উদ্দীপনা
-বার্ট্রান্ড রাসেল
এই অধ্যায়ে, যাকে সুখী মানুষের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এবং বিশ্বজনীন চিহ্ন বলে মনে করি, সেই উদ্দীপনা নিয়ে আলোচনা করব।
এই উদ্দীপনা বলতে কী বোঝায় সম্ভবত তা বুঝিয়ে বলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে মানুষ ভোজনের সময় বিভিন্নভাবে যে আচরণ প্রকাশ করেন তা নিয়ে আলোচনা করা। আহারের বস্তু যত ভালই হোক, অনেকের কাছে আহার শুধুই বিরক্তিকর, তারা এতে কোনও স্বাদ পান না। আগে তারা উৎকৃষ্ট খাদ্য খেয়েছেন সম্ভবত প্রত্যেক আহারের সময়।
ক্ষুধা অতি কাতর না হওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকার কোনও অভিজ্ঞতা তাদের নেই এবং তারা যে সমাজে বাস করেন সেই সমাজের আচরিত রীতি হিসাবেই তারা খাদ্যকে দেখেছেন। অন্যান্য সব কিছুর মতো আহারও তাদের কাছে ক্লান্তিকর। কিন্তু এটা নিয়ে অকারণ ব্যস্ত হওয়া অর্থহীন। কারণ অন্য কোনও কিছুই এর চেয়ে কম ক্লান্তিকর নয়।
তারপর ধরুন স্বাস্থ্যহীনদের কথা, তারা কর্তব্যবোধ থেকে খান, কারণ চিকিৎসকের নির্দেশ হল দেহের পুষ্টির জন্যে কিছু তাদের খেতেই হবে। তারপর ভোজনবিলাসীদের কথা, তারা খুব আশা নিয়ে শুরু করেন, কিন্তু তারপর দেখেন রান্না যতটা ভাল হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি। তারপর পেটুকদের কথা। যারা খাওয়ার আয়োজন দেখলেই লোলুপের মতো খেতে থাকে এবং বেশি খেয়ে ফেলেন।
তারপর অতিভোজনের অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন। সবার পরে যাদের কথা বলছি তারা ভাল ক্ষুধা নিয়ে খেতে বসেন, আনন্দের সঙ্গে যতটা প্রয়োজন ততটাই খান এবং শেষ করেন। আর যারা জীবনের ভোজে বসেছেন, জীবনের যা কিছু সুন্দর তার প্রতিও তাদের আগ্রহ সমতুল্য। ভোজনকারীদের মধ্যে সবার শেষে যার কথা বললাম, তিনি সুখী মানুষের অনুরূপ।
ক্ষুধার সাথে খাদ্যের যে সম্পর্ক, জীবনের সাথে উদ্দিপনারও তাই। যে মানুষ আহারে বিরক্তিবোধ থেকে আহার করেন তিনি তপস্বীর সমতুল্য। আর পেটুক ইন্দ্রিয়বিলাসীর সগোত্র। পেটুক ছাড়া অন্য সকলে, যে ব্যক্তি স্বাভাবিক ক্ষুধা বোধ করে তাকে ভালভাবে দেখে না এবং নিজেদের তার অপেক্ষা উচ্চস্তরের মনে করেন। ক্ষুধার খাদ্যকে উপভোগ করা এদের কাছে অমার্জিতসুলভ আচরণ এবং জীবনকে উপভোগ করাও তাই।
কারণ জীবন বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর ঘটনায় পূর্ণ এবং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার উৎস। যাদের তারা সাধারণ মানুষ বলে তুচ্ছ করেন তাদের মোহমুক্তির উচ্চতা থেকে নিচের স্তরের মানুষরূপেই দেখেন। আমি এই দৃষ্টি ভঙ্গীকে মোটেই সমর্থন করি না। সবরকম মোহমুক্তিকেই আমি একটি রোগ বলে মনে করি। কোনও বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ কোনও বিষয়ে অনিবার্যরূপে মোহমুক্তি ঘটতে পারে, একথা সত্যি;
কিন্তু যখনই ঘটুক অবিলম্বে সেই রোগটা সারিয়ে নেওয়া উচিত এবং তাকে জ্ঞানের উচ্চতর পর্যায়রূপে ভাবা ঠিক নয়। ধরা যাক কোনও একজন লোক স্ট্রবেরি ফল খেতে পছন্দ করেন, অন্যজন পছন্দ করেন না, তাহলে কোন্ দিক থেকে পরের লোকটি আগের জনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হন? সেইসব স্ট্রবেরি ভাল অথবা ভাল নয় তার কোনও বস্তু বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ প্রমাণ নেই।
যিনি স্ট্রবেরি পছন্দ করেন তার কাছে ওটা ভাল, যিনি করেন না তার কাছে ওটা ভাল নয়। কিন্তু যিনি পছন্দ করেন, তিনি তার থেকে একটা আনন্দ পান, অন্যে তা পান না। তাই যিনি আনন্দ পান, তার কাছে ততটুকু উপভোগ্য এবং যে পৃথিবীতে দুইজনকেই বাস করতে হয়, সেখানে তিনিই বেশি মানিয়ে নিতে পারবেন। এই তুচ্ছ বিষয়ে যা সত্যি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাই সত্যি।
এইভাবে হঠাৎ পাওয়া কোনও বস্তু যার মনে এত গভীর উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে তার কাছে জীবন কখনো বিরক্তিকর হতে পারে না। গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় কত রকমের জিনিস লক্ষ্য করা যেতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন। কেউ হয়তো পাখিদের বিষয়ে উৎসাহী, কেউ গাছপালায়, কেউ ভূতত্ত্বে, কেউ কৃষিতে, কেউবা অন্য কিছুতে।
যে ব্যক্তি ফুটবল খেলা দেখে আনন্দ পান, আর যিনি পান না, তার চেয়ে সেই পরিমাণ বড়, যে ব্যক্তি বই পড়ে আনন্দ পান, আর যিনি পান না, তার চেয়ে আরো বেশি বড়, কারণ বই পড়ার সুযোগ অনেক বেশি পাওয়া যায় ফুটবল খেলা দেখার চেয়ে। যিনি যত বেশি জিনিসে উৎসাহী, তার জন্যে আনন্দের উপকরণ ততটাই বেশি। কারণ ভাগ্যের দয়ার ওপর তিনি নির্ভরশীল নন।
কারণ তিনি একটা হারালে অন্যটা খুঁজে নিতে পারেন। মানুষের জীবনায়ু বড় কম, তাই সব বিষয়ে উৎসাহী হওয়া যায় না। কিন্তু সময়কে ভরিয়ে রাখার জন্যে যত বেশি বিষয়ে উৎসাহী হওয়া যায় তত ভাল। আমরা সকলেই অন্তবৃত রোগের প্রবণতার দিকে ঝুঁকে থাকি, যিনি তার সামনে পৃথিবীর বিচিত্র সব দৃশ্য ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টিকে ফিরিয়ে অন্তশূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা যেন এমন কিছু কল্পনা না করি যে এই অন্তত মানুষটির অসন্তোষের মধ্যে চমকপ্রদ কিছু রয়েছে।
সসেজ তৈরীর দুটি যন্ত্রের গল্প বলি। একদা কুশল হাতের তৈরী দুটি উৎকৃষ্ট যন্ত্র ছিল, যাদের কাজ ছিল শূকর মাংস থেকে সুস্বাদু সসেজ তৈরী করা। এদের একটি যন্ত্র সসেজ তৈরীতে খুবই উৎসাহী ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে তৈরী করত। অন্য যন্ত্রটি বলল, “শুকর মাংসে আমার কী হবে, আমার নিজের কাজ ওর চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক এবং বিস্ময়কর।”
সে এরপর শূকর মাংস নিতে অস্বীকার করে নিজের ভিতরকার সব কিছু পরীক্ষা করতে আরম্ভ করল, এইভাবে স্বাভাবিক খাদ্য বিহীনতায় তার ভিতরের সব কলকজা অকেজো হয়ে পড়ল এবং যতই সে তা নিয়ে সমীক্ষা করতে লাগল ততই তা তার কাছে শূন্য এবং তুচ্ছ মনে হতে লাগল। এই উৎকৃষ্ট যন্ত্রটার শুকর-মাংসের লোভনীয় রূপান্তর ঘটাবার যে দারুণ ক্ষমতা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেল, সে জানতেই পারল না তার ক্ষতির পরিমাণ।
যে ব্যক্তি তার জীবনের উদ্দীপনা হারিয়েছেন তার সাথে তুলনা করে চলে এই দ্বিতীয় সসেজ-যন্ত্রটির আর যিনি তা ধরে রেখেছেন তার সাথে তুলনা চলে প্রথম যন্ত্রটির। মানুষের মন এক অদ্ভুত যন্ত্র। যেসব পদার্থ তাকে দেওয়া হয়, অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সে তাদের সংযুক্ত করে দেয়, কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে উপকরণ না পেলে সে শক্তিহীন হয়ে যায়।
তবে মনকে তার প্রয়োজনীয় উপকরণ নিজেকেই সগ্রহ করে নিতে হয়, সসেজ-যন্ত্রকে যা করতে হয় না। ঘটনার প্রতি আমাদের যে আগ্রহ, তার মাধ্যমেই তারা অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়। যদি তারা আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে তারা আমাদের কাজে লাগে না।
যে মানুষের মনোযোগ অন্তর্মুখী তিনি দৃষ্টিকে আকর্ষণ করার মতো কিছু দেখতে পান না, পক্ষান্তরে যার মনোযোগ বহির্মুখী, নিজের ভিতর তিনি খুঁজে পান, সেইসব দুর্লভ মুহূর্তে বিচিত্র রকমের সব উপকরণ খণ্ডিত হয়ে আবার মিশে গিয়ে, দর্শনীয় এবং শিক্ষণীয় কত নতুন নতুন রূপে ফুটে উঠেছে।
উদ্দীপনার রকম অসংখ্য। শারলক হোমসের(১) কথা মনে করুন। তিনি পথ থেকে একটা টুপি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, তিনি এই টুপির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, এই টুপির মালিক মদ্য পানের ফলে অধঃপতন ডেকে এনেছে এবং তার পত্নী আর আগের মতো তাকে ভালবাসে না।
এইভাবে হঠাৎ পাওয়া কোনও বস্তু যার মনে এত গভীর উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে তার কাছে জীবন কখনো বিরক্তিকর হতে পারে না। গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় কত রকমের জিনিস লক্ষ্য করা যেতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন। কেউ হয়তো পাখিদের বিষয়ে উৎসাহী, কেউ গাছপালায়, কেউ ভূতত্ত্বে, কেউ কৃষিতে, কেউবা অন্য কিছুতে।
এর মধ্যে যে বিষয়ে আপনার আগ্রহ তাই আপনাকে আনন্দ দেবে, অন্য সব কিছু যদি সমান হয় এবং এর একটিতে যদি আগ্রহী হয়ে থাকেন তিনি, তাহলে সবদিকে আগ্রহহীন ব্যক্তির চেয়ে তিনি এই বিশ্বের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত।
বিভিন্ন মানুষের সহচরদের প্রতি আচরণ কত বিচিত্র রকমভাবে আলাদা, দীর্ঘ রেলভ্রমণে একজন যাত্রী তার সহযাত্রীদের একজনকেও লক্ষ্য করলেন না। অথচ অন্য একজন তাদের সবার সম্পর্কে একটা ধারণা গঠন করে নিলেন, তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন, তাদের কার কেমন অবস্থা তা নিয়েও অনুমান তৈরী করে। নিলেন, এমন কী তাদের অনেকের গোপন কথাও, মনে হয় তিনি জেনে নিলেন।
কোনও কোনও রোগ উদ্দীপনা নষ্ট করে দেয়, অন্যগুলি করে না। আমি জানি না জৈব রসায়নবিদরা এই দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তার সন্ধান পেয়েছেন কিনা, সম্ভবত জৈব রসায়নবিদ্যা আরো উন্নত হলে এমন ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হবে যা খেলে প্রত্যেকটি জিনিসে নিশ্চিতরূপে আমাদের আগ্রহ জন্মাবে।
অন্যদের সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির আচরণের মধ্যে যতটুকু পার্থক্য, অন্যদের ব্যাপারে ধারণা-গঠনেও ততটুকু পার্থক্য। কারো কারো কাছে আবার প্রত্যেক মানুষই বিরক্তিকর, অন্যেরা কারো সাথে পরিচিত হলে খুব সহজেই এবং স্বল্প সময়ে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করে নেন, যদি তাকে অন্যরকম ভাবার নিশ্চিত কোনও কারণ না থাকে। আবার একই বিষয় ভ্রমণের কথা ধরা যাক।
কিছু মানুষ আছেন যারা দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করেন, সবসময় সেরা হোটেলে ওঠেন, বাড়িতে যেমন খাবার খান ঠিক তেমন খান। দেশে যেমন অলস ধনীদের সাথে আড্ডা দিতেন, সেখানেও তাই করেন। বাড়িতে নিজেদের ডিনার-টেবিলে যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন সেখানেও সেই একই বিষয়ে চর্বিত-চর্বন করেন। যখন তারা ফিরে আসেন অনেক ব্যয়বহুল ভ্রমণের একঘেয়েমি যে শেষ হল, সেটাই হয় তাদের কাছে একমাত্র আরামের অনুভূতি।
অন্য এক ধরনের লোক তারা যেখানেই যান, সেখানকার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন; স্থানীয় লোকদের সাথে ভাব জমান, স্থানীয়ভাবে সামাজিক বা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ দেখে নেন, সেখানকার বিশেষ খাওয়া খান, সেখানকার রীতিনীতি এবং স্থানীয় ভাষা শিখে নেন এবং যখন বাড়ি ফিরে আসেন তখন বয়ে আনেন সুখকর নতুন কিছু ভাবনা যা উপভোগ করবেন দীর্ঘ শীতের সন্ধ্যায়।
এইসব আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তির জীবনে ভোগের উদ্দীপনা আছে, তার সুবিধা যার নেই তার চেয়ে বেশি। এমনকি অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও তার কাজে লাগে। আমি খুব খুশী যে চীনের জনতা এবং সিসিলির একটি গ্রামের ঘ্রাণ আমি পেয়েছি, যদিও আমি বলছি না যে সে সময় আমার তা অত ভাল লেগেছিল।
দুঃসাহসী লোক জাহাজডুবি, বিদ্রোহ, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড এবং সবরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা উপভোগ করে যতক্ষণ তা স্বাস্থ্য হানির সীমা ছাড়িয়ে না যায়। ভূমিকম্প হলে তারা নিজেকে হয়তো বলে : ‘এই হল ভূমিকম্প! তারা খুশি হয় এই নতুন একটি বিষয়ে পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান সমৃদ্ধ হল বলে।
এইরকম লোক যে ভাগ্যের হাতে বিড়ম্বিত হন না, একথা বললে সত্য বলা হবে না, কারণ তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাদের উদ্দীপনাও কমে যেত, যদিও নিশ্চিতভাবে সে কথা বলা যায় না। এমন এমন লোকদের জানি যাদের বছরের পর বছর ধীরে ধীরে যন্ত্রণা দেওয়ার ফলে তাদের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা উদ্দীপনা হারান নি।
কোনও কোনও রোগ উদ্দীপনা নষ্ট করে দেয়, অন্যগুলি করে না। আমি জানি না জৈব রসায়নবিদরা এই দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তার সন্ধান পেয়েছেন কিনা, সম্ভবত জৈব রসায়নবিদ্যা আরো উন্নত হলে এমন ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হবে যা খেলে প্রত্যেকটি জিনিসে নিশ্চিতরূপে আমাদের আগ্রহ জন্মাবে।
কিন্তু সেদিন না আসা পর্যন্ত কিছু লোক সব বিষয়ে আগ্রহী হন কেন এবং কিছু লোক কোনও বিষয়েই আগ্রহী নন কেন, সে ব্যাপারে আমাদের সাধারণ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত অনুমানের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে।
প্রাচীনদের মতো স্পষ্টভাবে উদ্ধৃষ্টও সৎ জীবনে বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা খুব প্রয়োজন এবং এসবের মধ্যে কোনও একটাকে এত দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যাতে অন্যসব কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পেটুক লোক ভোজনের কাছে আর সব আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছে আর তার ফলে জীবনের সমগ্র আনন্দকে কমিয়ে দিয়েছে।
উদ্দীপনা কখনো সাধারণ, কখনো বৈশিষ্ট্য সুচক। এটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণও হতে পারে। বরো লিখিত ‘রোমানি রাই’(২) উপন্যাসের একটি চরিত্রের কথা পাঠকদের মনে থাকতে পারে। তিনি স্ত্রীকে হারানোর পর, যার প্রতি ছিল তার অবিচল নিষ্ঠা, সাময়িকভাবে তার মনে হয়েছিল জীবন যেন শূন্য হয়ে গেছে।
কিন্তু ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠলেন চায়ের পাত্রে এবং চায়ের বাক্সে লেখা চীনা লিপিতে এবং একটি ফরাসী-চীন ব্যাকরণের সাহায্যে এবং সেই উদ্দেশ্যে ফরাসী ভাষা শিখে ধীরে ধীরে তার পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হলেন। এর ফলে জীবনের প্রতি তার একটা নতুন উৎসাহ জন্মাল, যদিও তিনি এই চীনা ভাষার জ্ঞান অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করেন নি।
আমি এমন লোকদের জানি যারা খ্রিস্টান অতীন্দ্রিয়বাদীদের প্রচলিত মতো সম্পর্কে যা কিছু জানবার তা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতে এবং অন্যদের দেখেছি হবস(৩)-এর গ্রন্থাবলীর প্রথম দিককার সংস্করণ এবং পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ এবং সেগুলি মিলিয়ে দেখা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতো কোথায়, কীসে কোন্ মানুষের আকর্ষণ তা আগে বলা অসম্ভব।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কোনও কোনও বিষয়ে অতি আগ্রহী হতে পারে এবং একবার যদি তেমন কোনও আগ্রহ জাগে তা হলে তাদের জীবন একঘেয়েমির কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে। বিশেষ কোনও বিষয়ের ওপর আগ্রহ, জীবনের সাধারণ উদ্দীপনার চেয়ে কম তৃপ্তিদায়ক সুখের উৎস, কারণ তা মানুষের সময়ের সবটুকু পূর্ণ করতে পারে না। তাছাড়া যে বিশেষ বিষয়ে তার উৎসাহ, সে বিষয়ে সব জানতে পারার বিপদও আছে।
নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে ভোজের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের যেসব মানুষের কথা উল্লেখ করেছিলাম তার মধ্যে পেটুকও ছিল, কিন্তু আমরা তার প্রশংসা করতে পারিনি। পাঠক ভাবতে পারেন যে সব উদ্দীপ্ত লোককে প্রশংসা করা হয়েছে তাদের সাথে পেটুকের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট নয়। কিন্তু আরো নির্দিষ্টভাবে দু’ধরনের মানুষের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার সময় এখন এসেছে।
প্রত্যেকেই জানেন প্রাচীনরা সংযমকে চরিত্রের একটা আবশ্যকীয় গুণ বলে মনে করতেন। রোমান্টিকতা এবং ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে অনেকে এই ধারণা পরিত্যাগ করেন এবং প্রবল প্রবৃত্তি উৎসারিত সব আবেগকে প্রশংসা করেন, এমন কী যদি তারা বায়রনের নায়কদের মতো ধ্বংসাত্মক এবং সমাজবিরোধী হন তবুও।
প্রাচীনদের মতো স্পষ্টভাবে উদ্ধৃষ্টও সৎ জীবনে বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা খুব প্রয়োজন এবং এসবের মধ্যে কোনও একটাকে এত দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যাতে অন্যসব কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পেটুক লোক ভোজনের কাছে আর সব আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছে আর তার ফলে জীবনের সমগ্র আনন্দকে কমিয়ে দিয়েছে।
ভোজনের মতো অন্যান্য প্রবৃত্তিও চরমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পোশাকের ব্যাপারে সম্রাজ্ঞী জোসেফিন ছিলেন পেটুকদের মত, প্রথমদিকে নেপোলিয়ন জোসেফিনের পোশাক তৈরীর বিল নিজে মিটিয়ে দিতেন, যদিও ক্রমাগত প্রতিবাদের মাত্রা বাড়িয়ে চলতেন। অবশেষে তিনি জোসেফিনকে বললেন, তাঁর সংযম-শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এবং ভবিষ্যতে বিলের অংক যুক্তিসংগত মনে হলে তবেই তিনি তা পরিশোধ করবেন।
যখন তার পরবর্তী পোশাক তৈরীর বিল আসে, তখন কিছু সময়ের জন্যে তিনি বোধের শেষপ্রান্তে চলে যান, কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে নেন। তিনি যুদ্ধমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দাবি জানালেন যুদ্ধের তহবিল থেকে তার পোশাকের বিল পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু যে লোক সারাদিন দাবা খেলার জন্যে কাজ বন্ধ রাখেন তিনি সংযমের মতো গুণ হারিয়ে ফেলেন। টলস্টয় সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যখন তরুণ ছিলেন, তাঁর খ্যাতির পূর্বের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্যে তাঁকে সামরিক ক্রস পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণের দিন তিনি দাবা খেলায় এমনই ডুবে ছিলেন যে খেলা ছেড়ে পুরস্কার গ্রহণ করা হয়নি।
মন্ত্রী জানতেন তাকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা তার রয়েছে, সুতরাং তিনি তাই করলেন। এরই ফলে জেনোয়া ফরাসীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কোনও কোনও বইতে আমি এরকম পড়েছি তবে এই কাহিনী কতটুকু সত্যি তা আমি বলতে পারব না। সত্যি হোক বা অতিরঞ্জিত হোক,
আমাদের উদ্দেশ্যসাধনের পক্ষে দুই-ই সমান উপযোগী, কারণ এই কাহিনী আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কোনও নারীর পোশাকের প্রতি আসক্তি তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে যদি তার সুযোগ থাকে তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার। পানাসক্ত পুরুষ এবং কামাসক্ত নারীকে একই জিনিসের উদাহরণরূপে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এইসব ব্যাপারে মুল নীতি খুবই স্পষ্ট।
আমাদের আলাদা সব রুচি এবং বাসনা জীবনের সাধারণ কাঠামোর মধ্যে মানিয়ে নেয়। এরা যদি সুখের উৎস হতে চায়, তবে তাদের, আমাদের স্বাস্থ্যের সাথে, আমাদের প্রিয়জনদের স্নেহের সাথে এবং যে সমাজে আমরা বাস করি তার শ্রদ্ধার সাথে সুসঙ্গত হতেই হবে। কোনও কোনও প্রবৃত্তিকে এইসব সীমা অতিক্রম না করিয়েও অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নেওয়া চলে, অন্যদের নয়।
কোনও ব্যক্তি, ধরা যাক দাবা খেলা পছন্দ করেন, তিনি যদি অবিবাহিত হন এবং পরনির্ভরশীল না হন, তা হলে তার প্রবৃত্তিকে কোনও বিশেষ সীমায় বেঁধে রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি তার স্ত্রী এবং সন্তান থাকে এবং স্বাধীন আয়ের উৎস না থাকে তাহলে এই প্রবৃত্তিকে তাকেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলেও পানাসক্ত এবং পেটুককে নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে বিবেচনা করলে বুদ্ধিহীন বলা যেতে পারে, কারণ তাদের অসংযম স্বাস্থ্যের ক্ষতিকারী এবং তারা কয়েক মিনিটের আনন্দের বিনিময়ে কয়েক ঘণ্টার দুঃখ ভোগ করে। কতকগুলি নির্দিষ্ট জিনিস দিয়ে যে কাঠামোটা তৈরী, বেদনার কারণ হতে দিতে না চাইলে যে কোনও বিশেষ প্রবৃত্তিকে সেই কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে।
সেই জিনিসগুলি হচ্ছে স্বাস্থ্য, মানসিক ও দৈহিক কর্মক্ষমতার সাধারণ অধিকার, প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য উপযুক্ত উপার্জন এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামাজিক কর্তব্য যেমন স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতিপালন। দাবা খেলার জন্যে যে ব্যক্তি এইসব পরিত্যাগ করেন তিনি নিশ্চিতভাবেই পানাসক্তের মতো নিন্দনীয়।
আমাদের এমন লোকের অপরাধ চোখে পড়ে না তার কারণ এমন লোক সংখ্যায় খুব কম এবং অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী না হলে দাবা খেলার মতো বুদ্ধিমত্তার খেলায় সহজে কেউ ডুবে থাকবেন না। সংযমের জন্যে গ্রীকদের যে অনুমোদিত বিধি রয়েছে এই ধরনের আচরণ তার মধ্যেই পড়ে। দাবাকে যথেষ্ট ভালবেসে যে তোক দিনে কাজ করতে করতে সন্ধ্যায় দাবা খেলার জন্যে অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করে থাকেন তিনি। ভাগ্যবান।
কিন্তু যে লোক সারাদিন দাবা খেলার জন্যে কাজ বন্ধ রাখেন তিনি সংযমের মতো গুণ হারিয়ে ফেলেন। টলস্টয় সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যখন তরুণ ছিলেন, তাঁর খ্যাতির পূর্বের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্যে তাঁকে সামরিক ক্রস পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণের দিন তিনি দাবা খেলায় এমনই ডুবে ছিলেন যে খেলা ছেড়ে পুরস্কার গ্রহণ করা হয়নি।
সে বিষয়ে টলস্টয়কে তেমন দোষ দেওয়া যায় না। কেননা সামরিক পদক লাভ করলেন কী করলেন না তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে উদাসীন থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্য কোনও লোকের পক্ষে এ কাজ করা অবশ্যই নির্বুদ্ধিতা হত।
বস্তুর অন্তর্নিহিত আনন্দ খুঁজে দেখা হয় না, খোঁজা হয় তাকে উপলক্ষ্য করে বিস্মৃতি। যদিও মদাসক্তির ফলে যে বিস্মৃতি চাওয়া হয় তার সাথে এর বিস্তর পার্থক্য। বরোর বন্ধু, যিনি স্ত্রীকে হারাবার বেদনা সহ্য করার জন্যে চীনা ভাষা শিখেছিলেন, তিনিও বিস্মৃতিই চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা এমন একটা উপায়ে যা অনিষ্টকর নয় বরং তা তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছিল।
যে নীতির কথা বলা হল, তার ব্যতিক্রম হিসাবে বলা যায়, কোনও কোনও কাজ এমনই মহৎ যে, যার জন্যে অন্যসব কাজকে পরিত্যাগ করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করা যায়। যদি কোনও ব্যক্তি স্বদেশ রক্ষায় জীবন দান করেন, তবে স্ত্রী সন্তানদের কপর্দকশূন্য অবস্থায় রেখে যাওয়ার জন্যে কেউ তার নিন্দা করবে না।
যদি কোনও বিজ্ঞানী কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের জন্যে গবেষণা করেন এবং শেষ পর্যন্ত তার প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে, তা হলে পরিবারকে দারিদ্রের যন্ত্রণা সহ্য করিয়েছেন বলে কেউ তার নিন্দা করবে না, কিন্তু যদি তার সেই আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের চেষ্টা কখনো সফল না হয়, তাহলে জনমত তাকে বাতিকগ্রস্ত বলবে। কিন্তু এরকম বলা অন্যায়, কারণ এরকম কাজে সাফল্য আসবে কিনা তা পূর্বেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
খ্রিস্ট যুগের প্রথম সহস্রাব্দে কোনও ব্যক্তি যদি সন্ন্যাস গ্রহণের জন্যে পরিবার ত্যাগ করে যেতেন তা হলে লোকে প্রশংসা করত। আজকাল কেউ এ কাজ করলে বলা হবে পরিবারের জন্যে বাঁচার সংস্থান রেখে তবেই তার তা করা উচিত।
আমার মনে হয় পেটুক আর স্বাভাবিক ক্ষুধাতুর মানুষের মধ্যে সবসময়েই একটা গভীর মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য থেকে যায়। যে মানুষের কোনও বাসনা অতিরিক্ত ধাবমান হয়, অন্যসব বাসনার বিনিময়ে, সে সাধারণত এমন লোক যার মনের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে কোনও বেদনা। আর সেইজন্যেই সে যেন একটা ছায়ামূর্তির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করছে।
পানাসক্তের বেলায় এটা স্পষ্ট দেখা যায়। ভুলে থাকবার জন্যে লোকে মদ খায়, তাদের জীবনে যদি ঐ রকম অপচ্ছায়ার উৎপাত না থাকত, তাহলে তারা মাতলামিকে কখনও মিতাচার থেকে বেশি গ্রহণীয় মনে করত না। লোক কাহিনীর চীনা বলেছিল, আমি মদ খাওয়ার জন্যে মদ খাই না। মাতাল হওয়ার জন্যে মদ খাই।’ এই হচ্ছে একপেশে এবং অত্যধিক সব প্রবৃত্তির পরিচিত রূপ।
বস্তুর অন্তর্নিহিত আনন্দ খুঁজে দেখা হয় না, খোঁজা হয় তাকে উপলক্ষ্য করে বিস্মৃতি। যদিও মদাসক্তির ফলে যে বিস্মৃতি চাওয়া হয় তার সাথে এর বিস্তর পার্থক্য। বরোর বন্ধু, যিনি স্ত্রীকে হারাবার বেদনা সহ্য করার জন্যে চীনা ভাষা শিখেছিলেন, তিনিও বিস্মৃতিই চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা এমন একটা উপায়ে যা অনিষ্টকর নয় বরং তা তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছিল।
যখন রেলগাড়িকে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করতে হবে, তখন মোটরবাহকদের অথবা ইঞ্চিনচালকদের অথবা সিগন্যালম্যানদের আদিম সমাজের সঙ্গীত শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করা অসম্ভব, এ কাজ তাদের করতে হবেই বলে তারা সকলে নিজের নিজের কাজ করবে। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য গৌণ। এই কাজে তাদের প্রেরণা স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
এই রকম পলায়নী মনোভাবের বিরুদ্ধে বলবার কিছু নেই, কিন্তু যে লোক সুরাপান, জুয়াখেলা অথবা অন্য কোনও অলাভজনক উত্তেজক কাজের মধ্যে বিস্মৃতিকে খুঁজে বেড়ায়, তার কথা আলাদা। এটা সত্যি এই দুই সীমারেখার মধ্যবর্তী অবস্থানের উদাহরণও আছে। ক্লান্তিকর জীবন থেকে রেহাই পেতে যে লোক বেপরোয়াভাবে গাড়ি বা বিমান চালায় অথবা পর্বতশীর্ষে ওঠে, তার বিষয়ে কী বলা উচিত?
তার এই জীবন নিয়ে ঝুঁকি যদি জনগণের উপকার করত, তা হলে তাকে প্রশংসা করা যেত। কিন্তু তা যদি না হয় তা হলে আমরা তাকে মাতাল অথবা জুয়াড়ি থেকে সামান্য ওপরে ছাড়া আর কী ভাবতে পারি?
অকৃত্রিম উদ্দীপনা, বিস্মৃতি সন্ধানের উদ্দীপনার যে ধরণ তার চেয়ে আলাদা, তা মানবিক সত্ত্বার এক স্বাভাবিক অংশ, যদি তা দুর্ভাগ্যবশত নষ্ট হয়ে না যায়। ছোট শিশুরা যা দেখে, যা শোনে তাতেই আকৃষ্ট হয়। তাদের কাছে পৃথিবী বিস্ময়ে ভরা। তারা সব সময় নতুন নতুন বিষয়ে খুব উৎসাহের সাথে জানবার কাজে ব্যস্ত থাকে, যদিও সে জানা পণ্ডিতদের জানা নয়।
তারা শুধু যেসব জিনিস তাদের উৎসাহ সৃষ্টি করে শুধু তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে চায়। পশুরা, যখন তারা বয়স্ক হয়, যদি সুস্থ থাকে উদ্দীপনা ধরে রাখে। কোনও বিড়াল অপরিচিত ঘরে থাকলেও চুপ করে থাকবে না। সে চারিদিকে শুঁকে শুঁকে দেখবে যদি হঠাৎ করে কোনও উঁদুরের সন্ধান পাওয়া যায়।
কোনও মানুষ যদি তার জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ না হন, তাহলে তিনি বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে স্বাভাবিক উৎসাহ বজায় রাখতে পারেন এবং যতকাল তা বজায় রাখবেন ততকাল জীবন তার কাছে আনন্দময় হয়ে থাকবে যদি না অন্যায়ভাবে তার স্বাধীনতা খর্ব করা হয় যা আমাদের জীবনপথে চলতে প্রয়োজনীয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই সভ্য সমাজের উদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যায়।
আদিম মানুষ যখন ক্ষুধার্ত হয় তখন সে শিকার করে এবং এই কাজে সে প্রত্যক্ষ প্রেরণাকেই মান্য করে। যে লোক প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যায়, সেও মৌলভাবে একই প্রেরণা থেকে তা করে যেমন তার স্থায়ী জীবিকার তাগিদ থেকে। কিন্তু তার বেলায় প্রেরণা প্রত্যক্ষভাবে কাজ থেকে আসেনা এবং যখন তা অনুভূত হয় তখনো নয়। এই প্রেরণা কাজ করে গৌণভাবে বিমূর্ততা, বিশ্বাস এবং ইচ্ছার মাধ্যমে।
যে সময় লোকটি কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সে ক্ষুধার্ত থাকে না, কারণ সে কিছুক্ষণ আগে মাত্র তার প্রাতঃরাশ খেয়ে নিয়েছে। সে জানে আবার তার ক্ষুধা পাবে এবং কাজে যাওয়ার অর্থ ভবিষ্যৎ ক্ষুধা-নিবৃত্তির একটি উপায়মাত্র। প্রেরণা অনিয়মিত, কিন্তু সভ্য সমাজে অভ্যাসকে নিয়মিত হতেই হয়। আদিম মানুষদের মধ্যে দলবদ্ধ কাজও যতটুকুই রয়েছে, তা স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রেরণাসঞ্চারী।
যখন তারা দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে যায়, তখন ঢোলের বাজনা তাদের মনে যুদ্ধের উদ্দীপনা জাগায় এবং তারা যখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে তখন দলের প্রত্যেকটি মানুষ যুদ্ধের কাজে অনুপ্রাণিত হয়। বর্তমানের কোনও উদ্যোগ এইভাবে পরিচালিত করা যায় না।
যখন রেলগাড়িকে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করতে হবে, তখন মোটরবাহকদের অথবা ইঞ্চিনচালকদের অথবা সিগন্যালম্যানদের আদিম সমাজের সঙ্গীত শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করা অসম্ভব, এ কাজ তাদের করতে হবেই বলে তারা সকলে নিজের নিজের কাজ করবে। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য গৌণ। এই কাজে তাদের প্রেরণা স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
কিন্তু এই কাজের জন্যে তারা যে মূল্য পাবে তার জন্যেই শুধু প্রেরণা আছে। সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের ভুল দেখা যায়। লোকেরা পরস্পর যে আলাপ করে তার মধ্যে তাদের কোনও ইচ্ছার প্রতিফলন থাকে না। তারা তা করে সেই আশায়, পরে এই আলাপ থেকে তাদের কোনও উপকার হলেও হতে পারে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রেরণার সীমাবদ্ধতা সভ্য মানুষকে জড়িয়ে রেখেছে।
সম্মানবোধ সম্বন্ধে ভুল ধারণার জন্যে নারীদের মধ্যে উদ্দীপনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। নারীরা পুরুষদের বিষয়ে আগ্রহী হবে, অথবা জনসমক্ষে প্রফুল্লতা প্রকাশ করবে এটা অবাঞ্ছিত ছিল। পুরুষদের বিষয়ে তারা আগ্রহী হবে না এই শিক্ষা থেকে তারা সব বিষয়েই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র এক বিশেষ ধরনের বিশুদ্ধ আচরণ ছাড়া।
মনে খুব আনন্দ হলে সে প্রকাশ্য পথে নাচতে অথবা গান করতে পারে না, আবার দুঃখ পেলেও পথের পাশে বসে কাঁদতে পারে না। কেননা তাতে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। প্রথম বয়সে স্কুলে তাদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক জীবরে যতক্ষণ কাজ,ততক্ষণের জন্যে তার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত।
এইসব কারণে উদ্দীপনাকে বাঁচিয়ে রাখা বেশ কঠিন, কারণ এর অবিরাম নিয়ন্ত্রণ থেকেই জন্ম নেয় ক্লান্তি এবং একঘেয়েমির বিরক্তি। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণা সুবিবেচনার সাথে নিয়ন্ত্রণ না করলে সভ্য সমাজ অস্তিত্ব সংকটে পৌঁছে যায়। কারণ এই প্রেরণা সরলতম সামাজিক সহযোগিতামূলক কাজের জন্ম দিতে পারলেও কিন্তু সেসব অতি জটিল কাজ করতে পারে না, যা আধুনিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দাবী করে।
উদ্দীপনাকে এতসব বাধার ওপরে তুলতে হলে একজন লোকের প্রয়োজন সুন্দর স্বাস্থ্য এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি অথবা তার ভাগ্য যদি প্রসন্ন থাকে তাহলে সে এমন কাজ পাবে যা তার নিজের পক্ষেই আগ্ৰহজনক। স্বাস্থ্য, যা পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে বিগত শতবর্ষে সব সভ্য দেশেই জনস্বাস্থ্য ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু শক্তিকে মাপা কঠিন কাজ।
স্বাস্থ্য উন্নত হলেও দৈহিক শক্তি পূর্বে যা ছিল তেমনটাই রয়েছে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সমস্যা এখানে অতিমাত্রায় সামাজিক, তাই স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে এই গ্রন্থে আমি কোনোও আলোচনায় যাব না। কিন্তু এই সমস্যার একটা ব্যক্তিগত এবং মনস্তত্ত্বমূলক দিক রয়েছে, যে বিষয়ে আমি পূর্বে অবসাদ নিয়ে আলোচনার সময় করেছি।
সভ্য সমাজের শত বাধার মুখেও কোনও কোনও ব্যক্তি উদ্দীপনা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, আরো অনেকে তা করতে পারত যদি তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারত যেখানে তাদের শক্তির অনেক অংশ ব্যয় হয়ে যায়। কাজের জন্যে যতটুকু শক্তি দরকার, উদ্দীপনা তার চেয়ে অতিরিক্ত দাবি করে এবং ফলে মননযন্ত্রটি যাতে বাধাহীনভাবে চলে সেই দাবি উঠে আসে। যেসব কারণে এই চলা মসৃণতর হয় সে বিষয়ে আমি পরের অধ্যায়গুলিতে আরও কিছু বলব।
সম্মানবোধ সম্বন্ধে ভুল ধারণার জন্যে নারীদের মধ্যে উদ্দীপনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। নারীরা পুরুষদের বিষয়ে আগ্রহী হবে, অথবা জনসমক্ষে প্রফুল্লতা প্রকাশ করবে এটা অবাঞ্ছিত ছিল। পুরুষদের বিষয়ে তারা আগ্রহী হবে না এই শিক্ষা থেকে তারা সব বিষয়েই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র এক বিশেষ ধরনের বিশুদ্ধ আচরণ ছাড়া।
নারী এবং পুরুষের উৎকর্ষের মধ্যে যথার্থভাবে ধারণা করলে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না, অন্ততপক্ষে প্রচলিত ধারণায় যে পার্থক্য তা নেই। নারীর পক্ষে যেমন পুরুষের পক্ষেও তেমন, উদ্দীপনাই হচ্ছে সুখ এবং মঙ্গলের জন্যে গোপন মন্ত্র।
নিষ্ক্রিয়তার মনোভাব তৈরীর শিক্ষা এবং জীবন থেকে পালানোর মনোভাব উদ্দীপনার প্রবল বিরোধী এবং নারীদের আত্মমগ্ন হতে উৎসাহিত করা, যা মহা সম্মানিত নারীদের বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে যদি তারা শিক্ষাহীন হয়। সাধারণ পুরুষদের খেলাধুলায় যে উৎসাহ থাকে তা তাদের থাকে না। তারা রাজনীতি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না।
পুরুষদের প্রতি তাদের মনোভাব প্রথাগত নিস্পৃহতা, অন্য নারীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন বৈরীভাবাপন্ন এবং তার কারণ অন্যেরা তাদের চেয়ে কম সম্মানিতা, এই বোধ থেকে। তাদের অহংকার তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে থাকে অর্থাৎ তাদের সহনারীদের প্রতি আগ্রহহীনতাকে তারা গুণ বলে মনে করে, অবশ্য এর জন্যে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
নারীদের সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে যে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচলিত, তাই শুধু তারা মেনে চলে। তারা একটি অবদমন নীতির কাছে নিজেদের উৎসর্গ করেছে যার ভিতরের অন্যায়টি তারা বুঝতে পারেনি বলেই করুণার পাত্রী হতে হয়েছে। এইসব নারীদের কাছে যা অনুদার তাই ভাল মনে হয় এবং যা উদার তা মনে হয় খারাপ।
তারা নিজেদের সামাজিক চক্রের মধ্যে আনন্দকে হত্যা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। তারা রাজনীতিতে নির্যাতনমূলক আইনকে ভালবাসে। সৌভাগ্যবশত এই ধরনের নারীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, যদিও যারা চিন্তার জগতে মুক্তিলাভ করেছে। তারা সেইসব নারীর সংখ্যা যতটা কমেছে বলে ভাবছেন, তার চেয়ে এখনও সেই সংখ্যা অনেক বেশি। কেউ যদি
আমার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করেন, তবে বলি, তিনি যেন একবার বাসাবাড়িগুলিতে একটা থাকার জায়গা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন এবং যেসব গৃহকত্রীর সাথে তার দেখা হবে তাদের আচরণ লক্ষ্য করেন, তা হলে তিনি দেখতে পাবেন তারা এমন একটা নারীসুলভ উৎকর্ষতার ধারণা নিয়ে বাস করছে, যা জীবনের সকল উদ্দীপনাকে ধ্বংস করার একটি প্রয়োজনীয় অংশ। তার ফলেই তাদের মন এবং হৃদয় সংকীর্ণ এবং বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যায়।
নারী এবং পুরুষের উৎকর্ষের মধ্যে যথার্থভাবে ধারণা করলে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না, অন্ততপক্ষে প্রচলিত ধারণায় যে পার্থক্য তা নেই। নারীর পক্ষে যেমন পুরুষের পক্ষেও তেমন, উদ্দীপনাই হচ্ছে সুখ এবং মঙ্গলের জন্যে গোপন মন্ত্র।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………….
১. শার্লক হোমস, Sherlock Homes। আর্থার কোনান ডয়েল, Sir Arthur Conan Doyle (১৮৫৯-১৯৩০) রহস্য উপন্যাসের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত, পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। লন্ডনের ২২১, বেকার স্ট্রীট ছিল গোয়েন্দা শারলক হেমসের ঠিকানা (১৮৮১-১৯০৪)।
২. রোমানি রাই, Romany Rye, ঔপন্যাসিক জর্জ বরো, George Borrow (১৮০৫ ১৮৮১) এর বিখ্যাত উপন্যাস, রচিত হয় ১৮৫৭-তে। এই উপন্যাস লেখকের আত্মজৈবনিক বলে মনে করা হয়। শুধু উপন্যাস নয় জর্জ বরো ইংরেজি সাহিত্যে ভ্রমণ কাহিনী রচনার জন্যেও বিখ্যাত। সেসব কাহিনীতে চিত্রিত হয়ে আছে পথ চলার বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং যাযাবর জীবনের ভিন্ন সুর।
৩. হবস,Thomas Hobbes (১৫৮৮-১৬৭৯)। বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনীতিবিদ। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সংক্রান্ত কাজের জন্যে এখনো তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।
৪. সম্রাজ্ঞী জোসেফিন, Empress Josephine (১৭৬০-১৮১৪), অভিজাত বংশে জন্ম, অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। ১৮০৪-এ সম্রাজ্ঞী হন ফ্রান্সের। ফরাসী বিপ্লবের সময় সম্রাটসহ কারারুদ্ধ হন। স্বামীর গিললাটিনে মৃত্যু হলেও, তিনি মুক্তি পান। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন বিশ্ববিখ্যাত নেপোলিয়নকে। যিনি পরে ফ্রান্সের সম্রাট হন। নেপোলিয়ন তাঁকে যে ঘড়িটি উপহার দিয়েছিলেন সেটি ‘Empress Josephine Clock’ নামে বিখ্যাত।
৫. টলস্টয়, Leo Tolstoy (১৮২৮-১৯১০)। রাশিয়ার বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক। তাঁর ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’, ‘আনা করোনিনা’ এবং ‘রেজারেকসন’ বিশ্ব সাহিত্যে অমর সৃষ্টি। এক বিশাল পটভূমিকায় বিরচিত “ওয়ার অ্যান্ড পীস”-কে বলা হয় গদ্যে মহাকাব্য।
……………………
সুখের সন্ধানে- বার্ট্রান্ড রাসেল।
অনুবাদক- আতা-ই-রাব্বি।
……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ