ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ সিঁথির ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীযুক্ত বেণী পালের সিঁথির বাগানে শুভাগমন করিয়াছেন। আজ সিঁথির ব্রাহ্মসমাজের ষান্মাসিক মহোৎসব। চৈত্র পূর্ণিমা (১০ই বৈশাখ, রবিবার), ২২শে এপ্রিল, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; বৈকাল বেলা। অনেক ব্রাহ্মভক্ত উপস্থিত; ভক্তেরা ঠাকুরকে ঘিরিয়া দক্ষিণের দালানে বসিলেন। সন্ধ্যার পর আদি সমাজের আচার্য শ্রীযুক্ত বেচারাম উপাসনা করিবেন।

ব্রাহ্মভক্তেরা ঠাকুরকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করিতেছেন।

ব্রাহ্মভক্ত – মহাশয়, উপায় কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – উপায় অনুরাগ, অর্থাৎ তাঁকে ভালবাসা। আর প্রার্থনা।

ব্রাহ্মভক্ত – অনুরাগ না প্রার্থনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – অনুরাগ আগে, পরে প্রার্থনা।

“ডাক দেখি মন ডাকার মতো, কেমন শ্যামা থাকতে পারে” –

শ্রীরামকৃষ্ণ সুর করিয়া এই গানটি গাইলেন।

“আর সর্বদাই তাঁর নামগুণগান-কীর্তন, প্রার্থনা করতে হয়। পুরাতন ঘটি রোজ মাজতে হবে, একবার মাজলে কি হবে? আর বিবেক, বৈরাগ্য, সংসার অনিত্য, এই বোধ।”

[ব্রাহ্মভক্ত ও সংসারত্যাগ – সংসারে নিষ্কামকর্ম ]

ব্রাহ্মভক্ত – সংসারত্যাগ কি ভাল?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সকলের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। যাদের ভোগান্ত হয় নাই তাদের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। দুআনা মদে কি মাতাল হয়?

ব্রাহ্মভক্ত – তারা তবে সংসার করবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম।১ এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।

[ব্রাহ্মভক্ত ও ভোগান্ত – বিদ্যারূপিণী স্ত্রীর লক্ষণ – বৈরাগ্য কখন হয় ]

ব্রাহ্মভক্ত – ভোগান্ত কিরূপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কামিনী-কাঞ্চন ভোগ। যে ঘরে আচার তেঁতুল আর জলের জালা, সে ঘরে বিকারের রোগী থাকলে মুশকিল! টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, দেহসুখ এই সব ভোগ একবার না হয়ে গেলে – ভোগান্ত না হলে – সকলের ইশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আসে না।

ব্রাহ্মভক্ত – স্ত্রীজাতি খারাপ, না আমরা খারাপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ – বিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে, আবার অবিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে। বিদ্যারূপিণী স্ত্রী ভগবানের দিকে লয়ে যায়, আর অবিদ্যারূপিণী ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়, সংসারে ডুবিয়ে দেয়।

“তাঁর মহামায়াতে এই জগৎসংসার। এই মায়ার ভিতর বিদ্যা-মায়া অবিদ্যা-মায়া দুই-ই আছে। বিদ্যা-মায়া আশ্রয় করলে সাধুসঙ্গ, জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, বৈরাগ্য – এই সব হয়। অবিদ্যা-মায়া – পঞ্চভূত আর ইন্দ্রিয়ের বিষয় – রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ; যত ইন্দ্রিয়ের ভোগের জিনিস; এরা ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

ব্রাহ্মভক্ত – অবিদ্যাতে যদি অজ্ঞান করে, তবে তিনি অবিদ্যা করেছেন কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁর লীলা, অন্ধকার না থাকলে আলোর মহিমা বোঝা ঝায় না। দুঃখ না থাকলে সুখ বোঝা যায় না। ‘মন্দ’ জ্ঞান থাকলে তবে ‘ভাল’ জ্ঞান হয়।

“আবার আছে খোসাটি আছে বলে তবে আমটি বাড়ে ও পাকে। আমটি তয়ের হয়ে গেলে তবে খোসা ফেলে দিতে হয়! মায়ারূপ ছালটি থাকলে তবেই ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। বিদ্যা-মায়া, অবিদ্যা-মায়া আমের খোসার ন্যায়; দুই-ই দরকার।”

ব্রাহ্মভক্ত – আচ্ছা, সাকারপূজা, মাটিতে গড়া ঠাকুরপূজা – এ-সব কি ভাল?২

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমরা সাকার মান না, তা বেশ; তোমাদের পক্ষে মূর্তি নয়, ভাব। তোমরা টানটুকু নেবে, যেমন কৃষ্ণের উপর রাধার টান, ভালবাসা। সাকারবাদীরা যেমন মা-কালী, মা-দুর্গার পূজা করে, ‘মা’ ‘মা’ বলে কত ডাকে কত ভালবাসে – সেই ভাবটিকে তোমরা লবে, মূর্তি না-ই বা মানলে।

ব্রাহ্মভক্ত – বৈরাগ্য কি করে হয়? আর সকলের হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – ভোগের শান্তি না হলে বৈরাগ্য হয় না। ছোট ছেলেকে খাবার আর পুতুল দিয়ে বেশ ভুলানো যায়। কিন্তু যখন খাওয়া হয়ে গেল, আর পুতুল নিয়ে খেলা হয়ে গেল, তখন “মা যাব” বলে। মার কাছে নিয়ে না গেলে পুতুল ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে কাঁদে।

[সচ্চিদানন্দই গুরু – ঈশ্বরলাভের পর সন্ধ্যাদি কর্মত্যাগ ]

ব্রাহ্মভক্তেরা গুরুবাদের বিরোধী। তাই ব্রাহ্মভক্তটি এ-সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।

ব্রাহ্মভক্ত – মহাশয়, গুরু না হলে কি জ্ঞান হবে না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সচ্চিদানন্দই গুরু; যদি মানুষ গুরুরূপে চৈতন্য করে তো জানবে যে, সচ্চিদানন্দই ওই রূপ ধারণ করেছেন। গুরু যেমন সেথো; হাত ধরে নিয়ে যান। ভগবানদর্শন হলে আর গুরুশিষ্য বোধ থাকে না। ‘সে বড় কঠিন ঠাঁই, গুরুশিষ্যে দেখা নাই!’ তাই জনক শুকদেবকে বললেন, ‘যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও আগে দক্ষিণা দাও।’ কেননা, ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর শিষ্য ভেদবুদ্ধি থাকবে না। যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন না হয়, ততদিনই গুরুশিষ্য সম্বন্ধ।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল। ব্রাহ্মভক্তেরা কেহ কেহ ঠাকুরকে বলিতেছেন, “আপনার বোধহয় এখন সন্ধ্যা করতে হবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, সেরকম নয়। ও-সব প্রথম প্রথম এক-একবার করে নিতে হয়। তারপর আর কোশাকুশি বা নিয়মাদি দরকার হয় না।

-১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল-

………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : একাদশ অধ্যায় : চতুর্থ পরিচ্ছেদ

…………………………………………………
১ কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। [গীতা, ২/৪৭]
যৎ করোষি যদশ্নাসি … কুরুষ্ব মদর্পণম্‌। [গীতা, ৯/২৭]
২ “মৃণ্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী” – কেশবের উপদেশ।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!