প্রভুস্পাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য বিপিনবিহারী রায় যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসায় রোগ না সারায় তিনি তার গুরু বিজয়কৃষ্ণের গেণ্ডারিয়া আশ্রমে উপস্থিত হন রোগমুক্তির আশায়। কিন্তু বিজযকৃষ্ণ তাঁকে বারদীর আশ্রমে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে যেতে আদেশ করেন।
বিপিনবাবু তখন শ্রীধর নামে এক গুরুভাই ও কয়েকজন লোক নিয়ে একটি নৌকা ভাড়া করে বারদী যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। বাবার সেবার জন্য তিনি প্রচুর ফল, তরি-তরকারি ও চারটি পাকা ফজলি আম কিনে সঙ্গে নিলেন। সঙ্গীদের খাবার জন্য আলাদা এক টুকরি আমা কিনলেন।
নৌকা ছেড়ে দিল। কিছুদূর যাবার পর নৌকা এক বাজারের কাছে এসে থামল। বিপিনবাবু ও তার সঙ্গীরা বাজারে যাবার জন্য নৌকা থেকে নামলেন, কিন্তু শ্রীধর বললেন- তোমরা যাও, আমি এখানেই থাকব।
বিপিনবাবু তখন তাঁকে বললেন- ভাই শ্রীধর, ইচ্ছে হলে তুমি টুকরির আম খেও ; এ চারটি ফজলি আমে হাত দিও না, ওগুলি আমি নিজের হাতে বাবাকে দেব।
বিপিনবাবুরা চলে গেলে চারটি ৫-৭ বছরের উলঙ্গ ছেলে নৌকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে শ্রীধরকে বললে- বাবা আমাদের কিছু খেতে দেবে?
তাদের একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীধর বাবার জন্য রাখা সেই ৪টি আম ৪জন ছেলেকে দিয়ে দিলেন।
সঙ্গীরা ছুটে এসে শ্রীধরকে ছাড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছাড়াতে পারলেন না। অবশেষে বিপিনবাবুর ঊরুর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করতেই শ্রীধর ছেড়ে দিলেন আপনা থেকে। তখন সঙ্গীরাও শ্রীধরকে তার পিঠটা কামড়ে ধরতে শ্রীধর ঝট্ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে শ্রীধরকে টানাটানি করে নৌকায় রয়ে গেলেন।
এদিকে বিপিনবাবু যখন সঙ্গীদের নিয়ে বাজার থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন পথে সেই চারটি ছেলের হাতে ৪টি ফজলি আম দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, শ্রীধরই তাদের আমগুলি দিয়েছে। তখন বিপিনবাবু ছেলেগুলিকে কিছু পয়সা দিয়ে আম ৪টি কিনে নিলেন। তারপর নৌকায় ফিরে তিনি রাগে গর্জন করতে করতে শ্রীধরকে বললেন- ব্রহ্মচারী বাবার জন্য যে আম রেখেছিলাম, সে আম কার হুকুমে তুমি দিলে?
শ্রীধর বললেন- ব্রহ্মচারী বাবার হুকুমে তো দিয়েছি, যাও না, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে এস।
বিপিনবাবু আর কিছু বললেন না। এদিকে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, নৌকার মধ্যে প্রদীপ জ্বালাতে হবে ; কিন্তু পলতে নেই। একটু ছেঁড়া নেকড়া পেলেই কাজ চলে যাবে। কিন্তু সে নেকড়া কোথায় পাওয়া যাবে- তা দিয়ে সবাই ভাবতে লাগলেন।
তবে সবাই জানতেন, শ্রীধরের ঝোলার মধ্যে অনেক টুকরো টুকরো ছেঁড়া ময়লা নেকড়া আছে। কিন্তু ঝোলাটা সব সময় নিজের কাছে কাছে রাখেন, মাথার নীচে রেখে শোন।
নৌকার ভিতরটা তখন একেবারে অন্ধকার। শ্রীধর ঝোলাটা নামিয়ে রেখে এক জায়গায় বসেছিলেন, সঙ্গীরা ইশারা করতে বিপিনবাবু সেই ঝোলা থেকে এক টুকরো নেকড়া বার করলেন পলতে হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীধর এক বিকট চিৎকার করে বিপিনবাবুর ঊরুটা কামড়ে ধরলেন। বিপিনবাবু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগলেন।
সঙ্গীরা ছুটে এসে শ্রীধরকে ছাড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছাড়াতে পারলেন না। অবশেষে বিপিনবাবুর ঊরুর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করতেই শ্রীধর ছেড়ে দিলেন আপনা থেকে। তখন সঙ্গীরাও শ্রীধরকে তার পিঠটা কামড়ে ধরতে শ্রীধর ঝট্ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে শ্রীধরকে টানাটানি করে নৌকায় রয়ে গেলেন।
যাই হোক, দারুণ উদ্বেগের মধ্য দিয়ে রাত কাটতে ভোরবেলায় বারদীর ঘাটে এসে নৌকা ভিড়ল। তখন সকলে মালপত্র নিয়ে আশ্রমের দিকে এগিয়ে চললেন, শ্রীধর নৌকাতেই রয়ে গেলেন।
তাঁরা আশ্রমে পৌঁছালে লোকনাথবাবা তাদের কাছে ডাকলেন। তারপর বললেন- হ্যাঁরে শ্রীধরকে দেখছি না।
বিপিনবাবু বললেন- সে নৌকায় বসে আছে।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন- কেন সে এল না? তোরা কি তাকে মেরেছিস?
বিপিনবাবু বললেন- আজ্ঞে, সারা রাস্তা সে বড় জ্বালিয়েছে ; দেখুন না, আমার ঊরু কামড়ে ঘা করে দিয়েছে।
এমন সময় হঠাৎ শ্রীধর এস হাজির হলেন। বিপিনবাবু তখন বাবা লোকনাথের কাছে তাঁর রোগের কথা বলে আরোগ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করলেন।
বাবা বললেন- হ্যাঁরে শ্রীধর তোর ঊরু কামড়ে দিয়েছিল, রক্ত বেরিয়েছে কি?
বিপিনবাবু বললেন- আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব রক্ত বেরিয়েছে।
বাবা বললেন- বিপিন, এতেই তোর যক্ষ্মারোগ সেরে যাবে। কিন্তু শ্রীধর তোকে কেন কামড়াল, জিজ্ঞাসা করেছিলি?
শ্রীধরের এই অলৌকিক কাহিনী শুনে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। এইভাবে শ্রীধর ও বিপিনবাবু বাবা লোকনাথের কৃপালাভে ধন্য হয়। শ্রীধরের কাছ থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গিয়ে আম চেয়ে নিয়ে আকাশপথে কীর্তনগানের আগে আগে এসে শ্রীধরকে বিপিনবাবুর ঊরু কামড়ে রক্ত বার করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া-এইসবই লোকনাথ বাবার অলৌকিক লীলা। তাঁর মত মহাযোগী মহাশক্তিধর মহাপুরুষের পক্ষেই সম্ভব।
শ্রীধরকে তখন সবাই জিজ্ঞাস করতে শ্রীধর বললেন- আরে ভাই, তোরা তো সবাই বাজারে গেলি, আমি তখন হঠাৎ সংকীর্তনের ধ্বনি শুনে চমকে উঠলাম। নৌকার ভিতর থেকে বাইরে এসে দেখলাম কোথাও কিছু নেই। এমন সময় দেখি, বাবা লোকনাথ ৪জন ঋষি-বালককে নিয়ে নৌকার কাছে এসে উপস্থিত হলেন। আমি তাঁকে প্রণাম করতে তিনি বললেন- কই, আমার ৪টি ফজলি আম? আমগুলো এদের হাতে দিয়ে দে।
আবার আদেশে আমি আমর ৪টি ৪জন বালকের হাতে দিয়ে দিলাম। তারপর সন্ধ্যার সময় আবার দেখি, আকাশ থেকে এক সংকীর্তনের দল আসছে। দলের আগে আছেন বাবা লোকনাথ, এসেই তিনি বললেন- শ্রীধর, তুই বিপিনের ঊরু কামড়ে দে ; তাহলে ওর রোগ সেরে যাবে।
তখন আমি ভাবতে লাগলাম, কি করে কামড়াই? আমি সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। এমন সময় বিপিনবাবু আমার ঝোলা থেকে নেকড়া বার করতেই তখন আমার মাথা গরম হয়ে গেল, আমি তার ঊরু কামড়ে ধরলাম। নানা তীর্থস্থান ঘুরে সাধু-সন্তদের কাপড়ের টুকরো সংগ্রহ করে ঝোলায় রেখে দিয়েছি, ঐগুলিই আমার সম্পদ। তাই রক্ত বার করে তবে ঊরু ছাড়লাম। তারপর আবার এক সংকীর্তনের দলকে আসতে দেখলাম, বাবা লোকনাথ তার আগে ছিলেন। আমি তার মধ্যে ঝাঁপ দিলাাম, তখন তোমরা আমায় ধরে তুললে।
শ্রীধরের এই অলৌকিক কাহিনী শুনে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। এইভাবে শ্রীধর ও বিপিনবাবু বাবা লোকনাথের কৃপালাভে ধন্য হয়। শ্রীধরের কাছ থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গিয়ে আম চেয়ে নিয়ে আকাশপথে কীর্তনগানের আগে আগে এসে শ্রীধরকে বিপিনবাবুর ঊরু কামড়ে রক্ত বার করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া-এইসবই লোকনাথ বাবার অলৌকিক লীলা। তাঁর মত মহাযোগী মহাশক্তিধর মহাপুরুষের পক্ষেই সম্ভব।
<<লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ ।। লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার