ঈশ্বরের দেহধারণ বা অবতার
The Divine Incarnation or Avatara
[খ্রীষ্ট-বিষয়ক বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিপির অনুবাদ]
যীশুখ্রীষ্ট ভগবান্ ছিলেন-মানবদেহে অবতীর্ণ সগুণ ঈশ্বর। বহু রূপে বহু বার ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেছেন এবং তোমরা শুধু তাঁর সেই রূপগুলিরই উপাসনা করিতে পার। পরমব্রহ্ম উপাসনার বস্তু নন। ঈশ্বরের নির্গুণ ভাবকে উপাসনা করা অর্থহীন। নরদেহে অবতীর্ণ যীশুখ্রীষ্টকেই আমাদের ঈশ্বর বলে পূজা করতে হবে। ঈশ্বরের এরূপ বিকাশের চেয়ে উচ্চতর কোন কিছুর পূজা কেউ করতে পারে না। খ্রীষ্ট থেকে পৃথক্ কোন ভগবানের উপাসনা যত শীঘ্র ত্যাগ করিবে ততই তোমাদের কল্যাণ। তোমাদের কল্পনানির্মিত যিহোবার কথা ধর, আবার সুন্দর মহান্ খ্রীষ্টের কথা ভেবে দেখ। যখনই খ্রীষ্টের ঊর্ধ্বে কোন ভগবান্ সৃষ্টি কর, তখনই সব পণ্ড কর। দেবতাই কেবল দেবতার উপাসনা করিতে পারে, মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, এবং ঈশ্বরের প্রচলিত প্রকাশের ঊর্ধ্বে তাঁকে উপাসনা করার যে-কোন প্রয়াস মানুষের পক্ষে বিপজ্জনকই হবে। যদি কেউ মুক্তি চাও তো খ্রীষ্টের সমীপবর্তী হও; তোমাদের কল্পিত যে কোন ঈশ্বরের চেয়ে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। যদি মনে কর খ্রীষ্ট একজন মানুষ ছিলেন তবে তাঁর উপাসনা কর না। কিন্তু যখনই ধারণা করতে পারবে-তিনি ঈশ্বর, তখনই তাঁর উপাসনা কর। যারা বলে-তিনি মানুষ ছিলেন, আবার তাঁকে পূজাও করে, তারা নিতান্ত অশাস্ত্রীয়, অধর্মের কাজই করে। এখানে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই, সমগ্র শক্তিকেই গ্রহণ করতে হবে। ‘যে পুত্রকে দেখেছে, সে পিতাকেই দর্শন করেছে’, আর পুত্রকে না দেখে কেউ পিতার দর্শন পাবে না। শুধু বড় বড় কথা, অসার দার্শনিক বিচার আর স্বপ্ন ও কল্পনা! যদি আধ্যাত্মিক জীবনে কিছু উপলব্ধি করতে চাও, তবে খ্রীষ্টে প্রকাশিত ঈশ্বরকে নিবিড়ভাবে ধরে থাক।
দার্শনিক দিক্ দিয়ে খ্রীষ্ট বা বুদ্ধ বলে কোন মানুষ ছিলেন না, তাঁদের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরকেই দেখেছিলাম। কোরানে মহম্মদ বার বার বলেছেন, খ্রীষ্ট কখনও ক্রুশবিদ্ধ হননি-ও একটা রূপকমাত্র; খ্রীষ্টকে কেউ ক্রুশবিদ্ধ করতে পারে না।
যুক্তিমূলক ধর্মের সর্বনিম্ন স্তর দ্বৈতভাব, আর একের মধ্যে তিনের অবস্থিতিই উচ্চতম। জগৎ ও জীব ঈশ্বরের দ্বারাই অনুস্যূত; ঈশ্বর, জগৎ এবং জীব-এই ‘একের মধ্যে তিন’-কেই আমরা দেখেছি। আবার সঙ্গে সঙ্গে আভাস পাচ্ছি যে, এক থেকেই এই তিনটি হয়েছে। এই দেহটি যেমন জীবাত্মার আবরণ, তেমনি এই জীবাত্মা যেন পরমাত্মার আবরণ বা দেহ। ‘আমি’ যেমন বিশ্বপ্রকৃতির চেতন আত্মা তেমনি ঈশ্বর আমার আত্মারও আত্মা-পরমাত্মা। তুমিই হচ্ছ সেই কেন্দ্র-যার মধ্যে তুমি বিশ্বপ্রকৃতিকে দেখছ, আবার তারই মধ্যে তুমি রয়েছ। জগৎ জীব আর ঈশ্বর, এই নিয়েই একটি সত্তা-নিখিল বিশ্ব। সুতরাং এগুলি মিলে একটি একক, তথাপি একইকালে এগুলি আবার পৃথকও বটে।
তৃতীয় হচ্ছে আনন্দ, পবিত্র আত্মার আবেশ। পূর্বোক্ত জ্ঞানলাভের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ আনন্দের অধিকারী হয়। যে-মুহূর্তে তুমি খ্রীষ্টকে তোমার হৃদয়ে বসাবে, তখন থেকেই তোমার পরমানন্দ; আর তাতেই হবে তিনের একত্ব-সাধন
আবার আর এক প্রকার ‘ত্রিত্ব’ (তিনে এক) আছে, অনেকটা খ্রীষ্টানদের ‘ট্রিনিটি’-র মত। ঈশ্বরই পরমব্রহ্ম, এই নির্বিশেষ সত্তায় আমরা তাঁকে অনুভব করতে পারি না; শুধু নেতি নেতি বলতে পারি মাত্র। তবুও ঈশ্বরীয় সত্তার সান্নিধ্যসূচক কয়েকটি গুণ কিন্তু আমরা ধারণা করতে পারি প্রথমতঃ সৎ বা অস্তিত্ব, দ্বিতীয়তঃ চিৎ বা জ্ঞান, তৃতীয়তঃ আনন্দ-অনেকটা যেন তোমাদের পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার অনুরূপ। পিতা হচ্ছেন সৎস্বরূপ, যা থেকে সব কিছুর সৃষ্টি; পুত্র হচ্ছেন চিৎ-স্বরূপ, খ্রীষ্টের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশ। খ্রীষ্টের পূর্বে ঈশ্বর সর্বত্র ছিলেন, সকল প্রাণীর মধ্যে ছিলেন; কিন্তু খ্রীষ্টের আবির্ভাবেই আমরা তাঁর সম্বন্ধে সচেতন হতে পেরেছি, ইনিই ঈশ্বর। তৃতীয় হচ্ছে আনন্দ, পবিত্র আত্মার আবেশ। পূর্বোক্ত জ্ঞানলাভের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ আনন্দের অধিকারী হয়। যে-মুহূর্তে তুমি খ্রীষ্টকে তোমার হৃদয়ে বসাবে, তখন থেকেই তোমার পরমানন্দ; আর তাতেই হবে তিনের একত্ব-সাধন।