ভবঘুরেকথা
গুরু-শিষ্য সংবাদ

-স্বামী বিবেকানন্দ

তবে গুরু চিনিব কিরূপে? সূর্যকে প্রকাশ করিতে মশালের প্রয়োজন হয় না। সূর্যকে দেখিবার জন্য আর বাতি জ্বালিতে হয় না। সূর্য উঠিলে আমরা স্বভাবতই জানিতে পারি যে সূর্য উঠিয়াছে; এইরূপ আমাদিগকে সাহায্য করিবার জন্য লোকগুরুর আবির্ভাব হইলে আত্মা স্বভাবতই জানিতে পারে যে, তাঁহার উপর সত্যের সূর্যালোক-সম্পাত আরম্ভ হইয়াছে।

সত্য স্বতঃপ্রমাণ, উহা প্রমাণ করিতে অপর কোন সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয় নাই-উহা স্বপ্রকাশ; সত্য আমাদের অন্তস্তলে প্রবেশ করে, উহার সমক্ষে সমগ্র জগৎ দাঁড়াইয়া বলে-‘ইহাই সত্য।’ যে-সকল আচার্যের হৃদয়ে জ্ঞান ও সত্য সূর্যালোকের ন্যায় প্রতিভাত, তাঁহারা জগতের মধ্যে সর্বোচ্চ মহাপুরুষ, আর জগতের অধিকাংশ লোকই তাঁহাদিগকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে।

কিন্তু আমরা অপেক্ষাকৃত অল্পজ্ঞানীর নিকটও আধ্যাত্মিক সাহায্য লাভ করিতে পারি। তবে আমাদের এরূপ অন্তর্দৃষ্টি নাই যে, আমরা আমাদের গুরু বা আচার্যের সম্বন্ধে যথার্থ বিচার করিতে পারি; এই কারণে গুরুশিষ্য উভয়ের সম্বন্ধেই কতকগুলি পরীক্ষা আবশ্যক।

শিষ্যের এই গুণগুলি আবশ্যক-পবিত্রতা, প্রকৃত জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যবসায়। অশুদ্ধাত্মা পুরুষ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। কায়মনোবাক্যে পবিত্র না হইলে কেহ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। আর জ্ঞানতৃষ্ণা সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে, আমরা যাহা ছাই, তাহাই পাই-ইহা একটি সনাতন নিয়ম। যে বস্তু আমরা অন্তরের সহিত চাই, তাহা ছাড়া আমরা অন্য বস্তু লাভ করিতে পারি না।

ধর্মের জন্য প্রকৃত ব্যাকুলতা বড় কঠিন জিনিষ; আমরা সচরাচর যত সহজ মনে করি, উহা তত সহজ নয়। শুধু ধর্মকথা শুনিলে আর ধর্মপুস্তক পড়িলেই যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না যে, হৃদয়ে ধর্মপিপাসা প্রবল হইয়াছে। যতদিন না প্রাণে ব্যাকুলতা জাগরিত হয় এবং যতদিন না আমরা প্রবৃত্তির উপর জয়লাভ করিতে পারি, ততদিন সদাসর্বদা অভ্যাস ও আমাদের পাশব প্রকৃতির সহিত নিরন্তর সংগ্রাম আবশ্যক।

এই পাতা-ডালপালা গোনা ও অপরকে উহার সংখ্যা জানাইবার চেষ্টা একেবারে ছাড়িয়া দাও। অবশ্য এরূপ কার্যের উপযোগিতা আছে, কিন্তু ধর্মরাজ্যে নয়। যাহারা এরূপ পাতা গনিয়া বেড়ায়, তাহাদের ভিতর হইতে কখনও একটিও ধর্মবীর বাহির করিতে পারিবে না। ধর্ম-যাহা মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য, মানুষের শ্রেষ্ঠ গৌরবের জিনিষ, তাহাতে পাতা-গোনারূপ অত পরিশ্রমের প্রয়োজন নাই।

উহা দু-এক দিনের কর্ম নয়, কয়েক বৎসর বা দু-এক জন্মেরও কর্ম নয়; শত শত জন্ম ধরিয়া এই সংগ্রাম চলিতে পারে। কাহারও পক্ষে অল্পকালের মধ্যেই সিদ্ধিলাভ ঘটিতে পারে, কিন্তু যদি অনন্তকাল অপেক্ষা করিতে হয়, ধৈর্যের সহিত তাহার জন্যও প্রস্তুত থাকা চাই। যে শিষ্য এইরূপ অধ্যবসায়-সহকারে সাধনে প্রবৃত্ত হয়, তাহার সিদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।

গুরু সম্বন্ধে এইটুকু দেখিতে হইবে, তিনি যেন শাস্ত্রের মর্মজ্ঞ হন। জগতের সকলেই বেদ বাইবেল বা কোরান পাঠ করিতেছে, কিন্তু শাস্ত্রসমূহ শুধু শব্দ এবং ব্যাকরণ-ধর্মের কয়েকখানা শুষ্ক অস্থিমাত্র। যে গুরু শব্দ লইয়া বেশী নাড়াচাড়া করেন ও মনকে কেবল শব্দের ব্যাখ্যা দ্বারা চালিত হইতে দেন, তিনি ভাব হারাইয়া ফেলেন। শাস্ত্রের মর্ম যিনি জানেন, তিনিই যথার্থ ধর্মাচার্য। শাস্ত্রের শব্দজাল যেন মহারণ্য, মানুষ নিজেকে উহার ভিতর হারাইয়া ফেলে, পথ খুঁজিয়া পায় না।

‘শব্দজাল মহারণ্যসদৃশ, চিত্তের ভ্রমণের কারণ।’২৩ ‘শব্দযোজনা, সুন্দর ভাষায় বক্তৃতা ও শাস্ত্রমর্ম ব্যাখ্যা করিবার বিভিন্ন উপায়-পণ্ডিতদিগের বিচার ও আমোদের বিষয়মাত্র, উহা দ্বারা সিদ্ধি বা মুক্তিলাভের সহায়তা হয় না।’২৪ যাহারা ধর্মব্যাখ্যার সময় এইরূপ প্রণালী অবলম্বন করে, তাহারা কেবল নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখাইতে ইচ্ছুক, তাহাদের ইচ্ছা-লোকে তাহাদিগকে মহাপণ্ডিত বলিয়া সম্মান করুক।

জগতের প্রধান ধর্মাচার্যগণ কেহই এইভাবে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করিতে অগ্রসর হন নাই। তাঁহারা শাস্ত্রের শ্লোকের অর্থ যথেচ্ছ ব্যাখ্যা করিতে কখনও চেষ্টা করেন নাই, শব্দার্থ ও ধাত্বর্থ লইয়া ক্রমাগত মারপ্যাঁচ করেন নাই। তাঁহারা শুধু জগৎকে শাস্ত্রের মহান্ ভাব শিক্ষা দিয়াছেন।

আর যাহাদের শিখাইবার কিছুই নাই, তাহারা হয়তো শাস্ত্র হইতে একটি শব্দ লইয়া তাহারই উপর এক তিনখণ্ডে এক পুস্তক রচনা করে। সেই শব্দের আদি কি, কে ঐ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করিয়াছিল, সে কি খাইত, কতক্ষণ ঘুমাইত, এইরূপ বিষয় লইয়াই কেহ হয়তো আলোচনা করিয়া গেলেন।

ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলিতেনঃ এক আম-বাগানে কয়েকজন লোক বেড়াইতে গিয়াছিল; বাগানে ঢুকিয়া তাহারা গনিতে আরম্ভ করিল, কটা আম গাছ, কোন্ গাছে কত আম, এক-একটা ডালে কত পাতা, আমের বর্ণ, আকার, প্রকার ইত্যাদি নানাবিধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিচার করিতে লাগিল। আর একজন ছিল বিচক্ষণ, সে এসব গ্রাহ্য না করিয়া আম পাড়িতে লাগিল ও খাইতে লাগিল। বলো দেখি, কে বেশী বুদ্ধিমান্? আম খাও, পেট ভরিবে, কেবল পাতা গনিয়া-হিসাব করিয়া লাভ কি?

এই পাতা-ডালপালা গোনা ও অপরকে উহার সংখ্যা জানাইবার চেষ্টা একেবারে ছাড়িয়া দাও। অবশ্য এরূপ কার্যের উপযোগিতা আছে, কিন্তু ধর্মরাজ্যে নয়। যাহারা এরূপ পাতা গনিয়া বেড়ায়, তাহাদের ভিতর হইতে কখনও একটিও ধর্মবীর বাহির করিতে পারিবে না। ধর্ম-যাহা মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য, মানুষের শ্রেষ্ঠ গৌরবের জিনিষ, তাহাতে পাতা-গোনারূপ অত পরিশ্রমের প্রয়োজন নাই।

যদি তুমি ভক্ত হইতে চাও, তাহা হইলে কৃষ্ণ মথুরায় কি ব্রজে জন্মিয়াছিলেন, তিনি কি করিয়াছিলেন বা ঠিক কোন্‌ দিনে গীতা বলিয়াছিলেন, তাহা জানিবার কিছু আবশ্যক নাই। গীতায় কর্তব্য ও প্রেম সম্বন্ধে যে সুন্দর শিক্ষা আছে, আগ্রহের সহিত তাহা অনুসরণ করাই তোমার কাজ। উহার সম্বন্ধে বা উহার প্রণেতার সম্বন্ধে অন্যান্য বিশেষ বিবরণ জানা কেবল পণ্ডিতদের আমোদের জন্য। তাহারা যাহা চায় তাহা লইয়াই থাকুক। তাহাদের পণ্ডিতী তর্কবিচারে ‘শান্তিঃ শান্তিঃ’ বলিয়া এস আমরা আম খাইতে থাকি।

কেবল শিষ্যের বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করিয়া দেওয়া নয়। বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, গুরু হইতে শিষ্যে যথার্থই একটি শক্তি আসিতেছে। সুতরাং গুরুর শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক।

দ্বিতীয়তঃ গুরুর নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক। অনেক সময়ে লোকে বলিয়া থাকে, ‘গুরুর চরিত্র, গুরু কি করেন না করেন, দেখিবার প্রয়োজন কি? তিনি যা বলেন তাহাই বিচার করিতে হইবে। সেইটি লইয়াই কাজ করা প্রয়োজন।’ এ কথা ঠিক নয়। গতি-বিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়-বিজ্ঞানের শিক্ষক যাহাই হউন না কেন, কিছু আসে যায় না। কারণ উহাতে কেবল বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানের আচার্য অশুদ্ধচিত্ত হইলে তাঁহাতে আদৌ ধর্মালোক থাকিতে পারে না।

অশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি কী ধর্ম শিখাইবে? নিজে আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করিবার বা অপরে শক্তি সঞ্চার করিবার একমাত্র উপায়-হৃদয় ও মনের পবিত্রতা। যতদিন না চিত্তশুদ্ধি হয়, ততদিন ভগবদ্দর্শন বা সেই অতীন্দ্রিয় সত্তার আভাসজ্ঞানও অসম্ভব। সুতরাং ধর্মাচার্যের সম্বন্ধে প্রথমেই দেখা আবশ্যক তিনি কি চরিত্রের লোক; তারপর তিনি কি বলেন তাহাও দেখিতে হইবে।

তাঁহার সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক, তবেই তাঁহার কথার প্রকৃত একটা গুরুত্ব থাকে; কারণ তাহা হইলেই তিনি প্রকৃত শক্তি-সঞ্চারকের যোগ্য হইতে পারেন। নিজের মধ্যেই যদি সেই শক্তি না থাকে, তবে তিনি সঞ্চার করিবেন কী? গুরুর মন এরূপ প্রবল আধ্যাত্মিকস্পন্দন-বিশিষ্ট হওয়া চাই যে, তাহা যেন সমবেদনাবশে শিষ্যে সঞ্চারিত হইয়া যায়।

গুরুর বাস্তবিক কার্যই এই-কিছু সঞ্চার করা, কেবল শিষ্যের বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করিয়া দেওয়া নয়। বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, গুরু হইতে শিষ্যে যথার্থই একটি শক্তি আসিতেছে। সুতরাং গুরুর শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক।

আর যে-সব দেশে গুরুশিষ্যের এ সম্বন্ধ রক্ষা করা হয় নাই, সে-সব দেশে ধর্মের শিক্ষক কেবল বক্তামাত্র। নিজের প্রাপ্যের দিকেই তাঁহার দৃষ্টি, আর শিষ্য কেবল গুরুর কথাগুলিতেই মাথা পরিপূর্ণ করেন এবং অবশেষে উভয়েই নিজ নিজ পথ দেখেন,-একে আর অপরের চিন্তা করেন না, এরূপ ক্ষেত্রে ধর্ম প্রায়ই অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়; আধ্যাত্মিক শক্তিসঞ্চার করিবার কেহ নাই, গ্রহণ করিবারও কেহ নাই।

তৃতীয়তঃ দেখা আবশ্যক, গুরুর উদ্দেশ্য কি? গুরু যেন অর্থ, নাম-যশ বা কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মশিক্ষাদানে প্রবৃত্ত না হন-সমগ্র মানবজাতির প্রতি শুদ্ধ প্রেমই যেন তাঁহার কার্যের নিয়ামক হয়। আধ্যাত্মিক শক্তি শুদ্ধ প্রেমের মাধ্যমেই সঞ্চারিত করা যাইতে পারে। কোনরূপ স্বার্থপূর্ণ ভাব, লাভ বা যশের ইচ্ছা এক মুহূর্তে এই সঞ্চারের মাধ্যম নষ্ট করিয়া ফেলে। ভগবান্ প্রেমস্বরূপ, আর যিনি ভগবানকে প্রেমস্বরূপ বলিয়া জানিয়াছেন, তিনিই মানুষকে ভগবদ্‌ভাব শিক্ষা দিতে পারেন।

যদি দেখ-গুরুতে এইসব লক্ষণ বর্তমান, তবে জানিবে তোমার কোন আশঙ্কা নাই। নতুবা তাঁহার নিকট শিক্ষায় বিপদ আছে; যেহেতু তিনি যদি হৃদয়ে সদ্‌ভাব সঞ্চার করিতে না পারেন, তিনি হয়তো অসদ্‌ভাব সঞ্চার করিবেন। এই বিপদ হইতে নিজেকে সর্বতোভাবে সাবধান রাখিতে হইবে। ‘যিনি বিদ্বান্ নিষ্পাপ ও কামগন্ধহীন, যিনি শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ’,২৫ তিনিই প্রকৃত সদ্‌গুরু।

যাহা বলা হইল, তাহা হইতে ইহা সহজেই প্রতীত হইবে যে, ধর্মে অনুরাগী হইবার, ধর্মের মর্মবোধ করিবার এবং উহা জীবনে পরিণত করিবার উপযোগী শিক্ষা যে-কোন ব্যক্তির নিকট হইতে পাওয়া যায় না। ‘শিলাখণ্ডের নিকট ধর্মোপদেশ-শ্রবণ, নদীর কলনাদে গ্রন্থপাঠ ও সর্বত্র শুভদর্শন’২৬ আলঙ্কারিক বর্ণনাহিসাবে সত্য বটে, কিন্তু যাহার নিজের মধ্যে সত্য বিকশিত হয় নাই, সে কখনও এগুলি হইতে এতটুকু জ্ঞান আহরণ করিতে পারে না।

পর্বত, নদী প্রভৃতি কাহাকে শিক্ষা দিতে পারে?-যাহার পবিত্র হৃদয়ে ভক্তিকমল ফুটিয়া উঠিয়াছে, সেই মানবাত্মাকে। আর যে আলোকে এই কমল সুন্দররূপে ফুটিয়া উঠে, তাহা ব্রহ্মবিৎ সদ্‌গুরুরই জ্ঞানালোক। যখন এইভাবে হৃদয় উন্মুক্ত হয়, তখন সেই হৃদয়-পর্বত, নদী, তারা, সূর্য, চন্দ্র অথবা এই বিশ্বে যাহা কিছু আছে, তাহা হইতেই শিক্ষা লাভ করিতে পারে।

কিন্তু যাহার হৃদয় এখনও উন্মুক্ত হয় নাই, সে এ-সকলে পর্বতাদি ব্যতীত আর কিছু দেখিতে পাইবে না। চিত্রশালায় গিয়া অন্ধের কিছু লাভ নাই। আগে তাহাকে চক্ষু দাও, তবেই সে সেখানকার দর্শনীয় বস্তুসমূহ হইতে কি শিক্ষা পাওয়া যায়, বুঝিতে পারিবে।

গুরুই ধর্মশিক্ষার্থীর চক্ষু খুলিয়া দেন। সুতরাং কোন ব্যক্তির সহিত তাহার বংশধরের যে সম্বন্ধ, গুরুর সহিত শিষ্যেরও ঠিক সেই সম্বন্ধ। গুরুর প্রতি বিশ্বাস, বিনয়নম্র আচরণ, তাঁহার নিকট শরণগ্রহণ ও তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যতিরেকে আমাদের হৃদয়ে ধর্মের বিকাশ হইতেই পারে না। আর ইহাও বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, যে-সব দেশে গুরুশিষ্যের এরূপ সম্বন্ধ আছে, কেবল সেই-সব দেশেই অসাধারণ ধর্মবীরগণ সকল জন্মিয়াছেন।

আর যে-সব দেশে গুরুশিষ্যের এ সম্বন্ধ রক্ষা করা হয় নাই, সে-সব দেশে ধর্মের শিক্ষক কেবল বক্তামাত্র। নিজের প্রাপ্যের দিকেই তাঁহার দৃষ্টি, আর শিষ্য কেবল গুরুর কথাগুলিতেই মাথা পরিপূর্ণ করেন এবং অবশেষে উভয়েই নিজ নিজ পথ দেখেন,-একে আর অপরের চিন্তা করেন না, এরূপ ক্ষেত্রে ধর্ম প্রায়ই অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়; আধ্যাত্মিক শক্তিসঞ্চার করিবার কেহ নাই, গ্রহণ করিবারও কেহ নাই।

এই-সব লোকের কাছে ধর্ম যেন ব্যবসায়ে পরিণত। তাহারা মনে করে, অর্থ দ্বারা ধর্ম ক্রয় করা যায়। ঈশ্বরেচ্ছায় ধর্ম যদি এত সুলভ হইত! তাহাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এরূপ হইবার নয়।

অমনি বালকবৎ বিশ্বাস ও সরলতা লইয়া তাঁহার সেবা কর, তাঁহার নিকট প্রাণ খুলিয়া দাও, তাঁহাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর-রূপে দেখ। যাহারা এইরূপ প্রেম ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সত্যানুসন্ধান করে, তাহাদের নিকট সত্যের ভগবান্ সত্য শিব ও সুন্দরের অতি আশ্চর্য তত্ত্বসমূহ প্রকাশ করেন।

ধর্ম-সর্বোচ্চ জ্ঞানস্বরূপ যে ধর্ম, তাহা ধন-বিনিময়ে কিনিবার জিনিষ নয়, গ্রন্থ হইতেও তাহা পাওয়া যায় না। জগতের সর্বত্র ঘুরিয়া আসিতে পার, হিমালয় আল্পস্ ককেসস্ প্রভৃতি অন্বেষণ করিতে পার, সমুদ্রের তলদেশে আলোড়ন করিতে পার, তিব্বতের চারিকোণ অথবা গোবি-মরুর চতুর্দিকে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিতে পার, কিন্তু যতদিন না তোমার হৃদয় ধর্ম গ্রহণ করিবার উপযুক্ত হইতেছে এবং যতদিন না তুমি গুরুলাভ করিতেছ, কোথাও ধর্ম খুঁজিয়া পাইবে না।

বিধাতৃনির্দিষ্ট এই গুরু যখনই লাভ করিবে, অমনি বালকবৎ বিশ্বাস ও সরলতা লইয়া তাঁহার সেবা কর, তাঁহার নিকট প্রাণ খুলিয়া দাও, তাঁহাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর-রূপে দেখ। যাহারা এইরূপ প্রেম ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সত্যানুসন্ধান করে, তাহাদের নিকট সত্যের ভগবান্ সত্য শিব ও সুন্দরের অতি আশ্চর্য তত্ত্বসমূহ প্রকাশ করেন।

…………………………………………………………
২৩ শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম্‌।-বিবেকচূড়ামণি, ৬০
২৪ বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্‌। বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে॥-ঐ, ৫৮
২৫ শ্রোত্রিয়োঽবৃজিনোঽকামহতো যো ব্রহ্মবিত্তমঃ। -বিবেকচূড়ামণি, ৩৩
২৬ And this our life exempt from public haunt, Finds tongues in trees, books in the running brooks, Sermons in stones and good in every thing. – Shakespeare’s ‘As you Like It,’ Act II, Sc. I

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!