ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

পুনর্যাত্রা – রথের সম্মুখে ভক্তসঙ্গে ঠাকুরের নৃত্য ও সংকীর্তন

ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হইল। গানও সমাপ্ত হইল। শশধর, প্রতাপ, রামদয়াল, রাম, মনোমোহন, ছোকরা ভক্তেরা প্রভৃতি অনেকেই বসিয়া আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন, “তোমরা একটা কেউ খোঁচা দেও না” – অর্থাৎ শশধরকে কিছু জিজ্ঞাসা কর।

রামদয়াল (শশধরের প্রতি) – ব্রহ্মের রূপকল্পনা যে শাস্ত্রে আছে, সে কল্পনা কে করেন?

পণ্ডিত – ব্রহ্ম নিজে করেন, – মানুষের কল্পনা নয়।

ডাঃ প্রতাপ – কেন রূপ কল্পনা করেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন? তিনি কারু সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করেন না। তাঁর খুশি, তিনি ইচ্ছাময়! কেন তিনি করেন, এ খপরে আমাদের কাজ কি? বাগানে আম খেতে এসেছ, আম খাও; কটা গাছ, ক-হাজার ডাল, কত লক্ষ পাতা, – এ-সব হিসাবে কাজ কি? বৃথা তর্ক-বিচার করলে বস্তুলাভ হয় না।

ডাঃ প্রতাপ – তাহলে আর বিচার করব না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – বৃথা তর্ক-বিচার করবে না। তবে সদসৎ বিচার করবে, – কোন্‌টা নিত্য। কোন্‌টা অনিত্য। যেমন কাম-ক্রোধাদি বা শোকের সময়।

পণ্ডিত – ও আলাদা। ওকে বিবেকাত্মক বিচার বলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, সদসৎ বিচার [সকলে চুপ করিয়া আছেন]

(পণ্ডিতের প্রতি) – “আগে বড় বড় লোক আসত।”

পণ্ডিত – কি, বড়মানুষ?

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, বড় বড় পণ্ডিত।

ইতিমধ্যে ছোট রথখানি বাহিরের দুতলার বারান্দার উপর আনা হইয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, সুভদ্রা ও বলরাম নানা বর্ণের কুসুম ও পুষ্পমালায় সুশোভিত হইয়াছেন এবং অলঙ্কার ও নববস্ত্র পীতাম্বর পরিধান করিয়াছেন। বলরামের সাত্ত্বিক পূজা, কোন আড়ম্বর নাই। বাহিরের লোকে জানেও না যে, বাড়িতে রথ হইতেছে।

এইবার ঠাকুর ভক্তসঙ্গে রথের সম্মুখে আসিয়াছেন। ওই বারান্দাতেই রথ টানা হইবে। ঠাকুর রথের দড়ি ধরিয়াছেন ও কিয়ৎক্ষণ টানিলেন। পরে গান ধরিলেন – নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।

গান – যাদের হরি বলিতে নয়ন ঝরে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।

ঠাকুর নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরাও সেই সঙ্গে নাচিতেছেন ও গাইতেছেন। কীর্তনীয়া বৈষ্ণবচরণ, সম্প্রদায়ের সহিত গানে ও নৃত্যে যোগদান করিয়াছেন।

দেখিতে দেখিতে সমস্ত বারান্দা পরিপূর্ণ হইল। মেয়েরাও নিকটস্থ ঘর হইতে এই প্রেমানন্দ দেখিতছেন! বোধ হইল, যেন শ্রীবাসমন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তসঙ্গে হরিপ্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছেন। বন্ধুবর্গসঙ্গে পণ্ডিতও রথের সম্মুখে এই নৃত্য গীত দর্শন করিতেছেন।

এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ঠাকুর বৈঠকখানাঘরে আবার ফিরিয়া আসিয়াছেন ও ভক্তসঙ্গে উপবেশন করিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) – এর নাম ভজনানন্দ। সংসারীরা বিষয়ানন্দ নিয়ে থাকে, – কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ। ভজন করতে করতে তাঁর যখন কৃপা হয়, তখন তিনি দর্শন দেন – তখন ব্রহ্মানন্দ।

শশধর ও ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

পণ্ডিত (বিনীতভাবে) – আজ্ঞা, কিরূপ ব্যাকুল হলে মনের এই সরস অবস্থা হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরকে দর্শন করবার জন্য যখন প্রাণ আটুপাটু হয় তখন এই ব্যাকুলতা আসে। গুরু শিষ্যকে বললে, এসো তোমায় দেখিয়ে দি কিরূপ ব্যাকুল হলে তাঁকে পাওয়া যায়। এই বলে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে শিষ্যকে জলে চুবিয়ে ধরলে। তুললে পর শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলে, তোমার প্রাণ কিরকম হচ্ছিল? সে বললে, প্রাণ আটুপাটু কচ্ছিল।

পণ্ডিত – হাঁ হাঁ, তা বটে, এবার বুঝেছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরকে ভালবাসা, এই সার! ভক্তিই সার। নারদ রামকে বললেন, তোমার পাদপদ্মে যেন সদা শুদ্ধাভক্তি থাকে; আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রামচন্দ্র বললেন, আর কিছু বর লও; নারদ বললেন, আর কিছু চাই না, – কেবল যেন পাদপদ্মে ভক্তি থাকে।

পণ্ডিত বিদায় লইবেন। ঠাকুর বললেন, এঁকে গাড়ি আনিয়া দাও।

পণ্ডিত – আজ্ঞা না, আমরা অমনি চলে যাব।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – তা কি হয়! ব্রহ্মা যাঁরে না পায়ে ধ্যানে –

পণ্ডিত – যাবার প্রয়োজন ছিল না, তবে সন্ধ্যাদি করতে হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণের পরমহংস অবস্থা ও কর্মত্যাগ – মধুর নাম কীর্তন

শ্রীরামকৃষ্ণ – মা আমার সন্ধ্যাদি কর্ম উঠিয়ে দিয়েছেন, সন্ধ্যাদি দ্বারা দেহ-মন শুদ্ধ করা, সে অবস্থা এখন আর নাই।

এই বলিয়া ঠাকুর গানের ধুয়া ধরিলেন – ‘শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্যঘরে কবে শুবি, তাদের দুই সতীনে পিরিত হলে তবে শ্যামা মারে পাবি!’

শশধর প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

রাম – আমি কাল শশধরের কাছে গিয়েছিলাম, আপনি বলেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কই, আমি তো বলি নাই, তা বেশ তো, তুমি গিছিলে।

রাম – একজন খবরের কাগজের (Indian Empire) সম্পাদক আপনার নিন্দা করছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা করলেই বা।

রাম – তারপর শুনুন! আমার কথা শুনে তখন আর আমায় ছাড়ে না, আপনার কথা আরও শুনতে চায়!

ডাক্তার প্রতাপ এখনও বসিয়া। ঠাকুর বলিতেছেন – সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) একবার যেও, – ভুবন (ধাত্রী) ভাড়া দেবে বলেছে।

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার নাম করিতেছেন – রামনাম, কৃষ্ণনাম, হরিনাম করিতেছেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে শুনিতেছেন। এত সুমিষ্ট নামকীর্তন, যেন মধুবর্ষণ হইতেছে। আজ বলরামের বাড়ি যেন নবদ্বীপ হইয়াছে। বাহিরে নবদ্বীপ, ভিতরে বৃন্দাবন।

আজ রাত্রেই ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিবেন। বলরাম তাঁহাকে অন্তঃপুরে লইয়া যাইতেছেন – জল খাওয়াইবেন। এই সুযোগে মেয়ে ভক্তেরাও তাঁহাকে আবার দর্শন করিবেন।

এদিকে ভক্তেরা বাহিরের বৈঠকখানায় তাঁহার অপেক্ষা করিতেছেন ও একসঙ্গে সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর বাহিরে আসিয়াই যোগ দিলেন। কীর্তন চলিতেছে –

আমার গৌর নাচে।
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে।।
হরিবোল বলে বদনে গোরা, চায় গদাধর পানে,
গোরার অরুণ নয়নে, বহিছে সঘনে, প্রেমধারা হেম অঙ্গে।।

ঠাকুর আখর দিতেছেন –

নাচে সংকীর্তনে (শচীর দুলাল নাচে রে)।
(আমার গোরা নাচে রে) (প্রাণের গোরা নাচে রে)।

 

-১৮৮৪, ৩রা জুলাই-

…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাবিংশ অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!