ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

কালীপূজা রাত্রে সমাধিস্থ – সাঙ্গোপাঙ্গ সম্বন্ধে দৈববাণী

ভক্তেরা কেহ কেহ কালীমন্দিরে ঠাকুর দর্শন করিতে গমন করিলেন। কেহ বা দর্শন করিয়া একাকী গঙ্গাতীরে বাঁধাঘাটের উপর বসিয়া নির্জনে নিঃশব্দে নামজপ করিতেছেন। রাত্রি প্রায় ১১টা। মহানিশা। জোয়ার সবে আসিয়াছে – ভাগীরথী উত্তরবাহিনী। তীরস্থ দীপালোকে এক-একবার কালো জল দেখা যাইতেছে।

রামলাল পূজাপদ্ধতি নামক পুঁথি হস্তে মায়ের মন্দিরে একবার আসিলেন। পুঁথিখানি মন্দিরমধ্যে রাখিয়া দিবেন। মণি মাকে সতৃষ্ণ নয়নে দর্শন করিতেছেন দেখিয়া রামলাল বলিলেন, ভিতরে আসবেন কি? মণি অনুগৃহীত হইয়া প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, মা বেশ সাজিয়াছেন। ঘর আলোকাকীর্ণ। মার সম্মুখে দুই সেজ; উপরে ঝাড় ঝুলিতেছে। মন্দিরতল নৈবেদ্যে পরিপূর্ণ।

মার পাদপদ্মে জবাবিল্ব। নানাবিধ পুষ্প মালায় বেশকারী মাকে সাজাইয়াছেন। মণি দেখিলেন, সম্মুখে চামর ঝুলিতেছে। হঠাৎ মনে পড়িল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই চামর লইয়া ঠাকুরকে কত ব্যজন করেন। তখন তিনি সঙ্কুচিতভাবে রামলালকে বলিতেছেন, “এই চামরটি একবার নিতে পারি?”

রামলাল অনুমতি প্রদান করিলেন; তিনি মাকে ব্যজন করিতে লাগিলেন। তখনও পূজা আরম্ভ হয় নাই।

যে সকল ভক্তেরা বাহিরে গিয়াছিলেন, তাঁহারা আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আসিয়া মিলিত হইলেন।

শ্রীযুক্ত বেণী পাল নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। আগামীকল্য সিঁথি ব্রাহ্মসমাজে যাইতে হইবে। ঠাকুরের নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ পত্রে কিন্তু তারিখ ভুল হইয়াছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – বেণী পাল নিমন্ত্রণ করেছে। তবে এরকম লিখলে কেন বল দেখি?

মাস্টার – আজ্ঞে, লেখাটি ঠিক হয় নাই। তবে অত ভেবে-চিন্তে লেখেন নাই।

ঘরের মধ্যে ঠাকুর দাঁড়াইয়া, বাবুরাম কাছে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর বেণী পালের চিঠির কথা কহিতেছেন। বাবুরামকে স্পর্শ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। হঠাৎ সমাধিস্থ!

ভক্তেরা সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছেন। এই সমাধিস্থ মহাপুরুষকে অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। ঠাকুর সমাধিস্থ; বাম পা বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছেন – গ্রীবাদেশ ঈষৎ আকুঞ্চিত। বাবুরামের গ্রীবার পশ্চাদ্দেশে কানের কাছে হাতটি রহিয়াছে।

কিয়ৎক্ষণ পরে সমাধিভঙ্গ হইল। তখনও দাঁড়াইয়া। এইবার গালে হাত দিয়া যেন কত চিন্তিত হইয়া দাঁড়াইলেন।

ঈষৎ হাস্য করিয়া এইবার ভক্তদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ – সব দেখলুম – কার কত দূর এগিয়েছে। রাখাল, ইনি (মণি), সুরেন্দ্র, বাবুরাম, অনেককে দেখলুম।

হাজরা – এখানকার?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ।

হাজরা – বেশি কি বন্ধন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – না।

হাজরা – নরেন্দ্রকে দেখলেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখি নাই, কিন্তু এখনও বলতে পারি – একটু জড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু সব্বায়ের হয়ে যাবে দেখলুম।

(মণির দিকে তাকাইয়া) – সব দেখলুম ঘুপটি মেরে রয়েছে!

ভক্তেরা অবাক্‌, দৈববাণীর ন্যায় অদ্ভুত সংবাদ শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু একে (বাবুরামকে) ছুঁয়ে ওরূপ হল!

হাজরা – ফার্স্ট (First) কে?

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিতেছেন, “নিত্যগোপালের মতো গোটাকতক হয়!”

আবার চিন্তা করিতেছেন। এখনও সেইভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।

আবার বলিতেছেন – “অধর সেন – যদি কর্মকাজ কমে, – কিন্তু ভয় হয় – সাহেব আবার বকবে। যদি বলে, এ ক্যা হ্যায়!” (সকলের ঈষৎ হাস্য)

ঠাকুর আবার নিজাসনে গিয়া বসিলেন। ভক্তেরা মেঝেতে বসিলেন। বাবুরাম ও কিশোরী তাড়াতাড়ি করিয়া ছোট খাটটিতে ঠাকুরের পাদমূলে বসিয়া একে একে পদসেবা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কিশোরীর দিকে তাকাইয়া) – আজ যে খুব সেবা!

রামলাল আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন; ও আতিশয় ভক্তিভাবে পদধূলি গ্রহণ করিলেন। মায়ের পূজা করিতে যাইতেছেন।

রামলাল (ঠাকুরের প্রতি) – তবে আমি আসি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ওঁ কালী, ওঁ কালী। সাবধানে পূজা করো। আবার মেড়া বলি দিতে হবে।

মহানিশা। পূজা আরম্ভ হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা দেখিতে আসিয়াছেন। মার কাছে গিয়া দর্শন করিতেছেন। এইবার বলি হইবে – লোক কাতার দিয়া দাঁড়াইয়াছে। বধ্য পশুর উৎসর্গ হইল। পশুকে বলিদানের জন্য লইয়া যাইবার উদ্যোগ হইতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির ত্যাগ করিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন।

ঠাকুরের সে অবস্থা নয়, পশুবধ দেখিতে পারিবেন না।

রাত দুইটা পর্যন্ত কোন কোন ভক্ত মা-কালীর মন্দিরে বসিয়াছিলেন। হরিপদ কালীঘরে আসিয়া বলিলেন, চলুন, তিনি ডাকছেন, খাবার সব প্রস্তুত। ভক্তেরা ঠাকুরের প্রসাদ পাইলেন ও যে যেখানে পাইলেন, একটু শুইয়া পড়িলেন।

ভোর হইল; মার মঙ্গল আরতি হইয়া গিয়াছে। মার সম্মুখে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে যাত্রা হইতেছে, মা যাত্রা শুনিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীবাড়ির বৃহৎ পাকা উঠান দিয়া যাত্রা শুনিতে আসিতেছেন। মণি সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছেন – ঠাকুরের কাছে বিদায় লইবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন তুমি এখন যাবে?

মণি – আজ আপনি সিঁথিতে বৈকালে যাবেন, আমারও ইচ্ছা আছে, তাই বাড়িতে একবার যাচ্ছি।

কথা কহিতে কহিতে মা-কালীর মন্দিরের কাছে আসিয়া উপস্থিত। অদূরে নাটমন্দির, যাত্রা হইতেছে। মণি সোপানমূলে ভূমিষ্ঠ হইয়া চরণ বন্দনা করিতেছেন।

ঠাকুর বলিলেন, “আচ্ছা এসো। আর দুখানা আটপৌরে নাইবার কাপড় আমার জন্য এনো।”

-১৮৮৪, ১৮ই অক্টোবর-

……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাত্রিংশ অধ্যায় : পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!