ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

ভাবাবস্থায় অন্তর্দৃষ্টি – নরেন্দ্রাদির নিমন্ত্রণ

গান সমাপ্ত হইল। নরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ঠাকুর কথা কহিতেছেন। সহাস্যে বলছেন, হাজরা নেচেছিল।

নরেন্দ্র (সহাস্যে) – আজ্ঞা, একটু একটু।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – একটু একটু?

নরেন্দ্র (সহাস্যে) – ভুড়ি আর একটি জিনিস নেচেছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – সে আপনি হেলে দোলে – না দোলাতে আপনি দোলে। (সকলের হাস্য)

শশধর যে বাড়িতে আছেন, সেই বাড়িতে ঠাকুরের নিমন্ত্রণ হইবার কথা হইতেছে।

নরেন্দ্র – বাড়িওয়ালা খাওয়াবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তার শুনেছি স্বভাব ভাল না – লোচ্চা।

নরেন্দ্র – আপনি তাই – যেদিন শশধরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয় – তাদের ছোঁয়া জলের গেলাস থেকে জল খেলেন না। আপনি কেমন করে জানলেন যে লোকটার স্বভাব ভাল না?

পূর্বকথা – সিওড়ে হৃদয়ের বাটীতে হাজরা ও বৈষ্ণব সঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাজরা আর একটা জানে, – ও-দেশে – সিওড়ে – হৃদের বাড়িতে।

হাজরা – সে একজন বৈষ্ণব – আমার সঙ্গে দর্শন করতে গিছল, যাই সে গিয়ে বসল, ইনি তার দিকে পেছন ফিরে বসলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – মাসীর সঙ্গে নাকি নষ্ট ছিল – তারপর শোনা গেল। (নরেন্দ্রের প্রতি) আগে বলতিস আমার অবস্থা সব মনের গতিক। (hallucination)

নরেন্দ্র – কে জানে! এখন তো অনেক দেখলাম – সব মিলেছে!

নরেন্দ্র বলিতেছেন, ঠাকুর ভাবাবস্থায় লোকের অন্তর বাহির সমস্ত দেখিতে পান – এটা তিনি অনেকবার মিলাইয়া দেখিলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তের জাতি বিচার – Caste

ঠাকুর ও ভক্তদের সেবার জন্য অধর অনেক আয়োজন করিয়াছিলেন। তিনি এইবার তাঁহাদিগকে আহ্বান করিতেছেন।

মহেন্দ্র ও প্রিয়নাথ – মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়কে – ঠাকুর বলিতেছেন, ‘কিগো, তোমরা খেতে যাবে না?’

তাঁহারা বিনীতভাবে বলিতেছেন – ‘আজ্ঞা, আমাদের থাক।’

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – এঁরা সবই কচ্ছেন, শুধু ওইটেতেই সঙ্কোচ।

“একজনের শ্বশুর ভাসুরের নাম হরি, কৃষ্ণ – এই সব। এখন হরিনাম তো করতে হবে? – কিন্তু হরে কৃষ্ণ, বলবার জো নাই। তাই সে জপ কচ্ছে –

ফরে ফৃষ্ট, ফরে ফৃষ্ট, ফৃষ্ট ফৃষ্ট ফরে ফরে!
ফরে রাম, ফরে রাম, রাম রাম ফরে ফরে!”

অধর জাতিতে সুবর্ণবণিক। তাই ব্রাহ্মণ ভক্তেরা কেহ কেহ প্রথম প্রথম তাঁহার বাটীতে আহার করিতে ইতস্ততঃ করিতেন। কিছুদিন পরে যখন তাঁহারা দেখিলেন, স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ওখানে খান, তখন তাঁহাদের চটকা ভাঙিল।

রাত্রি প্রায় নটা হইল। নরেন্দ্র ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ঠাকুর আনন্দে সেবা করিলেন।

এইবার বৈঠকখানায় আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন – দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাবর্তন করিবার উদ্যোগ হইতেছে।

আগামীকল্য রবিবার দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের আনন্দের জন্য মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় কীর্তনের আয়োজন করিয়াছেন। শ্যামদাস কীর্তনিয়া গান গাইবেন। শ্যামদাসের কাছে রাম নিজের বাটীতে কীর্তন শিখেন।

ঠাকুর নরেন্দ্রকে কাল দক্ষিণেশ্বরে যাইতে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – কাল যাবি – কেমন?

নরেন্দ্র – আচ্ছা, চেষ্টা করব।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সেখানে নাইবি খাবি।

“ইনিও (মাস্টার) না হয় গিয়ে খাবেন। (মাস্টারের প্রতি) – তোমার অসুখ এখন সেরেছে? – এখন পত্তি (পথ্য) তো নয়?”

মাস্টার – আজ্ঞা না – আমিও খাব।

নিত্যগোপাল বৃন্দাবনে আছেন। চুনিলাল কয়েকদিন হইল বৃন্দাবন হইতে ফিরিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহার কাছে নিত্যগোপালের সংবাদ লইতেছেন। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর যাত্রা করিবেন। মাস্টার ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁহার শ্রীপাদপদ্ম মস্তকের দ্বারা স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর সস্নেহে তাঁহাকে বলিতেছেন, ‘তবে যেও।’

(নরেন্দ্রাদির প্রতি, সস্নেহে) – ‘নরেন্দ্র ভবনাথ যেও।’

নরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রনাম করিলেন। তাঁহার অপূর্ব কীর্তনানন্দ ও কীর্তনমধ্যে ভক্তসঙ্গে অপূর্ব নৃত্য স্মরণ করিতে করিতে সকলে নিজ নিজ গৃহে ফিরিতেছেন।

আজ ভাদ্র কৃষ্ণাপ্রতিপদ। রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী – যেন হাসিতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, ভবনাথ, হাজরা প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বরাভিমুখে যাইতেছেন।

-১৮৮৪, ৬ই সেপ্টেম্বর-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চতুর্বিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!