ভবঘুরেকথা

মঙ্গলাচরণ
হরিচাঁদ রূপে প্রভু ক্ষীরোদ ঈশ্বর।
কলির সন্ধ্যায় হল পূর্ণ অবতার।।
ধন্য গ্রাম ওড়াকান্দি ধন্য বঙ্গ দেশ।
হরিচাঁদে পেয়ে নাই আনন্দের শেষ।।
পূর্ব পূর্ব অবতার যত জন হ’ল।
জীবের তারণ মন্ত্র কেবা কি কহিল।।
সত্যদর্শী মুনিগণে ধ্যানে যাহা পায়।
জ্ঞানের মিশ্রণে কত গ্রন্থ যে রচয়।।
বেদ, শ্রুতি, স্মৃতি আদি সংহিতা নিচয়।
পরম পুরুষ তত্ত্ব সবে প্রকাশয়।।
আর্য ঋষি সাধনাতে যেই তত্ত্ব পায়।
জীবের কল্যাণ হেতু সব লিখে যায়।।
চারি আশ্রমেতে ভাঙ্গে মানব জীবন।
ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্যাদি আছে নিরূপণ।।
ব্রহ্মচর্য পালি’ নর শুদ্ধ শান্ত হয়ে।
পালিবে গৃহস্থ ধর্ম দারা পুত্র ল’য়ে।।
বৃদ্ধ কালে বনবাসী বানপ্রস্থ মতে।
ভিক্ষু হবে মনে প্রাণে জীবন সন্ধ্যাতে।।
চারি আশ্রমের ধর্ম পালি কুতূহলে।
নরের জীবন ধর্ম সৃষ্টি আদিকালে।।
ক্রমে ক্রমে কাল গর্ভে দিন হয় গত।
মানব গোষ্ঠীর বৃদ্ধি হল অগণিত।।
নানা মতে নানা পথে জীব হল ভিন্ন।
ভুলিয়া নিগুঢ় তত্ত্ব পাপে অবসন্ন।।
ত্রাহি ত্রাহি সাধু কুল ডাকে বারে বার।
সাধুর ক্রন্দনে ভবে নামে অবতার।।
পথ-ভোলা পথিকেরে লয় ঠিক পথে।
মানব জীবন তত্ত্ব শিখায় জগতে।।
চুম্বকের আকর্ষণে যথা লৌহ ধায়।
তেমনি জগৎ জীব কেঁদে পরে পায়।।
সকলে মঙ্গল গাহে অবতার প্রতি।
অবতার আগমনে শান্ত বসুমতি।।
নাশিয়া ধর্মের গ্লানি দুষ্কৃতি দমন।
যুগে যুগে অবতারে স্বকার্য সাধনে।
অন্তত ক্ষীরোদশায়ী কভু কোন দিনে।।
আসে নাই ধরাপরে জীবের কারণে।
রাম হ’ল কৃষ্ণ হ’ল যীশু মোহাম্মদ।
জ্ঞানি অবতার বুদ্ধ পরম সম্পদ।।
এক বাণী এক গান নানা দেশে দেশে।
গাহিল কহিল তাঁরা প্রভুর আদেশে।।
তাঁদের শিক্ষার মাঝে বুঝে দেখ ভাই।
ব্যাক্তিগত সাধনার আছে বটে ঠাঁই।।
ভক্ত হ’ল দাস হ’ল হ’ল উদাসীন।
গৃহস্থজনেরে সদা মনে করে হীন।।
গার্হস্থ্য আশ্রম শ্রেষ্ঠ সর্ব্বাশ্রম সার।
কোন দিনে বলে নাই কোন অবতার।।
অসার সংসার বলি গৃহাশ্রমে কয়।
সংসার করিলে ত্যাজ্য সেই ধন্য হয়।।
এই বাণী এই শিক্ষা এত কাল ধরি।
অবতার, ধর্ম গুরু এল অনসরি’।।
কামিনী কাঞ্চন দোঁহে ভক্তি পথে কাঁটা।
তাদের ত্যাজিলে ফুটে ভক্তি প্রেমচ্ছটা।।
নরকের দ্বার বলি নারীজাতিগণে।
ভয় নাই মাতৃত্বের প্রতি অসন্মানে।।
সম্ভবতঃ গৃহী যেন ধর্ম হ’তে দুরে।
এই চিন্তা এই ভাব সবার অন্তরে।।
ধর্ম যেন রহে সদা পর্বতে, গহনে।
অথবা ঋষির বুকে দূর তপোবনে।।
এই চিন্তা এই ভাব এত কাল ধরি।
আসিল মনুষ্য সব জীবন আচরি।।
সাধক সন্ন্যাসী যারা গৃহাশ্রম ছাড়ি।
দূরে থেকে যোগায় ভব পারের কড়ি।।
মায়া মোহ পাপ তাপ সব নাকি ঝুটি।
গৃহীর সম্পদ সব লয় ক্রমে লুটি।।
ভব পারে যেতে তার নাহি আর ভেলা।
একমাত্র তরী নাকি সাধু পদ ধুলা।।
ব্রহ্মচারী বানপ্রস্থি অথবা সন্ন্যাসী।
সকল গৃহস্থ ভাবে গলে মায়া রশি।।
মানব রূপেতে হল যত অবতার।
প্রথম পুরুষ রাম রাজার কুমার।।
পিতৃসত্য পালিবারে আপনি কাঙ্গাল।
বনবাসে কষ্ট সহে রাজার দুলাল।।
রাজার দুলালী সীতা জনক নন্দিনী।
পতি সেবা ব্রত সাধে সেজে কাঙ্গালিনী।।
ভরত লক্ষণ দোঁহে ভ্রাতৃভক্তি সাধে।
আত্মা সমর্পিয়া হনু পেল রামচাঁদে।।
আপন জীবনে প্রভু আদর্শ দেখাল।
জীবে শিক্ষা দিতে প্রভু কাঙ্গাল সাজিল।।
হনু চিনে নল মানে জানে বিভীষণ।
গুহক চন্ডাল পূজে রামের চরণ।।
সত্য বটে গৃহী এরা গৃহাশ্রমে ছিল।
গৃহাশ্রমবাসী সবে কিবা শিক্ষা পেল।।
রামের যতেক প্রজা অযোধ্যা নগরে।
মিথ্যা অপরাধে সীতা দেয় দূর করে।।
সুপবিত্রা সুচরিত্রা স্নেহময়ী সীতা।
গৃহে নাহি পেল ঠাঁই হ’ল নির্বাসিতা।।
এসব দেখিয়া মনে এই ভাব হয়।
রাম অবতারে গৃহী পেল না উপায়।।
নন্দের নন্দন রূপে কৃষ্ণ অবতার।
পান্ডবেরে নিয়ে করে লীলা চমৎকার।।
আদর্শ গৃহস্থ রাজা যুধিষ্ঠির রায়।
প্রেমে বাধ্য ভবারাধ্য কৃষ্ণ দয়াময়।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পরদুঃখে দুঃখী।
রাজ্য করে ধর্ম লাগি নহে আত্মসুখী।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব আর যে নকুল।
জেষ্ঠ ভ্রাতা সম পিতা এই ধর্ম স্থুল।।
সুভদ্রা দ্রৌপদী দেবী সতী শিরোমণি।
পতিই নারীর গতি জানে এই বাণী।।
পিতৃভক্ত অভিমন্যু বৃষকেতু আর।
কুন্তীমাতা সর্বোপরি সোনার সংসার।।
জানিল দেখিল সবে আপনার চোখে।
কোন জন রাখি নাই ধরি তাহা বুকে।।
পৃথিবী ছাড়িয়া গেল ভাই পঞ্চজন।
মায়াবদ্ধ নর সব হ’ল না চেতন।।
পাপ নাশে ধর্ম রাজ্য করিতে গঠন।
নররূপে জন্ম নিল শ্রী মধুসূদন।।
শিশুপাল দন্তবক্র কংস জরাসন্ধ।
মহামানী দুর্য্যোধন অসংখ্য প্রসঙ্গ।।
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে পরীক্ষা নির্ণয়।
অধর্মের চূর্ণ যথা ধর্মের বিজয়।।
গৃহিণী গোপিনী যত কৃষ্ণে বাসে ভাল।
গার্হস্থ্য আশ্রমে তারা কি কার্য করিল।।
কৃষ্ণ গেল নিজ লোকে ধর্ম রাজ্য গড়ি।
পান্ডবের অবসানে কলি এল বেড়ি।।
গার্হস্থ্য আশ্রমে কালি কলি দিল মেখে।
রাজা প্রজা সবে এক চুন-কালি মুখে।।
প্রচ্ছন্ন থাকিয়া সৎ সহে নির্যাতন।
যম কলি গ্রন্থ খন্ডে আছে বিবরণ।।
ঠেকিয়া জীবের দায় নরদেহ ধরে।
শ্রী চৈতন্য রূপে প্রভু এল মায়া পুরে।।
মনে মনে চিন্তে প্রভু পূর্ব পূর্ব বারে।
পাপেরে ধ্বংসিতে শুধু মারিনু পাপীরে।।
অবিচার আনাচার নাশিবার তরে।
মহাশিক্ষা দিনু জীবে কুরুক্ষেত্র ‘পরে।।
অধর্ম্মের প্রতিমূর্তি যত নৃপগণ।
ধর্মের অস্ত্রেতে করি সবাকে দলন।।
মনে ভাবি অধর্মেরে করিয়াছি লয়।
স্থান ত্যাজে যদু বংশে লইল আশ্রয়।।
অশান্ত যদু বালক কিছু নাহি মানে।
বংশ ধ্বংস বাঞ্ছা মনে করি একারণে।।
দ্বাপরের শেষ দেখি কলির উদয়।
অসমাপ্ত রাখি কার্য যাই নিজালয়।।
বিশ্ববাসী জীবগণে বড় ভালবাসি।
নরদেহে বারে বারে তাই হেথা আসি।।
দণ্ড দানে পাষণ্ডেরে জয় নাহি হয়।
প্রেম দানে পাষণ্ডেরে মজা’ব নিশ্চয়।।
নাম মধ্যে প্রেম দিব অনর্পিত যাহা।
পাপী তাপী সব বুঝে বিলাইব তাহা।।
এত ভাবি বিশ্বপতি কাঙ্গাল সাজিল।
পদে ধরি কাঁদি কাঁদি প্রেম বিলাইল।।
কামিনী কাঞ্চন দোঁহে প্রভু করে ত্যজ্য।
কৃষ্ণ ভক্তে করে প্রভু সবাকার পূজ্য।।
ঘর ছাড়ি হরি বলি প্রভু বাহিরিল।
সংসারের জীব কিন্তু সংসারে রহিল।।
গৃহীজন পক্ষে কাম্য কামিনী কাঞ্চন।
তাহা ছাড়ি দুরে যায় বল কয় জন।।
কামিনী কাঞ্চন বলো কিসে গুণহীন।
ধর্ম পথে পাল যদি উভে চিরদিন।।
কি জানি প্রভুর মনে কি ভাব আছিল।
গৃহ রল গৃহাশ্রমে প্রভু কেঁদে গেল।।
উৎকলে লীলা সাঙ্গ প্রভু যবে করে।
প্রাণাধিক নিত্যানন্দে বলে বারে বারে।।
ওরে দাদা নিত্যানন্দ বলি যে তোমায়।
মনের বাসনা মোর মনে রয়ে যায়।।
গৃহে থেকে যে সন্ন্যাসী গৃহহীন মত।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চিত।।
গৃহে আছে গৃহী জন কৃষ্ণগত প্রাণ।
ইহাই গৃহীর ধর্ম জানিবে সন্ধান।।
মাতা ছাড়ি বধু ছাড়ি গৃহে গৃহশূন্য।
আচরি সন্ন্যাস ধর্ম জীবগণ জন্য।।
আমার আদর্শ জীবে বুঝিতে না পারে।
গৃহ জুড়ে বদ্ধ জীব রহিল সংসারে।।
প্রতি অবতার সাথে যারা আছে ভাই।
তারাই কাঁদিয়া ফেরে তারাই তারাই।।
মায়া কুহকিনী ঘিরে দেবী বসুমতী।
আপন মায়ায় বাঁধে জীবের সংহতি।।
পরম সম্পদ ভাবি পৃথিবীর সুখ।
সুখেরে ভাবিয়া ডেকে আনে মহাদুঃখ।।
কিছুই নহেক মিথ্যা গৃহে কি বাহিরে।
সত্যকে দেখায় মিথ্যা শুধু ব্যবহারে।।
আমি তাই মনে ভাবি লীলা সাঙ্গ করি।
গৃহস্থে তারিতে পুনঃ নরদেহ ধরি।।
মম ইচ্ছা নাহি আর থাকিতে সংসারে।
ঘরে যাও নাম দাও ফিরে যাও ঘরে।।
আদর্শ গৃহীর ধর্ম দেখাও সাক্ষাতে।
গৃহস্থ গৃহস্থ হ’ক তব আদর্শেতে।।
এত বলি গোরাচাঁদ লীলা সাঙ্গ কৈল।
মনের কামনা যত মনে তাহা রৈল।।
তাই পুনঃ খেতরেতে শ্রী নিবাস রূপে।
লীলা করে গোরাচাঁদ পৃথিবীর বুকে।।
গৃহে থাকি ধর্ম রাখি গৃহস্থ সাজিল।
নরোত্তম রূপে নিত্যানন্দ জনমিল।।
চেয়ে দেখে চারিদিকে দুই মহাশয়।
পাপেতে আচ্ছন্ন ধরা নাহিক উপায়।।
আচরে গার্হস্থ্য নীতি নিত্যানন্দ যাহা।
মায়া মোহে জীব গণে ভুলিয়াছে তাহা।।
গোরার আদর্শ তত্ত্ব কেহ নাহি বুঝে।
গৃহ ছেড়ে গৃহী হ’য়ে মরে পাপে মজে।।
ঐ কারণ গোরাচাঁদ গৃহস্থ সাজিল।
নাম ধর্ম্ম প্রচারিতে বাসনা করিল।।
কালচক্রে সে বাসনা পূর্ণ নাহি হ’ল।
চৈতন্যের মতে কলি বহু মত দিল।।
যম কলি প্রভাব গ্রন্থে আছয় প্রমাণ।
শুষিল কলির দাপে হরিভক্তি বান।।
যদ্যপি কহয় কেহ এ কেমন বাণী।
শক্তিক্রমে অবতারে শ্রেষ্ঠ বলে জানি।।
অধর্ম্মের শক্তি তারে বল কোন গুণে।
ধর্ম্মের শক্তিকে ক্ষীণ করে দিনে দিনে।।
সংসার পরীক্ষা ক্ষেত্র জানহ নিপুণ।
পাপ আছে পুণ্য আছে আছে গুণাগুণ।।
মনরূপী চালকের পিছে জীব চলে।
জীব করে সেই কাজ মনে যাহা বলে।।
মন যদি সোজা চলে বলে সোজা পথ।
পুণ্য লাভে ধর্ম্ম মানি জীব হয় সৎ।।
বক্রপথে চলে যদি মন দিশাহারা।
পাপে তাপে মগ্ন হয়ে জীব হয় সারা।।
মনেরে দেখাতে পথ জীবেরে তরা’তে।
যুগে যুগে আসে প্রভু এই অবনীতে।।
তার আগমনে মনে জ্বলে জ্ঞান বাতি।
জীবেরে তারেণ প্রভু দিয়ে ধর্ম্ম নীতি।।
আরো আছে গূঢ় কথা শুনিতে অপূর্ব্ব।
কলি শক্তি কেন করে ধর্ম্ম শক্তি খর্ব্ব।।
অংশকলা অবতার হয় যুগে যুগে।
স্বয়ং এর অবতার হল কোন যুগে।।
যারা অবতার হল সকলি অপূর্ণ।
পূর্ণ শক্তি বিনা কভু কলি নহে জীর্ণ।।
মানবের আচরণে আছয় প্রমাণ।
শত্রু প্রতি ক্ষুদ্র শক্তি আদি অভিযান।।
যে শক্তি নাশিতে লাগে যতখানি শক্তি।
তাই দিয়া শত্রু ক্ষয় মহাজন যুক্তি।।
অংশ অবতারে যত সুনীতি কহিল।
শক্তিমান মহাকলি সকলি নাশিল।।
মহাশক্তি দানিবারে সেই লক্ষ্মীপতি।
ক্ষীরোদ ছাড়িয়া এল ভক্ত সংহতি।।
সুযুক্তি বিধানে দিল ভক্তগনে শিক্ষা।
হরিনাম মহামন্ত্রে জীবগণে দীক্ষা।।
আদর্শ দানিতে নিজে সাজিল গৃহস্থ।
গৃহাশ্রমে পেল ঠাঁই ন্যাসী বানপ্রস্থ।।
এতকাল যতবার অবতার হয়।
জগতে জানায় শিক্ষা জানিও নিশ্চয়।।
অন্তরঙ্গ সঙ্গে লয়ে করে গুঢ় লীলা।
জগতের জীবে নাহি জানে মর্ম্ম খেলা।।
আপনা বিচ্ছিন্ন রাখি আদর্শ রূপেতে।
জীবদলে পলে পলে বলে ভাল হতে।।
অকূল সমুদ্রে যেন তরী দিয়া সাথে।
পাঠায় শিশুকে পিতা বৈঠা দিয়া হাতে।।
বলে দেয় “এই ভাবে তরী বেয়ে যাও।
সন্ধ্যা না লাগিতে সুখে ঘাটে উতরাও “।।
কথাতে কি কাজ দিবে হাতে নহে শিক্ষা।
যাহা নাহি আচরণে কি তার পরীক্ষা।।
অনন্ত ক্ষীরোদশায়ী শ্রী হরি ঠাকুর।
করিল আশ্চর্য লীলা মধুর মধুর।।
এই লীলা খন্ড নহে, পূর্ণ চারি ভিতে।
গৃহস্থ সন্ন্যাসী মিশে বসে এক সাথে।।
আদর্শ করিল প্রভু গৃহস্থ আশ্রমে।
গৃহাশ্রম শ্রেষ্ঠ কথা বলি ক্রমে ক্রমে।।
অন্য অন্য যে আশ্রম অবনী ভিতরে।
সকলে নির্ভর করে গৃহীর উপরে।।
গৃহী দেয় অন্ন জল গৃহী দেয় অর্থ।
গৃহীর স্বার্থেতে যুক্ত সর্ব্ব জীব স্বার্থ।।
বনে থাকি যে সন্ন্যাসী করে উপাসনা।
গৃহী নাহি দিলে খেতে পরাণে বাঁচেনা।।
পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে নাকি যোগী ন্যাসী যত।
অনাহারে অনিদ্রায় সাধনা করিত।।
কলিতে অল্পায়ুঃ জীব অল্পেতে মরণ।
কঠোর সাধন সাধ্য নহেত কখন।।
ব্রহ্মচারী যত জন পালে ব্রহ্মচর্য।
গৃহীকে ধরিয়া বাঁচে নহে তো আশ্চর্য।।
তপেতে করিত বিঘ্ন নিশাচরগণ।
রক্ষিত তপস্বী যত আর্য নৃপগণ।।
আদর্শ গৃহস্থ বটে নৃপগণ হয়।
যোগী ন্যাসী সবে বাঁচে গৃহীর কৃপায়।।
সর্ব্বাশ্রম মূল হয় আশ্রম গার্হস্থ্য।
পবিত্র করিতে তারে করিতে প্রশস্ত।।
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম্ম করিয়া স্থাপন।
তার সাথে জুড়ি দিতে অন্যাশ্রমিগণ।।
দেহ ঠিক করি দিয়ে নামামৃত মধু।
পূর্ণ লীলা পূর্ণ শিক্ষা পূর্ণ কোটি বিধু।।
হরিচাঁদ রূপে হরি অবতীর্ণ হ’ল।
গৃহীকে শিখাতে ধর্ম্ম গৃহস্থ সাজিল।।
“হরি লিলামৃত” গ্রন্থে কবি রসরাজ।
শ্রী তারকচন্দ্র পূজ্য সাধুর সমাজ।।
মীমাংসা করিয়া লিখে হরি গুহ্য লীলা।
কি কারণে হরিচাঁদ জগতে আসিলা।।
‘যুগ অবতার’ খন্ডে প্রস্তাবনা শীর্ষে।
আনন্দেতে লিখে তিনি মনের হরিষে।।
গৃহীর যতেক কর্ম্ম আপনি করিলা।
আপনি করিয়া কর্ম্ম জীবে শিখাইলা।।
অনর্পিত প্রেম দিতে ইচ্ছা করে মনে।
গৃহ ছেড়ে জগজ্জীবে দিতে প্রেমধনে।।
আদর্শ গৃহস্থ রূপে সঙ্গে কোন জনে।
রাখিতে ইচ্ছেন প্রভু নিজে মনে মনে।।
এই ভার কাকে দিবে মনে ইচ্ছা করে।
মহাকাল মহেশ্বরে স্মরিল সত্বরে।।
দণ্ডবৎ করি দেব ভোলা মহেশ্বর।
প্রভুর সম্মুখে আসি দাঁড়া’ল সত্বর।।
প্রভু কন “মহাকাল তুমি মহেশ্বর।
পূর্ণ অবতার আমি ক্ষীরোদ ঈশ্বর।।
অর্দ্ধকর্ম্ম ভার ইথে আমি তোমা দিব।
পিতা পুত্র রূপে দোঁহে জগত তরা’ব।।
হরিচাঁদ রূপ আমি যবে সম্বরিব।
তোমার মধ্যেতে শক্তি রূপে সদা র’ব।।
সে কারণে ডাকি তোমা দেব মহেশ্বর।
তোমার যে নিতে হবে মম কর্ম্ম ভার।।
প্রভুর আদেশ শুনি মহাকাল যিনি।
আপনা মানিয়া ধন্য লোটায় অবনী।।
কেন্দে বলে সর্ব্ব মূলাধার স্বামী তুমি।
তব ইচ্ছা পূর্ণ হোক ভিক্ষা চাই আমি।।
যুগে যুগে এ ভোলারে সাথে সাথে রেখে।
করেছ কতই দয়া তুলনা দেয় কে।।
প্রভু হলে দাস হ’লে হইলে বাহন।
পুত্র হ’লে মিত্র হ’লে পতিত পাবন।।
যদ্যপি তোমার পুত্র ইথে ভুল নাই।
মানব আকারে পুত্র হ’তে আমি চাই।।
আর অঙ্গীকার মোর আছে ত্রেতাযুগে।
রাম ভক্ত মহাবীর হনুমান আগে।।
সকলিত জানো প্রভু তবু তব ঠাঁই।
মনের সকল কথা বলিবারে চাই।।
যবে রাজা দশানন সীতাকে হরিল।
অশোক কাননে রাখি কত দুঃখ দিল।।
রামগত প্রাণ হনু সীতার তালাসে।
বহুকষ্টে লঙ্কাপুরে গেল অবশেষে।।
নিজ পরিচয় দেয় জননীর কাছে।
“রামদাস হনুমান পদাশ্রয় যাচে।।”
অন্তরে জানিলা সীতা হনু রামদাস।
তথাপি লৌকিক ভাবে না করে বিশ্বাস।।
অভিজ্ঞান আনিবারে বলে হনু ঠাঁই।
আজ্ঞা মাত্রে হনু বলে মাতা তবে যাই।।
পলকে রামের পদে প্রণমিল হনু।
আনন্দে বলিছে বাণী রোমাঞ্চিত তনু।।
“জগত আরাম রাম! পদে নিবেদন।
সফল জীবন মোর আমি অভাজন।।
তোমার দয়াতে প্রভু ভাগ্যের লিখন।
কৃপা ক্রমে পাই অদ্য মাতৃ দরশন।।
অশোক নামেতে বন লঙ্কাপুর মাঝে।
জনক নন্দিনী সেথা কাঙ্গালিনী সাজে।।
কোটি ব্রহ্মা শিব আদি পূজে যে চরণ।
দুষ্ট রাবণের চেড়ি করিছে শাসন।।
সক্রোধে উন্মত্ত আমি হইনু তখনে।
দন্ড নাহি দিনু মাত্র মায়ের বারণে।।
নিজ পরিচয় দিই মাতার নিকটে।
আমি যে রামের দাস বলি অকপটে।।
মনে মনে জানে মাতা আমি বুঝি ভালো।
তথাপি তোমার কাছে আমারে পাঠা’ল।।
পরিচয় চিহ্ন কিছু দেহ মম ঠাঁই।
মাতার সান্নিধ্যে আমি এক লম্ফে যাই।।”
হনুর বচন শুনি রাম দয়াময়।
নিজ অঙ্গুরীয় খুলি হনু হস্তে দেয়।।
“নিয়ে যাও হনুমান মম প্রিয়া আগে।
বলো তার স্মৃতি মম চিত্তে সদা জাগে।।”
রামের অঙ্গুরী পেয়ে বীর হনুমান।
অলঙ্ঘ্য সাগর যবে উত্তরিতে যান।।
তোমার চক্রেতে প্রভু পরে তাহা জলে।
ধরিতে অঙ্গুরী হনু ডুবিল সলিলে।।
বসিয়া অন্তত কাল ক্ষীরোদ সাগরে।
তোমার চরণ ধ্যান করি একান্তরে।।
দৈববাণী বলি দেব বলিলে আমারে।
‘চক্ষু মেলি দেখ ভক্ত পবন কুমারে।।
আদেশে নয়ন মেলি দেখিনু সম্মুখে।
বসিয়াছে বীরবর অবনত মুখে।।
রামের অঙ্গুরি দেখি মম ক্রোড় পরে।
আশ্চর্য হইয়া স্বপ্ন দেখিনু অন্তরে।।
বহুযুগ ধরি যেন ধ্যান মগ্ন থাকি।
অনন্ত রামের লীলা কতবার দেখি।।
কত রাম আসে যেন কত হনুমান।
তুমি কেবা কেহ নাহি রাখে সে সন্ধান।।
শুনা’তে তোমার কথা তাই ভাবালাপে।
বলিনু হনুর ঠাঁই বাণীর প্রলাপে।।
কত রাম আসে হনু কত রাম যায়।
বলিতে কি পার হনু কাহার ইচ্ছায়।।
আমার বচন শুনি সেই ভক্ত বীর।
প্রেমে পুলকিত তনু চক্ষে বহে নীর।।
মনে ভাবে হনুমান ভক্তি রসে পোরা।
আমি বুঝি পূর্ণ হরি সর্ব্ব রসে ভরা।।
ভক্তির নিগড় দেখি আমি অন্তর্ধান।
দৈববাণী বলি রাখি হনুর পরাণ।।
তখন প্রতিজ্ঞা করি কলির সন্ধ্যায়।
তব সাথে হনু দেখা হইবে নিশ্চয়।।
তুমি আসিয়াছ নাথ হনু আসিয়াছে।
তোমার সংহতি যত সব মিলিয়াছে।।
তব আজ্ঞা ক্রমে জন্ম লব তব ঘরে।
শান্তি মাতা ক্রোড়ে যেন র’ব শান্তিপুরে।।
যা কর করিবে তুমি আমি যে নিমিত্ত।
সকলের প্রভু তুমি আমি দীন ভৃত্য।।
সেই মহাকাল দেব মহেশ্বর যিনি।
হরিপুত্র গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী তিনি।।
পিতার আদেশে রাখে পিতৃধর্ম্ম যাহা।
আদর্শ গৃহস্থ রূপে সর্ব্বমূল তাহা।।
যবে হরিচাঁদ রূপ প্রভু সম্বরিল।
হরিচাঁদ শক্তি গুরুচাঁদেতে মিশিল।।
হরি লীলামৃত গ্রন্থে সমাপন পর্ব্বে।
কবি রসরাজ ডাকি বলিলেন সর্ব্বে।।
যেই দিন হরিচাঁদ দেহ তেয়াগিল।
অন্তরঙ্গ ভক্ত কত নিকটেতে ছিল।।
সকলে কাঁদিয়া বলে হরিচাঁদ ঠাঁই।
কি হবে উপায় বাবা বল আজি তাই।।
ঠাকুর বলেন শুন সব ভক্ত গণ।
নিশ্চয় জানিও মম নাহিক মরণ।।
কায়া মাত্র পরিত্যাগ হবে এই কালে।
গুরুচাঁদে রবে শক্তি জানিও সকলে।।
যে জন করিবে ভক্তি গুরুচাঁদে মোর।
মোরে ভক্তি করা হবে যাবে মায়া ঘোর।।
গুরুচাঁদ আর মোরে যেবা ভিন্ন দেখে।
উপায় নাহিক তার রবে কুম্ভি পাকে।।
এতেক কহিয়া প্রভু কায়া ত্যাগ করে।
পূর্ণ শক্তি নিয়া রহে শ্রী গুরু মাঝারে।।
আর কথা আছে জানা কবি রসরাজ।
স্বচক্ষে দেখিলা যাহা প্রচারিত আজ।।
যবে দেহ ত্যাগ করি হরিচাঁদ যায়।
রসরাজ কবিগান করে সে সময়।।
যশোহর জেলাধীনে বড়দিয়া নাম।
প্রকান্ড বন্দর সেথা সুন্দর সুঠাম।।
কবিগান সারারাত্রি হয় সেই খানে।
প্রভাতে জানায় কেহ তারকের স্থানে।।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ আছে নদী তীরে।
আজ্ঞা করিয়াছে সেথা যেতে তারকেরে।।
আজ্ঞা শুনি ব্যস্ত হয়ে কবি রসরাজ।
যাত্রা করে নদী ভিতে নাহি সহে ব্যাজ।।
দেখে দূরে দাঁড়াইয়া প্রাণের ঠাকুর।
অব্যক্ত সুন্দর রূপ মধুর মধুর।।
অপার আনন্দে প্রাণ পরিপূর্ণ হল।
আপনা ভুলিয়া সাধু ছুটিতে লাগিল।।
প্রভুর নিকটে পৌঁছি বাহু প্রসারিয়া।
প্রভুকে ধরিতে গেল আনন্দে মাতিয়া।।
হায় হায় কিবা হল প্রভু নিরুদ্দেশ।
বালু পরে পদচিহ্ন দেখা মাত্র শেষ।।
আকুল হইয়া সাধু কান্দিয়া উঠিল।
নিশ্চয় বুঝিল প্রভু লীলা সাঙ্গ কৈল।।
আছাড়ি পাছাড়ি সাধু ভূমে লুটি পরে।
কোথা প্রভু হরিচাঁদ ছাড়ি গেলা মোরে।।
সাধুর ক্রন্দনে প্রভু শূন্য বাণী ভরে।
ডাকি বলে হে তারক ফিরে যাহ ঘরে।।
পরম ভক্ত তুমি তারক রসনা।
লীলা সাঙ্গ হল এবে দেখা ত হবে না।।
শূন্য বাণী শুনি সাধু মূর্চ্ছা প্রায় হল।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া তবে বলিতে লাগিল।।
হায় হায় দুরদৃষ্ট আমি মহাপাপী।
আর না হইবে দেখা হেন তাপি তাপী।।
চর্ম্ম চক্ষে আর দেখা হবে না প্রভুর।
এই তাপে মরি জ্বলে প্রাণের ঠাকুর।।
ও হো রে অভাগা প্রাণ কেন রহ দেহে।
গৃহত্যাগি হব এবে কাজ নাই গৃহে।।
যে দেশে নাহিক মোর প্রাণের ঠাকুর।
আর না রহিব সেথা চলে যাব দূর।।
পরাণ পুতুল হরি গেছ যেই দেশে।
সে দেশে খুঁজিব আমি কাঙ্গালের বেশে।।
পরাণ পুতুল হরি পরাণ পুতুল।
হরি বিনে দিবারাত্রি পরাণ আকুল।।
হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি মোর প্রাণ।
বিনে হরি নাহি মরি এমনি পাষাণ।।
যেই দেশে গেছ হরি হরিচাঁদ মণি।
আমাকে না নিলে সাথে মরিব এখনি।।
এতেক বিলাপ করে কবি চূড়ামণি।
শূন্যে থেকে বলে তারে হরি রসখনি।।
“শুন শুন হে তারক! কাঁদ কেন মিছে।
মম শক্তি গুরুচাঁদে সকলি মিশেছে।।
কায়া মাত্র ছাড়িয়াছি রহিয়াছে শক্তি।
আমাকে পাইবে কৈলে গুরুচাঁদে ভক্তি।।
গুরুচাঁদে আছি আমি এই ঠিক জানো।
আমাকে ভাবিয়া সবে গুরুচাঁদে মানো।।
মহেশ্বর গুরুচাঁদ সর্ব্ব শক্তিমান।
গুরুচাঁদ দেহে আমি করেছি প্রয়াণ।।
আর শুন গূঢ় কথা তারক গোস্বামী।
যেথা র’বে গুরুচাঁদ তথা র’ব আমি।।
ওড়াকান্দি চলি যাও গুরুচাঁদ কাছে।
গুরুচাঁদ রূপে তব হরিচাঁদ আছে।।”
এত বলি শূন্য বাণী শুন্যেতে মিশায়।
শান্ত হয়ে সে তারক গৃহে ফিরি যায়।।
গৃহ হ’তে চলে সাধু ওড়াকান্দী বাড়ি।
গুরুচাঁদে দেখে কাঁদে ভূমেতে আছাড়ি।।
ডেকে বলে গুরুচাঁদ “কবি রসরাজ!
ওড়াকান্দী এসে বল আর কিবা কাজ।।
তোমাদের সে ঠাকুর গেছে নিজ দেশে।
ঠাকুর বিহীন দেশে কিবা কাজ এসে।।
কত কষ্টে গড়ে চক্র মধুপ সকল।
মধু পূর্ণ চক্র গুহা করে টলমল।।
মধুপ উড়িয়া যায় মধু পান হ’লে।
শূন্য চক্র পড়ি রহে শুধু অবহেলে।।
শুন্য চক্রে বল দেখি মধুপ কি যায়।
কালের অবাধ স্রোতে চক্র ধ্বংস হয়।।
তেমতি জানিবে এ ধাম ওড়াকান্দী।
হরি বিনে শূণ্য ধাম উঠে কান্দি কান্দি।।
হরি ছিল রসসিন্ধু প্রেম রসে ভরা।
জুড়া’ত তাপিত প্রাণ সর্ব্ব হারা যারা।।
আমার জনম ধন্য শুধু এই বলে।
তাঁর ঘরে জন্মিছিনু তাঁর কৃপা বলে।।
যাঁর প্রেম যাঁর ভাব সেই রসময়।
সাথে করে নিয়ে গেছে কি করি উপায়।।
তোমরা তাহার ভক্ত আছ যত জন।
সবাকার কাছে কহি এই বিবরণ।।
তোমাদের সে ঠাকুর গেছে নিজ দেশে।
কিবা কাজ আছে আর ওড়াকান্দী এসে।।
আপনি খুঁজিয়া লহ পরম পুরুষ।
খুঁজিলে পাইতে পার মনের মানুষ।।
আমি দেখ গৃহবাসী গৃহস্থ সরল।
নাহি জানি প্রেম তত্ত্ব নাহি কোন বল।।
হরি ছিল প্রেম দাতা বেদন নাশন।
তাঁহারে দিখিলে শান্ত হইত জীবন।।
মনোরম্য কারী হরিচাঁদ রসময়।
তাঁর কাছে এলে যেত সকল সংশয়।।
আমি গৃহী তার তত্ত্ব নাহি জানি।
মোর কাছে কেন এলে বল দেখি শুনি।।
আমার পিতার ভক্ত কবি চুড়ামণি।
পরম সাধক বলে আমি তোমা গণি।।
তোমার হরিত প্রাণ সেই হরিশ্চন্দ্র।
অস্তমিত হের আজি সেই পূর্ণ চন্দ্র।।
হরি নাই শুন তাই কবি রসরাজ।
ওড়াকান্দী এসে বল কিবা ফল আজ।।
তাই বলি হে তারক! যাহ নিজ ঘরে।
ইচ্ছা হলে মাঝে মাঝে দেখে যেও মোরে।।
এতেক বলিলা যদি প্রভু জগন্নাথ।
তারক কান্দিয়া বলে জুড়ি দুই হাত।।
“ওহে বাবা গুরুচাঁদ দিও না’ক ফাঁকি।
তুমি যে কে বুঝিবারে কিছু নাই বাকি।।
মোর হরি যায় নাই আছে হরি হেথা।
শূন্য বাণী ভরে প্রভু বলেছে সে কথা।।
হরিচাঁদ কায়া বটে আজি নাহি দেখি।
তব কায়া মধ্যে সে যে দেয় ঝিকিমিকি।।
তোমা মধ্যে মোর হরিচাঁদ মিশিয়াছে।
পূর্ণ চন্দ্র রূপে অন্ধকার নাশিয়াছে।।
যে দিন করিলা প্রভু সাঙ্গ নরলীলা।
বড়দিয়া নদী তটে বহুত কহিলা।।
তোমা মধ্যে আছে প্রভু এ বাণী বলে।
দয়া করি অভাগারে দিও না’ক ঠেলে।।
যেই হরিচাঁদ মোর সেই গুরুচান।
হরি গুরু অভেদাত্মা ইথে নহে আন।।
অন্ধ জীব বদ্ধ মোহে তোমা চেনা ভার।
আপনা সারিয়া প্রভু রাখিও না আর।।
আমার ঠাকুর আছে কভু যায় নাই।
আমারি ঠাকুর তুমি পদে দেহ ঠাঁই।।
এতেক বলিয়া সাধু পড়ে ভূমিতলে।
কান্দিতে লাগিল সাধু হরি-গুরু বলে।।
হস্তে ধরে গুরুচাঁদ তারে তুলে ধরে।
অনেক কহিয়া শান্ত করে তারকেরে।।
এ সব দেখিয়া মনে এই ভাব হয়।
অভিন্নাত্মা হরি-গুরুচাঁদ দয়াময়।।
দুই দেহে এক আত্মা হ’ল পিতা পুত্র।
কলুষ-পূরিত ধরা করিল পবিত্র।।
আর যে প্রমাণ আছে ক্রমে ক্রমে বলি।
যাহা কিছু গুরুচাঁদে আছে গুণাবলী।।
অনন্ত অশেষ গুণ শেষ নাহি যার।
কণামাত্র বলি আমি কৃপাও তাঁহার।।
কি জানি কি ছল ক্রমে প্রভু একদিন।
উপস্থিত জয়পুরে যেন উদাসীন।।
কবি রসরাজ শ্রী তারক চন্দ্র নাম।
উপনীত হইলিন তাঁহার আশ্রম।।
অমৃত মুখুয্যে নামে নৈকষ্য কুলীন।
শুদ্ধ শান্ত ভক্তি মন্ত শাস্ত্র পাঠে লীন।।
সম্মিলনী হাইস্কুল জিলা যশোহরে।
প্রধান শিক্ষক রূপে তথা কার্য করে।।
দৈবেতে দর্শন করে সেই মহাশয়।
তারকের গৃহ মধ্যে শ্রী গুরু উদয়।।
আজানুলম্বিত ভূজ চৌরাশ কপাল।
করুণা পূরিত চন্দ্র বদন কমল।।
রক্ত-রাগ-যুত শোভে চরণ যুগল।
আয়ত লোচন যুগ প্রেমে ঢল ঢল।।
গৌরাঙ্গ বরণ প্রভু গোরাচাঁদ প্রায়।
কোটি চন্দ্র ঘিরি যেন রহে পাহারায়।।
অপরূপ রূপ হেরি সেই দ্বিজ সুত।
আপনা ভুলিয়া হ’ল প্রেমেতে আপ্লুত।।
আচম্বিতে পদযুগে প্রণাম করিল।
কি করো, কি করো প্রভু বলিয়া উঠিল।।
‘বর্ণ শ্রেষ্ঠ ব্রহ্ম কুলে তুমি অভিজাত।
হীন নমঃশূদ্রে কেন করো প্রণিপাত।।’
ছল ছল আঁখি যুগ কহিছে ব্রাহ্মণ।
কেন নমি, শুন প্রভু সেই বিবরণ।।
সত্য বটে কুল শ্রেষ্ঠ মুখ বংশ জাত।
মোর চরণেতে করে দ্বিজে প্রণিপাত।।
ছল ছল আঁখি যুগ কহিছে ব্রাহ্মণ।
কেন নমি, শুন প্রভু সেই বিবরণ।।
বর্ণ মধ্যে শ্রেষ্ঠ বটে ব্রাহ্মণ প্রধান।
নর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কিন্তু পুরুষ মহান।
পুরুষ মহান যেই পরা শক্তি ধরে।
দ্বিজ শূদ্র সবে ক্ষুদ্র তাঁহার গোচরে।।
পুরুষ রতন তুমি পরা শক্তিশালী।
তোমারে ঘিরিয়া আছে মহা চিহ্নাবলী।।
মানবে সম্ভব নহে এসব লক্ষণ।
নিশ্চয় মানিনু তুমি দেব নারায়ণ।।
কুল গর্বে গর্বী মোরা দেখি না নয়নে।
আমি বড় আমি বড় নিত্য ভাবি মনে।।
ব্রহ্মকে জানে তারে ব্রাহ্মণ যে কয়।
ভক্তি বিনে বল কবে ব্রহ্ম দেখা যায়।।
“তৃণাদপি সুনিচেন” ভক্তির লক্ষণ।
এই শুদ্ধ নীতি বল কে মানে এখন।।
ব্রাহ্মণ কুলেতে মোরা যত অহংকারী।
পদ ধূলি দানে মোরা সবে ধন্য করি।।
ব্রহ্ম শক্তি আজি তাই দ্বিজ সুতে ছেড়ে।
রয়েছে ভক্তের দেহে ভক্তি রূপে বেড়ে।।
তব মাঝে ব্রহ্ম রাজে আমি দেখিয়াছি।
স্বয়ং ব্রহ্ম ভাবি তোমা প্রণাম করেছি।।
এই মত দ্বিজ সুত স্তব স্তুতি কৈল।
তার ভক্তি দেখি প্রভু আনন্দিত হৈল।।
হস্তে ধরি গুরুচাঁদ তাহাকে বসায়।
হাসি হাসি তার সাথে তত্ত্ব কথা কয়।।
বহু আলাপন পরে দ্বিজ চলি গেল।
যারে দেখে তার কাছে এ বার্তা কহিল।।
আরও ঘটনা এক শুন দিয়া মন।
কিসে গুরুচাঁদ হ’ন পতিত পাবন।।
ডুমুরিয়া গ্রাম মহাভারতের নারী।
উত্তরিল ওড়াকান্দী পুত্র কোলে করি।।
মৃত প্রায় জীর্ণ শিশু জ্বরে অচৈতন্য।
অস্থি চর্ম্ম সার তার বিকারে আচ্ছন্ন।।
প্রভুর সম্মুখে সেই শিশু পুত্র রাখি।
কাঁদিতে কাঁদিতে বলে “ওগো কমলাখি”।।
মরা ছেলে পদতলে আমি আনিয়াছি।
ইহাকে বাঁচালে প্রভু তবে আমি বাঁচি।।
নারীর ক্রন্দন শুনি গুরুচাঁদ বলে।
“ভয় নাই এ শিশুরে লহ তুমি তুলে।।
এ ছেলের মৃত্যু নাই বলিলাম আমি।
সপ্তাহ পরেতে যাবে এই রোগ থামি”।।
প্রভুর বচন শুনি দুঃখিনী রমণী।
কাঁদিতে লাগিল ধনি লোটায়ে ধরণী।।
প্রভু বলে শঙ্কা নাই আমি দিনু বলে।
“ছেলে যদি মরে তবে আমি হব ছেলে”।।
হরি লীলামৃত গ্রন্থে প্রমাণ রয়েছে।
নিজে রসরাজ যেথা বর্ণনা করেছে।।
প্রভুর অভয় বাণী ভব ভয় হরে।
আশার সঞ্চার হ’ল নারীর অন্তরে।।
সপ্তাহ পরেতে সেই শিশু সুস্থ হ’ল।
দিব্য কান্তি লভি শিশু হাসিতে লাগিল।।
যার বিনা আদেশেতে ধূলি নাহি নড়ে।
তার আজ্ঞা ক্ষুদ্র রোগ এড়া’তে কি পারে।।
আর ত প্রমাণ এক পড়ে গেল মনে।
গোস্বামী গোলক যাহা দেখিল জীবনে।।
হরিচাঁদ কায়া প্রভু যবে তেয়াগিল।
প্রেমে বাধ্য সে গোলক ওড়াকান্দী ছিল।।
এক বস্ত্র দীন বেশে হরিচাঁদ রহে।
সেই বেশে গুরুচাঁদ বাধ্য কিন্তু নহে।।
বাহিরে ঐশ্বর্য প্রভু কাঙ্গাল অন্তরে।
গোলক সে ভাব কিন্তু বুঝিতে না পারে।।
মনে ভাবে সে গোলক এই কিবা ভাব।
না ছিল হরির কভু এ হেন স্বভাব।।
এই রঙ্গ গুরুচাঁদ কেন করে তবে।
অর্ন্তযামী হ’লে মন অবশ্য বুঝিবে।।
আমরা কাঙ্গাল সবে শ্রী হরির গণ।
ঐশ্বর্যের পূজা মোরা না করি কখন।।
জুরি গাড়ী টাকা কড়ি অসার সকল।
সর্ব্ব ধন হ’তে শ্রেষ্ঠ নামামৃত ফল।।
তবে কেন গুরুচাঁদ মত্ত ধনে জনে।
এহেন দেহেতে প্রভু আসিল কেমনে।।
ভকত বৎসল প্রভু ভক্ত প্রতি দয়া।
দূর করে ভক্ত হ’তে অহংকার ছায়া।।
তমঃ যদি ঘিরে কভু নিজ ভক্ত জনে।
তমঃ দূর করে প্রভু বিবিধ বিধানে।।
গোলকের ভাব বুঝি প্রভু গুরুচাঁদ।
কৃপা করি হরিলেন তার মনোসাধ।।
যেই দিন সে গোলক এই ভাবে মনে।
অন্তর্যামী গুরুচাঁদ জানিল তখনে।।
পরদিন প্রাতঃকালে দয়াল আমার।
বাহ্য বেশ ভূষা সব করে পরিহার।।
ছিন্ন কান্থা গাত্রে ধরি কাঙ্গালের বেশে।
বসিলেন গুরুচাঁদ মন্দিরের পাশে।।
ভষ্ম মাঝে অগ্নি যথা জ্বল জ্বল জ্বলে।
অথবা মানিক শোভে সাগরের তলে।।
মেঘ আবরণে যথা পূর্ণচন্দ্র শোভা।
সেই মত বসে প্রভু ভক্ত মনোলোভা।।
গোস্বামী গোলক হেথা প্রাতঃস্নান করি।
মন্দিরতে যায় মুখে “শ্রী হরি” “শ্রী হরি”।।
হরিচাঁদ রূপ রসে মন ডুবাইয়ে।
গোস্বামী গোলক চলে প্রেমে মত্ত হয়ে।।
পাখীর কাকলী গান দশ দিশি ভাসে।
মাতিয়া উঠিল প্রাণ ফুলের সুবাসে।।
মলয় সমীরে স্নিগ্ধ তাপিত হৃদয়।
হেলিয়া দুলিয়া সাধু হরি গুণ গায়।।
“জয় হরিচাঁদ” বলি পুলক অন্তরে।
উদয় হইল সাধু মন্দিরের দ্বারে।।
বারেক চাহিয়া দেখে মন্দির চত্বরে।
ভাবে মত্ত গুরুচাঁদ আপনা ভিতরে।।
কিবা সে রূপের শোভা কহন না যায়।
পালটিতে নারে আঁখি ভরেছে হৃদয়।।
স্বেদ কম্প পুলক শরীর অবসন্ন।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ দেখিল অভিন্ন।।
দীন বেশ ধারী যেন সেই হরিচাঁদ।
গুরুচাঁদ দেহে ভরা ক্ষীরোদের চাঁদ।।
সংশয় হইল দূর মনেতে আনন্দ।
পদে পড়ি কেঁদে বলে শ্রী গোলক চন্দ্র।।
“অন্তরের ধন তুমি কত দিবে ফাঁকি।
তোমার লীলার খেলা আমি বুঝি নাকি।।
তব লীলা বোঝে সাধ্য আছে হেন কার।
ব্রহ্মা, শিব নাহি জানে মানব কি ছার।।
মনে মনে সে সন্দেহ করিয়াছি আমি।
গর্ব দূর করি দিলে প্রভু অন্তর্যামী।।
গুরুচাঁদ তত্ত্ব মাত্র হরি রূপান্তর।
যে শক্তি সে শক্তি আছে বিভিন্ন আকার।।
নিশ্চয় জানিনু প্রভু তুমি যাও নাই।
তুমি আছ মোরা শুধু বুঝিয়া না পাই।।
ভ্রান্তি দূর গোলকের চিত্ত সুনির্ম্মল।
গুরুচাঁদে চিনি করে জনম সফল।।
এমত অনন্ত আছে অনন্ত প্রমাণ।
যাহা সবে গুরুচাঁদে বলে ভগবান।।
সে সব বৃত্তান্ত পরে প্রকাশ করিব।
গুরু কৃপা বলে আর প্রমাণ কহিব।।
মূক মুখে বাণী ছোটে পঙ্গু লঙ্ঘে গিরি।
অন্ধ লভে দিব্য দৃষ্টি পেয়ে কৃপাবারি।।
অপুত্রকে পায় পুত্র মূর্খ মহা জ্ঞান।
যাঁর করুণায় হয় এসব সন্ধান।।
সেই সে পরম ধন পরম কারণ।
বেদ ও বেদান্ত করে যাঁহারে ধারণ।।
গুরুচাঁদ সেই প্রভু ইথে নাহি ভুল।
কারণ-কারণ তিনি এই জানো মূল।।
লীলাকালে হরিচাঁদ যে সব করিল।
তদাপেক্ষা বেশী কার্য শ্রী গুরু সাধিল।।
অপুত্রক পুত্র পেল মূর্খ হল জ্ঞানী।
দুর্বৃত্ত সাধক হ’ল দুঃখী মহাধনী।।
মরা দেহে যথা তথা প্রাণ লভিয়াছে।
সতী ধর্মে কত নারী পতি বাঁচায়েছে।।
জাতী বর্ণ নির্বিশেষে ভজনে চতুর।
বিশ্ব বাসী জানে আজ শ্রী হরি ঠাকুর।।
অজ্ঞান আঁধারে মগ্ন নর অগণন।
জ্ঞানালোকে দীপ্ত হল তাদের জীবন।।
মান্য করে নরগণে কথা মিথ্যা নয়।
হিংস্র জীব গণে মানে কাহার আজ্ঞায়।।
সর্পে মানে ব্যাঘ্রে মানে মানিল কুম্ভির।
রাজা মানে প্রজা মানে মানে কত বীর।।
যক্ষ মানে রক্ষ মানে মানে দেবগণ।
রোগে মানে শোকে মানে মানে শিবগণ।।
“শ্রী গুরুর দোহাই লাগে” যেখানে যে বলে।
নামগুণে সবে মানে জলে কিংবা স্থলে।।
আরত প্রমাণ দেখ যাহা বলি পিছে।
ওড়াকান্দী হতে সবে শক্তি পেয়েছে।।
দেশে দেশে আজি দেখি কত ধর্মমত।
ওড়াকান্দী হতে পেল সবে নিজ পথ।।
সহজ সুন্দর ভাবে যেই মর্ম কথা।
প্রচারিল হরিচাঁদ অপূর্ব বারতা।।
সেই বাণী পূর্ণ রূপে গৃহীর জীবনে।
গুরুচাঁদ প্রচারিল জীবের কারণে।।
অপর প্রমাণ এক উঠে মম মনে।
গুরুচাঁদে ভগবান বলে যে কারণে।।
সাধক সন্ন্যাসী যত অবনী ভিতরে।
রোগ তাপ নাশিবারে কিছু শক্তি ধরে।।
সে সব সাধক যবে দেহ রক্ষা করে।
যার শক্তি তার সাথে যায় অতঃপরে।।
তাহাদের ভক্ত যত আছে পৃথিবীতে।
রোগ নাশিবারে ছোটে বৈদ্য ভবনেতে।।
অভূত অপূর্ব লীলা শ্রী হরি করিল।
সেই লীলা পূর্ণ রূপে শ্রী গুরু সাধিল।।
পদ্মমুখে বাক্য যবে প্রভু মোর বলে।
দুরন্ত করাল ব্যাধি দূরে যায় চ’লে।।
নাহি লাগে বৈদ্য ওঝা না লাগে ঔষধ।
“শ্রী গুরু দোহাই নাশে সকল আপদ।।
কোনদিন গুরুচাঁদে যেবা মানিয়াছে।
পরশ পরশে লৌহ স্বর্ণ হইয়াছে।।
দেশে দেশে ফিরে যত মতুয়ার গণ।
রোগ সারে গুরুচাঁদে করিয়া স্মরণ।।
পূর্ব পূর্ব অবতার যেই শক্তি ধরে।
তদপেক্ষা বেশী শক্তি মতুয়া শরীরে।।
বিমানে উড়িতে পারে জলে চলে হাঁটি।
গৃহ থেকে সাধু হয় মন রেখে খাঁটি।।
আরও বহুত আছে প্রমাণ সকল।
গুরুচাঁদ কল্পবৃক্ষে ফলে সর্ব্বফল।।
অবতার বলি যারে ব্যাখ্যে মহাজন।
শ্রী গুরুচাঁদেতে দেখি সে সব লক্ষণ।।
সুঠাম সুন্দর রূপ চৌরাশ কপাল।
আজানুলম্বিত ভুজ পরম দয়াল।।
জীব দুঃখে দুঃখী সদা জীবে শান্তি দেয়।
যাঁর আগমনে পাপ তাপ দূরে যায়।।
পবিত্রতা মধুরতা জীবগণ দেহে।
অবিরাম হরিনাম ঘরে ঘরে কহে।।
অগোচরে প্রেম ধারা দেশে দেশে চলে।
যার স্পর্শে জীব বক্ষে আনন্দ উথলে।।
এ ঢেউ থামেনা কভু চলে ধীরে ধীরে।
সবারে আবিষ্ট করে অন্তরে বাহিরে।।
জগতের জীবগণে দিতে শান্তি সুধা।
জুড়াতে তাপিত প্রাণ মিটাইতে ক্ষুধা।।
যুগে যুগে বারে বারে আসিয়াছে যেই।
পিতা পুত্র রূপে এল ওড়াকান্দী সেই।।
হরিচাঁদ রূপে করে প্রথমে আবাদ।
গুরুচাঁদ রূপে করে প্রেম রসাস্বাদ।।
হরিচাঁদ রূপে দেয় ধরমের নীতি।
গুরুচাঁদ রূপে দেখি পূর্ণ পরিণতি।।
যেইকালে গুরুচাঁদ ধর্ম প্রচারিল।
ধর্ম বীজে সেই আদি অঙ্কুর ফুটিল।।
যেই যেই হরিচাঁদে প্রাণ সমর্পিল।
অজানা অজপা যে বা তাঁহারে জানিল।।
সংসার ছাড়িয়া কেহ হ’ল উদাসীন।
হরিপ্রেম মধুপানে মত্ত চিরদিন।।
অধিক গৃহস্থ সাধু গৃহ ধর্ম রাখে।
পবিত্র চরিত্রে থাকি হরিচাঁদে ডাকে।।
নাহি জানে ধ্যান জ্ঞান দীক্ষা মন্ত্র নাই।
মানুষে মানিয়া বলে পরমার্থ পাই।।
সহজ সরল ধর্ম কষ্ট কিছু নাই।
সহজ প্রাণের টানে সোজা ধর্ম পাই।।
“হরিলীলামৃত” গ্রন্থে কবি রসরাজ।
কহিল হরির ধর্ম যেন ধর্মরাজ।।
পর নারী মাতৃতুল্য মিথ্যা নাহি কবে।
পরদুঃখে দুঃখী সদা সচ্চরিত্র র’বে।।
পর সতী পর পতি স্পর্শ না করিবে।
না ডাক হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।।
দীক্ষা বৃথা করো বৃথা তীর্থ পর্যটন।
মুক্তি বৃথা কিবা কারো সাধন ভজন।।
দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন।
তার দরশনে সর্ব তীর্থ দরশন।।
দীক্ষা মন্ত্র দেয় গুরু কর্ণে মুখ রাখি।
হরিনাম মন্ত্র বিনা সব মন্ত্র ফাঁকি।।
মহামন্ত্র হরিনাম এই কলিকালে।
নামের সহিতে হরি নিজে হরি বলে।।
পরম উদার এই হরিনাম মন্ত্র।
গুপ্ত মন্ত্র নহে ইহা শুদ্ধ স্পষ্ট শান্ত।।
কিবা সে গোপন মন্ত্র গুরু কর্ণে দেয়।
দ্বার বদ্ধ করি কভু দিন ভোলা যায়।।
মহামণি রত্ন খনি পৃথিবী জননী।
তাঁর গর্ভে সংখ্যাতিত মণি আছে জানি।।
সরলা মৃন্ময়ী মাতা সবে ইহা জানে।
তবু মণি পারে তারে জিনিতে কিরণে।।
গুণে কি কিরণে কিংবা ওজন সাধনে।
জগদ্ধাত্রী সঙ্গে তুল্য হয় কোন দিনে।।
তেমতি এ মহামন্ত্র হরিনাম ধ্বনি।
তদাপেক্ষা কোন মন্ত্র নহে এত গুণী।।
এই মহামন্ত্র হয় সর্বমন্ত্র পিতা।
অন্তত অসীম গুণ সর্ব ফল দাতা।।
হরিনাম মহামন্ত্র বলো অবিরত।
হাতে কাম মুখে নাম করিবে নিশ্চিত।।
গৃহ ধর্ম রাখ আর মুখে বল হরি।
এই সুপবিত্র শিক্ষা দিলা বিশ্বভরি।।
গার্হস্থ্য আশ্রম শ্রেষ্ঠ বলে বারে বার।
গৃহাশ্রম নষ্ট করে যত দুরাচার।।
এক নারী ব্রহ্মচারী পালো গৃহধর্ম।
গৃহ ধর্ম নষ্ট হলে নষ্ট সব কর্ম।।
পাপ নহে দূরে কোথা পাপ নিজ ঘরে।
নিজ নারী সনে জীব নিত্য পাপ করে।।
কালাকাল নাহি মানে ভ্রান্ত জীবগণ।
আপনা আপনি মরে লোভের কারণ।।
পর নারী রত যেবা করে ব্যভিচার।
দিনে দিনে ক্ষয় প্রাপ্ত সেই দুরাচার।।
শুধু পরনারী রত নহে ব্যভিচারী।
অবিচারে করে পাপ লয়ে নিজ নারী।।
নিষ্কলঙ্ক পূর্ণ চন্দ্র প্রভু গুরু চন্দ্র।
ডাকিয়া বিশ্বের জীবে বলে মহামন্ত্র।।
গৃহাশ্রম পরে সর্ব ধর্ম বসি রয়।
গৃহাশ্রম রক্ষা হ’লে ধর্ম রক্ষা হয়।।
এই গৃহাশ্রম শুন কিসে রক্ষা পায়।
ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু ঘর সারা দায়।।
সরল পবিত্র রহি বল হরি হরি।
গৃহ ধর্ম রক্ষা কর লয়ে নিজ নারী।।
ঋতুকালে দিন মাত্র রহ নারী সনে।
সন্তান লভিতে যদি বাঞ্ছা হয় মনে।।
হরিনাম মহামন্ত্র বলো অবিরত।
হাতে কাম মুখে নাম করিবে নিশ্চিত।।
দম্পতি পবিত্র যদি রহে চিরদিন।
তারা নহে জরা ব্যাধি মৃত্যুর অধীন।।
ঋতুকাল ভিন্ন দিনে করে নারী সঙ্গ।
নিশ্চয় জানিহ তবে গৃহ ধর্ম ভঙ্গ।।
ঋতুর প্রথম তিন দিন ছাড়ি দেহ।
ষোড়শের একদিন নারী সঙ্গে রহ।।
ইহার অধিক যেবা নারী সঙ্গ করে।
ব্যভিচারে মহাপাপে তিলে তিলে মরে।।
অর্থকে অনর্থ ভাবি এতদিন সবে।
ধর্ম লভিবার চেষ্টা করিয়াছি ভবে।।
অর্থ শূন্য বাক্য যথা প্রলাপ বচন।
অর্থ শূন্য গৃহী জনে জানিবে তেমন।।
অর্থ দেয় অন্ন জল অর্থ রাখে প্রাণ।
অর্থের সংহতি রহে জীবের কল্যাণ।।
অতি যতনেতে সবে অর্থ রাখো ঘরে।
সদ্ভাবে উপায় করো আনন্দ অন্তরে।।
গৃহাশ্রম নাশে কিসে শুন সর্ব্বজন।
ব্যভিচারে গৃহ নষ্ট গৃহীর পতন।।
জগতে জীবের দেখি কত অনাচার।
ঘরে পরে করে নরে সদা ব্যভিচার।।
এমন হয়েছে দশা দুঃখে মরে যাই।
খুড়ি মাসি লঘু গুরু কিছু মান্য নাই।।
এ সব লিখিলা বাণী কবি রসরাজ।
শ্রী হরি চরিত্র গীতি লিলামৃত মাঝ।।
ক্ষণে ক্ষণে গুরুচাঁদ বলে ভক্ত ঠাঁই।
কালের দোসর নিদ্রা সবে জান তাই।।
স্বল্প নিদ্রা জীবগণে সুখের কারণ।
অতিনিদ্রা জানিবেক মৃত্যুর লক্ষণ।।
পৈশাচী বেতাল সিদ্ধি উগ্রচন্ডা নামে।
দক্ষিণে খর্পর তার খড়গ বহে বামে।।
অতি নিদ্রা কোলে যবে জীবগণ ঢলে।
উগ্রচণ্ডা হরে ধন স্বপনের ছলে।।
এই ভাবে দলে দলে জীবে বলি দেয়।
অতন্দ্র যে জন রহে নমে তার পায়।।
আরো বলি গৃহী জনে যে কর্ম সাধিবে।
সন্তান সন্ততি গণে বিদ্যা শিক্ষা দিবে।।
বিদ্যাহীন নর যেন পশুর সমান।
বিদ্যার আলোকে প্রাণে জ্বলে ধর্ম জ্ঞান।।
বারে বারে বলি আমি তোমাদের ঠাঁই।
বিদ্যাবিহীনের গতি কোন কালে নাই।।
আপন সন্তানে যেই বিদ্যা শিক্ষা দেয়।
পিতৃপুরুষের আশির্বাদ সেই পায়।।
ঘরে ঘরে কর সবে শ্রী হরি মন্দির।
নিত্য পূজা করো সেথা চিত্ত রাখি স্থির।।
নরনারী সুপবিত্র বিদ্বান সন্তান।
শ্রী হরি মন্দিরে যেথা হরি অধিষ্ঠান।।
সদ্ভাবে অর্জ্জিত অর্থ পালে গৃহ ধর্ম।
উদার সরল রহে করেনা কুকর্ম।।
নিত্য সংকীর্ত্তন করে বাল বৃদ্ধ যুবা।
স্নেহেতে কনিষ্ঠ বাধ্য জ্যেষ্ঠে করে সেবা।।
নারী যেথা পতি পদ করিয়াছে সার।
সতীর উপরে যেথা নাহি অত্যাচার।।
গৃহাদি প্রাঙ্গণ সব নির্মল পবিত্র।
আদর্শ গৃহস্থ সেই সেই ধর্মক্ষেত্র।।
এই ধর্মক্ষেত্রে রহে লক্ষ্মীনারায়ণ।
দেবের বাঞ্ছিত তাহা ছার নরগণ।।
এই পুণ্য ক্ষেত্রে সবে শুদ্ধ চিত্তে রহ।
অবিরাম হরিনাম মনে প্রাণে কহ।।
আপন জীবনে প্রভু পালে এই নীতি।
গতিহীনে দিল গতি অগতির গতি।।
গুরুচাঁদ বাণী পালে যেবা যেই খানে।
পূর্ণ শক্তি লাভ করে অতি অল্প দিনে।।
অসংখ্য ভকত লোক দেখি দিকে দিকে।
প্রাণদাতা গুরুচাঁদ বলি তারা ডাকে।।
দিনে দিনে ধীরে ধীরে প্রেমের প্লাবন।
চলিতেছে দশ দিশি করি সংক্রামণ।।
হরিচাঁদ লীলা কালে যত লোক জানে।
গুরুচাঁদ কৃপাগুণে লক্ষ গুণে মানে।।
ক্রমেই বাড়িছে ঢেউ নহে নিবারণ।
তাই বলি গুরুচাঁদে ঈশ্বর লক্ষণ।।
পূর্ব পূর্ব অবতারে যাহা কিছু কৈল।
হরিগুরু নাম গুণে তদধিক হৈল।।
তাই বলি অবতার হরি গুরুচাঁদ।
কৃপাবশে জীবগণে দিল আশীর্বাদ।।
জীবগণে তমঃ মন্দ সকলি নাশিল।
জয় হরি-গুরুচাঁদ সর্ব্ব জীবে বল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!