ভবঘুরেকথা
শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

একবার উত্তরবঙ্গের এক দোর্দণ্ড প্রতাপ জমিদার বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার নামডাক শুনে, একটি বিপদে পরে তাঁর শরণাপন্ন হন। তিনি এমন একটি মোকদ্দমায় জড়িয়ে পরেন, যাতে তাঁকে সর্বশান্ত হতে হবে। তাই তিনি লোকনাথ বাবার কাছে ছুটে আসেন।

তাঁকে দেখে বাবা সমাদর করে বসালেন, তারপর দু’টি চোখের অপলক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে তাঁর দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে জমিদারবাবুর অন্তরে জাগল এক অভূতপূর্ব আলোড়ন। তারপর প্রসন্ন মুখে মৃদুকণ্ঠে বললেন- তুই যেজন্য এসেছিস, তা আমি জানি। তোকে শূন্য হাতে ফিরতে হবে না, কিন্তু তার বিনিময়ে তোকে কিছু দিতে হবে।

জমিদারবাবু বললেন- সাধ্য থাকলে, তা অবশ্যই দেব। কি দিতে হবে বলুন? বাবা বললেন- যদি বলি তোকে সর্বস্ব দিতে হবে? জমিদারবাবু বললেন, সর্বস্ব তো আমার যেতেই বসেছে, বাকি আছে শুধু আমার কলঙ্কিত দেহ-মন। তা যদি আপনার কাজে লাগে, তো তা দিতে আমার আপত্তি নেই।

এই উত্তর শুনে বাবা খুশি হলেন, তিনি বললেন, তোর এখানে আসবার তিনদিন আগে তোর আপিলের রায় আমি লিখিয়ে দিয়ে এসেছি। পড়ে দেখিস, তাতে লেখা আছে- তুই বেকসুর খালাস পেয়েছিস, ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ হাজার টাকা পাবি; কাল আদালতে গেলেই হাকিম রায় দেবে। আমি আমার কাজ করেছি, এবার তোর পালা। তোকে তিন বছর সময় দিলাম- আমি যখন তোকে আশ্রয় দিয়েছি, তখন কারো সাধ্য নেই তোর অনিষ্ট করে।

এই তিন বছরের মধ্যে আমাকে দেওয়া দেহ-মন নিয়ে যা খুশি করে নে। এর মধ্যে আমি ডেকে না পাঠালে, তুই আমার ত্রিসীমানার মধ্যে আসবি না। তিন বছর পর এই দিনটিতে তোকে লোকের কাঁধে চেপে আসতে হবে- এই কথঅটা মনে রাখিস।

লোকের কাঁধে চেপে আসতে হবে- এই কথাটা মনে রাখিস। অন্তর্যামী বাবা তা বুঝতে পেরে বললেন- আমি যার রক্ষাকর্তা, তাকে মারে কে? কমপক্ষে নব্বই বছর তোর পরমায়ু। এখন নির্ভয়ে নিশ্চিন্ত মনে চলে যা।

জমিদারবাবুর তখন বাড়ি চলে গেলেন। পরদিন আদালতের রায় বার হলে, তিনি ধনে-প্রাণে রক্ষা পেয়ে গেলেন ; বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলল। আনন্দের উত্তেজনায় তখনি লোকনাথ বাবার কাছে ছূটে আসার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, কিন্তু বাবার নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করে ব্যথায় ভরে উঠল তাঁর সমস্ত মন। তিনি কয়েকবার লোক পাঠিয়ে বাবার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন, কিন্তু কিছুতেই বাবা তাঁর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেন না।

এদিকে ছেলেটিকে তখনি বাড়ি ফিরতে হবে, তাই সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। বাবা তা লক্ষ্য করে বললেন- বাড়ির কথা তোকে ভাবতে হবে না, সে ব্যবস্থা না করে কি আর তোকে এখানে আটকে রেখেছি রে-হাঁদা; এরই মধ্যে আমি নিজে গিয়ে তোর বাবাকে কলকাতা রওনা করে দিয়ে এসেছি, তা নইলে যে তোদের সেখানকার গদী লাটে উঠত। কোন ভয় নেই, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

বছরখানেক পর জমিদারবাবু জমিদারের আয় কমতে লাগল দিনে দিনে। ঠিকমত নজর দিতে না পারায় কাজ-কারবার পাঁচভুতে লুটেপুটে খেতে লাগল। তাঁর একমাত্র ছেলের বয়স তখন কুড়ি-একুশ। কাজ কারবার বা জমিদারির কিছুই জানে না সে। তখন নিবিড় হতাশায় ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি রাগ হলো তাঁর। মনে হলো, তিনি বড় নিষ্ঠুর। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে একটি চিঠি লিখে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন ব্রহ্মচারী বাবার কাছে।

চিঠি নিয়ে ছেলে আশ্রমে গেল। চিঠিতে কি লেখা ছিল, তা সে জানত না। ছেলের মনে হলো, ব্রহ্মচারী বাবা যেন তারই জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তখন আশ্রমের বেলগাছতলায় দাঁড়িয়েছিলেন; জমিদারের ছেলেকে দেখেই তিনি বললেন- চিঠি এনেছিস? গালাগালির ভাষা যত কুৎসিতই হোক, চিঠিখানির আগাগোড়া সব পড়, কিছু বাদ দিবি না। চিঠির কিছুটা পড়েই ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে গেল। সে বুঝল, বাবা সর্বজ্ঞ-অর্ন্তযামী। চিঠিতে কি লেখা আছে, তা সবই তিনি জানেন।

ছেলেটি চিঠি পড়তে কুণ্ঠিত হচ্ছে দেখে বাবা বললেন- ওরে, তুই কুণ্ঠিত হচ্ছিস কেন? ও চিঠি তো আমিই হাতে ধরে তোর বাবাকে দিয়ে লিখিয়েছি। এবার মিলিয়ে দেখ, ওতে লেখা আছে- আমি ঠক, জুয়োচোর, ভণ্ড, পাষণ্ড, আমি বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী, নরাধম, আমি তার সর্বনাশ করেছি- এই সব লেখা আছে এই চিঠিতে; এই তো আসল প্রেমপত্র।

তোর বাবাকে বলবি- আমি তার চিঠি পড়ে খুশি হয়োছ, আর বলবি- কষ্ট দিতে আমি কি চাই? তবে কষ্ট থেকে বাঁচতে গেলে কষ্ট তো করতেই হবে। বলবি- এবার থেকে তোদের আয়ের উন্নতি হবে, তোদের সংসারের রথ গড়গড় করে চলবে আমার সত্যরক্ষা হয়ে গেলে তার সত্যরক্ষার পালা।

বাবার কথা শুনে ছেলেটি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। যাঁর উপর রাগ করে তার বাবা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে চিঠি দিয়েছে, উপরে কঠোর হলেও অন্তরে তাঁর কত দয়া। তিনি তার বাবার সব অপরাধ ক্ষমা করে তারই সংসারের উন্নতি ও মঙ্গল চিন্তা করছেন। ছেলেটি বুঝল, ব্রহ্মচারী সাধারণ মানুষ নন, এক অসাধারণ অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ; এটা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব।

এইসব ভাবতে ভাবতে ছেলেটির বাহ্যজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হয়ে পরেছিল। এমন সময় বাবা আশ্রমের ভৃত্য ভজলেরামকে ডেকে বললেন- এখন ছেলেটার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর, ফজলি আম আর নলেন গুড়ের সন্দেশ।

ভজলেরাম বলল- এখন তো আমের সময় নয়, আর নলেন গুড়ের সন্দেশও নেই। তবে বাবার যখন ইচ্ছা হয়েছে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা হেসে বললেন- বড় জোর পাঁচ-সাত মাইল দূরে ছাওয়াল বাঘিনীর স্রোতে পানসী চেয়ে ওরা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছে। আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা এসে পরবে, ওদের কাছে এসব আছে।

এদিকে ছেলেটিকে তখনি বাড়ি ফিরতে হবে, তাই সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। বাবা তা লক্ষ্য করে বললেন- বাড়ির কথা তোকে ভাবতে হবে না, সে ব্যবস্থা না করে কি আর তোকে এখানে আটকে রেখেছি রে-হাঁদা; এরই মধ্যে আমি নিজে গিয়ে তোর বাবাকে কলকাতা রওনা করে দিয়ে এসেছি, তা নইলে যে তোদের সেখানকার গদী লাটে উঠত। কোন ভয় নেই, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

এই কথা বলার পর হঠাৎ বাবা নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনে হলো, তাঁর দেহ প্রাণ নেই; মনে হলো যেন তাঁর এই নিস্পন্দ জড়দেহটি ছেড়ে কোনও অজ্ঞাতলোকে চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলে বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ভক্তদের একজনকে বললেন- তোর অবস্থা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না, সংসার ছাড়ব বললেই কি ছাড়া যায় রে পাগল?

কিন্তু ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, এত অল্প সময়ের মধ্যে এতদূর তিনি এত কাজ কি করে করে এলেন। অথচ তিনি তো সর্বক্ষণ এখানেই ছিলেন। তার মনের কথা বুঝতে পেরে অন্তর্যামী বাবা বললেন- হ্যাঁ রে হ্যাঁ। আমি ছিলাম, সেখানেও ছিলাম। একই সময়ে আমি কত জায়গায় গিয়ে কত কাজ করি, তা তোর মাথায় ঢুকবে না। আজ সোমবার, এরপরের সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় তোর বাবা কলকাতা থেকে ফিরবে, তখন তার মুখ থেকেই সব শুনবি।

এমন সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে সেই দর্শনাথীরা এসে গেল। তারা বাবাকে প্রণাম করতেই বাবা তাদের একজনকে বললেন- হ্যাঁরে, এই অসময়ে ফজলি আম কোথায় পেলি

লোকটি বলল- আমার বারোমাসে একটি ফসজি আমের গাছ আছে, তার প্রথম ফলগুলি আশ্রমের জন্য এনেছি। কিন্তু সেসব তো বাক্সবন্দী হয়ে কুলির মাথায় চড়ে আসছে, তুমি জানলে কি করে!

বাবা হেসে বললেন- শুধু কি তাই? কোন দোকান থেকে কত দাম দিয়ে নলেন গুড়ের সন্দেশ এনেছিস, তাও আমি জানি। এখন সব তাড়াতাড়ি বার করে দে, আমি প্রসাদ করে দিলে সবাই প্রসাদ পাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভজলেরাম একটি বড় ধামায় করে প্রচুর আম, সন্দেশ এনে বাবার সামনে রাাখল; তখন বাবা প্রসাদ করে দিলে আশ্রমের পশুপাখি, মানুষ সবাই তা খেতে লাগল। বাবার ডাকে কালাচাঁদ নামে সেই ষাঁড় এসে আম খেতে লাগল ; একপাল কুকুর এসে তাদের ভাগ নিয়ে নিল ; আশ্রমে উপস্থিত সব লোকও তা খেল। সবাই মিলে যেন একটি পরিবার, পশুপাখি মানুষে কোন ভেদ নেই। নেই ছোট বড় কোন ইতর বিশেষ।

বাবা এবার ছেলেটিকে বললেন- তোকে সকালে যেতে দিইনি, বিকালেও যেতে দেব না। সন্ধ্যাবেলায় দারুণ ঝড়বৃষ্টি হবে, কত নৌকা নদীর জলে তলিয়ে যাবে, একটা দিন থেকে যা। তোর যাতে বিপদ না হয়, সেটা তো আমায় দেখতে হবে।

এই কথা বলার পর হঠাৎ বাবা নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনে হলো, তাঁর দেহ প্রাণ নেই; মনে হলো যেন তাঁর এই নিস্পন্দ জড়দেহটি ছেড়ে কোনও অজ্ঞাতলোকে চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলে বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ভক্তদের একজনকে বললেন- তোর অবস্থা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না, সংসার ছাড়ব বললেই কি ছাড়া যায় রে পাগল?

কাজকর্ম ছেড়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ালেই কি মুক্তি পাওয়া যায়? তারচেয়ে আমার কথা শোন, বিয়ে করে আবার নতুন করে সংসার পাত। সংসারকে আঁকড়ে ধরলেই দেখবি তার মধ্যে দিয়ে পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সেদিন রাতে আগে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পরলেন। ছেলেকে কলকাতা থেকে আসতে চিঠি লিখেছিলেন, হঠাৎ সে রাতে ডাকাত পরল বাড়িতে। দরজা খুলে বারান্দায় বার হতেই মাথায় বুকে লাঠির ঘা পরল, অজ্ঞান হয়ে তিনি পরে গেলেন সিঁড়ির উপর। তিনদিন অচৈতন্য হয়ে রইলেন। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরল, কিন্তু কথা কইতে পারলেন না। পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়ে গেছে সমস্ত দেহ। সাহেব ডাক্তার ইঞ্জেকসান, ওষুধ দিল। বলে গেল- এ রোগ সারবে না।

লোকটি বলল- আমার এ প্রাণ তো তোমারই দেওয়া। আমি তো প্রায় মরেই গিয়েছিলাম, ডাক্তার-কবিরাজ সবাই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। খবর পেয়ে তুমি অভয় দিলে, আমাকে তোমার কাছে আনা হলো। তুমি বললে- তুই অনেকদিন বাচঁবি। আমি যাকে আশ্রয় দিলাম, যমেরও সাধ্য নেই তাকে নিয়ে যায়। নসুতরাং তোমার আদেশ আমি মাথা পেত নেব।

এদিকে উত্তরবঙ্গের সেই জমিদারের ছেলেটি বাড়ি ফিরে দেখল, সত্যিই তার বাবা কলকাতা গেছেন। তিনি ফিরলে ছেলেটিকে লোকনাথ বাবা আশ্রমে যা যা বলেছিলেন, সে যা যা দেখেছিল, তা সব বলল। তখন তার বাবা তাকে বলতে লাগলেন- আমি তোকে বারদী পাঠিয়ে শোবার ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। দেখলাম, তিনি আমার সামনে আনন্দময় মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি বললেন- তোর প্রারব্ধ ভোগ কেটে গেছে, এবার তোকে কাজকর্মে মন দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পত্তি, দেহ-মন সব আমাকে দিয়েছিস, এবার আমার কাজ মনে করে সব করতে হবে তোকে।

এখনি উঠে কলকাতা চলে যা। স্টেশন থেকে সোজা গদীতে গিয়ে ম্যানেজারকে বরখাস্ত করবি, কোন কৈফিয়ৎ চাইবি না। ব্যবার লাভ-ক্ষতি সব আমার উপর ছেড়ে শুধু কর্তব্যবোধে কাজ করে যাবি। ছেলেকে ব্যবসার কাজ শিখিয়ে দিয়ে জমিদারির ভার তুই নিবি। এইভাবে দিনে দিনে জমিদারবাবু কাজকর্ম চালাতে লাগলেন।

দু’বছর কেটে গেল। এবার ব্রহ্মচারী বাবার সেই ভবিষ্যৎবাণীর কথা ভেবে ভয় হতে লাগল জমিদারবাবুর। বুঝতে পারলেন, তাঁর মহাপরীক্ষার দিন এগিয়ে আসছে। কখন কি অঘটন ঘটবে, বুঝতে পারলেন না। তিনি বলেছিলেন- তিন বছর পর কাঁধে চেপে তোকে আসতে হবে এখানে।

সেদিন রাতে আগে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পরলেন। ছেলেকে কলকাতা থেকে আসতে চিঠি লিখেছিলেন, হঠাৎ সে রাতে ডাকাত পরল বাড়িতে। দরজা খুলে বারান্দায় বার হতেই মাথায় বুকে লাঠির ঘা পরল, অজ্ঞান হয়ে তিনি পরে গেলেন সিঁড়ির উপর। তিনদিন অচৈতন্য হয়ে রইলেন। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরল, কিন্তু কথা কইতে পারলেন না। পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়ে গেছে সমস্ত দেহ। সাহেব ডাক্তার ইঞ্জেকসান, ওষুধ দিল। বলে গেল- এ রোগ সারবে না।

জমিদারবাবু বললেন, কোন ডাক্তারই আমার রোগ সারাতে পারবে না। তোমার আনা তিনজন বড় বড় বিশেষজ্ঞ যা বলেছে, আমি শুনেছি। তারা বলেছে, আমার পক্ষাঘাত সারবে না, সারাজীবন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, উঠতে পারব না, শুধু কথা বলতে ও বুঝতে পারব। মরি মরব- এখানেই মরব; আমি যখন আমার দেহ-মন ব্রহ্মচারী বাবাকে সমর্পণ করেছি, তখন তিনি যা করেন, তাই হবে। তাতে এই দেহ যায় তো যাবে।

ঊনিশ দিন পর কথা বলতে পারলেন। তারপরই লোকজন নিয়ে ছেলের আপত্তি সত্ত্বেও বারদীর আশ্রমে চলে গেলেন, কোন ডাক্তারি ওষুধ ব্যবহার করলেন না। লাঠির আঘাতে দেহের ও বুকের অনেক হাড়-পাঁজরা ভেঙে গিয়েছিল, সেইসব তখনো জোড়া লাগেনি; তার উপর হার্ট দুর্বল। তবু কারো কোন কথা শুনলেন না।

বারদীর আশ্রমে গিয়ে দেখলেন, ব্রহ্মচারী বাবা কোথায় গেছেন- আশ্রমে নেই; কবে ফিরবেন, তার কোনো ঠিক নেই। জমিদারবাবু তখন তার ছেলে ও লোকজনদের বললেন- ব্রহ্মচারী বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি আশ্রমে ঢুকব না। আশ্রমের বাইরে ঐ গাছতলায় আমার জন্য একটা বিছানা করে দাও, মশারি খাটিয়ে দাও; আমি কোন ওষুধ খাব না, কোন কিছুই খাব না।

এইভাবে তিনদিন কেটে গেল। চতুর্থ দিনে লোকনাথ বাবা আশ্রয়ে ফিরে এলেন। জমিদারবাবুর ছেলে তাঁর কাছে বলল- বাবা কোন ওষুধ খাচ্ছেন না, তিনি জলস্পর্শ করছেন না, আপনি গিয়ে তাঁকে একবার দর্শন দিন।

বাবা কিন্তু কড়া ভাষায় বললেন- আমি কাুউকে আশ্রমে ডেকে আনি না। তোর বাপ জমিদার বলে কি তাকে খাতির করে ডেকে আনতে হবে? তার মন হয় আসবে, না মন হয় আসবে না।

ছেলে হতাশ হয়ে ফিরে তার বাবাকে সব কথা জানাল। তারপর বলল- তুমি ফিরে চল, উনি আসবেন না। ডাক্তার বলেছে- আর দেরি করলে তোমার বুজের হাড় জোড়া লাগবে না, মস্তিষ্কের ক্ষত বিষিয়ে যাবে।

জমিদারবাবু বললেন, কোন ডাক্তারই আমার রোগ সারাতে পারবে না। তোমার আনা তিনজন বড় বড় বিশেষজ্ঞ যা বলেছে, আমি শুনেছি। তারা বলেছে, আমার পক্ষাঘাত সারবে না, সারাজীবন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, উঠতে পারব না, শুধু কথা বলতে ও বুঝতে পারব। মরি মরব- এখানেই মরব; আমি যখন আমার দেহ-মন ব্রহ্মচারী বাবাকে সমর্পণ করেছি, তখন তিনি যা করেন, তাই হবে। তাতে এই দেহ যায় তো যাবে।

তারপর ব্রহ্মচারী বাবা জমিদারবাবুকে বললেন- তোর প্রারব্ধ কেটে গেছে, তবে এখানে শেষ নয় ; দীর্ঘদিন পরে এই রোগ আবার হবে, তখন আমি থাকব না। কিন্তু কিছুমাত্র ভাববি না, এইখানে এসে আমাকে স্মরণ করে এমনি করে দিনকতক থাকবি, তাহলেই তোর সঞ্চিত কর্মের ভোগ কেটে যাবে।

এইভাবেও আরও সাতদিন কেটে গেল। এরমধ্যে গাঁয়ের সবাই ও আত্মীয়-স্বজন সকলে জমিদারবাবুর ছেলেকে দোষ দিতে লাগল। বলাবলি করতে লাগল- বিপুল সম্পত্তি থাকলেও, ছেলে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে না। ছেলের মুখের সামনেও অনেকে একথা বলত।

ছেলে তখন লোকনিন্দায় অতিষ্ট হয়ে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে গিয়ে সব কথা জানাল। ছেলের পিতৃভ্কিত দেখে বাবা সন্তুষ্ট হয়ে তার সঙ্গে জমিদার বাবুর বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তার হাতটি বারিয়ে দিয়ে তাঁর মাথা স্পর্শ করে বললেন- আর তোকে শুয়ে থাকতে হবে না, উঠে বস। তোর সব রোগ সেরে গেছে, আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার সঙ্গে বেলতলা পর্যন্ত আয়; কোন ওষুধপত্রের দরকার হবে না।

একে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী, তার উপর প্রায় বারোদিন কোন কিছু খঅওয়া তো দূরের কথা, জল পর্যন্ত স্পর্শ করেন নি ; তবু জমিদারবাবু বাবাকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে দেহে বল পেলেন। তিনি প্রথমে বাবার পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বাবার হাত ধরে হাঁটতে লাগলেন।

এই ঘটনা স্বচক্ষে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মন থেকে স্বাভাবিক চিকিৎসার প্রতি সব মোহ দূর হয়ে গেল। এ ঘটনা যেমন আশ্চর্যজনক, তেমনি অলৌকিক। সে ছিল বিজ্ঞানের ছাত্র, সাধু-সন্ন্যাসী বা ঠাকুর দেবতার অলৌকিক শক্তিতে তার কোন বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু এই ঘটনায় তার মনের আমূল পরিবর্তন হলো, তার সব সংশয় কেটে গেল। ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি অকুণ্ঠ ভক্তি শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে গেল তার সমস্ত অন্তর।

তারপর ব্রহ্মচারী বাবা জমিদারবাবুকে বললেন- তোর প্রারব্ধ কেটে গেছে, তবে এখানে শেষ নয় ; দীর্ঘদিন পরে এই রোগ আবার হবে, তখন আমি থাকব না। কিন্তু কিছুমাত্র ভাববি না, এইখানে এসে আমাকে স্মরণ করে এমনি করে দিনকতক থাকবি, তাহলেই তোর সঞ্চিত কর্মের ভোগ কেটে যাবে।

<<লোকনাথ বাবার লীলা : দুই ।। লোকনাথ বাবার লীলা : চার>>

………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা

……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!