ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সেবকসঙ্গে

রাত ১০টা-১১টা হইল। ঠাকুর ছোট খাটটিতে তাকিয়া ঠেসান দিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। মণির সহিত ঠাকুর কথা কহিতেছেন। ঘরের দেওয়ালের কাছে সেই পিলসুজের উপর প্রদীপে আলো জ্বলিতেছে।

ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু। মণির সেবা লইবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখ, আমার পাঞ্চটা কামড়াচ্ছে। একটু হাত বুলিয়া দাও তো।

মণি ঠাকুরের পাদমূলে ছোট্ট খাটটির উপর বসিলেন ও কোলে তাঁহার পা দুখানি লইয়া আস্তে আস্তে হাত বুলাইতেছেন। ঠাকুর মাঝে মাঝে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আজ সব কেমন কথা হয়েছে?

মণি – আজ্ঞা খুব ভাল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আকবর বাদশাহের কেমন কথা হল?

মণি – আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি বলো দেখি?

মণি – ফকির আকবর বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আকবর শা তখন নমাজ পড়ছিল। নমাজ পড়তে পড়তে ঈশ্বরের কাছে ধন-দৌলত চাচ্ছিল, তখন ফকির আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে যাবার উপক্রম করলে। পরে আকবর জিজ্ঞাসা করাতে বললে, যদি ভিক্ষা করতে হয় ভিখারীর কাছে কেন করব!

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর কি কি কথা হয়েছিল?

মণি – সঞ্চয়ের কথা খুব হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – (সহাস্যে) – কি কি হল?

মণি – চেষ্টা যতক্ষণ করতে হবে বোধ থাকে, ততক্ষণ চেষ্টা করতে হয়। সঞ্চয়ের কথা সিঁথিতে কেমন বলেছিলেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি কথা?

মণি – যে তাঁর উপর সব নির্ভর করে, তার ভার তিনি লন। নাবালকের যেমন অছি সব ভার নয়। আর-একটি কথা শুনেছিলাম যে, নিমন্ত্রণ বাড়িতে ছোট ছেলে নিজে বসবার জায়গা নিতে পারে না। তাকে খেতে কেউ বসিয়া দেয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না। ও হলো না, বাপে ছেলের হাত ধরে লয়ে গেলে সে ছেলে আর পড়ে না।

মণি – আর আজ আপনি তিনরকম সাধুর কথা বলেছিলেন। উত্তম সাধু সে বসে খেতে পায়। আপনি ছোকরা সাধুটির কথা বললেন, মেয়েটির স্তন দেখে বলেছিল, বুকে ফোঁড়া হয়েছে কেন? আরও সব চমৎকার চমৎকার কথা বললেন, সব শেষের কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – কি কি কথা?

মণি – সেই পম্পার কাকের কথা। রামনাম অহর্নিশ জপ করছে, তাই জলের কাছে যাচ্ছে কিন্তু খেতে পারছে না। আর সেই সাধুর পুঁথির কথা, – তাতে কেবল “ওঁ রামঞ্চঞ্চ এইটি লেখা। আর হনুমান রামকে যা বললেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি বললেন?

মণি – সীতাকে দেখে এলুম, শুধু দেহটি পড়ে রয়েছে, মন-প্রাণ তোমার পায়ে সব সমর্পণ করেছেন!

“আর চাতকের কথা, – ফটিক জল বই আর কিছু খাবে না।

“আর জ্ঞানযোগ আর ভক্তিযোগের কথা।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি?

মণি – যতক্ষণ ‘কুম্ভ’ জ্ঞান, ততক্ষণ “আমি কুম্ভ” থাকবেই থাকবে। যতক্ষণ ‘আমি’ জ্ঞান, ততক্ষণ “আমি ভক্ত, তুমি ভগবান।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, ‘কুম্ভ’ জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক, ‘কুম্ভ’ যায় না। ‘আমি’ যাবার নয়। হাজার বিচার কর, ও যাবে না।

মণি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। আবার বলিতেছেন –

মণি – কালীঘরে ঈশান মুখুজ্জের সঙ্গে কথা হয়েছিল – বড় ভাগ্য তখন আমরা সেখানে ছিলাম আর শুনতে পেয়েছিলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাঁ, কি কি কথা বল দেখি?

মণি – সেই বলেছিলেন, কর্মকাণ্ড। আদিকাণ্ড। শম্ভু মল্লিককে বলেছিলেন, যদি ঈশ্বর তোমার সামনে আসেন, তাহলে কি কতকগুলো হাসপাতাল ডিস্পেনসারি চাইবে?

“আর-একটি কথা হয়েছিল, – যতক্ষণ কর্মে আসক্তি থাকে ততক্ষণ ঈশ্বর দেখা দেন না। কেশব সেনকে সেই কথা বলেছিলেন।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি?

মণি – যতক্ষণ ছেলে চুষি নিয়ে ভুলে থাকে ততক্ষণ মা রান্নাবান্না করেন। চুষি ফেলে যখন ছেলে চিৎকার করে, তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ছেলের কাছে যান।

“আর-একটি কথা সেদিন হয়েছিল। লক্ষ্মণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ভগবানকে কোথা কোথা দর্শন হতে পারে। রাম অনেক কথা বলে তারপর বললেন – ভাই, যে মানুষে ঊর্জিতা ভক্তি দেখতে পাবে – হাঁসে কাঁদে নাচে গায়, – প্রেমে মাতোয়ারা – সেইখানে জানবে যে আমি (ভগবান আছি)।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা! আহা!

ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।

মণি – ঈশানকে কেবল নিবৃত্তির কথা বললেন। সেই দিন থেকে অনেকের আক্কেল হয়েছে। কর্তব্য কর্ম কমাবার দিকে ঝোঁক। বলেছিলেন – ‘লঙ্কায় রাবণ মলো, বেহুলা কেঁদে আকুল হলো!’

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা শুনিয়া উচ্চহাস্য করিলেন।

মণি (অতি বিনীতভাবে) – আচ্ছা, কর্তব্য কর্ম – হাঙ্গাম – কমানো তো ভাল?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, তবে সম্মুখে কেউ পড়ল, সে এক। সাধু কি গরিব লোক সম্মুখে পড়লে তাদের সেবা করা উচিত।

মণি – আর সেদিন ঈশান মুখুজ্জেকে খোসামুদের কথা বেশ বললেন। মড়ার উপর যেমন শকুনি পড়ে। ও-কথা আপনি পণ্ডিত পদ্মলোচনকে বলেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, উলোর বামনদাসকে।

কিয়ৎপরে মণি ছোট খাটের পার্শ্বে পাপোশের নিকট বসিলেন।

ঠাকুরের তন্দ্রা আসিতেছে, – তিনি মণিকে বলিতেছেন, তুমি শোওগে। গোপাল কোথায় গেল? তুমি দোর ভেজিয়ে রাখ।

পরদিন (১০ই নভেম্বর) সোমবার। শ্রীরামকৃষ্ণ বিছানা হইতে অতি প্রতূষ্যে উঠিয়াছেন ও ঠাকুরদের নাম করিতেছেন, মাঝে মাঝে গঙ্গাদর্শন করিতেছেন। এদিকে মা-কালীর ও শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে মঙ্গলারতি হইতেছে। মণি ঠাকুরের ঘরের মেঝেতে শুইয়াছিলেন। তিনি শয্যা হইতে উঠিয়া সমস্ত দর্শন করিতেছেন ও শুনিতেছেন।

প্রাতঃকৃত্যের পর তিনি ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিলেন।

ঠাকুর আজ স্নান করিলেন। স্নানান্তে ৺কালীঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন। ঠাকুর তাঁহাকে ঘরে তালা লাগাইতে বলিলেন।

কালীঘরে যাইয়া ঠাকুর আসনে উপবিষ্ট হইলেন ও ফুল লইয়া কখনও নিজের মস্তকে কখনও মা-কালীর পাদপদ্মে দিতেছেন। একবার চামর লইয়া ব্যজন করিলেন। আবার

নিজের ঘরে ফিরিলেন। মণিকে আবার চাবি খুলিতে বলিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া ছোট খাটটিতে বসিলেন। এখন ভাবে বিভোর – ঠাকুর নাম করিতেছেন। মণি মেঝেতে একাকী উপবিষ্ট। এইবার ঠাকুর গান গাহিতেছেন। ভাবে মাতোয়ারা হইয়া গানের ছলে মণিকে কি শিখাইতেছেন যে, কালীই ব্রহ্ম, কালী নির্গুণা, আবার সগুণা, অরূপ আবার অনন্তরূপিণী।

গান – কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে।

গান – এ সব ক্ষেপা মেয়ের খেলা।

গান – কালী কে জানে তোমায় মা (তুমি অনন্তরূপিণী!)

তুমি মহাবিদ্যা, অনাদি অনাদ্যা, ভববন্ধের বন্ধনহারিণী তারিণী!
গিরিজা, গোপজা, গোবিন্দমোহিনী, সারদে বরদে নগেন্দ্রনন্দিনী,
জ্ঞানদে মোক্ষদে, কামাখ্যা কামদে, শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণহৃদিবিলাসিনী।

গান – তার তারিণী! এবার ত্বরিত করিয়ে,

তপন-তনয়-ত্রাসে ত্রাসিত প্রাণ যায়।
জগত অম্বে জনপালিনী, জন-মিহিনী জগত জননী,
যশোদা জঠরে জনম লইয়ে, সহায় হরি লীলায়।।

বৃন্দাবনে রাধাবিনোদিনী, ব্রজবল্লভ বিহারকারিণী,
রাসরঙ্গিনী রসময়ী হ’য়ে, রাস করিলে লীলাপ্রকাশ।।

গিরিজা গোপজা গোবিন্দমোহিনী, তুমি মা গঙ্গে গতিদায়িনী,
গান্ধার্বিকে গৌরবরণী গাওয়ে গোলকে গুণ তোমার।।

শিবে সনাতনী সর্বাণী ঈশানী, সদানন্দময়ী, সর্বস্বরূপিণী,
সগুণা নির্গুণা সদাশিব প্রিয়া, কে জানে মহিমা তোমার।।

মণি মনে মনে করিতেছেন ঠাকুর যদি একবার এই গানটি গান –

“আর ভুলালে ভুলবো না মা, দেখেছি তোমার রাঙ্গা চরণ।”

কি আশ্চর্য! মনে করিতে না করিতে ওই গানটি গাহিতেছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিতেছেন – আচ্ছা, আমার এখন কিরকম অবস্থা তোমার বোধ হয়!

মণি (সহাস্যে) – আপনার সহজাবস্থা।

ঠাকুর আপন মনে গানের ধুয়া ধরিলেন, – “সহজ মানুষ না হলে সহজকে না যায় চেনা।”

-১৮৮৪, ৯ই – ১০ই নভেম্বর-

……………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চতুর্ত্রিংশ অধ্যায় : চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!