদয়ে আর ভালবাসার লেশমাত্র থাকে না, কাহারও প্রতি তাহাদের এক বিন্দু দয়া থাকে না। অতএব যে ব্যক্তি সর্বদাই নিজেকে দুঃখিত বোধ করে, সে কখনও ঈশ্বরকে লাভ করিতে পারে না। ‘আমি বড় দুঃখী!’-এরূপ বলা ধার্মিকের লক্ষণ নয়, ইহা শয়তানি। প্রত্যেককেই নিজ নিজ দুঃখের বোঝা বহন করিতে হয়।
বাস্তবিকই যদি আপনার দুঃখ থাকে, সুখী হইবার চেষ্টা করুন, দুঃখকে জয় করিবার চেষ্টা করুন। দুর্বল ব্যক্তি কখনই ভগবানকে লাভ করিতে পারে না-অতএব দুর্বল হইবেন না। আপানাকে শক্ত সবল হইতে হইবে-অনন্ত শক্তি আপনার ভিতর। নতুবা কোন কিছু জয় করিবেন কিরূপে? ঈশ্বর-লাভ করিবেন কিরূপে?
সঙ্গে সঙ্গে আবার ‘অনুদ্ধর্ষ’ সাধন করিতে হইবে। উদ্ধর্ষ-শব্দের অর্থ অতিরিক্ত আমোদ-প্রমোদ, উহা পরিত্যাগ করিতে হইবে। কারণ ঐ অবস্থায় মন কখনই শান্ত হয় না, চঞ্চল হইয়া থাকে, আর পরিণামে সর্বদা দুঃখই আসিয়া থাকে। কথায় বলে, ‘যত হাসি, তত কান্না’। মানুষ একবার একদিকে ঝুঁকিয়া আবার তাহার চূড়ান্ত বিপরীত দিকে গিয়া থাকে। মনকে প্রফুল্ল অথচ শান্ত রাখিতে হইবে। মন যেন কখনও কোন কিছুর বাড়াবাড়ি না করে, কারণ বাড়াবাড়ি করিলেই পরিণামে তাহার প্রতিক্রিয়া হইবে।
রামানুজের মতে এইগুলিই ভক্তির সাধন।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….