-স্বামী বিবেকানন্দ
[‘হিন্দু’, মান্দ্রাজ; ফেব্রুআরী, ১৮৯৭]
আমাদের জনৈক প্রতিনিধি চিঙলপুট ষ্টেশনে স্বামীজীর সহিত ট্রেনে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহার সহিত মান্দ্রাজ পর্যন্ত আসেন। গাড়ীতে উভয়ের নিম্নলিখিত কথোপকথন হইয়াছিলঃ
‘স্বামীজী, আপনি আমেরিকায় কেন গেছলেন?’
‘বড় শক্ত কথা। সংক্ষেপে এর উত্তর দেওয়া কঠিন। এখন আমি এর আংশিক উত্তর মাত্র দিতে পারি। ভারতের সব জায়গায় আমি ঘুরছিলুম-দেখলুম, ভারতে যথেষ্ট ঘোরা হয়েছে; তখন অন্য অন্য দেশে যাবার ইচ্ছা হল। আমি জাপানের দিক্ দিয়ে আমেরিকায় গেছলুম।’
‘আপনি জাপানে কি দেখলেন? জাপান উন্নতির যে-পথে চলেছে, ভারতের কি তা অনুসরণ করবার কোন সম্ভাবনা আছে-মনে করেন?’
‘কোন সম্ভাবনা নেই, যতদিন না ভারতের ত্রিশ কোটি লোক মিলে একটা জাতি হয়ে দাঁড়ায়। জাপানীর মত এমন স্বদেশহিতৈষী ও শিল্পপটু জাত আর দেখা যায় না; আর তাদের একটা বিশেষত্ব এই যে, ইওরোপ ও অন্য স্থানে একদিকে যেমন শিল্পের বাহার, অপরদিকে আবার তেমনি অপরিষ্কার, কিন্তু জাপানীদের যেমন শিল্পের সৌন্দর্য, তেমনি আবার তারা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
আমার ইচ্ছে-আমাদের যুবকেরা জীবনে অন্ততঃ একবার জাপানে বেড়িয়ে আসে। যাওয়াও কিছু শক্ত নয়। জাপানীরা হিন্দুদের সবই খুব ভাল বলে মনে করে, আর ভারতকে তীর্থস্বরূপ বলে বিশ্বাস করে। সিংহলের বৌদ্ধধর্ম আর জাপানের বৌদ্ধধর্ম ঢের তফাত। জাপানের বৌদ্ধধর্ম বেদান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সিংহলের বৌদ্ধধর্ম নাস্তিক্যবাদে দূষিত, জাপানের বৌদ্ধধর্ম আস্তিক।’
‘জাপান হঠাৎ এ-রকম বড় হল কি করে? এর রহস্যটা কি?’
‘জাপানীদের আত্মপ্রত্যয় আর তাদের স্বদেশের উপর ভালবাসা। যখন ভারতে এমন লোক জন্মাবে, যারা দেশের জন্য সব ছাড়তে প্রস্তুত, আর যাদের মন মুখ এক, তখন ভারতও সব বিষয়ে বড় হবে। মানুষ নিয়েই তো দেশের গৌরব। শুধু দেশে আছে কি?
জাপানীরা সামাজিক ও রাজনীতিক বিষয়ে যেমন সাচ্চা, তোমাদেরও যখন তাই হবে, তোমরাও তখন জাপানীদের মত বড় হবে। জাপানীরা তাদের দেশের জন্যে সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তাইতেই তারা বড় হয়েছে। তোমরা যে কাম-কাঞ্চনের জন্য সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত!’
‘আপনার কি ইচ্ছে যে ভারত জাপানের মত হোক?’
‘তা কখনই নয়। ভারত ভারতই থাকবে। ভারত কেমন করে জাপান বা অন্য জাতের মত হবে? যেমন সঙ্গীতে একটা করে প্রধান সুর থাকে, সেইরূপ প্রত্যেক জাতেরই এক-একটা মুখ্য ভাব থাকে, অন্য অন্য ভাবগুলি তার অনুগত। ভারতের মুখ্য ভাব হচ্ছে ধর্ম। সমাজ-সংস্কার এবং অন্য সবই গৌণ। লোকে বলে হৃদয় উন্মুক্ত হলে চিন্তার প্রবাহ আসে। ভারতের হৃদয়ও এক সময়ে উন্মুক্ত হবে, তখন ধর্মতরঙ্গ খেলতে থাকবে!
ভারত ভারতই। আমরা জাপানীদের মত নই, আমরা হিন্দু। ভারতের হাওয়াতেই কেমন শান্তি এনে দেয়! আমি এখানে সর্বদা কাজ করছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমি বিশ্রাম লাভ করছি। ভারতে ধর্মকার্য করলে শান্তি পাওয়া যায়, এখানে সাংসারিক কার্য করতে গেলে শেষে মৃত্যু হয়-বহুমূত্র হয়ে।’
‘যাক জাপানের কথা। আচ্ছা, স্বামীজী, আপনি আমেরিকায় গিয়ে প্রথমে কি দেখলেন?’ গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ভালই দেখেছিলুম। কেবল মিশনরী আর ‘চার্চের মেয়েরা’ (church-women) ছাড়া আমেরিকানরা সকলেই বড় অতিথিবৎসল সৎস্বভাব ও সহৃদয় ব্যক্তি।’
‘চার্চের মেয়েরা কি, স্বামীজী?’
‘মার্কিন মেয়ে যখন বে করবার জন্য উঠে পড়ে লাগে, তখন সব রকম সমুদ্রতীরবর্তী স্নানের জায়গায় ঘুরতে থাকে, আর একটা পুরুষ পাকড়াবার জন্য যত রকম কৌশল করবার চেষ্টা করে। সব চেষ্টা করে যখন বিফল হয়, তখন সে চার্চে যোগ দেয়, তখন তাকে ওখানে ‘ওল্ড মেড’ বলে।
তাদের মধ্যে অনেকে চার্চের বেজায় গোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়। … এদের বাদ দিলে, আমেরিকানরা বড় ভাল লোক। তারা আমায় ভালবাসত, আমিও তাদের খুব ভালবাসি। আমি যেন তাদেরই একজন, এই-রকম বোধ করতাম।’
‘চিকাগো ধর্ম-মহাসভা হয়ে কি ফল দাঁড়াল, আপনার ধারণা?’
‘আমার ধারণা, চিকাগো ধর্ম-মহাসভার উদ্দেশ্য ছিল-জগতের সামনে অ-খ্রীষ্টান ধর্মগুলিকে হেয় প্রতিপন্ন করা। কিন্তু দাঁড়াল অ-খ্রীষ্টান ধর্মের প্রাধান্য। সুতরাং খ্রীষ্টানদের দৃষ্টিতে ঐ মহাসভার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। দেখ না কেন, এখন প্যারিসে আর একটা মহাসভা হবার কথা হচ্ছে, কিন্তু রোমান ক্যাথলিকরা, যাঁরা চিকাগো মহাসভার উদ্যোক্তা ছিলেন, তাঁরাই এখন যাতে প্যারিসে ধর্ম-মহাসভা না হয়, তার জন্য বিশেষ চেষ্টা করছেন।
কিন্তু চিকাগো সভা দ্বারা ভারতীয় চিন্তার বিশেষরূপ বিস্তারের সুবিধা হয়েছে! ওতে বেদান্তের চিন্তাধারা বিস্তার হবার সুবিধে হয়েছে-এখন সমগ্র জগৎ বেদান্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। অবশ্য আমেরিকানরা চিকাগো সভার এই পরিণামে বিশেষ সুখী-কেবল গোঁড়া পুরোহিত আর ‘চার্চের মেয়েরা’ ছাড়া।’
‘ইংলণ্ডে আপনার প্রচারকার্যের কিরূপ আশা দেখছেন, স্বামীজী?’
‘খুব আশা আছে। দশ বৎসরও যেতে হবে না-অধিকাংশ ইংরেজই বেদান্তী হবে। আমেরিকার চেয়ে ইংলণ্ডে বেশী আশা। আমেরিকানরা তো দেখছ-সব বিষয়েই একটা হুজুক করে তোলে। ইংরেজরা হুজুগে নয়। বেদান্ত না বুঝলে খ্রীষ্টানেরা তাদের নিউ টেষ্টামেণ্টও বুঝতে পারে না। বেদান্ত সব ধর্মেরই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাস্বরূপ। বেদান্তকে ছাড়লে সব ধর্মই কুসংস্কার। বেদান্তকে ধরলে সবই ধর্ম হয়ে দাঁড়াবে।’
‘আপনি ইংরেজ-চরিত্রে বিশেষ কি গুণ দেখলেন?’
‘ইংরেজরা কোন বিষয়ে বিশ্বাস করলেই তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে যায়। ওদের কাজের শক্তি অসাধারণ। ইংরেজ পুরুষ ও মহিলার চেয়ে উন্নততর নরনারী সারা পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায় না। এইজন্যই তাদের উপর আমার বেশী বিশ্বাস। অবশ্য প্রথমে তাদের মাথায় কিছু ঢোকান বড় কঠিন; অনেক চেষ্টাচরিত্র করে উঠে পড়ে লেগে থাকলে তবে তাদের মাথায় একটা ভাব ঢোকে, কিন্তু একবার দিতে পারলে আর সহজে সেটি বেরোয় না।
ইংলণ্ডে কোন মিশনরী বা অন্য কোন লোক আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি-একজনও আমার কোন রকম নিন্দে করবার চেষ্টা করেনি। আমি দেখে আশ্চর্য হলুম, অধিকাংশ বন্ধুই ‘চার্চ অব্ ইংলণ্ডে’র অন্তর্ভুক্ত। আমি জেনেছি যে-সব মিশনরী এ দেশে আসে, তারা ইংলণ্ডের খুব নিম্নশ্রেণীভুক্ত। কোন ভদ্র ইংরেজ তাদের সঙ্গে মেশে না। এখানকার মত ইংলণ্ডেও জাতের খুব কড়াকড়ি। আর ‘চার্চে’র সদস্য ইংরেজরা ভদ্রশ্রেণীভুক্ত।
আপনার সঙ্গে তাঁদের মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তাতে আপনার সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব হবার কিছু ব্যাঘাত হবে না। এই জন্মে আমি আমার স্বদেশবাসীকে এই একটি পরামর্শ দিতে চাই যে, মিশনরীরা কি, তা তো এখন জেনেছি; এখন এই কর্তব্য যে, এই গালাগালবাজ মিশনরীদের মোটেই আমল না দেওয়া। আমরাই তো ওদের আস্কারা দিয়েছি। এখন ওদের মোটে গ্রাহ্যের মধ্যে না আনাই কর্তব্য।’
‘স্বামীজী, আমেরিকা ও ইংলণ্ডের সমাজসংস্কার আন্দোলন কি রকম, অনুগ্রহ করে এ সম্বন্ধে কিছু বলবেন কি?’
‘সব সমাজ-সংস্কারকেরা, অন্ততঃ তাঁদের নেতারা, এখন তাঁদের সাম্যবাদ প্রভৃতির একটা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভিত্তি বার করবার চেষ্টা করছে-আর সেই ভিত্তি কেবল বেদান্তেই পাওয়া যায়। অনেক নেতা, যাঁরা আমার বক্তৃতা শুনতে আসতেন, আমায় বলেছেন, নূতন ভাবে সমাজ গঠন করতে হলে বেদান্তকে ভিত্তিস্বরূপ নেওয়া দরকার।’
‘ভারতের জনসাধারণ সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?’
‘আমরা ভয়ানক গরীব। আমাদের জনসাধারণ লৌকিক বিদ্যায় বড়ই অজ্ঞ, কিন্তু তারা বড় ভাল। কারণ এখানে দারিদ্র্য একটা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। এরা দুর্দান্তও নয়। আমেরিকা ও ইংলণ্ডে অনেক সময় আমার পোষাকের দরুন জনসাধারণ খেপে অনেকবার আমাকে মারবার যোগাড়ই করেছিল। কিন্তু ভারতে কারও অসাধারণ পোষাকের দরুন জনসাধারণ খেপে গিয়ে মারতে উঠেছে, এ-রকম কথা তো কখনও শুনিনি। অন্যান্য সব বিষয়েও আমাদের জনসাধারণ ইওরোপের জনসাধারণের চেয়ে ঢের সভ্য।’
‘ভারতীয় জনসাধারণের উন্নতির জন্য কি করা ভাল বলেন?’
‘তাঁদের লৌকিক বিদ্যা শেখাতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে-প্রণালী দেখিয়ে গেছেন, তারই অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ বড় বড় আদর্শগুলি ধীরে ধীরে সাধারণের ভেতর সঞ্চারিত করতে হবে। ধীরে ধীরে তাদের তুলে নাও, ধীরে ধীরে তাদের সমান করে নাও। লৌকিক বিদ্যাও ধর্মের ভিতর দিয়ে শেখাতে হবে।’
‘কিন্তু স্বামীজী, আপনি কি মনে করেন, এ কাজ সহজে হতে পারে?’
‘অবশ্য এটা ধীরে ধীরে কাজে পরিণত করতে হবে। কিন্তু যদি আমি অনেকগুলি স্বার্থত্যাগী যুবক পাই, যারা আমার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত, তা হলে কালই এটা হতে পারে। কেবল এই কাজে যে পরিমাণে উৎসাহ ও স্বার্থত্যাগ করা হবে, তারই উপর নির্ভর করছে-এ কাজ তাড়াতাড়ি হবে বা দেরীতে হবে।’
‘কিন্তু যদি বর্তমান হীনাবস্থা তাদের অতীত কর্মের ফল হইয়া থাকে, তবে আপনার বিবেচনায় কিভাবে সহজে এটি ঘুচবে আর আপনি কেমন করেই বা তাদের সাহায্য করবার ইচ্ছা করেন?’
স্বামীজী মুহূর্তমাত্র চিন্তার অবসর না লইয়াই উত্তর দিলেন, ‘কর্মবাদই অনন্তকাল মানবের স্বাধীনতা ঘোষণা করছে। কর্মের দ্বারা নিজেদের হীন অবস্থায় এনেছি-এ কথা যদি সত্য হয়, তবে কর্মের দ্বারা আমাদের অবস্থার উন্নতিসাধনও নিশ্চয়ই করতে পারি। আরও কথা এই, জনসাধারণ কেবল যে নিজেদের কর্মের দ্বারাই এই হীনাবস্থা এনেছে, তা নয়। সুতরাং তাদের উন্নতি করবার আরও সুবিধা দিতে হবে। আমি সব জাতকে একাকার করতে বলি না। জাতিবিভাগ খুব ভাল।
এই জাতিবিভাগ-প্রণালীই আমরা অনুসরণ করতে চাই। জাতিবিভাগ যথার্থ কি, তা লাখে একজন বোঝে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে জাত নেই। ভারতে আমরা জাতিবিভাগের মধ্য দিয়ে ‘জাতির অতীত’ অবস্থায় গিয়ে থাকি। জাতিবিভাগ ঐ মূলসূত্রের উপরই প্রতিষ্ঠিত। ভারতে এই জাতিবিভাগ-প্রণালীর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে ব্রাহ্মণ করা-ব্রাহ্মণই আদর্শ মানুষ। যদি ভারতের ইতিহাস পড়, তবে দেখবে-এখানে বরাবরই নিম্নজাতিকে উন্নত করবার চেষ্টা হয়েছে।
অনেক জাতিকে উন্নত করা হয়েছেও। আরও অনেক হবে। শেষে সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। এই আমাদের কার্যপ্রণালী। কাকেও নামাতে হবে না-সকলকে ওঠাতে হবে। আর এইটি প্রধানতঃ ব্রাহ্মণদের করতে হবে, কারণ প্রত্যেক অভিজাত সম্প্রদায়েরই কর্তব্য নিজেদের মূলোচ্ছেদ করা। আর যত শীগগীর তাঁরা এটি করেন, ততই সকলের পক্ষে মঙ্গল। এ বিষয়ে দেরী করা উচিত নয়, বিন্দুমাত্র কালপেক্ষ করা উচিত নয়। ইওরোপ-আমেরিকার জাতিবিভাগের চেয়ে ভারতের জাতিবিভাগ অনেক ভাল।
অবশ্য আমি এ-কথা বলি না যে, এর সবটাই ভাল। যদি জাতিবিভাগ না থাকত তবে তোমরা থাকতে কোথায়? জাতিবিভাগ না থাকলে তোমাদের বিদ্যা ও আর আর জিনিষ কোথায় থাকত? জাতিবিভাগ না থাকলে ইওরোপীয়দের পড়বার জন্যে এ-সব শাস্ত্রাদি কোথায় থাকত? মুসলমানরা তো সবই নষ্ট করে ফেলত। ভারতীয় সমাজ স্থিতিশীল কবে দেখেছ? এ সমাজ সর্বদাই গতিশীল।
কখনও কখনও, যেমন বিজাতীয় আক্রমণের সময়, এই গতি মৃদু হয়েছিল, অন্য সময়ে আবার দ্রুত। আমি আমার স্বদেশীদের এই কথাই বলি। আমি তাদের গাল দিই না। আমি অতীতের দিকে দেখি। আর দেখতে পাই, দেশ-কাল-অবস্থা বিবেচনা করলে কোন জাতই এর চেয়ে মহৎ কর্ম করতে পারত না। আমি বলি, তোমরা বেশ করেছ, এখন আরও ভাল করবার চেষ্টা কর।’
‘জাতিবিভাগের সঙ্গে কর্মকাণ্ডের সম্বন্ধ-বিষয়ে আপনার কি মত, স্বামীজী?’
‘জাতিবিভাগ-প্রণালীও ক্রমাগত বদলাচ্ছে, ক্রিয়াকাণ্ডও ক্রমাগত বদলাচ্ছে! কেবল মূল তত্ত্ব বদলাচ্ছে না। আমাদের ধর্ম কি, জানতে গেলে বেদ পড়তে হবে। বেদ ছাড়া আর সব শাস্ত্রই যুগভেদে বদলে যাবে। বেদের শাসন নিত্য। অন্যান্য শাস্ত্রের শাসন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ। যেমন কোন ‘স্মৃতি’ এক যুগের জন্য, আর একটি ‘স্মৃতি’ আর এক যুগের জন্য। বড় বড় মহাপুরুষ অবতারেরা সর্বদাই আসছেন, আর কিভাবে কাজ করতে হবে, দেখিয়ে যাচ্ছেন।
কয়েকজন মহাপুরুষ নিম্নজাতির উন্নতির চেষ্টা করে গেছেন। কেউ কেউ- যেমন মধ্বাচার্য-নারীদের বেদ পড়বার অধিকার দিয়েছেন। জাতিবিভাগ কখনও যেতে পারে না, তবে মাঝে মাঝে একে নূতন ছাঁচে ঢালতে হবে। প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার ভেতর এমন প্রাণশক্তি আছে, যাতে দু-লক্ষ নূতন সমাজ-ব্যবস্থা গঠিত হতে পারে। জাতিবিভাগ উঠিয়ে দেবার ইচ্ছা করাও পাগলামি মাত্র। পুরাতনেরই নব বিবর্তন বা বিকাশ-এই হল নূতন কার্যপ্রণালী।’
‘হিন্দুদের কি সমাজ-সংস্কারের দরকার নেই?’
‘খুব আছে। প্রাচীনকালে মহাপুরুষেরা উন্নতির নূতন নূতন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতেন, আর রাজারা আইন করে সেগুলি চালিয়ে দিতেন। প্রাচীনকালে ভারতে এই-রকম করেই সমাজের উন্নতি হত। বর্তমান কালে এইভাবে সামাজিক উন্নতি করতে গেলে এমন একটি শক্তি চাই, যার কথা লোকে নেবে। এখন হিন্দু রাজা নেই, এখন লোকদের নিজেদেরই সমাজের সংস্কার, উন্নতি প্রভৃতির চেষ্টা করতে হবে।
সুতরাং যতদিন না লোকে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অভাব বোঝে, আর নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে প্রস্তুত ও সমর্থ হয়, ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কোন সংস্কারের সময় সংস্কারের পক্ষে লোক খুব অল্পই পাওয়া যায়, এর চেয়ে আর দুঃখের বিষয় কিছু হতে পারে না। এইজন্য কেবল কতকগুলি কাল্পনিক সংস্কারে-যা কখনও কার্যে পরিণত হবে না, তাতে বৃথা শক্তিক্ষয় না করে আমাদের উচিত একেবারে মূল থেকে প্রতিকারের চেষ্টা করা-এমন একদল লোক তৈরী করা, যারা নিজেদের আইন নিজেরাই করবে।
অর্থাৎ এর জন্যে লোকদের শিক্ষা দিতে হবে-তাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করে নেবে। তা না হলে এ-সব সংস্কার আকাশকুসুমই থেকে যায়। নূতন প্রণালী হল নিজেদের দ্বারা নিজেদের উন্নতি-সাধন। এটি কাজে পরিণত করতে সময় লাগবে, বিশেষতঃ ভারতবর্ষে; কারণ প্রাচীনকালে এখানে বরাবরই রাজার অব্যাহত শাসন ছিল।’
‘আপনি কি মনে করেন, হিন্দুসমাজ ইওরোপীয় সমাজের রীতিনীতি গ্রহণ করে কৃতকার্য হতে পারে?
‘না সম্পূর্ণরূপে নয়। আমি বলি যে, গ্রীক মন-যা ইওরোপীয় জাতির বহির্মুখ শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে-তার সঙ্গে হিন্দু মন মিলিত হলে ভারতের পক্ষে আদর্শ সমাজ হবে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, মিছামিছি শক্তিক্ষয়, আর দিনরাত কতকগুলো বাজে কাল্পনিক বিষয়ে বাক্যব্যয় না করে ইংরেজদের কাছ থেকে-আজ্ঞামাত্র নেতার আদেশ-পালন, ঈর্ষাহীনতা, অদম্য অধ্যবসায় ও নিজেতে অনন্ত বিশ্বাস স্থাপন করতে শেখা আমাদের পক্ষে বিশেষ দরকার।
কাকেও নেতা বলে স্বীকার করলে একজন ইংরেজ তাকে সব অবস্থায় মেনে চলবে, সব অবস্থায় তার আজ্ঞাধীন হবে। ভারতে সবাই নেতা হতে চায়, হুকুম তালিম করবার কেউ নেই। সকলেরই উচিত, হুকুম করবার আগে হুকুম তামিল করতে শেখা। আমাদের ঈর্ষার অন্ত নেই; হিন্দুর পদমর্যাদা যত বাড়ে, ঈর্ষাও তত বাড়ে। যতদিন না এই ঈর্ষা দ্বেষ দূর হয় এবং নেতার আজ্ঞাবহতা হিন্দুরা শেখে, ততদিন একটা সমাজ-সংহতি হতেই পারে না, ততদিন আমরা এই-রকম ছত্রভঙ্গ হয়ে থাকব,
কিছুই করতে পারব না। ইওরোপের কাছ থেকে ভারতকে শিখতে হবে-বহিঃপ্রকৃতি জয়, আর ভারতের কাছ থেকে ইওরোপকে শিখতে হবে-অন্তঃপ্রকৃতি জয়। তা হলে আর হিন্দু বা ইওরোপীয় বলে কিছু থাকবে না; উভয়-প্রকৃতিজয়ী এক আদর্শ মনুষ্যসমাজ গঠিত হবে। আমরা মনুষ্যত্বের একদিক, ওরা আর একদিক বিকাশ করেছে। এই দুইটির মিলনই দরকার। মুক্তি, যা আমাদের ধর্মের মূলমন্ত্র, তার প্রকৃত অর্থ-দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সব রকম স্বাধীনতা।’
‘স্বামীজী, ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে ধর্মের কি সম্বন্ধ?’
‘ক্রিয়াকাণ্ড হচ্ছে ধর্মের ‘কিণ্ডারগার্টেন’ বিদ্যালয়। জগতের এখন যে অবস্থা, তাতে ওটি এখনও পুরোপুরি আবশ্যক। তবে লোককে নূতন নূতন অনুষ্ঠান দিতে হবে। কতকগুলি চিন্তাশীল ব্যক্তির উচিত-এই কাজের ভার লওয়া। পুরাতন ক্রিয়াকাণ্ডগুলি উঠিয়ে দিতে হবে, নূতন নূতন আচার অনুষ্ঠান প্রবর্তন করতে হবে।’
‘তবে আপনি ক্রিয়াকাণ্ড একেবারে উঠিয়ে দিতে বলেন না, দেখছি।’
‘না, আমার মূলমন্ত্র গঠন, বিনাশ নয়। বর্তমান ক্রিয়াকাণ্ড থেকে নূতন নূতন ক্রিয়াকাণ্ড করতে হবে। সব বিষয়েরই অনন্ত উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে-এই আমার বিশ্বাস। একটা পরমাণুর পেছনে সমগ্র জগতের শক্তি রয়েছে। হিন্দুজাতির ইতিহাসে বরাবর-কখনই বিনাশের চেষ্টা হয়নি, গঠনেরই চেষ্টা হয়েছে। এক সম্প্রদায় বিনাশের চেষ্টা করেন, তার ফলে ভারত থেকে বহির্ভূত হলেন-তাঁদের নাম বৌদ্ধ। আমাদের শঙ্কর, রামানুজ, চৈতন্য প্রভৃতি অনেক সংস্কারক হয়েছেন।
তাঁরা সকলেই খুব বড় দরের সংস্কারক ছিলেন-তাঁরা সর্বদা গঠনই করেছিলেন, তাঁরা যে দেশ-কাল অনুসারে সমাজ গঠন করেছিলেন, সেই হল আমাদের কার্যপ্রণালীর বিশেষত্ব। আমাদের আধুনিক সংস্কারকেরা ইওরোপীয় ধ্বংসমূলক সংস্কার চালাতে চেষ্টা করেন-এতে কারও কোন উপকার হয়নি, হবেও না। কেবল একজন মাত্র আধুনিক সংস্কারক গঠনকারী ছিলেন-রাজা রামমোহন রায়।
হিন্দুজাতি বরাবরই বেদান্তের আদর্শ কার্যে পরিণত করার চেষ্টা করে চলেছে। সৌভাগ্যই হউক, আর দুর্ভাগ্যই হউক, সব অবস্থায় বেদান্তের এই আদর্শকে কার্যে পরিণত করবার প্রাণপণ চেষ্টাই-ভারতীয় জীবনের সমগ্র ইতিহাস। যখনই এমন কোন সংস্কারক সম্প্রদায় বা ধর্ম উঠেছে, যারা বেদান্তের আদর্শ ছেড়ে দিয়েছে, তারা তৎক্ষণাৎ একেবারে মুছে গেছে।’
‘আপনার এখানকার কার্যপ্রণালী কিরূপ?’
‘আমি আমার সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করবার জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চাই-একটি মান্দ্রাজে, আর একটি কলিকাতায়। আর আমার সঙ্কল্প সংক্ষেপে বলতে গেলে এই হয় যে, বেদান্তের আদর্শ প্রত্যেকের জীবনে পরিণত করবার চেষ্টা-তা তিনি সাধুই হন, অসাধুই হন, জ্ঞানীই হন বা অজ্ঞানই হন, ব্রাহ্মণই হন আর চণ্ডালই হন।’
এইবার আমাদের প্রতিনিধি ভারতের রাজনীতিক সমস্যা সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু তার কোন উত্তর পাবার আগেই ট্রেন মান্দ্রাজের এগমোর ষ্টেশনের প্লাটফর্মে লাগল। এইটুকু মাত্র স্বামীজীর মুখ থেকে শোনা গেল, ভারত ও ইংলণ্ডের সমস্যাগুলিকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানর তিনি ঘোর বিরোধী।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….