ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

কভু উঠি, কখনও বা পড়ি কালের তরঙ্গ সনে
গড়াইয়া চলিয়াছি হায়,
ক্ষণস্থায়ী এক দৃশ্য হতে স্বল্পস্থায়ী দৃশ্যান্তরে
জীবনের জোয়ার-ভাঁটায়।
অন্তহীন এই প্রহসনে তিক্ত আজি প্রাণ মোর;
আর ইহা নাহি লাগে ভাল,
মিছে ছোটা, পাব নাতো কভু, দেখা নাহি যায় দূরে,
সাগরের পারে তীর কালো!
জন্ম হতে জন্মান্তরাবধি দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছি,
কভু দ্বার খুলিল না হায়,
আঁখি মম ক্ষীণ হল তবু, বৃথা আশা ধরিবারে
সে আলোর একটি ছটায়।

অতি ক্ষুদ্র এই জীবনের সমুচ্চ সঙ্কীর্ণ সেই
সেতু ’পরে দাঁড়াইয়া চাহি—
অগণিত জনগণ নীচে যুঝিছে, কাঁদিছে কেহ
হাসিতেছে—কেন জানি নাহি,
সম্মুখেতে ভীষণ কপাট ভ্রূভঙ্গে চাহিয়া বলে,
‘আর নাহি হও অগ্রসর,
এই সীমা অদৃষ্টের তব; প্রলুদ্ধ করো না আর,
যত পার সব সহ্য কর।

মিশে যাও ইহাদের সাথে পান কর হলাহল
নাচো গাও উহাদের সনে
জানিবারে বাসনা যাহার, দুঃখ আছে তার ভালে,
অতএব রহ এই স্থানে।’
আমি কিন্তু থাকিতে না চাই, জলবুদ্বুদের সম
ভাসমান এই পৃথ্বীতল,
শূন্যগর্ভ গঠন ইহার, শূন্যগর্ভ নাম তার,
জন্মমৃত্যু-শূন্য সে সকল।
মোর কাছে মিছা এই সব, আমি চাই ভেদিবারে
নামরূপ মিথ্যা অবয়বে,
খুলিবারে চাহি আমি ওই সম্মুখের প্রশস্ত কপাট—
মোর লাগি খুলিতেই হবে।

দুয়ার খুলিয়া দাও মাতঃ! হেরি পথ আলোক-ছটায়
খেলা মোর হইয়াছে শেষ—
অতি শ্রান্ত পুত্র তব মা গো, আকুল আকাঙ্ক্ষা হৃদে
গৃহে আজি করিবে প্রবেশ।
ঘন ঘোর অন্ধকার মাঝে খেলিতে ছাড়িয়া দিয়ে
বিভীষিকা দেখাও আমারে,
আশা মোর হল আজি শেষ, ভয় আসি দেখা দিল
খেলার আনন্দ গেল দূরে।

তপ্ত স্ফীত সাগর সমান গভীর দুঃখের মাঝে
রিপুদল প্রবল তাড়নে,
তরঙ্গে বিক্ষিপ্ত হেথা সেথা কত কষ্ট পাই মা গো
ভবিষ্যৎ সুখের ছলনে।
জীবনের অর্থ হেথা হায় জীবন্ত মরণ, আর
মরণ যে কেবা বলো জানে—
সুখদুঃখ নিয়ত-চক্রের পুনঃ সেই প্রবর্তন
নব আবর্তন নাহি আনে।

শিশু দেখে মধুর স্বপন— স্বর্ণসম সমুজ্জ্বল,
ধূলিতে তা হয় পরিণত,
পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে হায়— ভগ্ন তার শত আশা,
পুঞ্জীভূত মরিচার মত।
জীবনের শেষপ্রান্তে যবে বিলম্বে লভিয়া জ্ঞান
চক্র ছাড়ি যাই মোরা চলি,
অন্যজন নবতেজ লয়ে সে চক্র ঘুরাতে আসে
দিন যায় বর্ষ পড়ে ঢলি।

ঘোরে চক্র অবিরত বেগে মায়া-ক্রীড়নক মাত্র
কামনা ইহার কেন্দ্রস্থল,
বৃথা আশা দেয় গতিবেগ এ চক্রের দণ্ড যত
সুখ দুঃখ অনিত্য কেবল।
ভাসিয়া চলেছি আজ আমি, কোথা তাহা নাহি জানি,
এ অনলে বাঁচাও গো আসি,
করুণা-আধার তুমি মা গো, রক্ষা কর মোরে, যেন
কামনা-সাগরে নাহি ভাসি।

ফিরায়ো না দেখায়ো না মোরে, ভয়ঙ্কর মুখ তব
সহিতে পারি না আমি এত,
ক্ষমা কর দেহ মা অভয় সদয়া হও গো আজি
দোষ মম নাহি ধর মাতঃ!
নিয়ে যাও জননি গো মোরে সেই দূরে পরপারে,
যেথায় সকল দ্বন্দ্ব শেষ,
সকল দুঃখের পারে, অশ্রু যেথা নাহি দেখা দেয়
পার্থিব সুখেরও নাহি লেশ।

যাহার গরিমা রবি শশী, অনন্ত তারকারাজি
উজলিত আকাশের পটে,
ক্ষণপ্রভা রূপের ছটায় প্রকাশিতে নাহি পারে
মাত্র তার প্রতিবিম্ব রটে।
দেখো যেন মিছা স্বপ্নে মা গো তোমার মু’খানি হতে
আমারে আড়াল নাহি করে,
খেলা মোর হল আজি শেষ, শৃঙ্খল ভাঙিয়া দাও,
মুক্ত আজি কর মা আমারে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!