ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, রাম, কেদার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে –
বেদান্তবাদী সাধুসঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়িতে উঠিয়াছেন – ৺ কালীঘাট দর্শনে যাইবেন। শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটী হইয়া যাইবেন – অধরও সেখান হইতে সঙ্গে যাইবেন। আজ শনিবার, অমাবস্যা; ২৯শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩। বেলা ১টা হইবে।

গাড়ি তাঁহার ঘরের উত্তরের বারন্দার কাছে দাঁড়াইয়া আছে।

মণি গাড়ির দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।

মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – আজ্ঞা, আমি কি যাব?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন?

মণি – কলকাতার বাসা হয়ে একবার আসতাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ (চিন্তিত হইয়া) – আবার যাবে? এখানে বেশ আছ।

মণি বাড়ি ফিরিবেন – কয়েক ঘন্টার জন্য, কিন্তু ঠাকুরের মত নাই।

রবিবার, ৩০শে ডিসেম্বর, পৌষ শুক্লা প্রতিপদ তিথি। বেলা তিনটা হইয়াছে। মণি গাছতলায় একাকী বেড়াইতেছেন, – একটি ভক্ত আসিয়া বলিলেন, প্রভু ডাকিতেছেন। ঘরে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। মণি গিয়া প্রণাম করিলেন ও মেঝেতে ভক্তদের সঙ্গে বসিলেন।

কলিকাতা হইতে রাম, কেদার প্রভৃতি ভক্তেরা আসিয়াছেন। তাঁহাদের সঙ্গে একটি বেদান্তবাদী সাধু আসিয়াছেন। ঠাকুর যেদিন রামের বাগান দর্শন করিতে যান, সেই দিন এই সাধুটির সহিত দেখা হয়। সাধু পার্শ্বের বাগানের একটি গাছের তলায় একাকী একটি খাটিয়ায় বসিয়াছিলেন। রাম আজ ঠাকুরের আদেশে সেই সাধুটিকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। সাধুও ঠাকুরকে দর্শন করিবেন – ইচ্ছা করিয়াছেন।

ঠাকুর সাধুর সহিত আনন্দে কথা কহিতেছেন। নিজের কাছে ছোট তক্তাটির উপর সাধুকে বসাইয়াছেন। কথাবার্তা হিন্দীতে হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এ-সব তোমার কিরূপ বোধ হয়?

বেদান্তবাদী সাধু – এ-সব স্বপ্নবৎ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা? আচ্ছা জী, ব্রহ্ম কিরূপ?

সাধু – শব্দই ব্রহ্ম। অনাহত শব্দ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু জী, শব্দের প্রতিপাদ্য একটি আছেন। কেমন?

সাধু – বাচ্য১ ওই হ্যায়, বাচক ওই হ্যায়।

এই কথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। স্থির, – চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। সাধু ও ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া ঠাকুরের এই সমাধি অবস্থা দেখিতেছেন। কেদার সাধুকে বলিতেছেন –

“এই দেখো জী! ইস্‌কো সমাধি বোলতা হ্যায়।”

সাধু গ্রন্থেই সমাধির কথা পড়িয়াছেন, সমাধি কখনও দেখেন নাই।

ঠাকুর একটু একটু প্রকৃতিস্থ হইতেছেন ও জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন, “মা, ভাল হব – বেহুঁশ করিস নে – সাধুর সঙ্গে সচ্চিদানন্দের কথা কব! – মা, সচ্চিদানন্দের কথা নিয়ে বিলাস করব!”

সাধু অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন ও এই সকল কথা শুনিতেছেন। এইবার ঠাকুর সাধুর সহিত কথা কহিতেছেন – বলিতেছেন – আব্‌ সোঽহম্‌ উড়ায়ে দেও। আব্‌ হাম্‌ তোম্‌; – বিলাস! (অর্থাৎ এখন সোঽহম্‌ – “সেই আমি” উড়ায়ে দাও; – এখন “আমি তুমি”)।

যতক্ষণ আমি তুমি রয়েছে ততক্ষণ মাও আছেন – এস তাঁকে নিয়ে আনন্দ করা যাক। এই কথা কি ঠাকুর বলিতেছেন?

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ঠাকুর পঞ্চবটীমধ্যে বেড়াইতেছেন, – সঙ্গে রাম, কেদার, মাস্টার প্রভৃতি।

শ্রীরামকৃষ্ণের কেদারের প্রতি উপদেশ – সংসারত্যাগ

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – সাধুটিকে কিরকম দেখলে?

কেদার – শুষ্ক জ্ঞান! সবে হাঁড়ি চড়েছে, – এখনও চাল চড়ে নাই!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা বটে, কিন্তু ত্যাগী। সংসার যে ত্যাগ করেছে, সে অনেকটা এগিয়েছে।

“সাধুটি প্রবর্তকের ঘর। তাঁকে লাভ না করলে কিছুই হল না। যখন তাঁর প্রেমে মত্ত হওয়া যায়, আর কিছু ভাল লাগে না, তখন:

যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে!
মন, তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে!

ঠাকুরের ভাবে কেদার একটি গান বলিতেছেন-

মনের কথা কইবো কি সই, কইতে মানা –
দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না।
মনের মানুষ হয় যে জনা, ও তার নয়নেতে যায় গো চেনা,
ও সে দুই-এক জনা, ভাবে ভাসে রসে ডোবে,
ও সে উজান পথে করে আনাগোনা (ভাবের মানুষ)।

ঠাকুর নিজের ঘরে ফিরিয়াছেন। ৪টা বাজিয়াছে, – মা-কালীর ঘর খোলা হইয়াছে। ঠাকুর সাধুকে সঙ্গে করিয়া মা-কালীর ঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন।

কালীঘরে প্রবেশ করিয়া ঠাকুর ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করিতেছেন। সাধুও হাতজোড় করিয়া মাথা নোয়াইয়া মাকে পুনঃপুনঃ প্রণাম করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেমন জী, দর্শন!

সাধু (ভক্তিভরে) – কালী প্রধানা হ্যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কালী ব্রহ্ম অভেদ। কেমন জী?

সাধু – যতক্ষণ বহির্মুখ, ততক্ষণ কালী মানতে হবে। যতক্ষণ বহির্মুখ ততক্ষণ ভাল মন্দ; ততক্ষণ এটি প্রিয়, এটি ত্যাজ্য।

“এই দেখুন, নামরূপ তো সব মিথ্যা, কিন্তু যতক্ষণ আমি বহির্মুখ ততক্ষণ স্ত্রীলোক ত্যাজ্য। আর উপদেশের জন্য এটা ভাল, ওটা মন্দ; – নচেৎ ভ্রষ্টাচার হবে।”

ঠাকুর সাধুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ঘরে ফিরিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – দেখলে, – সাধু কালীঘরে প্রণাম করলে!

মণি – আজ্ঞা, হাঁ!

পরদিন সোমবার, ৩১শে ডিসেম্বর (১৭ই পৌষ, শুক্লা দ্বিতীয়া)। বেলা ৪টা হইবে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে ঘরে বসিয়া আছেন। বলরাম, মণি, রাখাল, লাটু, হরিশ প্রভৃতি আছেন। ঠাকুর মণিকে ও বলরামকে বলিতেছেন –

মুখে জ্ঞানের কথা – হলধারীকে ঠাকুরের তিরস্কার কথা

“হলধারীর জ্ঞানীর ভাব ছিল। সে অধ্যাত্ম, উপনিষৎ, – এই সব রাতদিন পড়ত। এদিকে সাকার কথায় মুখ ব্যাঁকাত। আমি যখণ কাঙালীদের পাতে একটু একটু খেলাম, তখন বললে, ‘তোর ছেলেদের বিয়ে কেমন করে হবে!’ আমি বললাম, ‘তবে রে শ্যালা, আমার আবার ছেলেপিলে হবে! তোর গীতা, বেদান্ত পড়ার মুখে আগুন!’ দেখো না, এদিকে বলছে জগৎ মিথ্যা! – আবার বিষ্ণুঘরে নাক সিটকে ধ্যান!”

সন্ধ্যা হইল। বলরামাদি ভক্তেরা কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন। ঘরে ঠাকুর মার চিন্তা করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরবাড়িতে আরতির সুমধুর শব্দ শোনা যাইতে লাগিল।

রাত্রি প্রায় ৮টা হইয়াছে। ঠাকুর ভাবে সুমধুর স্বরে সুর করিয়া মার সহিত কথা কহিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বেদান্ত

ঠাকুর মধুর নাম উচ্চারণ করিতেছেন – হরি ওঁ! হরি ওঁ! ওঁ! মাকে বলিতেছেন – “ও মা! ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে বেহুঁশ করে রাখিস নে! ব্রহ্মজ্ঞান চাই না মা! আমি আনন্দ করব! বিলাস করব!”

আবার বলিতেছেন – “বেদান্ত জানি না মা! জানতে চাই না মা! – মা, তোকে পেলে বেদবেদান্ত কত নিচে পড়ে থাকে!

কৃষ্ণ রে! তোরে বলব, খা রে – নে রে – বাপ! কৃষ্ণ রে! বলব, তুই আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছিস বাপ।”

………………………………..
১ বাচ্যবাচকভেদেন ত্বমেব পরমেশ্বর [অধ্যাত্ম রামায়ণ]

-১৮৮৩, ২৯শে ডিসেম্বর-

………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : সপ্তদশ অধ্যায় : নবম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!