জিজ্ঞাসু- আমার মেয়ের খুব ঠাকুর ঠাকুর বাতিক। সারাদিন গা ধোয়া, পা ধোয়া, স্নান করা, কাপড় ছাড়া এসব নিয়েই থাকে। বারবেলা, কালবেলাও খুব মানে। তবে ঈশ্বরে খুবই ভক্তি। ওর এই লক্ষণগুলি কি ভালো না খারাপ?
গুরুমহারাজ- দ্যাখো মা! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘বন্যা এলে (অর্থাৎ প্লাবনের সময়) ডাঙ্গায় এক বাঁশ জল!’ সাধারণত গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায় মাঠের জমিগুলি ছোট ছোট ‘আল’ বা বাঁধ দিয়ে আলাদা আলাদা করা থাকে, কিন্তু বন্যার সময় সব চলে জলাকার বা একাকার, কোন বিভেদ বিচ্ছেদ থাকে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বর্ষাকালে কামারপুকুরে মাঠের ঐরকম বিভেদ-বিচ্ছেদহীন জল থৈ থৈ অবস্থা দেখে একবার ভাবস্থ হয়েছিলেন। মা! ঐ যে বলা হোল ছোট ছোট ‘আল’ দিয়ে বাঁধ বেঁধে রাখা, ওটাই সংকীর্ণতা। মনের বিস্তার হলে আর বাঁধ নেই। বিস্তারিত হোক না অসীম পর্যন্ত।
‘জয়কালী’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে-কাজ থাকলে তো বেরতেই হবে। তখন কি ‘বারবেলা’-‘কালবেলা’ মানলে হবে? ‘বারবেলা’ বলে সূর্য তার আলো দেওয়া বন্ধ করে কি? বাতাস প্রবাহিত হয় না? নদী বা যে কোন স্রোতস্বিনী কি তার স্রোতের গতি বন্ধ করে দেয়? করে না তো!
অতএব বুঝতেই পারছ মা, যারা নিজেকে ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়- তারাই এইসব সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটায়। প্রকৃতপক্ষে সঠিক কথা বলতে গেলে এটাই বলতে হয়, যে সমস্ত আচার বা সংস্কারগুলির মধ্যে বহুজনের হিতকর কোন কারণ নেই- সেইগুলি কুসংস্কার এবং এগুলি পরিত্যজ্য।
বহুজনের হিত না হোক, যদি তার নিজের মঙ্গল হয়- তাহলেও ভালো। কিন্তু যে সব আচার, যে সব সংস্কার তাকে দিনে দিনে আরও বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলছে, সংকীর্ণ করে তুলেছে- তা সে কেন গ্রহণ করবে?
এইগুলি আধ্যাত্মিকতা নয়- আধ্যাত্মিকতা মানুষকে বন্ধন থেকে মুক্ত হতে শেখায়। নতুন কোন বন্ধনে আবদ্ধ হতে শেখায় না। একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে পরিধি বাড়িয়ে যেমন বড়, আরও বড় বৃত্ত টানা যায়, ঠিক তেমনি যে কোন মানবজীবনকে কেন্দ্র করেও তার মনের পরিধি বাড়ানো যায় অনন্ত পর্যন্ত। এটাকেই বলা হয় ‘বাঁচার কলা’ বা Art of Life !
স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন- “সংকোচনই মৃত্যু, সম্প্রসারণই জীবন।” ‘তাই যা তোমাকে সংকুচিত করে তোলে বা মনকে সংকীর্ণ করে তা পরিত্যাগ করতে হয়। তোমরা জীবনমুখী হও- মুক্তির অনাবিল আনন্দের স্বাদ গ্রহণ কর’ এটাই প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের সনাতন শিক্ষা।
তুমি মা তোমার মেয়ের আচার-আচরণের কথা যা বলছ, সেটা তো শুচিবাইগ্রস্ততা! এটা এক ধরনের মনোরোগ বা ‘ম্যানিয়া’। মেয়েরা সাধারণত মায়েদের কাছ থেকেই এটা পায়। এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমি যেটা বললাম ওটাই হয়।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে থাকে মেয়েরা, ফলে অন্য অনেককিছুর সাথে এই শুচিবাইগ্রস্ততাও শেখে। তারপর সে যখন বড় হয়- সংসার করে, তখন তার নিজের জীবনেও ঐটির প্রকাশ ঘটে যায়। এটা ঠিক যেন ছোঁয়াচে রোগের মতো। সাংঘাতিক সংক্রামক।
থেকে মেয়েতে- শাশুড়ি থেকে বৌমায় সংক্রমিত হয়ে যায়। তাই বলছিলাম এইরকম ভাবে ‘ঠাকুর’- ‘ঠাকুর’ করা আধ্যাত্মিকতা নয়- এগুলি বিকার। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি তাকেই বলা হবে- যার অন্তরে শুচি। অন্তরে কোন বিকার নেই। যদি শাক্ত হয়- তাহলে ‘জয়কালী’ বললেই শুচি। যদি বৈষ্ণব হয়- তাহলে ‘জয় গোবিন্দ’ বলবে, শৈবরা বলবে “জয় শিবশম্ভু” ব্যাস্ এতেই শুচি হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন- অন্তর শুচি হলেই এই ধরনের ষোলআনা বিশ্বাস জাগ্রত হয়। অন্যথায় যতই উপরটা ধোও না কেন (হাত-পা ধোয়া, বারবার স্নান করা, কাপড় কাচা) তাতে ভেতরের ময়লা যাচ্ছে না যে। তাই ঐ ধরণের ব্যক্তিদের প্রতিমুহূর্তেই মনে হয়, “বোধহয় ঠিকমতো শুচিভাবে ঠাকুরপূজায় বসা হোল না, ঠিকমতো হাতের ময়লা ধোওয়া হয়নি, এই কাপড়টা পরা ঠিক হয়নি- আরো শুদ্ধ বস্ত্র পরা উচিত ছিল, ‘ওকে’ ছোঁওয়াটা ঠিক হয়নি- আর একবার স্নান করে আসি!”
আচ্ছা মা- আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি- হাত-পা ধুয়ে অথবা স্নান করে না হয় শরীরের উপরের অংশের ময়লা ধুয়ে ফেললে কিন্তু তোমার পেটের মধ্যে তো দুর্গন্ধযুক্ত মল (যাকে নোংরা, অপবিত্র ভাবা হচ্ছে) রয়েছে- সেটা কি করে পরিষ্কার করবে?
মনের ময়লা বাদ দিলেও শরীরের মধ্যে অত দুর্গন্ধযুক্ত মল বা ময়লা নিয়ে ঠাকুরের পূজা করছ- তাহলে আর শুচি থাকলে কই? ইসলাম ধর্মে রয়েছে মৃত্যুর পর দেহগুলি আল্লাহর দরবারে শেষবিচারের দিনের অপেক্ষায় থাকে। তাই তারা মৃতদেহটিকে মলমুক্ত করার জন্য এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় শরীরের সব মল বের করে দেয়। একে ‘দফন’ বলে।
ঐ সমাজে এই ব্যাপারে Expert-রা রয়েছে, তারা এসে সুচারুভাবে এই ‘দফন’ ক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। যাইহোক, তাহলে তোমার তো শরীরকে সম্পূর্ণরূপে মলমুক্ত করতে হলে প্রত্যেকবার পূজায় বসার আগে- ঐরকম Expert আনিয়ে ‘দফন’ ক্রিয়া করাতে হবে। তখন হয়তো তোমার মনে একটা Satisfaction আসবে যে তুমি ‘শুচি’ হয়েছ।
কিন্তু মজাটা কি জানো- এতকিছু করেও কিন্তু মনের খুঁতখুঁতুনি যাবে না। একটা পূরণ করবে তো অন্য আর একটা বাহানা জোগাড় হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম- আত্মবিশ্বাসী হও। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন- ‘নাই’ বললে সাপের বিষ থাকে না। এটা অবশ্য বিশ্বাসের কথা।
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে ইষ্টচিন্তা করলে বা ইষ্টনাম স্মরণ করলেই শুচি। বুঝতে পারছো তো- কি বলতে চাইছি। মনের ময়লা ধুয়ে ফেলাই তো আসল কথা। শরীরের উপরিভাগের ময়লা ধোয়া-মোছা করতে হয় না কেন- শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য, কোন আধ্যাত্মিকতার জন্য নয়।
হ্যাঁ, এটা ঠিকই শরীর সুস্থ থাকলে তবেই সাধন-ভজনও ঠিক মতো হয়- কিন্তু সেটাকেই সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিলে তো হবে না। যেটুকু প্রয়োজন ব্যাস্ সেটুকুই। আধ্যাত্মিক হতে গেলে মনের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। আর এরজন্য ঈশ্বরের কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে হবে।
ঈশ্বর করুণাময়- কৃপাসিন্ধু। তাঁর করুণা হলে এই ধরনের সব বন্ধন কেটে যাবে, তখন আর কুসংস্কারাদি এবং মনের বিকারাদি থাকবে না। তাই আমি সবাইকে বলি- শ্রীভগবানের শরণাপন্ন হও- এটাই একমাত্র পন্থা। অন্য কোনভাবে মানুষের মন থেকে কুসংস্কার, বিকার মিটিয়ে ফেলার উপায় নেই।
…………………………
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন