ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে

১০
স্থান-কাশ্মীর (অমরনাথ)
কাল-২৯ জুলাই হইতে ৮ অগষ্ট

২৯ জুলাই। এই সময় হইতে আমরা স্বামীজীকে খুব কমই দেখিতে পাই। তিনি তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে খুব উৎসাহান্বিত ছিলেন, বেশীর ভাগ দিন একাহারী হইয়া থাকিতেন, এবং সাধুসঙ্গ ভিন্ন অন্য সঙ্গ বড় একটা চাহিতেন না। কোথাও তাঁবু খাটান হইলে কখনও কখনও তিনি মালা হাতে সেখানে আসিতেন। বওয়ান জায়গাটি একটি পল্লীগ্রামের মেলার মত-সমস্তটির উপর একটি ধর্মভাবের ছাপ রহিয়াছে, আর পুণ্য কুণ্ডগুলি ঐ ধর্মভাবের কেন্দ্রস্বরূপ। ইহার পর আমরা ধীরামাতার সহিত তাঁবুর দ্বারের নিকট গিয়া যে বহুসংখ্যক হিন্দীভাষী সাধু স্বামীজীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিতেছিলেন, তাঁহাদের কথাবার্তা শুনিতে সক্ষম হইয়াছিলাম।

বৃহস্পতিবারে আমরা পহলগামে পৌঁছিলাম; উপত্যকাটির নিম্নপ্রান্তে আমাদের ছাউনি পড়িল। দেখিলাম যে, আমাদিগকে আদৌ ঢুকিতে দেওয়া হইবে কিনা, সে-বিষয়ে স্বামীজীকে গুরুতর আপত্তিসমূহ নিরাকরণ করিতে হইতেছে। নাগা সাধুগণ তাঁহাকে সমর্থন করিতেছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, ‘স্বামীজী, ইহা সত্য যে আপনার শক্তি আছে, কিন্তু তাহা প্রকাশ করা আপনার উচিত নহে!’ বলিবামাত্র স্বামীজী চুপ করিয়া গেলেন! যাহা হউক, সেদিন অপরাহ্নে তিনি তাঁহার কন্যাকে আশীর্বাদলাভে ধন্য হইবার জন্য, ছাউনির চারিধারে ঘুরাইয়া আনিলেন-প্রকৃতপক্ষে উহা ভিক্ষা-বিতরণ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। আর, লোকে তাঁহাকে ধনী ঠাওরাইয়াছিল বলিয়াই হউক, অথবা তাঁহাকে শক্তিমান্ বলিয়া বুঝিয়া লইয়াছিল বলিয়াই হউক, পরদিবস আমাদের তাঁবুটি ছাউনির পুরোভাগে একটি মনোহর পাহাড়ের উপর তুলিয়া লওয়া হইয়াছিল।

পরবর্তী বিশ্রামস্থান চন্দনবাড়ী যাইবার রাস্তাটি কি সুন্দর! চন্দনবাড়ীর একটি গভীর গিরিবর্ত্মের কিনারায় আমরা ছাউনি ফেলিলাম। সমস্ত বৈকাল ধরিয়া বৃষ্টি হইয়াছে, এবং স্বামীজী মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আমার সহিত দেখা করিতে ও সামান্য একটু কথাবার্তা কহিতে আসিয়াছিলেন।

চন্দনবাড়ীর সন্নিকটে স্বামীজী জেদ করিলেন, ইহাই আমার প্রথম তুষারবর্ত্ম, অতএব আমাকে উহা খালি পায় অতিক্রম করিতে হইবে। জ্ঞাতব্য প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির উল্লেখ করিতে তিনি ভুলিলেন না। ইহার পরেই বহুসহস্রফুট-ব্যাপী এক বিকট চড়াই আমাদের ভাগ্যে পড়িল। তারপর এক সরু পথ, পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিয়াছে; সেই দীর্ঘ পথ ধরিয়া চলিলাম; এবং সর্বশেষে আর একটি খাড়া চড়াই। প্রথম পর্বতটির উপরিভাগের জমিটিকে একজাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাস (Edelweiss) ঠিক যেন গালিচা দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে। তারপরে রাস্তাটি শেষনাগ হইতে পাঁচশত ফুট উচ্চ দিয়া চলিয়াছে। শেষনাগের জল গতিহীন। অবশেষে আমরা তুষারমণ্ডিত শিখরগুলির মধ্যে ১৮০০০ ফুট উচ্চে এক ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় ছাউনি ফেলিলাম। ফার গাছগুলি বহু নিম্নে ছিল, সুতরাং সারা বৈকাল ও সন্ধ্যাবেলা কুলীরা চারিদিক হইতে জুনিপার গাছ সংগ্রহ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। স্থানীয় তহসিলদারের, স্বামীজীর এবং আমার তাঁবু খুব কাছাকাছি ছিল; সন্ধ্যাবেলায় সম্মুখভাগে এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বলিত হইল। আমাদের ছাউনি পড়িবার পর আমি আর স্বামীজীকে দেখি নাই।

পাঁচটি তটিনীর মিলনস্থল ‘পঞ্চতরণী’ যাইবার রাস্তা এতটা দীর্ঘ ছিল না। অধিকন্তু ইহা শেষনাগ অপেক্ষা নীচু এবং এখানকার ঠাণ্ডা বেশ শুষ্ক ও প্রীতিপ্রদ। ছাউনির সম্মুখে এক কঙ্করময় শুষ্ক নদীগর্ভ, উহার মধ্য দিয়া পাঁচটি তটিনী চলিয়াছে। ইহাদের সকলগুলিতেই-একটির পর অপরটিতে ভিজা কাপড়ে হাঁটিয়া গিয়া যাত্রিগণের স্নান করার বিধি। সম্পূর্ণরূপে লোকের নজর এড়াইয়া স্বামীজী কিন্তু এ-বিষয়ক নিয়মটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন।

এই-সকল উচ্চ স্থানে প্রায়ই দেখিতাম যে, আমরা তুষার-শৃঙ্গরাজির মহান্ পরিধির মধ্যে রহিয়াছি-এই নির্বাক্‌ বিপুলায়তন পর্বতগুলিই হিন্দুমনে ভস্মানুলিপ্ত ভগবান্ শঙ্করের ভাব উদ্রেক করিয়া দিয়াছে।

২ অগষ্ট। ২ অগষ্ট মঙ্গলবার, অমরনাথের সেই মহোৎসব দিনে আমরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকে যাত্রা করিলাম। সঙ্কীর্ণ উপত্যকাটিতে পৌঁছিলে সূর্যোদয় হইল। রাস্তার এই অংশটিতে যাতায়াত যে খুব নিরাপদ ছিল, তাহা নয়। কিন্তু যখন আমরা ডাণ্ডি ছাড়িয়া চড়াই করিতে আরম্ভ করিলাম, তখনই প্রকৃত বিপদের সূত্রপাত হইল। কোনমতে ওপারের-উতারটির তলদেশে পৌঁছিয়া আমাদিগকে অমরনাথের গুহা পর্যন্ত ক্রোশের পর ক্রোশ তুষারবর্ত্মের উপর দিয়া বহুকষ্টে যাইতে হইয়াছিল।

ক্লান্ত হইয়া স্বামীজী ইতোমধ্যে পিছনে পড়িয়াছিলেন। অনেক বিলম্বে তিনি আসিয়া পৌঁছিলেন, এবং ‘স্নান করিতে যাইতেছি’-মাত্র এই কথা বলিয়া আমাকে অগ্রসর হইতে বলিলেন। অর্ধ ঘণ্টা পরে তিনি গুহামধ্যে প্রবেশ করিলেন। সস্মিতবদনে তিনি প্রথমে অর্ধবৃত্তটির এক প্রান্তে, পরে অপর প্রান্তটিতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। স্থানটি বিশাল ছিল, এত বড় যে, সেখানে একটি গীর্জা ধরিতে পারে, এবং সুবৃহৎ তুষারময় শিবলিঙ্গটি প্রগাঢ়চ্ছায় এক গহ্বরে অবস্থিত থাকায় যেন নিজ সিংহাসনেই অধিরূঢ় বলিয়া মনে হইতেছিল। কয়েক মিনিট কাটিয়া যাইবার পর তিনি গুহা ত্যাগ করিবার উদ্যোগ করিলেন।

তাঁহার চক্ষে যেন স্বর্গের দ্বারসমূহ উদ্‌ঘাটিত হইয়াছে। তিনি সদাশিবের শ্রীপাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছেন। পরে বলিয়াছিলেন-পাছে তিনি ‘মূর্ছিত হইয়া পড়েন’ এইজন্য নিজেকে শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার দৈহিক ক্লান্তি এত অধিক হইয়াছিল যে, জনৈক ডাক্তার পরে বলিয়াছিলেন-তাঁহার হৃৎপিণ্ডের গতিরোধ হইবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তৎপরিবর্তে উহা চিরদিনের মত বর্ধিতায়তন হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার গুরুদেবের সেই কথাগুলি কি অদ্ভুতভাবে প্রায় সফল হইয়াছিল, ‘ও যখন নিজেকে জানতে পারবে, তখন আর এ শরীর রাখবে না!’

আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একখানি পাথরের উপর বসিয়া সেই সহৃদয় নাগা সন্ন্যাসী এবং আমার সহিত জলযোগ করিতে করিতে স্বামীজী বলিলেন, ‘আমি কি আনন্দই উপভোগ করিয়াছি! আমার মনে হইতেছিল যে, তুষারলিঙ্গটি সাক্ষাৎ শিব। আর সেখানে কোন বিত্তাপহারী ব্রাহ্মণ ছিল না, কোন ব্যবসা ছিল না, খারাপ কোন কিছু ছিল না। [সেখানে] কেবল নিরবচ্ছিন্ন পূজার ভাব। আর কোন তীর্থক্ষেত্রেই আমি এত আনন্দ উপভোগ করি নাই!’

পরে তিনি প্রায়ই আমাদিগকে তাঁহার সেই চিত্তবিহ্বলকারী দর্শনের কথা বলিতেন; উহা যেন তাঁহাকে একেবারে স্বীয় ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টানিয়া লইবে বলিয়া বোধ হইয়াছিল। তিনি শভ্র তুষারস্তম্ভটির কাব্যময় রূপের বর্ণনা করিতেন, এবং তিনিই ইঙ্গিত করিলেন, একদল মেষপালকই উক্ত স্থানটি প্রথম আবিষ্কার করে। কোন এক নিদাঘ-দিবসে তাহারা নিজ নিজ মেষযূথের সন্ধানে বহুদূরে গিয়া পড়িয়াছিল এবং এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখে যে, তাহারা অদ্রব-তুষাররূপী সাক্ষাৎ শ্রীভগবানের সান্নিধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। তিনি সর্বদা ইহাও বলিতেন, ‘সেইখানেই অমরনাথ আমাকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়াছেন।’ আর আমাকে তিনি বলিলেন, ‘তুমি এখন বুঝিতেছ না; কিন্তু তোমার তীর্থযাত্রা সম্পন্ন হইয়াছে, এবং ইহার ফল ফলিতেই হইবে। কারণ থাকিলেই কার্য নিশ্চিত। তুমি পরে আরও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিবে। ফল অবশ্যম্ভাবী।’

পরদিন প্রাতঃকালে আমরা যে রাস্তা দিয়া পহলগামে প্রত্যাবর্তন করিলাম, তাহা কি সুন্দর রাস্তা! সেই রজনীতে তাঁবুতে ফিরিয়া আমরা তাঁবু উঠাইলাম এবং অনেক পরে পুরা এক চটীভর রাস্তা চলিয়া একটি তুষারময় গিরিসঙ্কটে রাত্রির জন্য ছাউনি ফেলিলাম। এইখানে আমরা একজন কুলীকে কয়েক আনা পয়সা দিয়া একখানি চিঠি লইয়া আগে পাঠাইয়া দিলাম, কিন্তু পরদিন মধ্যাহ্নে পৌঁছিয়া দেখিলাম যে, ইহার কোনই প্রয়োজন ছিল না। কারণ সমস্ত প্রাতঃকাল ধরিয়া যাত্রিগণ দলে দলে আমাদের তাঁবুর নিকট দিয়া যাইবার সময় নিতান্ত বন্ধুভাবে, অপর সকলকে আমাদের সংবাদ দিবার জন্য, এবং আমরা যে খুব শীঘ্রই আসিতেছি-এই কথা জানাইবার জন্য, আমাদের তত্ত্ব লইয়া যাইতেছিল। প্রাতঃকালে সূর্যোদয়ের বহু পূর্বেই আমরা গাত্রোত্থান করিয়া পথ চলিতে আরম্ভ করিলাম। সম্মুখে সূর্য উদিত হইতেছেন এবং পশ্চাতে চন্দ্র অস্ত যাইতেছেন, এমন সময়ে আমরা ‘হাতিয়ার তলাও’ (Lake of Death) নামক হ্রদের উপরিভাগের রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিলাম। এই সেই হ্রদ-যেখানে এক বৎসর প্রায় চল্লিশ জন যাত্রী তাহাদেরই স্তোত্র-পাঠের কম্পনে স্থানচ্যুত একটি তুষারপ্রবাহ (avalanche) কর্তৃক সবেগে নিক্ষিপ্ত হইয়া নিহত হইয়াছিল! একটি ক্ষুদ্র পগ‍্‍ডাণ্ডী পথ খাড়া পাহাড়ের গা দিয়া নীচে নামিয়াছে। অতঃপর আমরা তথায় উপস্থিত হইলাম এবং ঐ পথে চলিয়া দূরত্ব যথেষ্ট কমাইতে সমর্থ হইয়াছিলাম। ঐ পথ সকলকেই পায়ে হাঁটিয়া তাড়াতাড়ি কষ্টেসৃষ্টে ঠেলাঠেলি করিয়া অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। তলদেশে গ্রামবাসিগণ প্রাতঃকালীন জলযোগের মতন একটা কিছু প্রস্তুত রাখিয়াছিল। স্থানে স্থনে অগ্নি প্রজ্বলিত ছিল, চাপাটী সেঁকা হইতেছিল, এবং চা-ও প্রস্তুত ছিল, শুধু ঢালিলেই হইল। এখন হইতে যেখানে যেখানে রাস্তা পৃথক্ হইয়া গিয়াছে, সেইখানেই যাত্রিগণ দলে দলে মুখ্য দল হইতে পৃথক্ হইয়া যাইতে লাগিল, এবং এই সারা পথ ধরিয়া আমাদের মধ্যে যে একটি একত্বের ভাব জন্মিয়াছিল, তাহা ক্রমশঃ হ্রাস পাইতে লাগিল।

সেই দিন সন্ধ্যার সময় পহলগামের উপরিভাগে আমরা এক গোল পাহাড়ের উপর পাইন কাঠের এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বালিত করিয়া এবং সতরঞ্চি বিছাইয়া গল্প করিতে লাগিলাম; আমাদের বন্ধু সেই নাগা সন্ন্যাসীটি আমাদের সহিত যোগ দিলেন, এবং যথেষ্ট কৌতুক-পরিহাসাদি চলিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই আমাদের ক্ষুদ্র দলটি ব্যতীত আর সকলে চলিয়া গেল। আর আমরা বসিয়া এই সব দৃশ্য উপভোগ করিতে লাগিলাম-উপরে চন্দ্রদেব হাসিতেছেন, তুষারশৃঙ্গগুলি মাথা তুলিয়া দণ্ডায়মান, নদী খরবেগে প্রবাহিতা, এবং চারিদিকে অসংখ্য পার্বত্য পাইন বৃক্ষ।

৮ অগষ্ট। পরদিন আমরা ইসলামাবাদ যাত্রা করিলাম, এবং সোমবার প্রভাতে প্রাতঃকালীন জলযোগে বসিয়াছি, এমন সময়ে মাঝিরা গুণ টানিয়া নৌকাগুলি নিরাপদে শ্রীনগরে আনিয়া লাগাইয়া দিল।

১১
স্থান-প্রত্যাবর্তনের পথে (শ্রীনগর)
কাল-৯ হইতে ১৩ অগষ্ট

৯ অগষ্ট। এই সময়ে আচার্যদেব ক্রমাগত আমাদের নিকট বিদায় লইবার কথা বলিতেছিলেন। সুতরাং যখন আমি খাতায় ‘রমতা সাধু বহতা পানি, ইস‍্‍মে ন কোই মৈল লখানি’-এই বাক্যটি লিপিবদ্ধ দেখিতে পাই, তখন আমি স্পষ্ট জানি, ইহার অর্থ কি। ‘যখনই আমায় কষ্ট সহ্য করিতে হয় এবং ভিক্ষোপজীবী হইতে হয়, তখনই আমি কত বেশী ভাল থাকি!’ এই সাগ্রহ কাতরোক্তি, স্বাধীনতা এবং সাধারণ লোকদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, পদব্রজে স্বীয় দীর্ঘ দেশভ্রমণের চিত্রাঙ্কন এবং স্বস্থানে ফিরিয়া যাইবার জন্য পুনরায় আমাদিগের সহিত বারামুল্লায় সাক্ষাৎ, এই সবই উহার

যে নৌকার মাঝিরা স্বামীজীর আপনার হইয়া গিয়াছিল এবং যাহাদিগকে তিনি দুইটি ঋতু ধরিয়া সর্বতোভাবে সাহায্য করিয়া আসিয়াছেন, আজ তাহারা আমাদিগের নিকট বিদায় লইল। সহৃদয়তা এবং সহিষ্ণুতারও যে বাড়াবাড়ি হইতে পারে, তাহারই প্রমাণস্বরূপ পরে তিনি তাঁহার সহিত মাঝিদের সম্বন্ধরূপ সমগ্র ব্যাপারটি উল্লেখ করিতেন।

১০ অগষ্ট। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আমরা সকলে একজনের সহিত দেখা করিবার জন্য বাহির হইলাম। ফিরিবার সময় তাঁহার শিষ্যা নিবেদিতাকে তাঁহার সহিত ক্ষেতগুলির উপর দিয়া বেড়াইয়া আসিবার জন্য ডাকিলেন। তাঁহার কথাবার্তা সমস্তই ছিল স্ত্রীশিক্ষা-কার্য ও সে-বিষয়ে তাহার অভিপ্রায় কি, এই লইয়া। স্বদেশ এবং উহার ধর্মসমূহ সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা যে সমন্বয়মূলক, তাঁহার নিজের বিশেষত্ব শুধু এইটুকু যে, তিনি চাহেন-হিন্দুধর্ম নিষ্ক্রিয় না থাকিয়া সক্রিয় হউক এবং পরের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া তাহাদিগকে স্বমতে আনয়ন করিবার সামর্থ্য উহার থাকুক; কেবল অস্পৃশ্যতাকেই তিনি অস্বীকার করিতেন-এই-সব সম্বন্ধে তিনি বলিতে লাগিলেন। পরে তিনি গভীর ভাবের সহিত-যাঁহারা খুব প্রাচীনপন্থী (Orthodox), তাঁহাদের অনেকের অসাধারণ ধর্মভাব সম্বন্ধে বলিলেন। বলিলেন, ‘ভারতের অভাব কার্যকুশলতা (Practicality)। কিন্তু সেজন্য ভারত যেন কখনও পুরাতন চিন্তাশীল জীবনের উপর তাহার অধিকার ছাড়িয়া না দেয়।’

‘শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছেন, সমুদ্রের ন্যায় গভীর এবং আকাশের ন্যায় উদার হওয়াই আদর্শ। কিন্তু নিয়মনিষ্ঠার সহিত গভীর অন্তর্জীবনের কোন অপরিহার্য সম্পর্ক নাই, এই সম্বন্ধ আকস্মিক। আর যদি আমরা নিজেরা নিজেদের ঠিক করি, তাহা হইলে জগৎও ঠিক হইয়া যাইবে, কারণ আমরা সকলেই কি এক নহি? শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁহার ভিতরের নিগূঢ় তত্ত্বগুলির পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখিতেন; তথাপি বাহ্যদশায় তিনি পুরাদস্তুর কর্মতৎপর ও কর্মপটু ছিলেন।’

অতঃপর তিনি গুরুপূজা-রূপ সেই জটিল প্রশ্নটি সম্বন্ধে বলিলেন, ‘আমার নিজের জীবন সেই মহাপুরুষের চরিত্রের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ দ্বারা চালিত, কিন্তু এটি অপরের পক্ষে কতদূর খাটিবে, তাহা প্রত্যেকে নিজে নিজেই ঠিক করিয়া লইবে। অতীন্দ্রিয় তত্ত্বসকল শুধু যে একজন লোকের মধ্য দিয়াই জগতে প্রসারিত হয়, এমন নহে।’

১১ অগষ্ট। এই দিন করকোষ্ঠী দেখার জন্য আমাদের মধ্যে একজনকে স্বামীজীর নিকট ভর্ৎসনা সহ্য করিতে হইয়াছিল। তিনি বলিলেন, ‘এ জিনিষটাকে সকলেই চায়, তবু সমগ্র ভারত ইহাকে হেয় জ্ঞান করে, ঘৃণা করে।’ একজনের একটু বিশেষ ওকালতির উত্তরে বলিলেন, ‘চেহারা দেখিয়া চরিত্র বলিয়া দেওয়াও আমি সমর্থন করি না। বলিতে কি, তোমাদের অবতার এবং তাঁহার শিষ্যবর্গ যদি সিদ্ধাইগুলা না দেখাইতেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাকে আরও বেশী সত্যসন্ধ বলিয়া মনে করিতাম। এই কার্যের জন্য বুদ্ধ এক ভিক্ষুকে সঙ্ঘচ্যুত করিয়াছিলেন।’

১২ ও ১৩ অগষ্ট। স্বামীজী আজকাল একজন ব্রাহ্মণ পাচক রাখিয়াছেন। একজন মুসলমান পর্যন্ত তাঁহাকে রাঁধিয়া দিতে পারে, তাঁহার এইরূপ অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে অমরনাথ-যাত্রী সাধুদের যুক্তিগুলি বড়ই মর্মস্পর্শী ছিল। তাঁহারা বলিয়াছিলেন, ‘অন্ততঃ শিখদের দেশে এটি করিবেন না, স্বামীজী!’ এবং তিনিও অবশেষে সম্মতি দিয়াছিলেন। কিন্তু উপস্থিত তিনি তাঁহার মুসলমান মাঝির শিশু কন্যাটিকে উমারূপে পূজা করিতেছিলেন। ভালবাসা বলিতে সে শুধু সেবা করা বুঝিত, এবং স্বামীজীর কাশ্মীর ত্যাগের দিনে সেই শিশু তাঁহার জন্য একথাল আপেল সানন্দে নিজে সমস্ত পথ হাঁটিয়া টঙ্গায় তুলিয়া দিয়া গিয়াছিল। স্বামীজীকে তৎকালে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হইলেও বালিকাকে তিনি কখনও ভুলিয়া যান নাই। কাশ্মীরে থাকিতে থাকিতেই তিনি একদিনকার কথা প্রায়ই সানন্দে স্মরণ করিতেন। বালিকা সেদিন নৌকার গুণ টানিবার রাস্তায় একটি নীলবর্ণের ফুল দেখিতে পায়, এবং সেখানে বসিয়া উহাকে একবার এধারে, একবার ওধারে আঘাত করিতে করিতে কুড়ি মিনিট কাল সেই ফুলটির সহিত একাকী কাটায়।

নদীতটে একখণ্ড জমি ছিল, তাহার উপর তিনটি চেনার গাছ জন্মিয়াছিল। ইহাদের কথা ভাবিলেই আমরা এই সময়ে এক বিশেষ আনন্দ অনুভব করিতাম। কারণ-কাশ্মীরের মহারাজ স্বামীজীকে উহা দিবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন এবং আমাদের যে ভাবে কার্যে ‘দেশের লোকের দ্বারা, দেশের লোকের জন্য, এবং সেবক ও সেব্য-উভয়েরই প্রীতিকর’-এই মহান্ ভাব রূপায়িত হইবে, উক্ত স্থানটিকে তাহারই এক কর্ম-কেন্দ্র বলিয়া আমরা সকলে এক মানসচিত্র অঙ্কিত করিলাম।

নারীগণই গৃহনির্মাণস্থানের মাঙ্গলিক কার্য বিধান করিবেন, ভারতে প্রচলিত এই ধারণা জানা থাকায় একজন বলিয়া উঠিলেন, আমরা উক্ত স্থানে গিয়া কিছুক্ষণের জন্য ছাউনি ফেলিয়া উহাকে দখল করিয়া লইলে কিরূপ হয়? উক্ত স্থান ইওরোপীয়গণ কর্তৃক ব্যবহৃত ছাউনি ফেলিবার ছোটখাট স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বলিয়া ইহা সম্ভব হইয়াছিল।

১২
স্থান-চেনার-তলে ছাউনি, শ্রীনগর)
কাল-১৪ অগষ্ট হইতে ২০ সেপ্টেম্বর

১৪ অগষ্ট-৩ সেপ্টেম্বর। রবিবার প্রাতঃকাল; পরবর্তী অপরাহ্নে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে স্বামীজী আমাদের সহিত চা পান করিতে আসিতে সম্মত হন। একজন ইওরোপীয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তিনি বেদান্তের একজন অনুরাগী বলিয়া বোধ হইয়াছিল। এ-বিষয়ে স্বামীজীর কিন্তু কোন উৎসাহ দেখা গেল না। তিনি ঐ জিজ্ঞাসুকে বুঝাইবার জন্য যৎপরোনাস্তি ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার চেষ্টা একেবারেই নিষ্ফল হইয়াছিল। অন্যান্য কথার সঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি তো চাই-নিয়মলঙ্ঘন করা সম্ভব হউক, কিন্তু তা হয় কই? যদি সত্য-সত্যই আমরা কোন নিয়মের ব্যতিক্রম করিতে সমর্থ হইতাম, তাহা হইলে তো আমরা মুক্ত হইয়া যাইতাম। যাহাকে আপনি নিয়ম-ভঙ্গ বলেন, উহা তো অন্য এক প্রকারে নিয়মপালন মাত্র।’ তৎপরে তিনি তুরীয় অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যাঁহাকে তিনি কথাগুলি বলিলেন, তাঁহার শুনিবার কান ছিল না।

১৬ সেপ্টেম্বর। মঙ্গলবার দিন তিনি আর একবার মধ্যাহ্নভোজনে আমাদের ক্ষুদ্র ছাউনিতে আসিলেন। অপরাহ্নে এমন জোরে বৃষ্টি শুরু হইল যে, তাঁহার ফিরিয়া যাওয়া হইল না। নিকটে একখানি টডের ‘রাজস্থান’ পড়িয়াছিল, তাহাই উঠাইয়া লইয়া কথায় কথায় মীরাবাঈ-এর কথা পাড়িলেন। বলিলেন, ‘বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।’ যাহার সকল অংশই উত্তম এমন ‘টডে’র মধ্যে-যিনি রাণী হইয়াও রাণীত্ব পরিত্যাগ করিয়া কৃষ্ণ-প্রেমিকাগণের সঙ্গে পৃথিবীতে বিচরণ করিতে চাহিয়াছিলেন, সেই মীরাবাঈ-এর গল্পটি তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। তিনি যে শরণাগতি, প্রার্থনাপরতা ও সর্বজীবে সেবা প্রচার করিয়াছিলেন, উহা যে শ্রীচৈতন্য-প্রচারিত ‘নামে রুচি জীবে দয়া’র ভাব হইতে ভিন্ন, তাহাও উল্লেখ করিলেন। মীরাবাঈ স্বামীজীর অন্যতম প্রধান প্রেরণাদাত্রী। বিখ্যাত দস্যুদ্বয়ের হঠাৎ স্বভাব-পরিবর্তন, এবং শেষে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হইয়া তাঁহাকে বিগ্রহে লীন করিয়া ফেলিলেন-এই-সব গল্পের কথা লোকে অন্যান্য সূত্রে অবগত আছে, সেগুলিকে তিনি মীরাবাঈ-এর গল্পের অন্তর্ভুক্ত করিতেন। একবার তিনি মীরাবাঈ-এর একটি গীত আবৃত্তি এবং অনুবাদ করিয়া একজন মহিলাকে শুনাইতেছেন, শুনিলাম; আহা, যদি সবটা মনে রাখিতে পারিতাম! তাঁহার অনুবাদের প্রথম কথাগুলি এই, ‘ভাই লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক!’ এবং শেষাংশ এই ছিল-‘সেই অঙ্কা বঙ্কা নামক দস্যু ভ্রাতৃদ্বয়, সেই নিষ্ঠুর সুজন কসাই এবং খেলার ছলে টিয়াপাখীকে কৃষ্ণনাম করিতে শিখাইয়াছিল সেই গণিকা, তাহারা যদি উদ্ধার পাইয়া থাকে, তবে সকলেরই আশা আছে।’২১

আবার, আমি তাঁহাকে মীরাবাঈ-এর সেই অদ্ভুত গল্পটি বলিতে শুনিয়াছি। মীরাবাঈ বৃন্দাবনে পৌঁছিয়া জনৈক বিখ্যাত সাধুকে২২ নিমন্ত্রণ করেন। বৃন্দাবনে পুরুষের সহিত নারীগণের সাক্ষাৎ অকর্তব্য, এই বলিয়া সাধু যাইতে অস্বীকার করেন। যখন তিনবার এইরূপ ঘটিল, তখন ‘বৃন্দাবনে আর কেহ যে পুরুষ আছে, তাহা আমি জানিতাম না। আমার ধারণা ছিল-এখানে শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষরূপে বিরাজিত!’ এই বলিয়া মীরাবাঈ স্বয়ং তাঁহার নিকট গমন করিলেন। যখন বিস্মিত সাধুর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল, তখন ‘নির্বোধ, তুমি নাকি নিজেকে পুরুষ বলিয়া অভিহিত কর?’-এই বলিয়া তিনি স্বীয় অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করিয়া ফেলিলেন আর যেমন সাধু সভয়ে চীৎকার করিয়া তাঁহার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিলেন, অমনি তিনিও তাঁহাকে মাতা যেরূপে সন্তানকে আশীর্বাদ করেন, সেইরূপে আশীর্বাদ করিলেন।

অদ্য স্বামীজী আকবরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন, এবং উক্ত বাদশাহের সভাকবি তানসেনের রচিত তাঁহার সিংহাসনাধিরোহণ-বিষয়ক একটি গীত আমাদের নিকট গাহিলেন।

তারপর স্বামীজী নানা কথা কহিতে কহিতে ‘আমাদের জাতীয় বীর’ প্রতাপসিংহের সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেনঃ কেহ তাঁহাকে কখনও বশ্যতা স্বীকার করাইতে পারে নাই। হাঁ, একবার মুহূর্তের জন্য তিনি পরাভব স্বীকার করিতে প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন বটে। একদিন চিতোর হইতে পলায়নের পর মহারাণী স্বয়ং রাত্রের সামান্য খাবার প্রস্তুত করিয়াছেন, এমন সময়ে এক ক্ষুধিত মার্জার ছেলেদের জন্য যে রুটীখানি নিদিষ্ট ছিল, তাহারই উপর ঝাপট মারিয়া সেখানি লইয়া গেল। মেবার-রাজ স্বীয় শিশুসন্তানগুলিকে খাদ্যের জন্য কাঁদিতে দেখিলেন। তখন বাস্তবিকই তাঁহার বীরহৃদয় অবসন্ন হইয়া পড়িল। অদূরে স্বাচ্ছন্দ্য এবং শান্তির চিত্র দেখিয়া তিনি প্রলুব্ধ হইলেন, এবং মুহূর্তের জন্য তিনি এই অসমান যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া আকবরের সহিত মিত্রতা-স্থাপনের সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা কেবল এক মুহূর্তেরই জন্য। সনাতন বিশ্বনিয়ন্তা পরমেশ্বর তাঁহার প্রিয়জনকে রক্ষা করিয়া থাকেন। উক্ত চিত্র প্রতাপের মানসপট হইতে অন্তর্হিত হইতে না হইতেই এক রাজপুত নরপতির নিকট হইতে দূত আসিয়া তাঁহাকে সেই প্রসিদ্ধ কাগজপত্রগুলি দিল। তাহাতে লেখা ছিলঃ ‘বিধর্মীর সংস্পর্শে যাঁহার শোণিত কলুষিত হয় নাই, এরূপ লোক আমাদের মধ্যে মাত্র একজন আছেন। তাঁহারও মস্তক ভূমিস্পর্শ করিয়াছে, এ কথা যেন কেহ কখনও বলিতে না পারে।’ পাঠ করিবামাত্র প্রতাপের হৃদয় সাহস এবং নূতন আত্মপ্রত্যয়ে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল। তিনি বীরগর্বে দেশ হইতে শত্রুকুল নির্মূল করিয়া উদয়পুরে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

তারপর অনূঢ়া রাজনন্দিনী কৃষ্ণকুমারীর সেই অদ্ভুত গল্প শুনিলাম। একাধিক নরপতি একসঙ্গে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিতে চাহিতেছিলেন। আর যখন তিনটি বৃহৎ বাহিনী পুরদ্বারে উপস্থিত, তাঁহার পিতা কোন উপায়ান্তর না দেখিয়া কন্যাকে বিষ দিতে মনঃস্থ করিলেন। কৃষ্ণকুমারীর খুল্লতাতের উপর এই ভার অর্পিত হইল। বালিকা যখন নিদ্রিতা-সেই সময় খুল্লতাত উক্ত কার্য সম্পাদনার্থ তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু সৌন্দর্য ও কোমল বয়স দেখিয়া এবং শিশুকালের মুখও মনে পড়ায় তাঁহার যোদ্ধৃহৃদয় দমিয়া গেল এবং তিনি নির্দিষ্ট কার্য করিতে অক্ষম হইলেন। কোন শব্দ শুনিতে পাইয়া কৃষ্ণকুমারী জাগিয়া উঠিলেন এবং নির্ধারিত সঙ্কল্পের বিষয় অবগত হইয়া হাত বাড়াইয়া বাটিটি লইলেন এবং হাসিতে হাসিতে সেই বিষ পান করিয়া ফেলিলেন। এইরূপ ভূরি ভূরি গল্প আমরা শুনিতে লাগিলাম। কারণ, রাজপুত-বীরগণের এরূপ গল্প অসংখ্য।

২০ সেপ্টেম্বর। শনিবারে স্বামীজী দুই দিনের জন্য আমেরিকার রাজদূত ও তাঁহার পত্নীর আতিথ্য স্বীকার করতে ডাল হ্রদে গমন করিলেন। সোমবারে ফিরিয়া আসিলেন এবং মঙ্গলবারে স্বামীজী আমাদের নূতন ‘মঠে’ (আমরা ছাউনির ঐ আখ্যাই দিয়াছিলাম) আসিলেন এবং যাহাতে তিনি গাণ্ডেরবল যাত্রা করিবার পূর্বে কয়েক দিন আমাদের সহিত বাস করিতে পারেন-এই উদ্দেশ্যে তাঁহার নৌকাখানিকে আমাদের নৌকার খুব নিকটে লাগাইলেন।

[সম্পাদক (স্বামী সারদানন্দ)-লিখিত পরিশিষ্ট]

গাণ্ডেরবল হইতে স্বামীজী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ফিরিয়া আসিলেন, এবং বিশেষ কোন কারণবশতঃ তিনি যে কয়েক দিনের মধ্যেই বাঙলা দেশে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছেন, তাহা সকলের নিকট প্রকাশ করিলেন। স্বামীজীর ইওরোপীয় সঙ্গিগণ ইতঃপূর্বে শীত পড়িতেই লাহোর, দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি উত্তর-ভারতের মুখ্য নগরগুলি দেখিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। অতএব সকলেই একত্র লাহোরে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এখানে কয়জনকে উত্তর-ভারতের স্থানাদি দর্শন করিবার সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিতে রাখিয়া স্বামীজী সদলবলে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!