: তাপ শব্দের অর্থ কি?
:: সুখে বা দু:খে, জয়ে বা পরাজয়ে, মনের যে অবস্থা হয়, তাহার নাম “তাপ”।
: আমি যাহা ইচ্ছা করি তাহাই করিব, এই কথা সত্য হইলে চুরি ও পরদার গমন প্রভৃতি উৎকট পাপকার্য্যও আমি করিতে পারি?
:: তুমি তাহা করিতে পার না। করিতে চেষ্টা করিয়া দেখিও, তুমি তাহা পারিবে না। জীব যতই শ্রেষ্ঠতা লাভ করে, ততই সে সমাজে যাহাকে নিকৃষ্ট কার্য্য বলে, সেই সকল কার্য্য করিতে পারে না। যথা- তুমি এখন আর হাঁটুতে ভর দিয়া চলিতে পার না।
: পাপ কাহাকে বলে?
:: যাহাতে তাপ লাগে। সেই তাপ তোমার নিজেরও হইতে পারে, অথবা তোমার সমাজেরও হইতে পারে। যে কার্য্য দ্বারা তুমি নিজে তাপগ্রস্থ হও, অথবা তোমার সমাজকে তাপগ্রস্থ কর, তাহাই পাপকার্য্য।
: পাপকার্য্য করা কি কর্তব্য?
:: কর্তব্য কি অকর্তব্য, তাহা ব্যক্তিগত কথা। যাহা তোমার অকর্তব্য তাহা অন্যের কর্তব্য এবং যাহা অন্যের অকর্তব্য তাহা তোমার অর্তব্য।
: আমার মাথাবেদনায় আমি তাপগ্রস্ত হইলাম; মাথাব্যাথাও কি পাপ হইল?
:: হ্যাঁ।
: ইহাতে পাপ কোথায় আছে বুঝিলাম না।
:: মাথা কি? কাহার মাথা? বেদনা কি? কে বেদনা বোধ করে? ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করিলে দেখিবে, অবিদ্যাতেই (মনে) বেদনার উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়। তবেই বুঝতে পারিবে, যেখানে অবিদ্যা সেইখানেই পাপ এবং সেইখানেই তাপ। বিদ্যা অর্থাৎ জ্ঞানে পাপ তাপ থাকে না।
যখন দেখিলাম ধন ও জনের সৃষ্টি স্থিতি লয় এই তিন অবস্থাই তাপজনক, তখন যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম-
: তাপশূন্য ত বাবা, কোন কার্য্যই দেখি না?
:: ঠিক কথা। ইহা জানিয়া যে কার্য্য করে সেই মুক্ত। কিঞ্চিৎ পরিমাণ তাপ বিনা কোন কার্য্যই হয় না। কিঞ্চিৎ পরিমাণ তাপ ছাড়া ঈশ্বরও সৃষ্টি করেন না।
: ঈশ্বর ও কিঞ্চিৎ তাপ ব্যতিরেকে সৃষ্টি করেন না, একথা বুঝিলাম না।
:: অজ্ঞানতাই তাপের মূল কারণ। ঈশ্বরও অবিদ্যার সাহায্য ব্যতিরেকে সৃষ্টি করেন না। অতএব কিঞ্চিৎ পরিমাণ তাপ সকলকার্য্যেই আছে।
: গুরু কে?
:: ঠেকা। যে, যে স্থানে ঠেকে, সে সেই স্থানেই শিক্ষা পায়। যাহার আদেশ তুমি অনুসরণ কর তিনিই তোমার গুরু।
: গুরুকে সর্ব্বদা স্মরণ করিবে ইহার অর্থ কি?
:: গুরুর আদেশ সর্ব্বদা স্মরণ করিবে। গুরুর আদেশই গুরু।
: গুরুর আদেশ যদি গুরু হয়, তবে তাহার দেহকে আমি অনাদর করিতে পারি?
:: না; গঙ্গাজলের পাত্রকেও লোকে আদর করে।
: ‘গুরুর আচরণ ধরিবে’ ইহার অর্থ কি?
:: গুরু আচরণ ধরিবে, অর্থাৎ গুরু যে আচরণ করিয়া শিবত্ব লাভ করিয়াছেন, তদনুরূপ আচরণ করিবে-
“মহাজনের যেই পথ, তাতে হতে অনুগত;
পূর্ব্বাপর করিয়া বিচার।”
: গুরুকে “আসন দিবে” ইত্যাদি গুরুগীতার বাক্যগুলির অর্থ কি?
:: গুরুকে “আসন দিবে” অর্থাৎ গুরুর আদেশ হৃদয়ে ধারণ করিবে। “বসন দিবে” অর্থাৎ আচ্ছাদন করিবে- অভক্ত নাস্তিক প্রভৃতির নিকট তাহার আদেশ প্রকাশ করিবে না। “বাহন দিবে” অর্থাৎ ভক্ত ও আস্তিক প্রভৃতির সহিত গুরুর উপদেশ সম্বন্ধে আলোচনা করিবে। “ভূষণ দিবে” অর্থাৎ তাঁহার কৃতী শিষ্য হইবার জন্য যত্ন করিবে- কৃতী শিষ্যই গুরুর ভূষণ। “শয়ন দিবে” অর্থাৎ গুরুর আদেশ হৃদয়ে রাখিবে এবং ক্রমে উহা নিজের প্রকৃতিগত করিয়া লইবে।
: “গুরুবৎ গুরু পুত্রেষু” ইত্যাদির অর্থ কি?
:: গুরুর ন্যায় যোগ্য যে গুরুর পুত্র পৌত্রাদি তাহাদিগকেও গুরুর ন্যায় ভক্তি করিবে।
: গুরু পুত্র কে?
:: “তাহার ঔরসপুত্র বা “গুরু উপদেশে যাঁহার জ্ঞান জন্মিয়াছে”।
: গুরু পুত্র মূর্খ হইলেও যদি আমি তাঁহাকে ভক্তি করিতে পারি তাহাদের দোষ কি?
:: “যদি” শব্দ সংশয়াত্মক। তুমি পার কিনা তাহা দেখ; না পারিলে লোক দেখান কার্য্য করিলে তাহাতে লাভ না হইয়া ক্ষতি হইবে।
: গুরু শিষ্যের কি করেন?
::
“অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নম:।।”
অর্থাৎ তিনি জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকা দ্বারা অজ্ঞানান্ধ মানবের চক্ষু: উন্মীলিত করেন।
আমি কে? আমার কর্ম্ম কি? আমি কোথা হইতে আসিয়াছি; কোথায় যাইব? গুরু কে? গুরুর সহিত আমার সম্বন্ধ কি? জগতের সৃষ্টিকর্তা কে? সৃষ্টিকৌশল কি? এই সকল বিষয় গুরু শিষ্যকে বুঝাইয়া দিয়া সাধন পথে তাহাকে সাহায্য করেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ব্রহ্মচারীবাবা প্রত্যক্ষবাদী ছিলেন। তিনি বলিতেন তুমি যাহা অনুভব করিতে পার নাই, তাহা কাহাকেও বলিও না। তিনি “গুরুর কার্য্য কি” ইহা প্রত্যক্ষভাবে আমাকে বুঝাইয়া দেওয়ার নিমিত্ত একদিন তাঁহার আহারান্তে আমাকে ডাকিয়া নিয়া আমার সঙ্গে একপাত্রে আবার ভোজন করিতে আরম্ভ করিলেন; আমাকেও আহার করাইতেছেন, নিজেও আহার করিতেছেন, তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, যামিনী! কি কার্য্য হইতেছে?
আমি বলিলাম- আপনি আমার মুখে অন্ন তুলিয়া দিতেছেন, আর আমি চিবাইয়া গলাধ: করিতেছি। তাহা শুনিয়া তিনি বলিলেন- গুরু শিষ্যের এই পর্যন্তই করেন- মুখে উঠাইয়া দেন পর্যন্তই; শিষ্য নিজে চিবাইয়া উদরস্থ করিবে।
: শাস্ত্র, জ্ঞানশিক্ষা দিতে পারে, কিন্তু শাস্ত্র পড়িয়া বিজ্ঞান লাভ হয় না; অর্থাৎ শাস্ত্র অর্থ ও তাহার প্রকৃত মর্ম্ম, অন্যে বুঝিতে পারে না। তুমি যে সকল শাস্ত্রের নামোল্লেখ করিলে, মোনযোগপূর্ব্বক অধ্যয়ন করিলে দেখিতে পাইবে, প্রত্যেক শাস্ত্রই সম্যক উপদেশ দিয়াও বলিয়াছেন- তুমি গুরুর নিকট যাইয়া উপদেশ গ্রহণ কর। যথা-
“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতের পরিপ্রশ্নের সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিন:।।”
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ৪/৩৪)
অর্থাৎ গুরুর পাদ বন্দনা করিয়া, তাঁহার আরাধনা করিয়া, এবং তাঁহাকে পুন: পুন: জিজ্ঞাসা করিয়া, সেই তত্ত্ব (ব্রহ্ম) কে জ্ঞাত হইবে, তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীগণ তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন। অপিচ-
“ন গুরোরথিকং ন গুরোরধিকং ন গুরোরধিকম্।”
(গুরুগীতা)
অর্থাৎ গুরু অপেক্ষা অধিক (শ্রেষ্ঠ) নাই! গুরু অপেক্ষা অধিক নাই। গুরু অপেক্ষা অধিক নাই! গুরুগীতা অতিশয় দৃঢ়তার সহিত এই বাক্য তিনবার উচ্চারণ করিয়াছেন। অন্যচ্চ-
“যজ্ঞ-দান-তপো-ব্রত-জপ-তীর্থানুসেবনম্
গুরুতত্ত্বমবিজ্ঞায় নিষ্ফলং নাত্র সংশয়:।।”
অর্থাৎ গুরুতত্ত্ব (গুরু কি পদার্থ) তাহা না জানিয়া যজ্ঞ, দান, তপ:, ব্রত, জপ ও তীর্থবাসের অনুশীলন করিলে, সে সমস্তই বিফল হয় সন্দেহ নাই।
শাস্ত্র- মোক্ষলাভের প্রধান উপায়। গুরুর সাহায্যে সেই শাস্ত্রানুসারে চলিতে অভ্যাস করতে হয়।
: গুরুগীতাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে গুরুর ধ্যান লিখিবার কারণ কি?
:: গুরু অনন্ত; তাঁহার মহিমা এবং মূর্ত্তি অনন্ত। তন্মধ্যে গুরুগীতাতে তাঁহার কিঞ্চিৎমাত্র প্রভাব ও কয়েকটি মাত্র মূর্ত্তির, উল্লেখ আছে। অধিকারভেদে যে, যেভাবে গুরুকে ধরিতে ও বুঝিতে পারিবে, সেই সেইভাবে ক্রমে উন্নতি লাভ করিতে পারিবে।
(চলবে…)
<<লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার ।। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা
2 Comments