ভবঘুরেকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

শ্রীরামকৃষ্ণ মণি প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

আবার রাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত কথা কহিতেছেন। রাখাল, লাটু, হরিশ প্রভৃতি আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – আচ্ছা, কেহ কেহ কৃষ্ণলীলার অধ্যাত্ম ব্যাখ্যা করে; তুমি কি বল?

মণি – নানা মত, তা হলেই বা। ভীষ্মদেবের কথা আপনি বলেছেন – শরশয্যায় দেহত্যাগের সময় বলেছিলেন, ‘কেন কাঁদছি? যন্ত্রণার জন্য নয়। যখন ভাবছি যে, সাক্ষাৎ নারায়ণ অর্জুনের সারথি হয়েছিলেন অথচ পাণ্ডবদের এত বিপদ, তখন তাঁর লীলা কিছুই বুঝতে পারলাম না – তাই কাঁদছি।’

“আবার হনুমানের কথা আপনি বলেছিলেন – হনুমান বলতেন, ‘আমি বার, তিথি, নক্ষত্র – এ-সব জানি না, আমি কেবল এক রামচিন্তা করি।’

“আপনি তো বলেছেন, দুটি জিনিস বই তো আর কিছু নাই – ব্রহ্ম আর শক্তি। আর বলেছেন, জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) হলে ওই দুইটি এক বোধ হয়; যে একের দুই নাই।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ বটে; চীজ নেবে তা কাঁটাবন দিয়েই হউক আর ভাল রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েই হউক।

“নানা মত বটে। ন্যাংটা বলত, মতের জন্য সাধুসেবা হল না। এক জায়গায় ভাণ্ডারা হচ্ছিল। অনেক সাধু সম্প্রদায়; সবাই বলে আমাদের সেবা আগে, তারপর অন্য সম্প্রদায়। কিছুই মিমাংসা হল না; শেষে সকলে চলে গেল! আর বেশ্যাদের খাওয়ানো হল!”

মণি – তোতাপুরী খুব লোক।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাজরা বলে অমনি (সামান্য)। না বাবু, কথায় কাজ নাই – সবাই বলে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে।

“দেখ, নারাণ শাস্ত্রীর খুব বৈরাগ্য হয়েছিল। অত বড় পণ্ডিত – স্ত্রী ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মন থেকে একেবারে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করলে তবে যোগ হয়। কারু কারু যোগীর লক্ষণ দেখা যায়।

“তোমায় ষট্‌চক্রের বিষয় কিছু বলে দিতে হবে। যোগীরা ষট্‌চক্র ভেদ করে তাঁর কৃপায় তাকে দর্শন করে। ষট্‌চক্র শুনেছ?”

“মণি – বেদান্তমতে সপ্তভূমি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – বেদান্ত নয়, বেদ মত। ষট্‌চক্র কিরকম জান? সূক্ষ্মদেহের ভিতর সব পদ্ম আছে – যোগীরা দেখতে পায়। যেমন মোমের গাছের ফলপাতা।

মণি – আজ্ঞা হাঁ, যোগীরা দেখতে পায়। একটা বইয়ে আছে, একরকম কাচ (Magnifier) আছে, তার ভিতর দিয়ে দেখলে খুব ছোট জিনিস বড় দেখায়। সেইরূপ যোগের দ্বারা ওই সব সূক্ষ্মপদ্ম দেখা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীর ঘরে থাকিতে বলিয়াছেন। মণি ওই ঘরে রাত্রিবাস করিতেছেন।

প্রত্যূষে ওই ঘরে একাকী গান গাহিতেছেন:

গৌর হে আমি সাধন-ভজনহীন
পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন ৷৷
চরণ পাবো পাবো বলে হে,
(চরণ তো আর পেলাম না, গৌর!)
আমার আশায় আশায় গেল দিন!

হঠাৎ জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। “পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন!” – এই কথা শুনিয়া তাঁহার চক্ষু, কি আশ্চর্য, অশ্রুপূর্ণ হইয়াছে।

আবার একটি গান হইতেছে:

আমি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে পরিব
শঙ্খের কুণ্ডল পরি।
আমি যোগিনীর বেশে যাব সেই দেশে,
যেখানে নিঠুর হরি ৷৷

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল বেড়াইতেছেন।

পরদিন শুক্রবার, ২১শে ডিসেম্বর (৭ই পৌষ, কৃষ্ণা অষ্টমী)। সকালবেলা শ্রীরামকৃষ্ণ একাকী বেলতলায় মণির সঙ্গে অনেক কথা কহিতেছেন। সাধনের নানা গুহ্যকথা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা। আর কখনও কখনও মনই গুরু হয় – এ-সব কথা বলিতেছেন।

আহারের পর পঞ্চবটীতে আসিয়াছেন – মনোহর পীতাম্বরধারী! পঞ্চবটীতে দু-তিনজন বাবাজী বৈষ্ণব আসিয়াছেন – একজন বাউল। তিনি বৈষ্ণবকে বলছেন, তোর ডোরকৌপীনের স্বরূপ বল দেখি!

অপরাহ্নে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুকে বলিতেছেন, ডুব দাও; উপর উপর ভাসলে রত্ন পাওয়া যায় না। আর ঈশ্বর নিরাকারও বটেন আবার সাকার। সাকার চিন্তা করলে শীঘ্র ভক্তি হয়। তখন আবার নিরাকার চিন্তা। যেমন পত্র পড়ে নিয়ে সে পত্র ফেলে দেয়। তারপর লেখা অনুসারে কাজ করে।

-১৮৮৩, ১৯শে ডিসেম্বর-

…………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ষোড়শ অধ্যায় : পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!