আমার সহিত কথা প্রসঙ্গে পরম কারুণিক ব্রহ্মচারীবাবা স্বয়ং, অথবা আমার প্রশ্নের উত্তরে, ধর্ম্মধর্ম্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে যে কয়েকটি মহামূল্য উপদেশ প্রদান করিয়াছেন, ধর্ম্ম ও তত্ত্ব জিজ্ঞাসু সাধকদিগের সাধন পথে উহা কথঞ্চিৎ সাহায্যকারী হইতে পারিবে এই বিশ্বাসে আমি সেই সকল উপদেশ, যতদূর স্মরণ হইতেছে, যথাযথ এস্থানে উপন্যাস্ত করিলাম।
অত:পর আমাদের সতীর্থদিগের মধ্যে পরস্পর আলাপ পরস্পরায় যে কয়েকটি সর্ব্বদা ব্যবহার্য্য শাস্ত্রীয় পারিভাষিক শব্দের অর্থ লইয়া সময়ে সময়ে সংশয়, বিতর্ক ও মতভেদ উপস্থিত হইত; এবং যে সম্বন্ধে সংশয় ও মতভেদ অপরের মধ্যেও সর্বদা সংঘটিত হওয়ার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; সেই সকল শব্দের নি:সন্দেহ ও প্রকৃত অর্থ শাস্ত্রানুসন্ধান পূর্ব্বক যতদূর উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি তাহাও এস্থলে নিম্নে প্রকটিত হইল:
চিত্ত, হৃদয় ও যোগ শব্দের প্রকৃত শাস্ত্রীয় অর্থ এবং প্রথমোক্তদ্বয়ের মধ্যে অর্থভেদ লইয়া প্রায়ই সাধকসমাজে বিতর্ক ও আলোচনা হইয়া থাকে। অনুসন্ধান করিয়া এ সম্বন্ধে যোগবরিষ্ঠ রমায়ণে ভগবান বশিষ্টদেব শ্রীরামচন্দ্রকে যে উপদেশ করিয়াছেন, সমধিক প্রামাণিক বোধে সেই সেই অর্থই এস্থলে উল্লিখিত হইল-
চিত্ত: অন্তরে প্রাণের অর্থাৎ প্রাণাদি বায়ুর স্পন্দন হইয়া সংসার ভবোন্মুখী যে চিতি শক্তির উৎপত্তি হয়, তাহাকেই চিত্ত বলে।
হৃদয়: হৃদয় দুই প্রকারে বিভক্ত। তন্মধ্যে একটি ‘হেয়’ ও অপর একটি ‘উপাদেয়’ দেহাত্মবাদীদের মতে বক্ষ ও পৃষ্ঠদেশের মধ্যস্থলে হৃদয় নামে যে স্থান আছে, তাকেই ‘হেয়’ বলে। জ্ঞানীগণ জ্ঞানমাত্র যে হৃদয় তাহাকেই ‘উপাদেয়’ সংজ্ঞা প্রদান করেন। এই উপাদেয় হৃদয়ই অন্তরে ও বাহিরে সর্ব্বত্র বিদ্যমান; অথচ আবার কোথাও অবস্থিত নহে। উহাই ‘প্রধান’ হৃদয়।
উহাতেই এই নিখিল বিশ্ব অবস্থান করিতেছে। উহা সমস্ত পদার্থের দর্পণস্বরূপ, সকল সম্পদের কোষাগার, এবং সমস্ত জীবের চিন্ময় জ্ঞানস্বরূপ বলিয়া কথিত হয়। উহা দেহীর, দেহের কোন অবয়ব বা কোনও অবয়বের অংশ নহে।
যোগ: চিত্ত ও তদীয় স্পন্দন, এই উভয়ই নিত্য এবং অভিন্ন ও অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। ইহাদের একতরের ধ্বংস হইলে, অপরের অর্থাৎ গুণী ও গুণ উভয়েরই বিনাশ হইয়া থাকে।
যোগ ও জ্ঞান, এই দুইটি ক্রমান্বয়ে চিত্তনাশের প্রধান উপায়। চিত্তের ব্যাপার নিরোধকে “যোগ” এবং বস্তুর অর্থাৎ তত্ত্বের সম্যক দর্শনকে ‘জ্ঞান’ বলে। শাস্ত্রে ‘বস্তু’ শব্দে আত্মাকে বুঝায়। তদ্ভিন্ন পদার্থকে ‘অবস্তু’ কহে।
প্রাণ সম্যক রুদ্ধ হইলেই মনের ও (চিত্তের) নিরোধ ঘটে। যে যে উপায়ে প্রাণকে নিরুদ্ধ করা যাইতে পারে, তাহা নিম্নে প্রদর্শিত হইতেছে:
শাস্ত্রালোচনা, সজ্জন সংসর্গ ও বৈরাগ্যের অনুশীলনদ্বারা ক্রমে সংসার বৃত্তান্তে অনাস্থা জন্মিলে, একাগ্রতা লক্ষণ অভীষ্ট-বস্তু ধ্যানের আশ্রয় গ্রহণ করত: দীর্ঘকাল ব্রহ্মতত্ত্বের অনুশীলন করিতে থাকিলেই প্রাণের স্পন্দন রহিত হইয়া যায়।
ঐকান্তিক ধ্যানযোগ অভ্যাস করিলেও প্রাণের স্পন্দন বিনষ্ট হয়। পূরক, কুম্ভক ও রেচকাদি নিরন্তর অভ্যাস করিলেও প্রাণের স্পন্দন নিরুদ্ধ হইয়া যায়।
অ উ ম দ্বারা যে প্রণব অর্থাৎ ওঁকারের উৎপত্তি হয়, তাহার সুদীর্ঘ উচ্চারণের অবসানে ঐ শব্দের স্বরূপের উপলব্ধী হইয়া থাকে। এবং সেই কালেই বাহ্যবিষয়ক জ্ঞঅনের উপরতি হয়। ইহাতে প্রাণের নিরোধ হইয়া থাকে।
বারংবার রেচকের অনশীলন করিলেও প্রাণ দীর্ঘতা প্রাপ্ত হইয়া বাহ্যকাশে উপনীত হয়, তখন আর সে নাসাবিবরকে স্পর্শ করে না। ইহাতেও প্রাণ নিরুদ্ধ হইয়া থাকে।
কেবল পূরকের পুন: পুন: অভ্যাস দ্বারাও প্রাণের নিরোধ ঘটিয়া থাকে। সেইরূপ কেবল কুম্ভকের বারংবার অভ্যাসেও প্রাণের নিরোধ হইয়া থাকে।
যম, নিয়ম, আসন, প্রণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি এই অষ্টাঙ্গ যোগের মধ্যে, শেষোক্ত চারিটির অনুশীলন করিলেও যোগে সিদ্ধি লাভ করা যায়।
যোগে সিদ্ধিলাভ করিলে, সাধকের নিম্ন লিখিত অবস্থা ঘটে-
চক্ষু: স্থিরং যস্য বিনাবলোকনম্,
প্রাণ: স্থিরং যস্য বিনা নিরোধনম্,
মন: স্থিরং যস্য বিনাবলম্বনম্।
“তখন যোগীর অবলোকন ব্যতিরেকেও চক্ষু: স্থির হয়; বায়ু রোধের যত্ন ব্যতিরেকেও প্রাণবায়ু স্থিরত্ব লাভ করে; এবং আশ্রয় বিনাও চিত্ত নিশ্চল অবস্থা প্রাপ্ত হয়।”
যোগীর এইরূপ অবস্থার কথা যাহা শুনিয়াছি, আমি যতদূর দেখিতে ও বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাতে ব্রহ্মচারীবাবার এইরূপ অবস্থা হইয়াছিল বলিয়া সাহস করিয়া বলিতে পারি। এখানে আমরা আমাদের সাধক ভ্রাতাদের হিতের জন্য আর দুই একটি কথা না বলিয়া প্রবন্ধ শেষ করিতে চাহি না।
যোগে সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন এইরূপ মহাপুরুষের সাহায্য ও উপদেশ না পাইয়া যোগাভ্যাস করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ আছে।
বৈরাগ্যকে মূলভিত্তি না করিয়া যাহারা যোগ বলে বলীয়ান হইতে যান, তাহাদিগকর্তৃক সংসারে অনিষ্ট সংসাধিত হওয়ার সম্ভাবনা যত অধিক, ইষ্ট সিদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা তত নহে। কারণ, তাহারা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য প্রভৃতির এবং রজ: ও তমোগুণের অধীন থাকা বশত: আসক্তি ত্যাগে সমর্থ হন না।
(সমাপ্ত)
<<লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার ।। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা