ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ ও সত্যকথা – নরলীলায় বিশ্বাস করো

শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণাদি ভক্তের প্রতি) – আর সংসারে থাকতে গেলে সত্য কথার খুব আঁট চাই। সত্যতেই ভগবানকে লাভ করা যায়। আমার সত্য কথার আঁট এখন তবু একটু কমছে, আগে ভারী আঁট ছিল। যদি বলতুম ‘নাইব’, গঙ্গায় নামা হল, মন্ত্রোচ্চারণ হল, মাথায় একটু জলও দিলুম, তবু সন্দেহ হল, বুঝি পুরো নাওয়া হল না! অমুক জায়গাতে হাগতে যাব, তা সেইখানেই যেতে হবে। রামের বাড়ি গেলুম কলকাতায়। বলে ফেলেছি, লুচি খাব না। যখন খেতে দিলে, তখন আবার খিদে পেয়েছে। কিন্তু লুচি খাব না বলেছি, তখন মেঠাই দিয়ে পেট ভরাই। (সকলের হাস্য)

“এখন তবু একটু আঁট কমেছে। বাহ্যে পায় নি, যাব বলে ফেলেছি, কি হবে? রামকে১ জিজ্ঞাসা কল্লুম। সে বললে, গিয়ে কাজ নাই। তখন বিচার কল্লুম; সব তো নারায়ণ। রামও নারায়ণ। ওর কথাটাই বা না শুনি কেন? হাতি নারায়ণ বটে, কিন্তু মাহুতও নারায়ণ। মাহুত যে কালে বলছে, হাতির কাছে এসো না, সেকালে মাহুতের কথা না শুনি কেন? এই রকম বিচার করে আগেকার চেয়ে একটু আঁট কমেছে।”

পূর্বকথা – বৈষ্ণবচরণের উপদেশ – নরলীলায় বিশ্বাস করো

“এখন দেখছি, এখন আবার একটা অবস্থা বদলাচ্ছে। অনেকদিন হল, বৈষ্ণবচরণ বলেছিল, মানুষের ভিতর যখন ঈশ্বরদর্শন হবে, তখন পূর্ণজ্ঞান হবে। এখন দেখছি, তিনিই এক-একরূপে বেড়াচ্ছেন। কখন সাধুরূপে, কখন ছলরূপে – কোথাও বা খলরূপে। তাই বলি, সাধুরূপ নারায়ণ, ছলরূপ নারায়ণ, খলরূপ নারায়ণ, লুচ্চরূপ নারায়ণ।

“এখন ভাবনা হয়, সব্বাইকে খাওয়ানো কেমন করে হয়। সব্বাইকে খাওয়াতে ইচ্ছা করে। তাই একজনকে এখানে রেখে খাওয়াই।”

প্রাণকৃষ্ণ (মাস্টার দৃষ্টে, সহাস্যে) – আচ্ছা লোক! (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) মহাশয়, নৌকা থেকে নেমে তবে ছাড়লেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) – কি হয়েছিল?

প্রাণকৃষ্ণ – নৌকায় উঠেছিলেন। একটু ঢেউ দেখে বলেন, নামিয়া দাও – (মাস্টারের প্রতি) কিসে করে এলেন?

মাস্টার (সহাস্যে) – হেঁটে।

(ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন)

সংসারী লোকের বিষয়কর্মত্যাগ কঠিন – পণ্ডিত ও বিবেক

প্রাণকৃষ্ণ (ঠাকুরের প্রতি) – মহাশয়! এইবার মনে করছি কর্ম ছেড়ে দিব। কর্ম করতে গেলে আর কিছু হয় না। (সঙ্গী বাবুকে দেখাইয়া) এঁকে কাজ শেখাচ্ছি, আমি ছেড়ে দিলে ইনি কাজ করবেন। আর পারা যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, বড় ঝঞ্ঝাট। এখন দিন কতক নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করে খুব ভাল। কিন্তু তুমি বলছো বটে ছাড়বে। কাপ্তেনও ওই কথা বলেছিল। সংসারী লোকেরা বলে, কিন্তু পেরে ওঠে না।

“অনেক পণ্ডিত আছে, কত জ্ঞানের কথা বলে। মুখেই বলে, কাজে কিছুই নয়। যেমন শকুনি খুব উঁচুতে উঠে; কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর; অর্থাৎ সেই কামিনী-কাঞ্চনের উপর – সংসারের উপর আসক্তি। যদি শুনি, পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য আছে, তবে ভয় হয়; তা না হলে কুকুর-ছাগলজ্ঞান হয়।”

প্রাণকৃষ্ণ প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন ও মাস্টারকে বলিলেন, আপনি যাবেন? মাস্টার বলিলেন, না, আপনারা আসুন। প্রাণকৃষ্ণ হাসিতেছেন ও বলিলেন, তুমি আর যাও! (সকলের হাস্য)

মাস্টার পঞ্চবটীর কাছে একটু বেড়াইয়া ঠাকুর যে ঘাটে স্নান করিতেন, সেই ঘাটে স্নান করিলেন। তৎপরে ৺ভবতারিণী ও ৺রাধাকান্ত দর্শন ও প্রণাম করিলেন। ভাবিতেছেন, শুনিয়াছিলাম ঈশ্বর নিরাকার তবে এই প্রতিমার সম্মুখে কেন প্রণাম? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাকার দেবদেবী মানেন, এই জন্য? আমি তো ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু জানি না, বুঝি না। ঠাকুর যেকালে মানেন আমি কোন্‌ ছার, মানিতেই হইবে।

মাস্টার ৺ভবতারিণীকে দর্শন করিতেছেন। দেখিলেন – বামহস্তদ্বয়ে নরমুণ্ড ও অসি, দক্ষিণহস্তদ্বয়ে বরাভয়। একদিকে ভয়ঙ্করা আর-একদিকে মা ভক্তবৎসলা। দুইটি ভাবের সমাবেশ। ভক্তের কাছে, তাঁর দীনহীন জীবের কাছে, মা দয়াময়ী! স্নেহময়ী! আবার এও সত্য, মা ভয়ঙ্করী কালকামিনী! একাধারে কেন দুই ভাব, মা-ই জানেন।

ঠাকুরের এই ব্যাখ্যা, মাস্টার সমরণ করিতেছেন। আর ভাবিতেছেন, শুনেছি কেশব সেন ঠাকুরের কাছে কালী মানিয়াছেন। এই কি “মৃন্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী” কেশব এই কথা বলিতেন।

সমাধিস্থ পুরুষের (শ্রীরামকৃষ্ণের) ঘটি-বাটির খপর

এইবার তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসিয়া বসিলেন। স্নান করিয়াছেন দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে ফলমূলাদি প্রসাদ খাইতে দিলেন। তিনি গোল বারান্দায় বসিয়া প্রসাদ পাইলেন। পান করিবার জলের ঘটি বারান্দাতে রহিল। ঠাকুরের কাছে তাড়াতাড়ি আসিয়া ঘরের মধ্যে বসিতে যাইতেছেন, ঠাকুর বলিলেন, “ঘটি আনলে না?”

মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ, আনছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – বাহ্‌!

মাস্টার অপ্রস্তুত। বারান্দায় গিয়া ঘটি ঘরের মধ্যে রাখিলেন।

মাস্টারের বাড়ি কলিকাতায়। তিনি গৃহে অশান্তি হওয়াতে শ্যামপুকুরে বাড়ি ভাড়া করিয়া আছেন। সেই বাড়ির কাছেই কর্মস্থল। তাঁহার ভদ্রাসন বাটীতে তাঁহার পিতা ও ভাইয়েরা থাকিতেন। ঠাকুরের ইচ্ছা যে, তিনি নিজ বাটীতে গিয়া থাকেন, কেননা, একান্নভুক্ত পরিবার মধ্যে ঈশ্বরচিন্তা করিবার অনেক সুবিধা। কিন্তু ঠাকুর মাঝে মাঝে যদিও ওইরূপ বলিতেন, তাঁহার দুর্দৈবক্রমে তিনি বাটীতে ফিরিয়া যান নাই। আজ ঠাকুর সেই বাড়ির কথা আবার তুলিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেমন, এইবার তুমি বাড়ি যাবে?

মাস্টার – আমার সেখানে ঢুকতে কোন মতে মন উঠে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন? তোমার বাপ বাড়ি ভেঙেচুরে নূতন করছে।

মাস্টার – বাড়িতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার যেতে কোন মতে মন হয় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কাকে তোমার ভয়?

মাস্টার – সব্বাইকে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীরস্বরে) – সে তোমার যেমন নৌকাতে উঠতে ভয়!

ঠাকুরদের ভোগ হইয়া গেল। আরতি হইতেছে ও কাঁসর ঘন্টা বাজিতেছে। কালীবাড়ি আনন্দে পরিপূর্ণ। আরতির শব্দ শুনিয়া কাঙাল, সাধু, ফকির সকলে অতিথিশালায় ছুটিয়া আসিতেছেন। কারু হাতে শালপাতা, কারু হাতে বা তৈজসপত্র – থালা, ঘটি। সকলে প্রসাদ পাইলেন। আজ মাস্টারও ভবতারিণীর প্রসাদ পাইলেন।

…………………………………………….
১ রাম চাটুজ্জে ঠাকুরবাড়ির শ্রীশ্রীরাধাকান্তের সেবক।

-১৮৮৪, ৫ই এপ্রিল-

…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!