ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

সোমবার, ২৯ জুলাই, প্রাতঃকাল

আমরা কখনও কখনও কোন জিনিষ নির্ণয় করতে হলে তার পরিবেশ বর্ণনা করে থাকি। এ-কে তটস্থ লক্ষণ বলে। আমরা যখন ব্রহ্মকে ‘সচ্চিদানন্দ’ নামে অভিহিত করি, প্রকৃতপক্ষে আমরা তখন সেই অনির্বাচ্য সর্বাতীত সত্তারূপ সমুদ্রের তটের কিছু কিছু বর্ণনা করছি মাত্র। আমরা এ-কে ‘অস্তি’ বলতে পারি না, কারণ ‘অস্তি’ বলতে গেলেই তার বিপরীত ‘নাস্তি’র জ্ঞানও হয়ে থাকে, সুতরাং তাও আপেক্ষিক। তাঁর সম্বন্ধে কোন ধারণা, কোন প্রকার কল্পনা ঠিক ঠিক হতে পারে না। কেবল ‘নেতি, নেতি’-এ নয়, ও নয়-এই বলেই তাঁকে বর্ণনা করা যেতে পারে, কারণ তাঁকে চিন্তা করতে গেলেও সীমাবদ্ধ করতে হয়; সুতরাং চিন্তা দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না।

ইন্দ্রিয়গুলো দিবারাত্র তোমায় (ভুলজ্ঞান এনে দিয়ে) প্রতারিত করছে। বেদান্ত অনেককাল আগে এটি আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান সবেমাত্র ঐ তত্ত্বটি বুঝতে আরম্ভ করেছে। একখানা ছবির প্রকৃতপক্ষে কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে। কিন্তু চিত্রকর ছবিখানিতে কৃত্রিমভাবে গভীরতার ভাব ফলিয়ে প্রকৃতির প্রতারণা অনুকরণ করে থাকে। দুজন লোক কখনও এক জগৎ দেখে না। চূড়ান্ত জ্ঞানলাভ হলে তুমি দেখতে পাবে, কোন বস্তুতে কোন প্রকার গতি-কোন প্রকার পরিণাম নেই।

কোন প্রকার গতি বা পরিবর্তন আছে, আমাদের এই ধারণাই মায়া। প্রকৃতিকে সমষ্টিভাবে আলোচনা কর অর্থাৎ গতির তত্ত্ব আলোচনা কর। দেহ ও মন কোনটাই আমাদের যথার্থ আত্মা নয়-দুই-ই প্রকৃতির অন্তর্গত, কিন্তু কালে আমরা এদের ভিতরের সারসত্য-যথার্থ তত্ত্বকে জানতে পারি। তখন আমরা দেহ-মনের পারে চলে যাই, সুতরাং দেহ-মনের দ্বারা যা কিছু অনুভব হয়, তাও চলে যায়। তখন তুমি এই জগৎপ্রপঞ্চকে দেখতে পাবে না বা জানতে পারবে না, তখনই তোমার আত্মোপলব্ধি হবে।

আমাদের বাস্তবিক প্রয়োজন এই দ্বৈত বা আপেক্ষিক জ্ঞানকে অতিক্রম করা। অনন্ত মন বা অনন্ত জ্ঞান বলে কিছুই নেই, কারণ মন ও জ্ঞান-উভয়ই সসীম। আমরা এখন আবরণের মধ্য দিয়ে দেখছি-তারপর ক্রমশঃ আবরণকে অতিক্রম করে আমরা আমাদের সমুদয় জ্ঞানের সারসত্য-স্বরূপ সেই অজ্ঞাত বস্তুর কাছে পৌঁছব।

যদি আমরা একটা কার্ডবোর্ডের ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে একখানা ছবি দেখি, তা হলে আমরা ঐ ছবির সম্বন্ধে একটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা লাভ করি; তথাপি আমরা যা দেখি, তা বাস্তবিক ছবিটাই। ফুটোটা যত বড় করতে থাকি, ততই আমরা ছবিটার সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পেতে থাকি। আমাদের নামরূপের ভ্রমাত্মক উপলব্ধি অনুসারে আমরা সত্য জিনিষটারই সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণা করে থাকি। আবার যখন আমরা কার্ডবোর্ডখানা ফেলে দিই, তখনও আমরা সেই একই ছবি দেখে থাকি, কিন্তু এবার ছবিটাকে ঠিক ঠিক দেখতে পাই।

আমরা ঐ ছবিটাতে যত বিভিন্ন প্রকার গুণ বা ভ্রমাত্মক ধারণা আরোপ করি না কেন, তা দ্বারা ছবিটার কিছু পরিবর্তন হয় না। এইরূপ-আত্মাই সকল বস্তুর মূল সত্যস্বরূপ; আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আত্মা-কিন্তু আমরা যেভাবে এদের নামরূপাকারে দেখছি, সেভাবে নয়। ঐ নামরূপ আবরণের অন্তর্গত-মায়ার অন্তর্গত।

ঐগুলি যেন দূরবীনের কাচের উপরের দাগ; আবার যেমন সূর্যের আলোকের দ্বারাই আমরা ঐ দাগগুলি দেখতে পাই, সেইরূপ ব্রহ্মরূপ সত্যবস্তু পশ্চাতে না থাকলে আমরা মায়াটাকেও দেখতে পেতাম না। ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বলে মানুষটা ঐ দূরবীনের কাচের উপর একটা দাগমাত্র। প্রকৃত ‘আমি’ সত্যস্বরূপ অপরিণামী আত্মা, আর কেবল সেই সত্যবস্তুটাই আমাকে-(নামরূপাত্মক) স্বামী বিবেকানন্দ দেখতে সমর্থ করছে।

প্রত্যেকটি ভ্রমেরও সারসত্তা আত্মা-আর যেমন সূর্য কখনও ঐ কাচের উপরের দাগগুলির সঙ্গে এক হয়ে যায় না, দাগগুলি আমাদের দেখিয়ে দেয় মাত্র, সেইরূপ আত্মাও কখনই নামরূপের সঙ্গে মিশিয়ে যান না। আমাদের শুভ ও অশুভ কর্মসমূহ ঐ দাগগুলিকে যথাক্রমে কমায় বাড়ায় মাত্র, কিন্তু তারা আমাদের অন্তর্যামী ঈশ্বরের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। মনের দাগগুলি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে ফেল। তা হলেই আমরা দেখব-‘আমি ও আমার পিতা এক।’

সেই মুহূর্তেই হৃদয়ের গ্রন্থি সব ছিন্ন হয়ে যায়, সব বাঁকাচোরা সিধা হয়ে যায়, আর এই জগৎপ্রপঞ্চ স্বপ্নের মত মিলিয়ে যায়। আর ঘুম ভাঙলে ভেবে আশ্বর্য হই যে কি করে এই সব বাজে স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম।

আগে আমাদের অনুভূতি হয়, যুক্তিবিচার পরে এসে থাকে। আমাদের এই অনুভূতি লাভ করতে হবে, আর এই প্রত্যক্ষানুভূতিই হল বাস্তবিক ধর্ম। কোন ব্যক্তি শাস্ত্র, ধর্মমত বা অবতারের কথা কখনও না শুনে থাকতে পারে, কিন্তু তার যদি প্রত্যক্ষ অনুভূতি হয়ে থাকে, তবে আর কিছু দরকার নেই। চিত্ত শুদ্ধ কর-এই হচ্ছে ধর্মের সার কথা; আর আমরা নিজেরা যতক্ষণ না মনের ঐ দাগগুলো দূর করছি, ততক্ষণ আমরা সেই সত্যস্বরূপকে ঠিক ঠিক দর্শন করতে পারি না।

শিশু কোথাও কোন পাপ দেখতে পায় না, কারণ বাইরের পাপটার পরিণাম নির্ণয় করবার কোন মাপকাঠি তার নিজের ভিতর নেই। তোমার ভিতর যে দোষগুলি আছে, সব দূর করে ফেল-তা হলেই তুমি আর বাইরে কোন দোষ দেখতে পাবে না। ছোটছেলের সামনে চুরি-ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে, তার কাছে এর কোন অর্থই নেই, সে এর কিছুই বোঝে না। ধাঁধার ছবির ভিতর লুকানো জিনিষটা একবার যদি দেখতে পাও, তা হলে পরেও সর্বদাই দেখতে পাবে।

এইরূপে যখন তুমি একবার মুক্ত ও নির্দোষ হয়ে যাবে, তখন জগৎপ্রপঞ্চের ভিতর তুমি মুক্তি ও শুদ্ধতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না। সেই মুহূর্তেই হৃদয়ের গ্রন্থি সব ছিন্ন হয়ে যায়, সব বাঁকাচোরা সিধা হয়ে যায়, আর এই জগৎপ্রপঞ্চ স্বপ্নের মত মিলিয়ে যায়। আর ঘুম ভাঙলে ভেবে আশ্বর্য হই যে কি করে এই সব বাজে স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম।

‘যাঁকে লাভ করলে পর্বতপ্রমাণ দুঃখও হৃদয়কে বিচলিত করতে পারে না’, তাঁকে লাভ করতে হবে।৫৭

জ্ঞানকুঠার দ্বারা দেহমনরূপ চক্রদয়কে পৃথক্ করে ফেল, তা হলেই আত্মা মুক্তস্বরূপ হয়ে পৃথক্‌ভাবে দাঁড়াতে পারবে-যদিও পুরাতন বেগে তখনও দেহমনরূপ-চক্র খানিকক্ষণের জন্য চলবে। তবে তখন চাকাটি সোজাই চলবে, অর্থাৎ এই দেহমনের দ্বারা তখন শুভ কার্যই হবে। যদি সেই শরীরের দ্বারা কিছু মন্দ কার্য হয়, তা হলে জেনো সে ব্যক্তি জীবন্মুক্ত নয়-যদি সে আপনাকে ‘জীবন্মুক্ত’ বলে দাবী করে, তবে সে মিথ্যা কথা বলছে।

এটাও বুঝতে হবে যে, তখন চিত্তশুদ্ধির দ্বারা চক্রের বেশ সরল গতি এসে গেছে, সেই সময় তার উপর কুঠারপ্রয়োগ সম্ভব। সকল শুদ্ধিকর কর্মই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ভ্রম বা অজ্ঞানকে নষ্ট করছে। অপরকে পাপী বলাই সবচেয়ে গর্হিত কাজ। ভাল কাজ না জেনে করলেও তার ফল একই প্রকার হয়-তা বন্ধন-মোচনের সহায়তা করে।

দূরবীনের কাচের দাগগুলি দেখে সূর্যকেও দাগমুক্ত মনে করাই আমাদের মৌলিক ভ্রম। সেই ‘আমি’-রূপ সূর্য কোনপ্রকার বাহ্যদোষে লিপ্ত নন-এইটি জেনে রাখো, আর নিজেকে ঐ দাগগুলি তুলতে নিযুক্ত কর। যত প্রাণী সম্ভব, তার মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও খ্রীষ্টের ন্যায় মনুষ্যের উপাসনাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনা। তোমার যা কিছুর অভাব বোধ হয়, তাই তুমি সৃষ্টি করে থাক;-বাসনামুক্ত হও।

দেবতারা ও পরলোকগত ব্যক্তিরা সকলে এখানেই রয়েছেন-এই জগৎকেই তাঁরা স্বর্গ বলে দেখছেন। একই অজ্ঞাত বস্তুকে সকলে নিজ নিজ মনের ভাব অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখছে। এই পৃথিবীতেই কিন্তু ঐ অজ্ঞাত বস্তুর উৎকৃষ্ট দর্শনলাভ হতে পারে। কখনও স্বর্গে যাবার ইচ্ছা কর না-এইটেই সব চেয়ে নিকৃষ্ট ভ্রম। এই পৃথিবীতেও খুব বেশী পয়সা থাকা ও ঘোর দারিদ্র্য, দুই-ই বন্ধন-দুই-ই আমাদের ধর্মপথ থেকে, মুক্তিপথ থেকে দূরে রাখে।

তিনটি জিনিষ এ পৃথিবীতে বড় দুর্লভঃ প্রথম-মনুষ্যদেহ (মনুষ্যমনেই ঈশ্বরের উৎকৃষ্ট প্রতিবিম্ব বিদ্যমান; বাইবেলে আছে, ‘মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিস্বরূপ’)। দ্বিতীয়-মুক্ত হবার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তৃতীয়-মহাপুরুষের আশ্রয়লাভ, যিনি স্বয়ং মায়ামোহ-সমুদ্র পার হয়ে গেছেন, এমন মহাত্মাকে গুরুরূপে পাওয়া৫৮। এই তিনটি যদি পেয়ে থাক, তবে ভগবানকে ধন্যবাদ দাও, তুমি মুক্ত হবেই হবে!

কেবল তর্কযুক্তির দ্বারা তোমার যে সত্যের জ্ঞান লাভ হয়, তা একটা নূতন যুক্তিতর্কের দ্বারা উড়ে যেতে পারে, কিন্তু তুমি যা সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ অনুভব কর, তা তোমার কোন কালে যাবার নয়। ধর্ম সম্বন্ধে কেবল বচনবাগীশ হলে কিছু ফল হয় না। যে-কোন বস্তুর সংস্পর্শে আসবে-যেমন মানুষ, জানোয়ার, আহার, কাজকর্ম-সকলের উপর ব্রহ্মদৃষ্টি কর; আর এইরূপ সর্বত্র ব্রহ্মদৃষ্টি করাকে একটা অভ্যাসে পরিণত কর।

ইঙ্গারসোল৫৯ আমায় একবার বলেন, ‘এই জগৎটা থেকে যতদূর লাভ করা যেতে পারে, তার চেষ্টা সকলের করা উচিত-এই আমার বিশ্বাস। কমলালেবুটাকে নিংড়ে যতটা সম্ভব রস বার করে নিতে হবে, যেন এক ফোঁটা রসও বাদ না যায়; কারণ এই জগৎ ছাড়া অপর কোন জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা সুনিশ্চিত নই।’ আমি তাকে উত্তর দিয়েছিলামঃ এই জগৎরূপ কমলালেবু নিংড়াবার যে প্রণালী আপনি জানেন, তার চেয়ে ভাল প্রণালী আমি জানি, আর আমি তা দ্বারা বেশী রস পেয়ে থাকি।

আমি জানি-আমার মৃত্যু নেই; সুতরাং আমার ঐ রস নিংড়ে নেবার তাড়া নেই। আমি জানি, ভয়ের কোন কারণ নেই; সুতরাং বেশ করে ধীরে ধীরে আনন্দ করে নিংড়াচ্ছি। আমার কোন কর্তব্য নেই, আমার স্ত্রীপুত্রাদি ও বিষয়সম্পত্তির কোন বন্ধন নেই, আমি সকল নরনারীকে ভালবাসতে পারি। সকলেই আমার পক্ষে ব্রহ্মস্বরূপ। মানুষকে ভগবান্ বলে ভালবাসলে কি আনন্দ-একবার ভেবে দেখুন দেখি! কমলালেবুটাকে এইভাবে নিংড়ান দেখি-অন্যভাবে নিংড়ে যা রস পান, তার চেয়ে দশহাজারগুণ রস পাবেন-একটি ফোঁটাও বাদ যাবে না। প্রত্যেকটি ফোঁটাই পাবেন।

যাকে আমাদের ‘ইচ্ছা’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অধিষ্ঠানস্বরূপ আত্মা, এবং বাস্তবিকই তা মুক্তস্বভাব।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

যীশুখ্রীষ্ট অসম্পূর্ণ ছিলেন, কারণ তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তদনুসারে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করেননি, আর সর্বোপরি তিনি নারীগণকে পুরুষের তুল্য মর্যাদা দেননি। মেয়েরাই তাঁর জন্য সব করলে, কিন্তু তিনি য়াহুদীদের দেশাচার দ্বারা এতদূর বদ্ধ ছিলেন যে, একজন নারীকেও তিনি ‘প্রেরিত শিষ্য’ (Apostle) পদে উন্নীত করলেন না। তথাপি উচ্চতম চরিত্র হিসাবে বুদ্ধের পরেই তাঁর স্থান-আবার বুদ্ধও যে একেবারে সম্পূর্ণ নিখুঁত ছিলেন, তা নয়।

যাই হোক, বুদ্ধ ধর্মরাজ্যে পুরুষের সহিত স্ত্রীলোকের সমানাধিকার স্বীকার করেছিলেন, আর তাঁর নিজের স্ত্রীই তাঁর প্রথম ও একজন প্রধানা শিষ্যা। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের অধিনায়িকা হয়েছিলেন। আমাদের কিন্তু এই-সকল মহাপুরুষের সমালোচনা করা উচিত নয়, আমাদের শুধু উচিত-তাঁদের আমাদের চেয়ে অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা। তা হলেও যিনি যত বড়ই হোন না কেন, কোন মানুষকেই আমাদের শুধু বিশ্বাস করে পড়ে থাকলে চলবে না, আমাদেরও বুদ্ধ ও খ্রীষ্ট হতে হবে।

কোন ব্যক্তিকেই তার দোষ বা অসম্পূর্ণতা দেখে বিচার করা উচিত নয়। মানুষের যে বড় বড় গুণগুলি দেখা যায়, সেগুলি তার নিজের, কিন্তু তার দোষগুলি মনুষ্যজাতির সাধারণ দুর্বলতা মাত্র; সুতরাং তার চরিত্র বিচার করবার সময় সেগুলি কখনও গণনা করতে নেই।

 

* * *

ইংরেজী ভার্চু (virtue)-শব্দটি সংস্কৃত ‘বীর’ (vira) শব্দ থেকে এসেছে, কারণ প্রাচীনকালে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদেরই লোকে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক লোক বলে বিবেচনা করত।

মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই

খ্রীষ্ট ও বুদ্ধের মত মহাপুরুষেরা কেবল বহিরবলম্বন; তাঁদের উপর আমাদের ভিতরের শক্তিগুলি আমরা আরোপ করে থাকি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে আমরাই আমাদেরই প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকি।

যীশু যদি না জন্মাতেন, তবে মনুষ্যজাতির কখনও উদ্ধার হত না-এরূপ ভাবা ঈশ্বরনিন্দার সমান। মনুষ্য-স্বভাবের ভিতর যে ঐশ্বরিক ভাব অন্তর্নিহিত রয়েছে, তাকে ঐ রূপ ভুলে যাওয়া বড় ভয়ানক-ঐ ঐশ্বরিক ভাব কোন-না-কোন সময়ে প্রকাশিত হবেই হবে।

মনুষ্য-স্বভাবের মহত্ত্ব কখনও ভুলো না। ঈশ্বর অতীতে যা হয়েছেন, ভবিষ্যতে যা হবেন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমরাই। ‘আমি’ই সেই অনন্ত মহাসমুদ্র-খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণ তারই উপরে তরঙ্গ-মাত্র। তোমার নিজের অন্তরাত্মা ব্যতীত আর কারও কাছে মাথা নত কর না। যতক্ষণ না তুমি নিজেকে সেই দেবদেব বলে জানতে পারছ, ততক্ষণ তোমার মুক্তি হতে পারে না।

আমাদের সকল অতীত কর্মই বাস্তবিক ভাল, কারণ কর্মগুলিই আমাদের চরম আদর্শ লাভ করিয়ে দেয়। কার কাছে আমি ভিক্ষা করব?-আমিই যথার্থ সত্তা, আর যা কিছু আমার স্বরূপ থেকে ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়, তা স্বপ্নমাত্র। আমি সমগ্র সমুদ্র; তুমি নিজে ঐ সমুদ্রে যে একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গের সৃষ্টি করেছ, সেটাকে ‘আমি’ বল না। সেটা ঐ তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয় বলে জেন। সত্যকাম (অর্থাৎ সত্যলাভের জন্য যাঁর প্রবল আকাঙ্ক্ষা হয়েছে) শুনতে পেলেন-তাঁর অন্তরের বাণী তাঁকে বলছে, ‘তুমি অনন্তস্বরূপ, সেই সর্বব্যাপী সত্তা তোমার ভিতরে রয়েছে।’ নিজেকে সংযত কর, আর তোমার যথার্থ আত্মার বাণী শ্রবণ কর।

ঐ-সকল শান্তিপ্রিয় নির্জনবাসী মহাপুরুষ একের পর এক আবির্ভূত হন-শেষে তাঁদের শক্তিরই চরমফলস্বরূপ এমন এক শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয়, যিনি সেই তত্ত্বগুলি চারিদিকে প্রচার করে বেড়ান।

যে-সকল মহাপুরুষ প্রচারকার্যের জন্য প্রাণপাত করে যান, তাঁরা-যে- সকল মহাপুরুষ নির্জনে নীরবে মহাপবিত্র জীবনযাপন করেন, বড় বড় ভাব চিন্তা করে যান এবং ঐরূপে জগতের সাহায্য করেন-তাঁদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অসম্পূর্ণ। ঐ-সকল শান্তিপ্রিয় নির্জনবাসী মহাপুরুষ একের পর এক আবির্ভূত হন-শেষে তাঁদের শক্তিরই চরমফলস্বরূপ এমন এক শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয়, যিনি সেই তত্ত্বগুলি চারিদিকে প্রচার করে বেড়ান।

 

* * *

জ্ঞান স্বতই বর্তমান রয়েছে, মানুষ কেবল সেটা আবিষ্কার করে মাত্র। বেদসমূহই এই চিরন্তন জ্ঞান-যার সহায়তায় ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। ভারতের দার্শনিকগণ উচ্চতম দার্শনিক তত্ত্ব বলে থাকেন, আর এই প্রচণ্ড দাবীও করে থাকেন।

সত্য যা, তা সাহসপূর্বক নির্ভীকভাবে লোকের কাছে বলো,-ঐ সত্য প্রকাশের জন্য ব্যক্তিবিশেষের কষ্ট হল বা না হল, সে দিকে খেয়াল কর না। দুর্বলতাকে আমল দিও না। সত্যের জ্যোতিঃ বুদ্ধিমান্ লোকদের পক্ষেও যদি অতিমাত্রায় প্রখর বোধ হয়, তাঁরা যদি তা সহ্য করতে না পারেন, সত্যের বন্যা যদি তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা যাক-যত শীঘ্র যায়, ততই ভাল। ছেলেমানুষী ভাব-শিশুদের ও বুনো অসভ্যদেরই শোভা পায়; কিন্তু দেখা যায়, ঐ-সব ভাব কেবল শিশুমহলে বা জঙ্গলেই আবদ্ধ নয়, ঐ-সকল ভাবের অনেকগুলি ধর্মপ্রচারকদেরও কুক্ষিগত।

আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ হলে আর সম্প্রদায়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকা খারাপ। তা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে দেহপাত কর।

উন্নতি যা কিছু, তা এই ব্যাবহারিক বা আপেক্ষিক জগতেই হয়ে থাকে। মানবদেহই সর্বশ্রেষ্ঠ দেহ এবং মানুষই সর্বোচ্চ প্রাণী, কারণ এই মানবদেহে-এই জন্মেই আমরা সম্পূর্ণরূপে এই আপেক্ষিক জগতের বাইরে যেতে পারি, সত্য সত্যই মুক্তির অবস্থা লাভ করতে পারি, আর ঐ মুক্তিই আমাদের চরম লক্ষ্য। শুধু যে আমরা পারি তা নয়, অনেকে সত্য সত্যই ইহজীবনে মুক্তাবস্থা লাভ করেছেন, পূর্ণতা-প্রাপ্ত হয়েছেন।

সুতরাং কেউ এ দেহ ত্যাগ করে যতই সূক্ষ্ম-সূক্ষ্মতর দেহ লাভ করুক, সে তখনও এই আপেক্ষিক জগতের ভিতরই রয়েছে, সে আর আমাদের চেয়ে বেশী কিছু করতে পারে না, কারণ মুক্তিলাভ করা ছাড়া আর কি উচ্চাবস্থা লাভ করা যেতে পারে।

দেবতারা (angels) কখনও কোন অন্যায় কাজ করেন না, কাজেই তাঁরা শাস্তিও পান না; সুতরাং তাঁরা মুক্ত হতেও পারেন না। সংসারের ধাক্কাই আমাদের জাগিয়ে দেয়, এই জগৎস্বপ্ন ভাঙবার সাহায্য করে। ঐরূপ ক্রমাগত আঘাতই এই জগতের অসম্পূর্ণতা বুঝিয়ে দেয়, আমাদের এ সংসার থেকে পালাবার-মুক্তিলাভ করবার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দেয়।

 

* * *

কোন বস্তু-যখন আমরা অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি, তখন আমরা তার এক নাম দিই, আবার সেই জিনিষকেই যখন সম্পূর্ণ উপলব্ধি করি, তখন অন্য নাম দিই। আমাদের নৈতিক প্রকৃতি যত উন্নত হয়, আমাদের উপলব্ধিও তত উৎকৃষ্ট হয়, আমাদের ইচ্ছাশক্তিও তত অধিক বলবতী হয়।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

আমরা যে জড় ও চিন্তারাশির ভিতর সামঞ্জস্য দেখতে পাই, তার কারণ উভয়ই এক অজ্ঞাত বস্তুর দুটি দিক্‌মাত্র, সেই জিনিষটাই দুভাগ হয়ে বাহ্য ও আন্তর হয়েছে।

ইংরেজী ‘প্যারাডাইস’ (Paradise)-শব্দটি সংস্কৃত ‘পরদেশ’ শব্দ থেকে এসেছে, ঐ শব্দটা পারস্য ভাষায় চলে গিয়েছিল-(ফার-দৌস)-এর শব্দার্থ হচ্ছে দেশের পারে, অথবা অন্য দেশ বা অন্য লোক। প্রাচীন আর্যেরা বরাবরই আত্মায় বিশ্বাস করতেন, তাঁরা মানুষকে কেবল দেহ বলে কখনও ভাবতেন না। তাঁদের মতে স্বর্গ নরক-দুই-ই অনিত্য ও সান্ত, কারণ কোন কার্যই কখনও তার কারণ-নাশের পর স্থায়ী হতে পারে না, আর কোন কারণই চিরস্থায়ী নয়; সুতরাং কার্য বা ফলমাত্রের নাশ হবেই। এই রূপকটিতে৬০ সমগ্র বেদান্তদর্শনের সার রয়েছেঃ

সোনার মত পালকযুক্ত দুটি পাখি একটা গাছে বসে আছে। উপরে যে পাখিটা বসে আছে, সে স্থির শান্তভাবে নিজ মহিমায় নিজে বিভোর হয়ে রয়েছে; আর যে পাখিটা নীচের ডালে রয়েছে, সে সদাই চঞ্চল-ঐ গাছের ফল খাচ্ছে-কখনও মিষ্ট ফল, কখনও বা কটু ফল। একবার সে একটা অতিরিক্ত কটু ফল খেলে, তখন সে একটু স্থির হয়ে উপরের সেই মহিমময় পাখিটার দিকে চাইলে। কিন্তু আবার সে শীঘ্রই তাকে ভুলে গিয়ে পূর্বের মত সেই গাছের ফল খেতে লাগলো।

আবার একটা কটু ফল খেলে-এইবার সে টুপ টুপ করে লাফিয়ে উপরের পাখিটার দু-এক ডাল কাছে গেল। এইরূপ অনেকবার হল, অবশেষে নীচের পাখিটা একেবারে উপরের পাখিটার জায়গায় গিয়ে বসল, আর নিজেকে হারিয়ে ফেলল। সে অমনি বুঝলে যে, দুটো পাখি কোন কালেই ছিল না, সে নিজেই বরাবর শান্ত-স্থিরভাবে নিজ মহিমায় নিজে মগ্ন-উপরের পাখিই ছিল।

বুধবার, ৩১ জুলাই

প্রটেস্টাণ্টধর্ম-সংস্থাপক লুথার ধর্মসাধনের ভিতর থেকে সন্ন্যাস বা ত্যাগ বাদ দিয়ে তার স্থানে কেবল নীতিমাত্র প্রচার করে ধর্মের সর্বনাশ করে গেলেন। নাস্তিক ও জড়বাদীরাও নীতিপরায়ণ হতে পারে, কেবল ঈশ্বর-বিশ্বাসীরাই ধর্মলাভ করতে পারে |

সমাজ যাদের অসৎ বলে, তারা মহাপুরুষদের পবিত্রতার জন্য মূল্য দেয়-সুতরাং তাদের দেখে, ঘৃণা না করে ঐ কথাই ভাবা উচিত। যেমন গরীব লোকের পরিশ্রমের ফলে বড় লোকের বিলাসিতা সম্ভব হয়, আধ্যাত্মিক জগতেও সেইরূপ। ভারতের সাধারণ লোকের যে এত অবনতি দেখা যায়, সেটা মীরাবাঈ, বুদ্ধ প্রভৃতি মহাত্মাদের উৎপন্ন করার জন্য যেন প্রকৃতিকে তার মূল্য ধরে দিতে হয়েছে।

 

* * *

আমিই পবিত্রাত্মাদের পবিত্রতা’ ‘আমিই সকলের মূল, প্রত্যেকে নিজের মত করে সেটি ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু সবই আমি।’ ‘আমিই সব করছি, তুমি নিমিত্তমাত্র।’৬১

বেশী কথা বল না, তোমার নিজের ভিতর যে আত্মা রয়েছেন, তাঁকে অনুভব কর, তবেই তুমি জ্ঞানী হবে। এই হল জ্ঞান, আর সব অজ্ঞান। জানবার বস্তু একমাত্র ব্রহ্ম, তিনিই সব।

* * *

সত্ত্ব মানুষকে সুখ ও জ্ঞানের অন্বেষণে বদ্ধ করে, রজঃ বাসনা দ্বারা বদ্ধ করে, তমঃ ভ্রমজ্ঞান আলস্য প্রভৃতি দ্বারা বদ্ধ করে।৬২ রজঃ ও তমঃ-এই দুটি নিম্নতর গুণকে সত্ত্বের দ্বারা জয় কর, তারপর সমুদয় ঈশ্বরে সমর্পণ করে মুক্ত হও।

ভক্তিযোগের দ্বারা সাধক অতি শীঘ্র ব্রহ্মোপলব্ধি করেন ও তিন গুণের পারে চলে যান।৬৩

ইচ্ছা, চেতনা, ইন্দ্রিয়, বাসনা, রিপু-এইগুলি মিলিত হয়ে যা হয়েছে, তাকে আমরা ‘জীবাত্মা’ বলে থাকি।

প্রথম হচ্ছে প্রতীয়মান আত্মা (দেহ); দ্বিতীয়, মানস আত্মা-যে ঐ দেহটাকে ‘আমি’ বলে মনে করে (এইটি মায়াবদ্ধ ব্রহ্ম); তৃতীয়, যথার্থ আত্মা, যিনি নিত্যশুদ্ধ-নিত্যমুক্ত। তাঁকে আংশিকভাবে দেখলে ‘প্রকৃতি’ বলে বোধ হয়, আবার তাঁকেই পূর্ণভাবে দেখলে সমস্ত প্রকৃতি উড়ে যায়; এমন কি তাঁর স্মৃতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম-পরিণামী ও অনিত্য (মরণধর্মী বা ধ্বংসশীল), দ্বিতীয়-সদা পরিবর্তনশীল, কিন্তু প্রবাহরূপে নিত্য (প্রকৃতি), তৃতীয়-কূটস্থ নিত্য (আত্মা)।

* * *

আশা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ কর, এই হল সর্বোচ্চ অবস্থা। আশা করবার কি আছে? আশার বন্ধন ছিঁড়ে ফেল, নিজের আত্মার উপর দাঁড়াও, স্থির হও; যাই কর না কেন, সব ভগবানে অর্পণ কর, কিন্তু তার ভিতর কোন কপটতা রেখ না।

ভারতে কারও কুশল জিজ্ঞাসা করতে ‘স্বস্থ’ (যা থেকে ‘স্বাস্থ্য’ কথাটা এসেছে) এই সংস্কৃত শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘স্বস্থ’ শব্দের অর্থ-স্ব অর্থাৎ আত্মাতে প্রতিষ্ঠিত থাকা। কোন জিনিষ দেখেছি, এটা বুঝাতে হলে হিন্দুরা বলে থাকে, ‘আমি একটা পদার্থ দেখেছি।’ ‘পদার্থ’ কি না পদ বা শব্দের অর্থ, অর্থাৎ শব্দপ্রতিপাদ্য ভাববিশেষ। এমন কি এই জগৎপ্রপঞ্চটা তাদের কাছে একটা ‘পদার্থ’ (অর্থাৎ শব্দের অর্থ)।

* * *

জীবন্মুক্ত সিদ্ধ পুরুষের দেহ আপনা-আপনি ন্যায় কার্যই করে থাকে (তার দ্বারা অন্যায় কার্য হয় না)। তাঁর শরীর কেবল শুভ কার্যই করতে পারে, কারণ তা সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে গেছে। অতীত সংস্কাররূপ যে বেগের দ্বারা তাঁদের দেহচক্র পরিচালিত হতে থাকে, তা সব শুভ সংস্কার। মন্দ সংস্কার সব দগ্ধ হয়ে গেছে।

* * *

সেই দিনকেই যথার্থ দুর্দিন বলা যায়, যে দিন আমরা ভগবৎ-প্রসঙ্গ না করি; কিন্তু যে দিন মেঘ-ঝড়-বৃষ্টি হয়, সে দিনকে প্রকৃতপক্ষে দুর্দিন বলা যায় না।৬৪

সেই পরম প্রভুর প্রতি ভালবাসাকে যথার্থ ‘ভক্তি’ বলা যায়। অন্য কোন পুরুষের প্রতি ভালবাসাকে-তিনি যত বড়ই হোন না কেন-‘ভক্তি’ বলা যায় না। এখানে ‘পরম প্রভু’ বলতে পরমেশ্বরকে বুঝাচ্ছে, তোমরা পাশ্চাত্য দেশে ব্যক্তি-ভাবাপন্ন ঈশ্বর (Personal God) বলতে যা বোঝ, তাকে অতিক্রম করে আছে এই ধারণা। ‘যা হতে এই জগৎপ্রপঞ্চের উৎপত্তি হচ্ছে, যাঁতে এর স্থিতি, আবার যাঁতে লয়, তিনিই ঈশ্বর-নিত্য, শুদ্ধ, সর্বশক্তিমান্, সদামুক্তস্বভাব, দয়াময়, সর্বজ্ঞ, সকল গুরুর গুরু, অনির্বচনীয়-প্রেমস্বরূপ।’

মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে ভগবানকে সৃষ্টি করে না; তবে তার যতদূর শক্তি, সে সেইভাবে তাঁকে দেখতে পারে, আর তার যত ভাল ভাল ধারণা তাঁতে আরোপ করে। এই এক-একটি গুণই ঈশ্বরের সবটাই, আর এই এক-একটি গুণের দ্বারা সবটাকে বোঝানোই বাস্তবিক ব্যক্তি-ঈশ্বরের (Personal God) দার্শনিক ব্যাখ্যা। ঈশ্বর নিরাকার, অথচ তাঁর সব গুণ রয়েছে। আমরা যতক্ষণ মানবভাবাপন্ন, ততক্ষণ ঈশ্বর, প্রকৃতি ও জীব-এই তিনটি সত্তা আমাদের দেখতে হয়। তা না দেখে থাকতেই পারি না।

কিন্তু ভক্তের পক্ষে এই-সকল দার্শনিক পার্থক্য বাজে কথা মাত্র। সে যুক্তি-বিচার গ্রাহ্যই করে না, সে বিচার করে না-সে দেখে, প্রত্যক্ষ অনুভব করে। সে ঈশ্বরের শুদ্ধ প্রেমে আত্মহারা হয়ে যেতে চায়; আর এমন অনেক ভক্ত হয়ে গেছেন, যাঁরা বলেন, মুক্তির চেয়ে ঐ অবস্থাই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। যাঁরা বলেন, ‘চিনি হওয়া ভাল নয় মন, চিনি খেতে ভালবাসি’৬৫ -আমি সেই প্রেমাস্পদকে ভালবাসতে চাই, তাঁকে সম্ভোগ করতে চাই।

ভক্তিযোগে বিশেষ প্রয়োজন এই যে, অকপটভাবে ও প্রবলভাবে ঈশ্বরের অভাব বোধ করা। আমরা ঈশ্বর ছাড়া আর সবই চাই, কারণ বহির্জগৎ থেকেই আমাদের সাধারণ সব বাসনা পূরণ হয়ে থাকে। যতদিন আমাদের প্রয়োজন বা অভাববোধ জড়জগতের ভিতরেই সীমাবদ্ধ, ততদিন আমরা ঈশ্বরের জন্য কোন অভাববোধ করি না; কিন্তু যখন আমরা এ জীবনে চারদিক্‌ থেকে প্রবল ঘা খেতে থাকি, আর ইহজগতের সকল বিষয়েই হতাশ হই, তখনই উচ্চতর কোন বস্তুর জন্য আমাদের প্রয়োজন বোধ হয়ে থাকে, তখনই আমরা ঈশ্বরের অন্বেষণ করে থাকি।

ভক্তি আমাদের কোন বৃত্তিকে ভেঙ্গেচুরে দেয় না, বরং ভক্তিযোগের শিক্ষা এই যে, আমাদের সব বৃত্তিই মুক্তিলাভ করবার উপায়স্বরূপ হতে পারে। ঐসব বৃত্তিকেই ঈশ্বরাভিমুখী করতে হবে-সাধারণতঃ যে ভালবাসা অনিত্য ইন্দ্রিয়-বিষয়ে নষ্ট করা হয়ে থাকে, সেই ভালবাসা ঈশ্বরকে দিতে হবে।

তোমাদের পাশ্চাত্য ধর্মের ধারণা থেকে ভক্তির এইটুকু তফাত যে, ভক্তিতে ভয়ের স্থান নাই-ভক্তি দ্বারা কোন পুরুষের ক্রোধ শান্ত করতে বা কাউকে সন্তুষ্ট করতে হবে না। এমন-কি এমন সব ভক্তও আছেন, যাঁরা ঈশ্বরকে তাঁদের সন্তান বলে উপাসনা করে থাকেন-এরূপ উপাসনার উদ্দেশ্য এই যে, ঐ উপাসনায় ভয় বা ভয়মিশ্র ভক্তির কোন ভাব না থাকে। প্রকৃত ভালবাসায় ভয় থাকতে পারে না, আর যতদিন পর্যন্ত এতটুকু ভয় থাকবে, ততদিন ভক্তির আরম্ভই হতে পারে না।

আবার ভক্তিতে ভগবানের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার, আদান-প্রদানের ভাব কিছুই নাই। ভগবানের কাছে কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা ভক্তের দৃষ্টিতে মহা অপরাধ। ভক্ত কখনও ভগবানের নিকট আরোগ্য বা ঐশ্বর্য, এমন-কি স্বর্গ পর্যন্ত কামনা করেন না।

তাঁকে এর দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে আগে দোকানদারি ধর্মের পুঁটলি বাইরে ফেলে আসতে হবে। এ-কথা বলছি না যে, ভগবানের কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় না-সবই পাওয়া যায়, কিন্তু ঐরূপ প্রার্থনা করা অতি নীচু দরের ধর্ম, ভিখারীর ধর্ম।

যিনি ভগবানকে ভালবাসতে চান, ভক্ত হতে চান, তাঁকে ঐ-সব বাসনা একটি পুঁটলি করে দরজার বাইরে ফেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। যিনি সেই জ্যোতির রাজ্যে প্রবেশ করতে চান, তাঁকে এর দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে আগে দোকানদারি ধর্মের পুঁটলি বাইরে ফেলে আসতে হবে। এ-কথা বলছি না যে, ভগবানের কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় না-সবই পাওয়া যায়, কিন্তু ঐরূপ প্রার্থনা করা অতি নীচু দরের ধর্ম, ভিখারীর ধর্ম।

‘উষিত্বা জাহ্নবীতীরে কূপং খনতি দুর্মতিঃ।’

সে ব্যক্তি বাস্তবিকই মূর্খ, যে গঙ্গাতীরে বাস করে জলের জন্য আবার কুয়া খোঁড়ে।

এই-সব আরোগ্য, ঐশ্বর্য ও ঐহিক অভ্যুদয়ের জন্য প্রার্থনাকে ভক্তি বলা যায় না-এগুলি অতি নিম্নস্তরের কর্ম। ভক্তি এর চেয়ে উঁচু জিনিষ। আমরা রাজরাজের সামনে আসবার চেষ্টা করছি। আমরা সেখানে ভিখারীর বেশে যেতে পারি না। যদি আমরা কোন মহারাজার সম্মুখে উপস্থিত হতে ইচ্ছা করি, ভিখারীর মত ছেঁড়া ময়লা কাপড় পরে গেলে সেখানে কি ঢুকতে দেবে? কখনই নয়। দরোয়ান আমাদের ফটক থেকে বার করে দেবে।

ভগবান্ রাজার রাজা-আমরা তাঁর সামনে কখনও ভিক্ষুকের বেশে যেতে পারি না। দোকানদারদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই-সেখানে কেনাবেচা একেবারেই চলবে না। তোমরা বাইবেলেও পড়েছ, যীশু ক্রেতা-বিক্রেতাদের মন্দির থেকে বার করে দিয়েছিলেন।

সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, ভক্ত হবার জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, স্বর্গাদির কামনা একেবারে দূর করে দেওয়া। এরূপ স্বর্গ এই জায়গারই-এই পৃথিবীরই মত, না হয় এর চেয়ে একটু ভাল। খ্রীষ্টানদের স্বর্গের ধারণা এই যে, সেটা একটা তীব্র ভোগের জায়গা। তা কি করে ভগবান্ হতে পারে? এই যে সব স্বর্গে যাবার বাসনা-এ সুখভোগেরই কামনা। এ বাসনা ত্যাগ করতে হবে। ভক্তের ভালবাসা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ হওয়া চাই-নিজের জন্য ইহলোকে বা পরলোকে কোন কিছু আকাঙ্ক্ষা করা হবে না।

সুখদুঃখ, লাভক্ষতি-এ-সকলের বাসনা ত্যাগ করে দিবারাত্র ঈশ্বরোপাসনা কর, এক মুহূর্তও যেন বৃথা নষ্ট না হয়।

আর সব চিন্তা ত্যাগ করে দিবারাত্র সর্বান্তঃকরণে ঈশ্বরের উপাসনা কর। এইরূপে দিবারাত্র উপাসিত হলে তিনি নিজ স্বরূপ প্রকাশ করেন, তিনিই তাঁর উপাসকদের শক্তি দেন-যাতে তারা তাঁকে অনুভব করতে পারে।

বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট

প্রকৃত গুরু তিনি, আমরা যাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। তিনিই সেই প্রণালী, যাঁর মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক প্রবাহ আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তিনিই সমগ্র আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে আমাদের সংযোগসূত্র। ব্যক্তিবিশেষের উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস থেকে দুর্বলতা ও পৌত্তলিকতা আসতে পারে; কিন্তু গুরুর প্রতি প্রবল অনুরাগে খুব দ্রুত উন্নতি সম্ভবপর হয়, তিনি আমাদের ভিতরের গুরুর সঙ্গে সংযোগ করে দেন। যদি তোমার গুরুর ভিতরে যথার্থ সত্য থাকে, তবে তাঁর আরাধনা কর, ঐ গুরুভক্তিই তোমাকে অতি চরম অবস্থায় নিয়ে যাবে।

শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্রতা ছিল শিশুর মত। তিনি জীবনে কখনও টাকা স্পর্শ করেননি, আর তাঁর ভিতরে কাম একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় ধর্মাচার্যদের কাছে জড়বিজ্ঞান শিখতে যেও না, তাঁদের সমগ্র শক্তি আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিতর মানুষ-ভাবটা মরে গিছল, কেবল ঈশ্বরত্ব অবশিষ্ট ছিল। বাস্তবিকই তিনি পাপ দেখতে পেতেন না-যে-চোখে মানুষ পাপ বা অন্যায় দেখে, তার চেয়ে তাঁর দৃষ্টি পবিত্রতর ছিল।

এইরূপ অল্প কয়েকজন পরমহংসের পবিত্রতাই সমগ্র জগৎটাকে ধারণ করে রেখেছে। যদি এঁদের ধারা লুপ্ত হয়ে যায়, সকলেই যদি জগৎটাকে ত্যাগ করে যান, তা হলে জগৎ খণ্ড খণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁরা কেবল নিজে মহোচ্চ পবিত্র জীবন যাপন করে লোকের কল্যাণ-বিধান করেন, কিন্তু তাঁরা যে অপরের কল্যাণ করছেন, তা তাঁরা টেরও পান না; তাঁরা নিজেরা আদর্শ জীবনযাপন করেই সন্তুষ্ট থাকেন।

 

* * *

আমাদের ভিতর যে জ্ঞানজ্যোতিঃ বর্তমান রয়েছে, শাস্ত্র তার আভাস দিয়ে থাকে, আর তাকে অভিব্যক্ত করবার উপায় বলে দেয়, কিন্তু যখন আমরা নিজেরা সেই জ্ঞানলাভ করি, তখনই আমরা ঠিক ঠিক শাস্ত্র বুঝতে পারি। যখন তোমার ভিতরে সেই অন্তর্জ্যোতির প্রকাশ হয়, তখন আর শাস্ত্রে কি প্রয়োজন?-তখন কেবল অন্তরের দিকে দৃষ্টিপাত কর। সমুদয় শাস্ত্রে যা আছে, তোমার নিজের মধ্যেই তা আছে, বরং তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী আছে। নিজের উপর বিশ্বাস কখনও হারিও না, এ জগতে তুমি সব করতে পার। কখনও নিজেকে দুর্বল ভেব না, সব শক্তি তোমার ভিতর রয়েছে।

প্রকৃত ধর্ম যদি শাস্ত্রের উপর বা কোন মহাপুরুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তবে চুলোয় যাক সব ধর্ম, চুলোয় যাক সব শাস্ত্র। ধর্ম আমাদের নিজেদের ভিতর রয়েছে। কোন শাস্ত্র বা কোন গুরু আমাদের তাঁকে লাভ করবার জন্য সাহায্য ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। এমন-কি এদের সহায়তা ছাড়াও আমাদের নিজেদের ভিতরেই সব সত্য লাভ করতে পারি। তথাপি শাস্ত্র ও আচার্যগণের প্রতি কৃতজ্ঞ হও, কিন্তু এরা যেন তোমায় বদ্ধ না করেন; তোমার গুরুকে ঈশ্বর বলে উপাসনা কর, কিন্তু অন্ধভাবে তাঁর অনুসরণ কর না।

তাঁকে যতদূর সম্ভব ভালবাস, কিন্তু স্বাধীনভাবে চিন্তা কর। কোনরূপ অন্ধবিশ্বাস তোমায় মুক্তি দিতে পারে না, তুমি নিজেই নিজের মুক্তি-সাধন কর। ঈশ্বরসম্বন্ধে এই একটিমাত্র ধারণা পোষণ কর যে, তিনি আমাদের চিরকালের সহায়।

স্বাধীনতার ভাব এবং উচ্চতম প্রেম-দুই-ই একসঙ্গে থাকা চাই, তা হলে এদের মধ্যে কোনটাই আমাদের বন্ধনের কারণ হতে পারে না। আমরা ভগবানকে কিছু দিতে পারি না, তিনিই আমাদের সব দিয়ে থাকেন, তিনি সকল গুরুর গুরু। তিনি আমাদের আত্মার আত্মা, আমাদের যথার্থ স্বরূপ। যখন তিনি আমাদের আত্মার অন্তরাত্মা, তখন আমরা যে তাঁকে ভালবাসব, এ আর আশ্চর্য কি? আর কাকে বা কোন্ বস্তুকে আমরা ভালবাসতে পারি?

আমরা হতে চাই সেই স্থির অগ্নিশিখা-যার তাপ নেই, ধোঁয়া নেই! যখন তোমরা কেবল ব্রহ্মকেই দেখবে, তখন আর কার উপকার করতে পারবে? ভগবানের তো আর উপকার করতে পার না? তখন সব সংশয় চলে যায়, সর্বত্র সমত্বভাব এসে যায়। যদি তখন কারও কল্যাণ কর তো নিজেরই কল্যাণ করবে।

এইটি অনুভব কর যে, দানগ্রহীতা তোমার চেয়ে বড়, তুমি যে তার সেবা করছ, তার কারণ-তুমি তার চেয়ে ছোট; এ নয় যে, তুমি বড় আর সে ছোট। গোলাপ যেমন নিজের স্বভাবেই সুগন্ধ বিতরণ করে, আর সুগন্ধ দিচ্ছে বলে সে মোটেই টের পায় না, তুমিও সেই ভাবে দিয়ে যাও।

সেই মহান্ হিন্দু সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এইরূপ নিঃস্বার্থ কর্মের অদ্ভুত দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর সমুদয় জীবনটা ভারতের সাহায্যকল্পে অর্পণ করেছিলেন। তিনিই সতীদাহ-প্রথা বন্ধ করেন। সাধারণতঃ লোকের বিশ্বাস, এই সংস্কার কার্য সম্পূর্ণরূপে ইংরেজদের দ্বারা সাধিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। রাজা রামমোহন রায়ই এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং একে রহিত করবার জন্য গভর্নমেণ্টের সহায়তালাভে কৃতকার্য হন।

যতদিন না তিনি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন, ততদিন ইংরেজরা কিছুই করেনি। তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে বিখ্যাত ধর্মসমাজও স্থাপন করেন, আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়-স্থাপনের জন্য তিন লক্ষ টাকা চাঁদা দেন। তিনি তারপর সরে এলেন এবং বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে তোমরা নিজেরাই এগিয়ে যাও।’ তিনি নামযশ একদম চাইতেন না, নিজের জন্য কোনরূপ ফলাকাঙ্ক্ষা করতেন না।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

জগৎপ্রপঞ্চ অনন্তভাবে অভিব্যক্ত হয়ে ক্রমাগত চলেছে, যেন নাগরদোলা-আত্মা যেন ঐ নাগরদোলায় চড়ে ঘুরছে। এই ক্রম চিরন্তন। এক একজন লোক ঐ নাগরদোলা থেকে নেমে পড়ছে বটে, কিন্তু চিরকাল সেই একরকম ঘটনাই বার বার ঘটছে, আর এই কারণেই লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দেওয়া যেতে পারে; কারণ প্রকৃতপক্ষে সবই তো বর্তমান। যখন আত্মা একটা শৃঙ্খলের ভিতর এসে পড়ে, তখন তাকে সেই শৃঙ্খলের যা কিছু অভিজ্ঞতা তার ভিতর দিয়ে যেতে হবে।

ঐরূপ একটা শৃঙ্খল বা শ্রেণী থেকে আত্মা আর একটা শৃঙ্খল বা শ্রেণীতে চলে যায়, আর কোন কোন শ্রেণীতে এলে তারা আপনাদের ব্রহ্মস্বরূপ অনুভব করে একেবারে তা থেকে বেরিয়ে যায়। ঐরূপ শ্রেণীর বা ঘটনা-পরম্পরার একটি প্রধান ঘটনাকে অবলম্বন করে সমুদয় ঘটনা-শৃঙ্খলটাই টেনে আনা যেতে পারে, আর তার ভিতরের সমুদয় ঘটনাই যথাযথ পাঠ করা যেতে পারে। এই শক্তি সহজেই লাভ করা যায়, কিন্তু এতে বাস্তবিক কোন লাভ নেই, আর ঐ শক্তিলাভের সাধনায় আমাদের সমপরিমাণ আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যয়িত হয়ে যায়। সুতরাং ও-সব বিষয়ের চেষ্টা কর না, ভগবানের উপাসনা কর।

শুক্রবার, ২ অগাস্ট

ভগবদ্-উপলব্ধির জন্য প্রথমে নিষ্ঠা দরকার।

‘সব্‌সে রসিয়ে সব্‌সে বসিয়ে সব্‌কা লীজিয়ে নাম।
হাঁ জী হাঁ জী কর্‌তে রহিয়ে বৈঠিয়ে আপনা ঠাম॥’

সকলের সঙ্গে আনন্দ কর, সকলের সঙ্গে বস, সকলের নাম লও, অপরের কথায় ‘হাঁ, হাঁ’ করতে থাক, কিন্তু নিজের ভাব কোন মতে ছেড় না। এর চেয়ে উচ্চতর অবস্থা-অপরের ভাবে নিজেকে যথার্থ ভাবিত করা। যদি আমিই সব হই, তবে আমার ভাইয়ের সঙ্গে যথার্থভাবে এবং কার্যতঃ সহানুভূতি করতে পারব না কেন? যতক্ষণ আমি দুর্বল, ততক্ষণ আমাকে নিষ্ঠা করে একটা রাস্তা ধরে থাকতে হবে; কিন্তু যখন আমি সবল হব, তখন অপর সকলের মত অনুভব করতে পারব, তাদের সকলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহানুভূতি করতে পারব।

প্রাচীনকালের লোকের ভাব ছিল-অপর সকল ভাব নষ্ট করে একটা ভাবকে প্রবল করা। আধুনিক ভাব হচ্ছে-সকল বিষয়ে সামঞ্জস্য রেখে উন্নতি করা। একটা তৃতীয় পন্থা হচ্ছে-মনের বিকাশ করা ও তাকে সংযত করা, তারপর যেখানে ইচ্ছা তাকে প্রয়োগ কর-তাতে ফল খুব শীঘ্র হবে। এইটি হচ্ছে যথার্থ আত্মোন্নতির উপায়। একাগ্রতা শিক্ষা কর, আর যে দিকে ইচ্ছা তাকে প্রয়োগ কর। এরূপ করলে তোমার কিছুই ক্ষতি হবে না। যে সমগ্রটাকে পায়, সে অংশটাকেও পায়। দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদের অন্তর্ভুক্ত।

‘আমি প্রথমে তাকে দেখলাম, সেও আমায় দেখলে; আমিও তার প্রতি কটাক্ষ করলাম, সেও আমার প্রতি কটাক্ষ করলে’-এইরূপ চলতে লাগলো। শেষে দুটি আত্মা এমন সম্পূর্ণভাবে মিলিত হয়ে গেল যে, তারা প্রকৃতপক্ষে এক হয়ে গেল।৬৬

* * *

সমাধির দু-টি ভাব আছেঃ এক ভাবে আমি নিজেরই ধ্যান করি, আর এক ভাবে বাইরের বস্তু ধ্যান করি। তারপর ধ্যানের ধ্যাতা ধ্যেয় অভেদ হয়ে যায়।

প্রত্যেক বিশেষ বিশেষ ভাবের সঙ্গে তোমাকে সহানুভূতি-সম্পন্ন হতে হবে, তারপর একেবারে উচ্চতম অদ্বৈতভাবে লাফিয়ে যেতে হবে। নিজে সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থা লাভ করে তারপর ইচ্ছা করলে নিজেকে আবার সীমাবদ্ধ করতে পার। প্রত্যেক কাজে নিজের সমুদয় শক্তি প্রয়োগ কর। খানিকক্ষণের জন্য অদ্বৈতভাব ভুলে দ্বৈতবাদী হবার শক্তিলাভ করতে হবে, আবার যখন খুশী যেন ঐ অদ্বৈতভাব আশ্রয় করতে পারা যায়।

* * *

কার্য-কারণ সব মায়া, আর আমরা যত বড় হব, ততই বুঝব যে, ছোট ছেলেদের পরীর গল্প এখন যেমন আমাদের কাছে বোধ হয়, তেমনি যা কিছু আমরা দেখছি, সবই ঐরূপ অসম্বদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে কার্য-কারণ বলে কিছু নেই, আর আমরা কালে তা জানতে পারব। সুতরাং যদি পার তো যখন কোন রূপক-গল্প শুনবে, তখন তোমার বুদ্ধিবৃত্তিকে একটু নামিয়ে এন, মনে মনে ঐ গল্পের পূর্বাপর সঙ্গতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলো না। হৃদয়ে রূপক-বর্ণনা ও সুন্দর কবিত্বের প্রতি অনুরাগের বিকাশ কর, তারপর সমুদয় পৌরাণিক বর্ণনাগুলিকে কবিত্ব মনে করে উপভোগ কর।

পুরাণ-চর্চার সময় ইতিহাস ও যুক্তিবিচারের দৃষ্টি নিয়ে এস না। ঐ-সব পৌরাণিক ভাবগুলি তোমার মনের ভিতর দিয়ে প্রবাহকারে চলে যাক। তোমার চোখের সামনে তাকে মশালের মত ঘোরাও, কে মশালটা ধরে রয়েছে-এ প্রশ্ন কর না, তা হলেই একটা আলোক-চক্র দেখতে পাবে; এতে যে সত্যের কণা অন্তর্নিহিত রয়েছে, তা তোমার মনে থেকে যাবে।

পুরাণ-লেখকেরা সকলেই-তাঁরা যা যা দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন, সেইগুলি রূপকভাবে লিখে গেছেন। তাঁরা কতকগুলি প্রবাহকার-চিত্র এঁকে গেছেন। তার ভিতর থেকে কেবল তার প্রতিপাদ্য বিষয়টা বার করবার চেষ্টা করে ছবিগুলিকে নষ্ট করে ফেল না। সেগুলিকে যথাযথ গ্রহণ কর, সেগুলি তোমার উপর কাজ করুক। এদের ফলাফল দেখে বিচার কর-তাদের মধ্যে যেটুকু ভাল আছে, সেইটুকুই নাও।

তোমার নিজের ইচ্ছাশক্তিই তোমার প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকে-তবে বিভিন্ন ব্যক্তির মনের ধর্মসম্বন্ধীয় বিভিন্ন ধারণা অনুসারে সেটা বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পায়। আমরা তাকে বুদ্ধ, যীশু, জিহোবা, আল্লা বা অগ্নি-যেমন ইচ্ছা নাম দিতে পারি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই হচ্ছে আমাদের ‘আমি’ বা আত্মা।

আমাদের ধারণার ক্রমে উৎকর্ষ হতে থাকে, কিন্তু ঐ ধারণা যে-সকল রূপকাকারে আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়, তাদের কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই। আমাদের অলৌকিক দর্শনসমুহ অপেক্ষা মুশার অলৌকিক দর্শনে ভুলের সম্ভাবনা অধিক, কারণ আমাদের অধিকতর জ্ঞান এবং মিথ্যা ভ্রম দ্বারা প্রতারিত হবার সম্ভাবনা আমাদের অনেক কম।

জগতে এ পর্যন্ত যত বাইবেল, খ্রীষ্ট বা বুদ্ধ হয়েছেন, সব আমাদেরই আলোকে আলোকিত। এই আলোক ব্যতীত ঐগুলি আমাদের পক্ষে আর জীবন্ত থাকবে না, মৃত হয়ে যাবে। তোমার নিজ আত্মার উপর দাঁড়াও।

যতদিন না আমাদের হৃদয়-রূপ আশ্রয় খুলছে, ততদিন শাস্ত্রপাঠ বৃথা। তখন ঐ শাস্ত্রগুলি আমাদের হৃদয়শাস্ত্রের সঙ্গে যতটা মেলে, ততটাই তাদের সার্থকতা। শক্তি কি, তা শক্তিমান্ ব্যক্তিই বুঝতে পারে; হাতিই সিংহকে বুঝতে পারে, ইঁদুর কখনও সিংহকে বুঝতে পারে না। আমরা যতদিন না যীশুর সমান হচ্ছি, ততদিন আমরা কেমন করে যীশুকে বুঝব? দুখানা পাঁউরুটিতে ৫০০০ লোক খাওয়ানো, অথবা ৫ খানা পাঁউরুটিতে দুজন লোক খাওয়ানো-এই দুই-ই মায়ার স্বপ্নরাজ্যে।

এদের মধ্যে কোনটাই সত্য নয়, সুতরাং এই দুটোর কোনটাই অপরটির দ্বারা বাধিত হয় না। মহত্ত্বই কেবল মহত্ত্বের আদর করতে পারে, ঈশ্বরই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেন। স্বপ্ন সেই স্বপ্নদ্রষ্টাই-তা ছাড়া আর কিছু নয়, তার অন্য কোন ভিত্তি নেই। ঐ স্বপ্ন বা স্বপ্নদ্রষ্টা পৃথক্ বস্তু নয়। সমগ্র সঙ্গীতটার ভিতর ‘সোঽহম্, সোঽহম্’-এই এক সুরে বাজছে, অন্যান্য সুরগুলি তারই ওলট-পালট মাত্র, সুতরাং তাতে মূল সুরের-মূল তত্ত্বের কিছু এসে যায় না।

জীবন্ত শাস্ত্র আমরাই, আমরা যে-সব কথা বলেছি, সেগুলিই শাস্ত্র বলে পরিচিত। সবই জীবন্ত ঈশ্বর, জীবন্ত খ্রীষ্ট-ঐভাবে সব দর্শন কর। মানুষকে অধ্যয়ন কর, মানুষই জীবন্ত কাব্য। জগতে এ পর্যন্ত যত বাইবেল, খ্রীষ্ট বা বুদ্ধ হয়েছেন, সব আমাদেরই আলোকে আলোকিত। এই আলোক ব্যতীত ঐগুলি আমাদের পক্ষে আর জীবন্ত থাকবে না, মৃত হয়ে যাবে। তোমার নিজ আত্মার উপর দাঁড়াও।

মৃতদেহের সঙ্গে যেরূপ ব্যবহারই কর না, তাতে সে ক্ষুব্ধ হয় না। আমাদের দেহকে ঐরূপ মৃতবৎ করে ফেলতে হবে, আর দেহের সঙ্গে যে আমাদের অভিন্ন ভাব রয়েছে, সেটা দূর করে ফেলতে হবে।

শনিবার, ৩ অগাস্ট

যে-সকল ব্যক্তি এই জন্মেই মুক্তিলাভ করতে চায়, তাদের এক জন্মেই হাজার বছরের জীবন যাপন করতে হয়। তারা যে যুগে জন্মেছে, সেই যুগের ভাবের চেয়ে তাদের অনেক এগিয়ে যেতে হয়; কিন্তু সাধারণ লোক কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণের উৎপত্তি এইরূপেই।

* * *
একদা এক হিন্দু রানী৬৭ ছিলেন, তাঁর ছেলেরা এই জন্মেই মুক্তিলাভ করুক-এ বিষয়ে তাঁর এত আগ্রহ হয়েছিল যে, তিনি নিজেই তাদের লালন-পালনের সম্পূর্ণ ভার নিয়েছিলেন। তাঁদের শৈশবে যখন তিনি তাদের দোল দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন, তখন সর্বদা তাদের কাছে এই একটি গান গাইতেন-‘তত্ত্বমসি, তত্ত্বমসি’-তুমি সেই আত্মা, তুমি সেই ব্রহ্ম। তাদের তিনজন সন্ন্যাসী হয়ে গেল, কিন্তু চতুর্থ পুত্রকে রাজা করবার জন্য অন্যত্র নিয়ে গিয়ে মানুষ করা হতে লাগল।

বিদায় দেবার সময় মা তাকে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বললেন, ‘বড় হলে পড় এতে কি লেখা আছে’। সেই কাগজখানাতে লেখা ছিল-‘ব্রহ্ম সত্য, আর সব মিথ্যা। আত্মা কখনও মরেন না, কখনও মারেনও না। নিঃসঙ্গ হও, অথবা সৎসঙ্গে বাস কর।’ যখন রাজপুত্র বড় হয়ে লেখাটি পড়লেন, তিনিও তখনই সংসারত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন।

ত্যাগ কর, সংসার ত্যাগ কর। আমরা এখন যেন একপাল কুকুর-রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছি, এক টুকরো মাংস খাচ্ছি, আর ভয়ে এদিক্ ওদিক্ চেয়ে দেখছি, পাছে কেউ এসে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তা না হয়ে রাজার মত হও-জেনো যে, সমুদয় জগৎ তোমার। যতক্ষণ না তুমি সংসার ত্যাগ করছ, যতক্ষণ সংসার তোমায় বাঁধতে থাকবে; ততক্ষণ ঐ ভাবটি তোমার আসতেই পারে না। যদি বাইরে ত্যাগ করতে না পার, মনে মনে সব ত্যাগ কর। অন্তরের অন্তর থেকে সব ত্যাগ কর। বৈরাগ্যসম্পন্ন হও।

এই হল যথার্থ আত্মত্যাগ-এ না হলে ধর্মলাভ অসম্ভব। কোন প্রকার বাসনা কর না; কারণ যা বাসনা করবে তাই পাবে। আর সেইটাই তোমার ভয়ানক বন্ধনের কারণ হবে, যেমন সেই গল্পে আছে-এক ব্যক্তি তিনটি বর লাভ করেছিল এবং তার ফলে তার সর্বাঙ্গে নাক৬৮ হয়েছিল, বাসনা করলে ঠিক সেই রকম হয়। যতক্ষণ না আমরা আত্মরত ও আত্মতৃপ্ত হচ্ছি, ততক্ষণ মুক্তিলাভ করতে পারছি না। ‘আত্মই আত্মার মুক্তিদাতা, অন্য কেউ নয়।’

এইটি অনুভব করতে শিক্ষা কর যে, তুমি অন্য সকলের দেহেও বর্তমান-এইটি জানবার চেষ্টা কর যে, আমরা সকলেই এক। আর সব বাজে জিনিষ ছেড়ে দাও। ভালমন্দ কাজ যা করেছ, সেগুলি সম্বন্ধে একদম ভেব না-সেগুলি থু থু করে উড়িয়ে দাও। যা করেছ, করেছ। কুসংস্কার দূর করে দাও। সম্মুখে মৃত্যু এলেও দুর্বলতা আশ্রয় কর না।

সকল কর্মের ভার ভগবানের উপর ফেলে দাও, ভাল-মন্দ-সব দাও। নিজে ভালটা রেখে কেবল মন্দটা তাঁর ঘাড়ে চাপিও না। যে নিজেকে নিজে সাহায্য করে, ভগবান্ তাকেই সাহায্য করেন।

অনুতাপ কর না-পূর্বে যে-সব কাজ করেছ, সে-সব নিয়ে মাথা ঘামিও না; এমন কি-যে-সব ভাল কাজ করেছ, তাও স্মৃতিপথ থেকে দূর করে দাও। আজাদ (মুক্ত) হও। দুর্বল, কাপুরুষ ও অজ্ঞ ব্যক্তিরা কখনও আত্মাকে লাভ করতে পারে না। তুমি কোন কর্মের ফলকে নষ্ট করতে পার না-ফল আসবেই আসবে; সুতরাং সাহসী হয়ে তার সম্মুখীন হও, কিন্তু সাবধান, যেন পুনর্বার সেই কাজ কর না। সকল কর্মের ভার ভগবানের উপর ফেলে দাও, ভাল-মন্দ-সব দাও। নিজে ভালটা রেখে কেবল মন্দটা তাঁর ঘাড়ে চাপিও না। যে নিজেকে নিজে সাহায্য করে, ভগবান্ তাকেই সাহায্য করেন।

* * *
বাসনা-মদিরা পান করে সমস্ত জগৎ মত্ত হয়েছে। ‘যেমন দিবা ও রাত্রি কখনই একসঙ্গে থাকতে পারে না, সেইরূপ বাসনা ও ভগবান্ দুই কখনও একসঙ্গে থাকতে পারে না।’৬৯ সুতরাং বাসনা ত্যাগ কর।

‘খাবার, খাবার’ বলে চেঁচান এবং খাওয়া, ‘জল, জল’ বলে চেঁচান এবং জল পান করা-এই দুটোর ভিতর আকাশ-পাতাল তফাত; সুতরাং কেবল ‘ঈশ্বর, ঈশ্বর’ বলে চেঁচালে কখনও ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির আশা করতে পারা যায় না। আমাদের ঈশ্বরলাভ করবার চেষ্টা ও সাধনা করতে হবে।

সমুদ্রের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেলেই তরঙ্গ অসীমত্ব লাভ করতে পারে, কিন্তু তরঙ্গরূপে নয়। তারপর সমুদ্রস্বরূপ হয়ে গিয়ে আবার তরঙ্গাকার ধারণ করতে পারে ও যত বড় ইচ্ছা তত বড় তরঙ্গ হতে পারে। নিজেকে তরঙ্গপ্রবাহ বলে মনে কর না; জেন যে তুমি মুক্ত।

প্রকৃত দর্শনশাস্ত্র হচ্ছে-কতকগুলি প্রত্যক্ষানুভূতিকে প্রণালীবদ্ধ করা। যেখানে বুদ্ধিবিচারের শেষ, সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ। সমাধি বা ঈশ্বরভাবাবেশ যুক্তিবিচারের চেয়ে ঢ়ের বড়, কিন্তু ঐ অবস্থায় উপলব্ধ সত্যগুলি কখনও যুক্তিবিচারের বিরোধী হবে না। যুক্তিবিচার মোটা হাতিয়ারের মত, তা দিয়ে শ্রমসাধ্য কাজগুলি করতে পারা যায়, আর সমাধি বা ঈশ্বরভাবাবেশ (inspiration) উজ্জ্বল আলোকের মত সমগ্র সত্য দেখিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের ভিতর একটা কিছু করবার ইচ্ছা বা প্রেরণা আসাকেই ঈশ্বরভাবাবেশ (inspiration) বলতে পারা যায় না।

মায়ার ভিতর উন্নতি করা বা অগ্রসর হওয়াকে একটি বৃত্ত বলে বর্ণনা করা যেতে পারে-এতে এই হয় যে, যেখান থেকে তুমি যাত্রা করেছিলে, ঠিক সেইখানে এসে পৌঁছবে। তবে প্রভেদ এই যে, যাত্রা করবার সময় তুমি অজ্ঞান ছিলে, আর যখন সেখানে ফিরে আসবে, তখন তুমি পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছ। ঈশ্বরোপাসনা, সাধু-মহাপুরুষদের পূজা, একাগ্রতা, ধ্যান, নিষ্কাম কর্ম-মায়ার জাল কেটে বেরিয়ে আসবার এই-সব উপায়; তবে প্রথমেই আমাদের তীব্র মুমুক্ষুত্ব থাকা চাই।

যে জ্যোতিঃ দপ্ করে প্রকাশ হয়ে আমাদের হৃদয়ান্ধকার দূর করে দেবে, তা আমাদের ভিতরেই রয়েছে-এ হচ্ছে সেই জ্ঞান, যা আমাদের স্বভাব বা স্বরূপ (ঐ জ্ঞানকে আমাদের ‘জন্মগত অধিকার’ বলা যেতে পারে না, কারণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্মই নেই)। কেবল যে মেঘগুলো ঐ জ্ঞানসূর্যকে ঢেকে রেখেছে, সেইগুলো আমাদের দূর করে দিতে হবে।

ইহলোকে বা স্বর্গে সর্বপ্রকার ভোগ করবার বাসনা ত্যাগ কর (ইহামুত্র-ফলভোগ-বিরাগ)। ইন্দ্রিয় ও মনকে সংযত কর (দম ও শম)। সর্বপ্রকার দুঃখ সহ্য কর, মন যেন জানতেই না পারে যে, তোমার কোনরূপ দুঃখ এসেছে (তিতিক্ষা)। মুক্তি ছাড়া আর সব ভাবনা দূর করে দাও, গুরু ও তাঁর উপদেশে বিশ্বাস রাখ।

তুমি যে নিশ্চয়ই মুক্ত হতে পারবে, এটিও বিশ্বাস কর (শ্রদ্ধা)। যাই হোক না কেন, সর্বদা বল, ‘সোঽহম্, সোঽহম্’। খেতে বেড়াতে, কষ্টে পড়েও বল ‘সোঽহম্, সোঽহম্’; মনকে অবিরত ভাবে বল-এই যে জগৎপ্রপঞ্চ দেখছি, কোন কালে এর অস্তিত্ব নেই, কেবল আমি-মাত্র আছি (সমাধান)। দেখবে-একদিন দপ্ করে জ্ঞানের প্রকাশ হয়ে বোধ হবে-জগৎ শূন্যমাত্র, কেবল ব্রহ্মই আছেন। মুক্ত হবার জন্য প্রবল ইচ্ছাসম্পন্ন হও (মুমুক্ষুত্ব)।৭০

আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব সব পুরানো অন্ধকূপের মত; আমরা ঐ অন্ধকূপে পড়ে কর্তব্য, বন্ধন প্রভৃতি নানা স্বপ্ন দেখে থাকি-ঐ স্বপ্নের আর শেষ নেই। কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে আর ভ্রমের সৃষ্টি কর না। এ যেন বটগাছের মত ক্রমাগত ঝুরি নামিয়ে বাড়তেই থাকে। যদি তুমি দ্বৈতবাদী হও, তবে ঈশ্বরকে সাহায্য করতে চাওয়াই তোমার মূর্খতা। আর যদি অদ্বৈতবাদী হও, তবে তুমি তো স্বয়ংই ব্রহ্মস্বরূপ-তোমার আবার কর্তব্য কি? তোমার স্বামী, ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধব-কারও প্রতি কিছু কর্তব্য নেই।৭১ যা হচ্ছে হয়ে যাক্, চুপচাপ করে পড়ে থাক।

“রামপ্রসাদ বলে-ভব-সাগরে বসে আছি ভাসিয়ে ভেলা;
যখন আসবে জোয়ার উজিয়ে যাব, ভাটিয়ে যাব ভাটার বেলা॥”

শরীর মরে মরুক-আমার যে একটা দেহ আছে, এটা তো একটা পুরানো উপকথা বৈ আর কিছুই নয়। চুপচাপ করে থাক, আর জান, আমি ব্রহ্ম।

কেবল বর্তমান কালই বিদ্যমান-আমরা চিন্তায় পর্যন্ত অতীত ও ভবিষ্যতের ধারণা করতে পারি না; কারণ চিন্তা করতে গেলেই তাকে ‘বর্তমান’ করে ফেলতে হয়। সব ছেড়ে দাও, তার যেখানে যাবার ভেসে যাক। এই সমগ্র জগৎটাই একটা ভ্রমমাত্র, এটা যেন তোমায় আর প্রতারিত করতে না পারে। জগৎটা যা নয়, তুমি তাকে তাই বলে জেনেছ, অবস্তুতে বস্তু জ্ঞান করেছ, এখন এটা বাস্তবিক যা, একে তাই বলে জান। যদি দেহটা কোথাও ভেসে যায়, যেতে দাও; দেহ যেখানেই যাক না কেন, কিছু গ্রাহ্য কর না। কর্তব্যের নিদারুণ ধারণা ভীষণ কালকূট-স্বরূপ, জগৎ ধ্বংস করে ফেলছে।

স্বর্গে গেলে একটা বীণা পাবে, আর তাই বাজিয়ে যথাসময়ে বিশ্রাম-সুখ অনুভব করবে-এর জন্য অপেক্ষা কর না। এইখানেই একটা বীণা নিয়ে আরম্ভ করে দাও না কেন? স্বর্গে যাবার জন্য অপেক্ষা করা কেন? ইহালোকটাকেই স্বর্গ করে ফেল। স্বর্গে বিবাহ করা নেই, বিবাহ দেওয়াও নেই-তাই যদি হয়, এখনই তা আরম্ভ করে দাও না কেন? এইখানেই বিবাহ তুলে দাও না কেন? সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন মুক্তপুরুষের চিহ্ন। সংসারিত্ব-রূপ ভিক্ষুকের বেশ ফেলে দাও। মুক্তির পতাকা-গৈরিক বস্ত্র ধারণ কর।

রবিবার, ৪ অগাস্ট

‘অজ্ঞ ব্যক্তিরা যাঁকে না জেনে উপাসনা করছে, আমি তোমার নিকট তাঁরই কথা প্রচার করছি।’

এই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মই সকল জ্ঞাত বস্তুর চেয়ে আমাদের অধিক জ্ঞাত। তিনিই সেই এক বস্তু, যাঁকে আমরা সর্বত্র দেখছি। সকলেই তাদের নিজ আত্মাকে জানে; সকলেই-এমন-কি পশুরা পর্যন্ত জানে যে ‘আমি আছি’। আমরা যা কিছু জানি সব আত্মারই বহিঃক্ষেপ-বিস্তার-স্বরূপ। ছোট ছোট ছেলেদের শেখাও, তারাও এ তত্ত্ব ধারণা করতে পারে। অজ্ঞাতসারে হলেও প্রত্যেক ধর্ম এই আত্মাকেই উপাসনা করে এসেছে, কারণ আত্মা ছাড়া আর কিছু নেই।

আমরা এই জীবনটাকে এখানে যেমন ভাবে জানি, তার প্রতি এরূপ অশোভন আসক্তি সমুদয় অনিষ্টের মূল। এই থেকেই যত সব প্রতারণা ও চুরি হয়ে থাকে। এরই জন্য লোকে টাকাকে দেবতার আসন দেয়, আর তা থেকেই যত পাপ ও ভয়ের উৎপত্তি। কোন জড়বস্তুকে মূল্যবান্ বলে মনে কর না, আর তাতে আসক্ত হয়ো না। তুমি যদি কিছুতে, এমন-কি জীবনে পর্যন্ত আসক্ত না হও, তা হলে আর কোন ভয় থাকবে না।

‘মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি’৭২ যিনি এই জগতে নানা দেখেন, তিনি মৃত্যুর পর মৃত্যুকে প্রাপ্ত হন, বরাবর তিনি মৃত্যুর কবলে পড়েন। আমরা যখন সবই এক দেখি, তখন আমাদের শারীরিক মৃত্যুও থাকে না, মানসিক মৃত্যুও থাকে না। জগতের সকল দেহই আমার, সুতরাং আমার দেহ চিরকাল থাকবে; কারণ গাছপালা, জীবজন্তু, চন্দ্রসূর্য, এমন-কি সমগ্র জগদ্‌ব্রহ্মাণ্ডই আমার দেহ-ঐ দেহের আর নাশ হবে কি করে?

প্রত্যেক মন, প্রত্যেক চিন্তাই যে আমার-তবে মৃত্যু আসবে কি করে? আত্মা কখনও জন্মানও না, মরেনও না-যখন আমরা এইটি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করি, তখন সকল সন্দেহ উড়ে যায়; ‘আমি আছি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ভালবাসি’-‘অস্তি, ভাতি, প্রিয়’-এগুলির উপর কখনই সন্দেহ করা যেতে পারে না। আমার ক্ষুধা বলে কিছু থাকতে পারে না, কারণ জগতে যে-কেউ যা-কিছু খাচ্ছে, তা আমিই খাচ্ছি। যদি একগাছা চুল উঠে যায়, আমরা মনে করি না যে আমরা মরে গেলাম। সেই রকম যদি একটা দেহের মৃত্যু হয়, সে তো ঐ একগাছা চুল উঠে যাওয়ারই মত।

অতএব যদি ঈশ্বরলাভের কামনা কর, তবে ব্রহ্মবিদের পূজা কর। যখন আমরা তিনটি দেবানুগ্রহ-মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব ও মহাপুরুষসংশ্রয় লাভ করি, তখনই বুঝতে হবে-মুক্তি আমাদের করতলগত।

সেই জ্ঞানাতীত বস্তুই ঈশ্বর-তিনি বাক্যের অতীত, চিন্তার অতীত, জ্ঞানের অতীত। … তিনটে অবস্থা আছে-পশুত্ব (তমঃ), মনুষ্যত্ব (রজঃ) ও দেবত্ব (সত্ত্ব)। যাঁরা সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করেন, তাঁরা অস্তিমাত্র বা সৎস্বরূপ হয়ে থাকেন। তাঁদের পক্ষে কর্তব্য একেবারে শেষ হয়ে যায়, তাঁরা মানুষকে কেবল ভালবাসেন, আর চুম্বকের মত অপরকে তাঁদের দিকে আকর্ষণ করেন। এরই নাম মুক্তি। তখন আর চেষ্টা করে কোন সৎকার্য করতে হয় না, তখন তুমি যে কাজ করবে তাই সৎকার্য হয়ে যাবে।

ব্রহ্মবিৎ সকল দেবতার চেয়েও বড়। যীশুখ্রীষ্ট যখন মোহকে জয় করে বলেছিলেন, ‘শয়তান, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা’, তখনই দেবতারা তাঁকে পূজা করতে এসেছিলেন। ব্রহ্মবিৎকে কেউ কিছু সাহায্য করতে পারে না, সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁর সামনে প্রণত হয়ে থাকে, তাঁর সকল বাসনাই পূর্ণ হয়, তাঁর আত্মা অপরকে পবিত্র করে থাকে। অতএব যদি ঈশ্বরলাভের কামনা কর, তবে ব্রহ্মবিদের পূজা কর। যখন আমরা তিনটি দেবানুগ্রহ-মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব ও মহাপুরুষসংশ্রয় লাভ করি, তখনই বুঝতে হবে-মুক্তি আমাদের করতলগত।’৭৩

* * *

চিরকালের জন্য দেহের মৃত্যুর নামই ‘নির্বাণ’। এটা নির্বাণ-তত্ত্বের ‘না’-এর দিক্, এতে বলে-আমি এটা নই, ওটা নই। বেদান্ত আর একটু অগ্রসর হয়ে ‘হাঁ’-এর দিকটা বলেন-ওরই নাম মুক্তি। ‘আমি সৎ-চিৎ-আনন্দ, সোঽহম্-আমিই সেই’; এই হল বেদান্ত-নিখুঁতভাবে তৈরী একটি খিলানের যেন শীর্ষপ্রস্তর।

বৌদ্ধধর্মের মহাযান-সম্প্রদায়ের বেশীর ভাগ লোকই মুক্তিতে বিশ্বাসী-তারা যথার্থই বৈদান্তিক। কেবল সিংহলবাসীরাই নির্বাণের ‘বিনাশ’ অর্থ গ্রহণ করে।

কোনরূপ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস ‘আমি’কে নাশ করতে পারে না। যার অস্তিত্ব বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে এবং অবিশ্বাসে উড়ে যায়, তা ভ্রমমাত্র। আত্মাকে কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। ‘আমি আমার আত্মাকে নমস্কার করি।’ ‘স্বয়ংজ্যোতিঃ আমি নিজেকেই নমস্কার করি, আমি ব্রহ্ম।’ এই দেহটা যেন একটা অন্ধকার ঘর; আমরা যখন ঐ ঘরে প্রবেশ করি, তখনই তা আলোকিত হয়ে ওঠে, তখনই তা জীবন্ত হয়। আত্মার এই স্বপ্রকাশ জ্যোতিকে কিছুই স্পর্শ করতে পারে না, একে কোনমতেই নষ্ট করা যায় না। একে আবৃত করা যেতে পারে, কিন্তু কখনও নষ্ট করা যায় না।

ভারতে বুদ্ধ, শঙ্কর ও অন্যান্য মহামনীষী ব্যক্তিরা এই-সকল ভাব প্রচার করেছিলেন, কিন্তু জনসাধারণ সেগুলিকে ধরে রাখতে পারেনি। এই নূতন যুগে জনসাধারণ বেদান্তের আদর্শানুযায়ী জীবনযাপন করবে, আর মেয়েদের দ্বারাই এটা কাজে পরিণত হবে।

বর্তমান যুগে ভগবানকে অনন্তশক্তিস্বরূপিণী জননী-রূপে উপাসনা করা কর্তব্য। এতে পবিত্রতার উদয় হবে, আর এই মাতৃপূজায় আমেরিকার মহাশক্তির বিকাশ হবে। এখানে (আমেরিকায়) কোন মন্দির (পৌরোহিত্যশক্তি) কাউকে দাবিয়ে রাখছে না, অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলির মত এখানে কেউ কষ্টভোগ করে না। নারীজাতি শত শত যুগ ধরে দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, তাই তাদের ভিতর অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিকাশ হয়েছে। তারা একটা ভাব আঁকড়ে ধরে থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না।

এই জন্যই সকল দেশে তারা এমন-কি কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মসমূ্হের এবং পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষক-স্বরূপ হয়ে থাকে, আর এইটেই পরে তাদের স্বাধীনতার কারণ হবে। বৈদান্তিক হয়ে আমাদের বেদান্তের এই মহান্ ভাবকে জীবনে পরিণত করতে হবে। জনসাধারণকেও ঐ ভাব দিতে হবে-এটা কেবল স্বাধীন আমেরিকাতেই কাজে পরিণত করা যেতে পারে। ভারতে বুদ্ধ, শঙ্কর ও অন্যান্য মহামনীষী ব্যক্তিরা এই-সকল ভাব প্রচার করেছিলেন, কিন্তু জনসাধারণ সেগুলিকে ধরে রাখতে পারেনি। এই নূতন যুগে জনসাধারণ বেদান্তের আদর্শানুযায়ী জীবনযাপন করবে, আর মেয়েদের দ্বারাই এটা কাজে পরিণত হবে।

‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে,
মন, তুমি দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে।
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন ‘মা’ বলে ডাকে। (মাঝে মাঝে)
কুবুদ্ধি কুমন্ত্রী যত, নিকট হতে দিয়ো নাকো,
জ্ঞান-নয়নে প্রহরী রেখো, সে যেন সাবধানে থাকে।’

যত কিছু প্রাণী জীবনধারণ করছে, তুমি সে-সকলের পারে। তুমি আমার জীবনের সুধাকর-স্বরূপ, আমার আত্মারও আত্মা।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

দেহ যেমন মনের হাতে একটা যন্ত্রবিশেষ, মনও তেমনি আত্মার হাতে একটা যন্ত্রস্বরূপ। জড় হচ্ছে বাইরের গতি, মন হচ্ছে ভিতরের গতি। কালেই সমুদয় পরিবর্তন বা পরিণামের আরম্ভ ও সমাপ্তি। আত্মা যদি অপরিণামী হন, তিনি নিশ্চিত পূর্ণস্বরূপ; আর যদি পূর্ণস্বরূপ হন, তবে তিনি অনন্তস্বরূপ; আর অনন্তস্বরূপ হলে অবশ্যই তিনি অদ্বিতীয়; কারণ দুটি অনন্ত থাকতে পারে না, সুতরাং আত্মা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’ই হতে পারেন। যদিও আত্মাকে বহু বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি এক। যদি কোন ব্যক্তি সূর্যের অভিমুখে চলতে থাকে, প্রতি পদক্ষেপে সে এক-একটা বিভিন্ন সূর্য দেখবে বটে, কিন্তু বস্তুতঃ সবগুলি তো সেই একই সূর্য।

‘অস্তিভাব’ই হচ্ছে সর্বপ্রকার একত্বের ভিত্তিস্বরূপ, আর ঐ ভিত্তিতে যেতে পারলেই পূর্ণতা লাভ হয়। যদি সব রংকে এক রঙে পরিণত করা সম্ভব হত, তবে চিত্রবিদ্যাই লোপ পেয়ে যেত। সম্পূর্ণ একত্ব হচ্ছে বিশ্রাম বা লয়; আমরা বলে থাকি-সকল প্রকাশই এক ঈশ্বর থেকে হয়েছে। তাও-বাদী৭৪, কংফুছ (Confucius)-মতাবলম্বী, বৌদ্ধ, হিন্দু, য়াহুদী, মুসলমান, খ্রীষ্টান ও জরথুস্ট্র-শিষ্যগণ (Zoroastrians) সকলেই প্রায় একপ্রকার ভাষায় এই মহৎ নীতি প্রচার করছেন, তুমি অপরের কাছ থেকে যেরূপ ব্যবহার চাও, অপরের প্রতি ঠিক সেইরূপ ব্যবহার কর’-কিন্তু হিন্দুরাই কেবল এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কারণ তাঁরা এর যুক্তি দেখতে পেয়েছিলেন। মানুষ অপর সকলকেই অবশ্য ভালবাসবে; কারণ সেই অপর সকলে যে সে নিজে, সেই এক বস্তুই রয়েছেন কিনা।

জগতে যত বড় বড় ধর্মাচার্য হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল লাওৎসে, বুদ্ধ ও যীশুই উক্ত নীতিরও উপরে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে গেছেন-‘তোমার শত্রুদেরও উপকার কর, যারা তোমায় ঘৃণা করে, তাদেরও ভালবাসো।’

তত্ত্বসমূহ পূর্ব থেকেই রয়েছে; সেগুলি আমরা সৃষ্টি করি না, আবিষ্কার করি মাত্র। ধর্ম কেবল প্রত্যক্ষানুভূতি। বিভিন্ন মতামত-প্রণালী মাত্র, ওগুলি ধর্ম নয়। জগতের যত ধর্ম, সব বিভিন্ন জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী ‘ধর্ম’-এরই বিভিন্ন প্রয়োগমাত্র। শুধু মতবাদ কেবল বিরোধ বাধিয়ে দেয়; দেখ না, কোথায় ঈশ্বরের নামে লোকের শান্তি হবে-তা না হয়ে জগতে যত রক্তপাত হয়েছে, তার অর্ধেক ঈশ্বরের নাম নিয়ে হয়েছে। একেবারে মূলে যাও; স্বয়ং ঈশ্বরকেই জিজ্ঞাসা কর-তাঁর স্বরূপ কি? যদি তিনি কোন উত্তর না দেন, বুঝতে হবে-তিনি নেই। কিন্তু জগতের সকল ধর্মই বলে যে, তিনি উত্তর দিয়ে থাকেন।

আজ আমার সঙ্গেও তিনি কথা কইতে পারেন। তা না হলে কি করে জানব, তিনি মরে যাননি? যে-কোন পথে হোক, ঈশ্বরের কাছে এস-কিন্তু আসা চাই। তবে আসবার সময় যেন কাউকে ঠেলে ফেলে দিও না।

তোমার নিজের যেন কিছু বলবার থাকে, তা না হলে অপরে কি বলেছে, তার কোনরূপ ধারণা করতে পারবে কেন? পুরাতন কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থেক না, সর্বদাই নূতন সত্যসমূহের জন্য প্রস্তুত হও। ‘মূর্খ তারা, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের খোঁড়া কুয়ার নোনতা জল খাবে, কিন্তু অপরের খোঁড়া কুয়ার বিশুদ্ধ জল খাবে না।’ আমরা যতক্ষণ না নিজেরা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করছি, ততক্ষণ তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারি না।

প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বভাবতঃ পূর্ণস্বরূপ। মহাপুরুষেরা তাঁদের এই পূর্ণস্বরূপকে প্রকাশ করেছেন, আমাদের ভিতর এখনও ওটা অব্যক্তভাবে রয়েছে। আমরা কি করে বুঝব যে, মুশা ঈশ্বর দর্শন করেছিলেন- যদি আমরাও তাঁকে দেখতে না পাই? যদি ঈশ্বর কখনও মুশার কাছে এসে থাকেন তো আমার কাছেও আসবেন। আমি একেবারে সোজাসুজি তাঁর কাছে যাব, তিনি যেন আমার সঙ্গে কথা কন।

বিশ্বাসকে ভিত্তি বলে আমি গ্রহণ করতে পারি না-সেটা নাস্তিকতা ও ঘোর ঈশ্বরনিন্দা। যদি ঈশ্বর দু-হাজার বছর আগে আরবের মরুভূমিতে কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলে থাকেন, আজ আমার সঙ্গেও তিনি কথা কইতে পারেন। তা না হলে কি করে জানব, তিনি মরে যাননি? যে-কোন পথে হোক, ঈশ্বরের কাছে এস-কিন্তু আসা চাই। তবে আসবার সময় যেন কাউকে ঠেলে ফেলে দিও না।

জ্ঞানী ব্যক্তিরা অজ্ঞান ব্যক্তিদের করুণা করবেন। যিনি জ্ঞানী, তিনি একটা পিঁপড়ের জন্য পর্যন্ত নিজের দেহ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক থাকেন, কারণ তিনি জানেন দেহটা কিছুই নয়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!