ভবঘুরেকথা
আচার্য শঙ্করাচার্য

আচার্য শঙ্করাচার্য: দুই

একদিন মার সঙ্গে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে গেলেন শঙ্কর। স্নান করার সময় তার মার সামনে একটা কুমীর তাড়া করে আসে। নদীর জলে সাঁতার কেটে ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগলেন শঙ্কর আর কুমীরটা তাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগলো।

নদীর মধ্যে ছোট একটা চড়া ছিল। ক্লান্ত হয়ে তার উপর উঠে দাঁড়ালো শঙ্কর। কুমীরটা সেখানেও তেড়ে গেল। তিনি চীৎকার করে মাকে বলতে লাগলেন, মা! আমার মৃত্যু এবার আসন্ন। আমাকে সন্ন্যাস নেবার অনুমতি দাও। তা না হলে আমার মুক্তি হবে না। তোমার অনুমতি পেলে সন্ন্যাস নেই আমি।

মা তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্ন্যাস নেবার অনুমতি দিলেন শঙ্করকে। অনুমতি দিয়েই মূর্ছিত হয়ে পরলেন নদীর পারে। এদিকে গোলমাল শুনে কয়েকজন জেলে বর্শা নিয়ে ছুটে এসে কুমীরটাকে মেরে ফেলে। এইভাবে ভগবানের দয়ায় বেঁচে যান শঙ্কর।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিশিষ্টা দেবী পুত্রকে বিপদ থেকে মুক্ত ও অক্ষতদেহ দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু এদিকে এক নতুন বিপদ দেখা দিল। শঙ্কর মাকে বললেন, তিনি আর বাড়িতে বাস করবেন না। তিনি যখন সন্ন্যাস নিয়েছেন তখন আর কোন উপায় নেই।

এবার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম যা করার তা করে বাইরের জীবনেও সন্ন্যাস নিয়ে চলে যেতে হবে। বিপদে পরে একবার যখন আমি সন্ন্যাস নিয়ে ফেলেছি তখন আর আমি মিথ্যাচারী হয়ে নরকে যেতে পারি না। সুতরাং তুমি যদি সত্যি সত্যিই আমার মঙ্গল চাও তাহলে এ কাজে আমায় বাধা দিও না মা।

মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি তখন তোকে সন্ন্যাস নিতে বলেছিলাম। সে শুধু কথার কথা, অন্তরের কথা নয়। তাছাড়া তুই এখন ছেলেমানুষ, সন্ন্যাস জীবনের এত কষ্ট কি করে সহ্য করবি?

শঙ্কর বললেন, যিনি আমায় কুমীরের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন তিনিই আমায় রক্ষা করে চলবেন মা। তুমি সেই ভগবানের হাতেই আমাকে সঁপে দাও।

মা বললেন, কিন্তু তুই চলে গেলে বৃদ্ধ বয়সে আমায় কে দেখবে? কে আমায় অন্নজল দেবে? মৃত্যুর পর কে আমার মুখে আগুন দেবে? কি করে আমার মুক্তি হবে?

শঙ্কর তখন তার জ্ঞাতিদের ডেকে বললেন, আমার দু চার বিঘা যে জমি জায়গা আছে তা আপনাদের দান করছি। আমি এর বিনিময়ে কিছুই চাই না। শুধু কথা দিন আপনারা আমার মার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবেন‌। জ্ঞাতিরা সকলে শঙ্করকে ভালোবাসত।

তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কথা দিল‌। তারা বিশিষ্টা দেবীর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করল। তিনি যতদিন বাঁচবেন তার ভরণপোষণের কোন অভাব বা অসুবিধা হবে না।

আচার্য শঙ্কর একটা বিষয় নিশ্চিন্ত হয়ে মাকে বললেন, আমি কথা দিচ্ছি মা, আমি সন্ন্যাস নিয়ে যেখানেই থাকি তোমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে আমি ঠিক সময় চলে আসব। তোমার শেষকৃত্য ও পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ঠিকমত সম্পন্ন করব।

মা তখন নিজের হাতে সন্ন্যাস গ্রহণের আগে যে অনুষ্ঠান করা হয় তার ব্যবস্থা করে দিলেন। শঙ্কর সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য নিজেই নিজের শ্রাদ্ধাদি ও বিরজা হোম সম্পন্ন করলেন। তারপর মস্তক মুণ্ডিত করে নর্মদা নদীর দিকে রওনা হয়ে পরলেন।

পরিব্রাজন করতে করতে একদিন তুঙ্গভদ্রার তীরে এসে উপনীত হলেন আচার্য শঙ্কর। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে কদম্ববন নামে এক অরণ্য প্রদেশে প্রবেশ করলেন। তখন ভরা দুপুর। একে পথশ্রমে ক্লান্ত তার উপর সূর্যের তেজ বড় প্রখর।

তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয় এখানে কোন মহা তপস্বী আছেন নিকটেই যার তপো প্রভাবে সাপ তার হিংসা ভাব পরিত্যাগ করেছে‌। চারিদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে তিনি দেখলেন কদম্বগিরির গায়ে এক সাধুর কুটির রয়েছে।

শঙ্কর বিশ্রামের জন্য নদীর ধারে একটা গাছের ছায়াতলে বসলেন। সহসা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। নদীর জল হতে একদল ব্যাঙের ছানা লাফাতে লাফাতে নদীর পারে পাথরের উপরে উঠে বসল‌‌। কিন্তু রোদের তাপে পাথরটা গরম হয়ে যাওয়ায় বসতে পারছিল না। তাই তারা আবার নদীর জলে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হলো।

এমন সময় কোথা হতে এক বিরাট এক সাপ এসে তার চওড়া ফণাটি বিস্তার করে ব্যাঙের ছানাগুলিকে ছায়াদান করতে লাগল। হিংসা তো দূরের কথা, সাপটি মায়ের মত পরম স্নেহভরে ছায়াদান করে যেতে লাগল। ছানাগুলিও সাপ দেখে কোনরূপ ভয় করল না।

যে সাপ ও ব্যাঙের মধ্যে চিরকাল এক খাদ্য খাদকের তিক্ত সম্পর্ক সেই সাপ ও ব্যাঙের মধ্যে কি করে এমন মধুর স্নেহ ভালবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা ভেবে পেলেন না শঙ্কর।

তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয় এখানে কোন মহা তপস্বী আছেন নিকটেই যার তপো প্রভাবে সাপ তার হিংসা ভাব পরিত্যাগ করেছে‌। চারিদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে তিনি দেখলেন কদম্বগিরির গায়ে এক সাধুর কুটির রয়েছে।

সেই কুটির লক্ষ্য করে তিনি ধীরে ধীরে উঠে গেলেন পাহাড়ের উপরে। গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ তপস্বী সেই কুটিরে থেকে সাধন ভজন ও তপস্যা কার্য করেন। তপস্বী বললেন, পুরাকালে এই স্থানেই ছিল মহামুনি ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম। শঙ্কর এবার বুঝতে পারলেন এই অঞ্চলের সাপ কেন তার স্বাভাবিক হিংসা ও খলতার ভাব ত্যাগ করেছে।

এই মনোরম নির্জন ও অরণ্য সংকুল পার্বত্য প্রদেশে এক আশ্রম প্রতিষ্ঠার বাসনা জাগে আচার্য শঙ্করের মনে। পরবর্তীকালে এই ইচ্ছাপূরণ করেন তিনি এবং তার ফলে গড়ে ওঠে বিখ্যাত শৃঙ্গেরী মঠ। পাহাড় হতে নেমে এসে আবার যাত্রা শুরু করেন শঙ্কর।

দুই মাস ক্রমাগত কত পথ চলতে চলতে পুরাণ প্রসিদ্ধ মাহিষ্মতী নগর পার হয়ে উপস্থিত হন ওঙ্কারনাথের দ্বীপশৈলে। এই পাহাড়েই একদিন সৌভাগ্য ক্রমে তিনি দেখতে পান মহাযোগী গোবিন্দপাদের। এই ওঙ্কারনাথ পাহাড়টি নর্মদার স্রোতধারাকে দুভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে‌।

পুরাণে এই পাহাড়কেই বলা হয়েছে বৈদুর্যমণি পর্বত। পুরাকালে একসময় ভক্তবীর মান্ধাতার রাজধানী ছিল এই পাহাড়ে। ওঙ্কারনাথ, মহাকাল প্রভৃতি জাগ্রত লিঙ্গগুলি যুগ যুগ ধরে বিরাজ করছে এই পাহাড়ের কোলে‌‌। আজও ভারতের দূর-দূরান্ত হতে অগণিত তীর্থ-যাত্রীর সমাগম হয় এই সব জাগ্রত শিবলিঙ্গ দর্শনের জন্য।

এই ওঙ্কারনাথ পাহাড়ে এসে হঠাৎ জঙ্গলে ঢাকা এক সংকীর্ণ গুহার মুখ দেখতে পেলেন শঙ্কর। গুহার মুখে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। দেখলেন, ভিতরে এক প্রশস্ত সুড়ঙ্গপথ সামনে প্রসারিত হয়ে আছে‌‌। কয়েকজন জটাজুটধারী প্রবীণ সন্ন্যাসী ধ্যানস্থ হয়ে আছেন‌। গুহাটি একেবারে অন্ধকার নয়‌। বাইরে থেকে আসা স্বল্প আলোয় মোটের উপর ভিতরটা দেখা যায়।

যে কয়েকজন সন্ন্যাসী ধ্যান করছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ তপস্বীর কাছে গিয়ে শঙ্কর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে তাকে বললেন, প্রভু! আমায় ক্ষমা করবেন। আমি মহাযোগী গোবিন্দপাদের দর্শনাভিলাসী। তাঁর করুণা চাই‌। বহুদূর থেকে এই অভিলাষ নিয়ে এসেছি।

কৃপা করে তাঁর সন্ধান বলে দিয়ে আমার প্রাণ রক্ষা করুন। কিছুক্ষণ পরে মৌন সাধক চক্ষু উন্মীলন করে তাকালেন শঙ্করের মুখপানে‌। দেখলেন, এক বালক নতজানু হয়ে বারবার সেই একই প্রার্থনা করছে কাতরভাবে। তার চোখ দিয়ে সমানে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরল জলের ধারা।

বালকের এই সকাতর প্রার্থনায় বিচলিত হলো সাধকের অন্তর। তিনি হাত তুলে অভয় দিলেন শঙ্করকে। পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বেলে সেই আগুনে প্রদীপ জ্বালালেন সাধক। তারপর সেই প্রদীপটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমাকে অনুসরণ করো।

সেই গিরিগুহার শেষপ্রান্তে একটি গর্ভগুহা ছিল। সেই গর্ভগুহার মুখটি একটি বড় পাথর দিয়ে বন্ধ করা ছিল। সেখানে গিয়ে থামলেন প্রবীণ সাধক। বললেন, এই গুহার মধ্যেই মহাযোগী গোবিন্দপাদ সমাধিস্থ অবস্থায় আছেন। সাধনার দ্বারা যাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি খুলেছে, যারা আত্মজ্ঞান লাভ করেছে তারাই তাঁর কৃপালাভ করে।

দীর্ঘকাল ধরে আমরা এখানে সাধনা করে চলেছি তাঁর কৃপালাভের আশায়। কিন্তু আজও তাঁর কৃপালাভ করতে পারি নি। কবে যে এই মহাযোগী সমাধি হতে জাগবেন তা কেউ জানে না। তোমার যা কিছু জানাবার এখান থেকেই জানাও।

শঙ্কর তেমনি কাতর ভাবে বললেন, প্রভু, আমি যে যোগীরাজ গোবিন্দপাদ দর্শন করার অভিলাষেই এসেছি। তাঁর আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি।

সাধক বললেন, বৎস! বুঝেছি তুমি মহাভাগ্যবান। তাই এই বয়সেই তোমার মধ্যে জেগেছে এই আধ্যাত্মিক আর্তি। তুমি শক্তিধর। এই পাথরটি সরিয়ে গুহাদ্বার মুক্ত করে তোমার প্রার্থনা জানাও।

অথবা এ হয়ত যোগীরাজের লীলা, তাই তিনি হয়ত তাঁর চিহ্নিত শিষ্যকে আকর্ষণ করে এনেছেন তাঁর কাছে। যোগীরাজ বালক শঙ্করের স্তবে তুষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন‌। মুমুক্ষু বালককে অভয় ও আশ্রয় দিলেন তখনি।

অর্জিত তেজ ও আত্মপ্রত্যয়ে উদ্দীপিত হয়ে শঙ্কর হাত দিয়ে পাথরটি সরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিকে তখন অন্যান্য সাধকদের ধ্যান ভেঙ্গে গেছে। তাঁরাও সবাই এসে পাথরটিতে হাত দিলেন। তখন সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় পাথর সরে গেল। গুহাদ্বার উন্মুক্ত হলো‌‌।

প্রদীপের আলোয় দেখা গেল, মহাযোগীর চক্ষু দুটি ধ্যাননিমীলিত রয়েছে তখনো‌। এই অলৌকিক জ্যোতির আভায় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাঁর তপোসিদ্ধ দেহখানি। সে দেহে প্রাণের স্পন্দন না থাকলেও মৃত্যুকে অতিক্রম করে আত্মজ্ঞানের সুউচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে সমাসীন হয়ে আছেন হয়ে আছেন তিনি।

বালক শঙ্কর তখন মহাযোগীর স্তব করতে লাগলেন একমনে। তাঁর স্তবগান শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন সাধকরা। তাঁরা বুঝলেন, এ বালক নিশ্চয় দৈববলে বলীয়ান, তা না হলে সমাধিস্থ গোবিন্দপাদের মত মহাযোগীর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নির্ভীকভাবে স্তব গান করতে সাহস করত না।

অথবা এ হয়ত যোগীরাজের লীলা, তাই তিনি হয়ত তাঁর চিহ্নিত শিষ্যকে আকর্ষণ করে এনেছেন তাঁর কাছে। যোগীরাজ বালক শঙ্করের স্তবে তুষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন‌। মুমুক্ষু বালককে অভয় ও আশ্রয় দিলেন তখনি।

এরপর গোবিন্দপাদের আদেশে হিমালয়ের কোলে বদরিকাশ্রমে বেদান্তভাষ্য রচনায় ব্রতী হন শঙ্কর। নূতন ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে করেন অদ্বৈত বেদান্তের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল বছর। এই নবীন আচার্যের কাছে অনেক শক্তিধর পণ্ডিত সাধক এসে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই সব সুযোগ্য শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে হিমালয় হতে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত সমস্ত ভারত জয় করে বেড়ান যুগাচার্য শঙ্কর।

কিন্তু বদরিকাশ্রমে থেকে বেদান্ত ভাষ্য রচনা করতে যাবার আগে গোবিন্দপাদের কাছে তিন বছর ধরে কঠোর তপস্যা করে যান শঙ্কর। এই তিন বছরের মধ্যেই অসামান্য যোগসিদ্ধি ও তত্ত্বজ্ঞান আয়ত্ত করে ফেলেন তিনি‌।

গোবিন্দপাদের গিরিগুহায় আচার্য শঙ্কর থাকাকালে তাঁর কতকগুলি আশ্চর্য যোগ বিভূতির লীলা প্রকাশিত হয়।

(চলবে)

আচার্য শঙ্করাচার্য: তিন>>

…………………………………
আরো পড়ুন:
আচার্য শঙ্করাচার্য: এক
আচার্য শঙ্করাচার্য: দুই
আচার্য শঙ্করাচার্য: তিন
আচার্য শঙ্করাচার্য: চার
আচার্য শঙ্করাচার্য: পাঁচ
আচার্য শঙ্করাচার্য: ছয়

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!