মাস্টরমহাশয় বললেন, “বাবা! একটু বোসো। আমি জগজ্জননীর সঙ্গে এখন কথা বলছি।” গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি নীরবে ঘরে প্রবেশ করলাম। মাস্টার মহাশয়ের দিব্য আকৃতি আমার চোখকে যেন রীতিমত ঝলসে দিল।
রেশমের মত তাঁর শ্বেত শ্মশ্রু আর উজ্জ্বল বড় বড় চোখ দু’টিতে মনে হয় তিনি যেন পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। তাঁর ঈষৎ উন্নত গ্রীবা আর যুক্তকর দেখেই বুঝতে পারলাম- প্রথম সন্দর্শনের জন্যে তাঁর গৃহমধ্যে আমার প্রবেশ যেন তাঁর পূজায় কিঞ্চিৎ বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।
তাঁর সরল আন্তরিক আহ্বান আমার মনের উপর এতাবৎ অনুপলব্ধ একটা দারুণ প্রভাব বিস্তার করল। মায়ের মৃত্যুর করুণ বিচ্ছেদে মনে হয়েছিল, আমার সকল দুঃখের সেটাই চরম পরিণতি। এখন কিন্তু জগন্মাতার আদর্শনে আমার মনের মধ্যে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণাবোধ হতে লাগল। বিলাপ করতে করতে মেঝের উপরে বসে পরলাম।
“বাবা! শান্ত হও।” বলে সাধু মহাশয় সহানুভূতিসূচক দুঃখ প্রকাশ করলেন।
নিদারুণ দুঃখে অভিভূত হয়ে তাঁর চরণ দু’টিই আমার উদ্ধারের একমাত্র উপায় ভেবে তাঁকে আঁকড়ে ধরে বললাম, “মহাত্মা! আপনার সাহায্য বিনা আমার আর গতি নেই। মাকে জিজ্ঞাসা করুন- তাঁর করুণা আমি পাব কি না!”
মধ্যস্থতা করার এইরূপ পূত আশ্বাস সহজে দেবার নয়। বাধ্য হয়েই মাস্টার মহাশয় চুপ করে বসে রইলেন। নিঃসংশয়ে স্থির বিশ্বাস হলো যে মাস্টারমশায় জগন্মাতার সঙ্গে একান্তে কথা বলছেন। ভাবতেও নিজেকে অত্যন্ত হীন বলেই বোধ হল যে, যিনি এই ক্ষণেতেই এই সাধুটির অমল দৃষ্টির সামনে উপস্থিত, তাঁকেই আমি আমার এই পোড়া চোখে দেখতে পাচ্ছি না। লজ্জার মাথা খেয়ে, তাঁর মৃদু ভৎসর্নায় কিছু কর্ণপাত না করে, তাঁর পা দু’টি ধরে বার বার তাঁর কৃপা ভিক্ষা করতে লাগলাম।
মাস্টার মহাশয় বললেন, “আচ্ছা গো! মায়ের কাছে তোমার কথা জানাবো।” ধীর করুণাভরা হাসিমুখে অবশেষে তাঁর অঙ্গীকার পাওয়া গেল।
ঐ কয়েকটি মাত্র শব্দে কি অনন্য শক্তি!
মনে হলো, আমার সত্ত্বা বুঝিবা তার উত্তাল নির্বাসন থেকে এবার মুক্তি পাবে। বললাম, “মহাত্মা! আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণ থাকে যেন ; মায়ের উত্তর পাবার জন্যে শীগগিরই আমি আবার আসবো।” ক্ষণেক পূর্বের দুঃখে অবরুদ্ধ আমার কণ্ঠস্বরে যেন আবার আশার আনন্দধ্বনি মুখরিত হয়ে উঠল।
দীর্ঘ সিঁড়িপথ দিয়ে নিচে নেমে আসবার সময় কত স্মৃতিই না মনে পডরতে লাগল। ৫০নং আমহার্স্ট স্ট্রীটের এই বাড়ি। যেখানে এখন মাস্টার মহাশয় থাকেন, এককালে সেটাই আমাদের বসতবাড়ি ছিল। এই বাড়িতেই মা দেহরক্ষা করেছেন।
আর এখানেই আমার মানবহৃদয় মাতৃবিয়োগে কাতর হয়েছিল; আর আজ মনে হচ্ছে ভগবতী মায়ের অদর্শনে আমার সত্তা যেন ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে। পুণ্য-স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আমার শোকের নিদারুণ বেদনা ও তার অন্তিম নিরাময়ের এক নীরব সাক্ষী।
দ্রুতপায়ে গড়পার রোডের বাড়িতে ফিরলাম। সেদিন রাত দশটা অবধি আমার সেই নির্জন ছোট্ট চিলেকোঠায় আমি ধ্যানে ডুবে রইলাম। নিদাঘ নিশীথের অন্ধকার সহসা এক অলৌকিক দৃশ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
দিব্যজ্যোতি বিভূষিতা জগজ্জননী মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে! মধুর হাসিতে ভরা তাঁর মুখখানি স্বর্গীয় সুষমা মাখা। স্পষ্ট তাঁর বাণী কানে এসে প্রবেশ করল, বললেন, ‘তোমায় ত’ আমি চিরকালই স্নেহ করি, আর তা সর্বদায় করব!’
স্বর্গীয় বাণী তখনও হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিল- মা অন্তর্হিত হলেন। পরদিন, সূর্য তখন সবেমাত্র উঁকি দিতে শুরু করেছে, এমন সময় আমি মাস্টার মহাশয়ের বাড়িতে গিয়ে আবার উপস্থিত হলাম। নানা দুঃখময় স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে আমি তাঁর পাঁচতলার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
বন্ধ দরজার হাতলে একটুকরো কাপড় জড়ানো। বুঝলাম মাস্টার মহাশয় এখন কারুর ভিতরে আসা পছন্দ করেন না। কি করব ভেবে না পেয়ে অনিশ্চিতভাবে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় মাস্টার মহাশয় সাদরে দুয়ার খুলে দিলেন।
আমি তাঁর পূণ্যপদতলে প্রণত হলাম। দিব্য আনন্দের ভাব চেপে রেখে মুখের উপর একটা ছদ্মগাম্ভীর্যের আবরণ টেনে দিয়ে নিরীহভাবে বললাম, “মাস্টার মহাশয়! উত্তরটা জানবার জন্যে খুব সকাল সকালই এসে পরলাম। মা কি আমার কথা আপনাকে কিছু বলেছেন নাকি?”
“দুষ্ট ছেলে কথাকার!” শুধু এইটুকুমাত্র বলেই আর কিছু বললেন না। বাহ্যতঃ আমার কৃত্রিম গাম্ভীর্য তাঁর মনে কোনই রেখাপাত করেনি।
ফের জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার এত হেঁয়ালিই বা কিসের, আর আমাকে এত এড়াতেই বা চাইছেন কেন? সাধুসন্ন্যাসীরা কি সোজাসুজি কোন কিছু বলেন না নাকি?” বোধহয় একটু অধৈর্যও হয়ে পরেছিলাম।
“তুমি কি আমায় পরীক্ষা করতে চাও নাকি, বল?” তাঁর শান্ত নয়নের দৃষ্টি অর্থপূর্ণ।
“সেই করুণাময়ী জগজ্জননীর কাছ থেকে কাল রাত দশটার সময় যে আশ্বাস তুমি পেয়েছ, তার উপর কি আজ এই সকালে আমার আর একটাও কথা বলা চলে, বল?”
পুনরায় তাঁর চরণে আমি সাষ্টাঙ্গে প্রাণিপাত করলাম। এবার আমার চোখ আর দুঃখে নয়, যেন অসহ্য সুখেই অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল।
“তুমি কি মনে কর, তোমার ভক্তি মায়ের অসীম করুণাকে স্পর্শ করেনি? ঈশ্বরের মাতৃভাব, যা তুমি মানবী আর দেবীর আকারে পূজো করে এসেছ, তা তোমার আকুল ক্রন্দনে সাড়া না দিয়েই পারে না।”
কে এই সরল সাধু, যার সামান্য অনুরোধটুকুও পরমাত্মার কাছে মধুর স্বীকৃতি লাভ করে? পৃথিবীতে তাঁর কর্মজীবন অতি সামান্যই- আমার জানা অতি দীনতম ব্যক্তিরই মত।
এই আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে মাস্টার মহাশয় এইরূপ সম্মানসূচক উপাধিতেই তিনি সাধারণতঃ অভিহিত হতেন। তাঁর আসল নাম শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তাঁর রচনাবলীতে তিনি “শ্রীম” এই সংক্ষিপ্ত নামেই স্বাক্ষর দিতেন। ছেলেদের একটি ছোট্ট উচ্চ বিদ্যালয় চালান।
ছেলেদের শাসনের জন্যে কোনরকম বকুনিই তাঁর মুখ দিয়ে বেরোয় না। কোন বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন বা বেতের শাসন তিনি প্রয়োগ করতেন না। এইসব অত্যন্ত সাধারণ ক্লাস ঘরে, উচ্চতর অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হত- আর শিক্ষা দেওয়া হত প্রেমের রসায়ন শাস্ত্র, যা কোন ইস্কুলের পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যায় না।
তিনি দুর্বোধ্য নীতিশিক্ষার বদলে ধর্মভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানদানও করতেন। মা ভগবতীর প্রতি অকৃত্রিম ভক্তির আগুনে পুড়ে তিনি এমন হয়েছিলেন যে, ছোট শিশুর মতই কোন বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শনের লৌকিকতা প্রত্যাশা করতেন না।
তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি তোমার গুরু নই, তিনি কিছুকাল পরেই আসবেন। তাঁরই নির্দেশনায় প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে তোমার উপলব্ধ দিব্যানুভূতি, তাঁরই প্রদত্ত গভীর জ্ঞানে রূপান্তরিত হবে।”
রোজই বিকেলের দিকে একবার করে আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে যেতাম। মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গ আমি প্রত্যহই কামনা করতাম। তাঁর পবিত্র সাহচর্যের আনন্দ আমার সকল সত্তাকে পরিপ্লাবিত করে যেন একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।
এত প্রগাঢ় ভক্তির সঙ্গে আমি কখনও আগে প্রণাম করি নি। মাস্টার মহাশয়ের পদচিহ্ন যে ভূমিকে পবিত্র করেছে, সেখানে দাঁড়াতে পাওয়াটা একটা পরম সৌভাগ্য বলেই মনে করি।
একদিন সন্ধ্যেবেলা একছড়া চাঁপাফুলের মালা হাতে করে এনে বললাম, “মাস্টার মশাই! আজ এই মালাটি পরুন, আপনার জন্যই বিশেষ করে এটিকে তৈরি করিয়ে এনেছি।” কিন্তু তিনি এই সম্মান গ্রহণ করতে বারংবার অস্বীকার করে সসঙ্কোচে সরে গেলেন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, মনে আঘাত পেলাম ভেবে অবশেষে রাজি হলেন। বললেন, “আচ্ছা বেশ, আমরা দু’জনেই যখন মায়ের ভক্ত সন্তান, তখন মায়ের আবাস এই দেহমন্দিরে তুমি তাঁকেই অর্ঘ্য দিতে পার- আমাকে কিন্তু নয়।”
তাঁর নিরহঙ্কার ও উদার প্রকৃতিতে আত্মশ্লাঘার কোন স্থান ছিল না। তারপর বললেন, “চল, কাল আমরা আমার গুরুস্থান, পুণ্যতীর্থ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির দেখে আসি।” মাস্টার মহাশয় হলেন ঈশ্বরকোটি জগদগুরু ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য।
তার পরদিন সকালে গঙ্গায় নৌকা করে আমাদের চারমাইল যাত্রা শুরু হল। দক্ষিণেশ্বরের ঘাটে পৌঁছে আমরা নবচূড়াশোভিত কালীমন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মন্দিরের ভিতর মা ভবতারিণী ও শিব- উজ্জ্বল ও সুনিপুণ কারুকার্যশোভিত রৌপ্যনির্মিত সহস্রদল পদ্মের উপর বিরাজ করছেন। মাস্টার মহাশয় আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলেন। হৃদয়েশ্বরীর সঙ্গে অফুরন্ত প্রেমলীলায় তিনি তখন নিমগ্ন। মায়ের নামগান যখন শুরু করলেন, তখন আমার আনন্দোদ্বেলিত হৃদয় যেন শতদলের মতই বিদীর্ণ হতে লাগল।
তারপর আমরা সেই পূণ্যভূমি মন্দির-প্রাঙ্গনের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে একটা ঝাউগাছের ঝোপের ধারে এসে দাঁড়ালাম। এর বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য যে রসক্ষরণ, তা যেন মাস্টার মহাশয়ের পরিবেশিত আধ্যাত্মিক অমৃত ধারারই প্রতীক।
তাঁর সেই দিব্য নামগান তখনও সমান ভাবেই চলতে লাগল। চারপাশে ছড়ানো লালচে রঙের ঝাউফুলের মধ্যে আমি ঘাসের ওপর স্থির নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। মনে হল, যেন সাময়িকভাবে দেহ থেকে বিযুক্ত হয়ে আমি কোন স্বর্গীয় ভাবরাজ্যে গিয়ে পড়েছি।
এরপর সেই পুণ্যাত্মা মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে আরো বহুবার আমি দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গিয়েছি। তাঁরর কাছে ঈশ্বরের দয়াময়ী মাতৃভাবে আরাধনার মাধুর্য উপলব্ধি করেছি। পিতৃভাব বা ঐশ্বরিক ন্যায়মূর্তি ভজনা করার মধ্যে তিনি বিশেষ কোন আকর্ষণ অনুভব করতেন না। কঠোর, আর খুব খুঁটিনাটি নিখুঁত হিসাব করে চলা, তাঁর শান্ত প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।
একদিন তিনি উপাসনায় বসেছেন- দেখে মনে হল যেন তিনি মর্ত্যে স্বর্গের দেবদূতদেরই প্রতিমূর্তি। কোন বিচার-বিতর্ক বা অভিযোগ-অনুযোগ মনে বহন না করে, তিনি এই জগতকে তাঁর চিরদিনের ক্ষমাসুন্দর চক্ষেই দেখতেন। দেহ, মন, কথা, কাজ- সবই ছিল তাঁর অন্তরের সরলতার সঙ্গে একান্তভাবেই সুসমঞ্জস।
কোন জ্ঞানোপদেশ বিতরণের সময় আত্মগরিমাকে দূরে রেখে তিনি প্রায়ই এই কথা বলে শেষ করতেন, “আমার গুরুদেব এই কথা বলেছেন।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর একাত্মবোধ এতই নিবিড় ছিল যে, মাস্টার মহাশয় কোন চিন্তাকে তাঁর নিজের বলেই ভাবতে পারতেন না।
তাঁর স্কুলবাড়ির একটা অংশে একদিন সন্ধ্যেবেলা আমরা হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছি। এক পরিচিত ভদ্রলোক সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। লোকটি অত্যন্ত আত্মম্ভরী। দীর্ঘ তত্ত্বালোচনায় তিনি আমাদের ভারাক্রান্ত করে তুললেন।
ভদ্রলোক নিজের বক্তৃতায় নিজেই বিভোর; সেই আত্মম্ভরীর কর্ণগোচর না হয়, এমনভাবে মাস্টার মহাশয় চুপিচুপি আমায় বললেন, “দেখছি, এই লোকটিকে দেখে তুমি খুশি নও। যাইহোক, মায়ের কাছে সব জানিয়েছি। তিনি আমাদের দুর্ভোগ বুঝতে পেরেছেন। মা বললেন, যেই আমরা ওধারের ঐ লালবাড়িটার কাছে পৌঁছাব, অমনি ওর একটা ভয়ানক জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে যাবে।”
আমার চোখ দু’টি সেই মুক্তিতীর্থে নিবদ্ধ হয়ে রইল। লালবাড়িটার দরজার কাছে পৌঁছতেই লোকটি ঘুরে একেবারেই চলে গেল; না শেষ করলো তার কথা, না নিল বিদায়। বিক্ষুব্ধ পরিবেশ আবার শান্তশ্রী ধারণ করল।
আর একদিন হাওড়া স্টেশনের কাছ দিয়ে একলাই হাঁটছি। ক্ষণেকের জন্যে সেখানকার একটা মন্দিরের কাছে একটু দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটা ছোট দল, ঢোলক আর করতালের সঙ্গে উদ্দাম হয়ে গান শুরু করে দিয়েছে। আমি তাদের মনে মনে নিন্দা করছিলাম।
ভাবছিলাম “দেখেছো, কোন ভক্তিভাব ছাড়াই যন্ত্রের মত এরা নামগান করছে।” হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলাম মাস্টার মশায় খুব দ্রুতগতিতে আমারই দিকে এগিয়ে আসছেন। বললাম, “আপনি এখানে?” মাস্টার মহাশয় আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে যেন তার চিন্তার প্রত্যুত্তরেই বললেন, “আচ্ছা বাবা, ঠাকুরের নাম, কি জ্ঞানী কি মূর্খ, সকলের মুখ থেকেই কি শুনতে মধুর লাগে না?”
এই বলে সস্নেহে তিনি এক হাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। মনে হলো যেন তাঁর জাদু কার্পেটে চড়ে ভেসে তাঁর সঙ্গে মায়ের দরবারে গিয়ে হাজির হয়েছি। একদিন বিকেলে হঠাৎ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “একটা বায়োস্কোপ দেখবে না কি?”
প্রশ্নটা সংসার-বিরাগী মাস্টার মহাশয়ের কাছে থেকে আসাতে বেশ রহস্যময় বলেই বোধ হল। বায়োস্কোপ কথাটা তখন চলচ্চিত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হত। আমি তখনি রাজি হয়ে গেলাম, কারণ যে কোন উপলক্ষ্যে তাঁর সান্নিধ্য আমার অতীব প্রিয়।
যাইহোক, দু’জনে তো তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গোলদিঘীতে এসে পৌঁছালাম। মাস্টার মহাশয় সেখানে একটা বেঞ্চে বসতে ইঙ্গিত করলেন। মাস্টার মহাশয় বললেন, “এসো, খানিকক্ষণ এখানেই বসি।
গুরুদেব সর্বদাই বলতেন- কোন জলাশয় দেখলেই তার পাশে বসে ধ্যান করবে। এই নিস্তরঙ্গ রূপ-ঈশ্বরের বিরাট শান্তির ভাবটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সব জিনিষই যেমন জলে প্রতিবিম্বিত হতে পারে, তেমনি নিখিল বিশ্বজগতও বিশ্বচৈতন্য সাগরে প্রতিফলিত হতে পারে। গুরুদেব প্রায়ই এই কথা বলতেন।”
অল্প কিছুক্ষণ বাদেই আমার আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘরে প্রবেশ করলাম। সেখানে তখন একটা বক্তৃতা চলছিল। সেটা নীরস আর অত্যন্ত একঘেয়ে বলেই বোধ হল, যদিও স্লাইড দেখিয়ে মাঝে মাঝে একঘেয়ে বক্তৃতার ভিতর বৈচিত্র্য আনবার চেষ্টা করাও হচ্ছিল।
ভাবলাম “তা হলে মাস্টার মহাশয় কি আমায় এই ধরণের বায়োস্কোপ দেখাতে চেয়েছিলে না কি?” আমি অধীর হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু মুখে সেরকম ভাব প্রকাশ করে মাষ্টার মহাশয়ের সরল মনে আঘাত দিতে আর আমার মন চাইল না। যাইহোক, তিনি সাগ্রহে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “তবে ত’ দেখছি, তোমার এই ধরণের বায়োস্কোপ আর মনে ধরছে না।
মাকে জানালাম; তিনিও আমাদের দু’জনের জন্যে সমান দুঃখিত। তিনি আমায় জানিয়ে দিলেন যে, এই হলের বৈদ্যুতিক আলোগুলো এক্ষুনি নিভে যাবে, আর আমরা হল থেকে বেরিয়ে না পড়া পর্যন্ত তা নিভেই থাকবে, জ্বলবে না।”
আশ্চর্য! যেই মাত্র তাঁর কথা শেষ হল, অমনি হলটি একেবারে অন্ধকারে ডুবে গেল। বক্তা অধ্যাপক মহাশয়ের উচ্চ কণ্ঠ বিস্ময়ে একেবারে নীরব হয়ে গেল। তারপর তিনি বলে উঠলেন, “হলের ইলেকট্রিক লাইনগুলো দেখছি সব একদম খারাপ।” এর মধ্যেই মাস্টার মহাশয় আর আমি নিরাপদে দরজায় পৌঁছে গিয়েছি। বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে চেয়ে দেখলাম- হলঘরটি আবার আলোকিত হয়ে উঠেছে।
“বাবা, তুমি ঐ রকমের বায়োস্কোপ আদৌ খুশি হও নি দেখছি। যাক্, তুমি এবার আর এক ধরণের বায়োস্কোপ দেখে নিশ্চয় খুশি হবে বলে মনে হয়।” বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের ফুটপাথের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমার বুকে, হৃদপিণ্ডের উপর মৃদুভাবে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা নীরব আর অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেল।
শব্দযন্ত্র হঠাৎ বিকল হয়ে গেল আধুনিক ‘টকি’র কথাবলা ছবিগুলো যেমন এক নিমেষে শব্দহীন হয়ে যায়, তেমনি ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ যেন অলৌকিকভাবে জগতের সকল আওয়াজের কণ্ঠরূদ্ধ হয়ে গেল। পথচারীর দল, ট্রামগাড়ি, মোটর, গরুরগাড়ি, লোহার চাকাওয়ালা ‘ছ্যাকড়াগাড়ি’- সবই যেন নিঃশব্দ গতিতে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।
যেন একটি সর্বদর্শী চক্ষু দিয়ে সামনে পেছনে, দু’ধারে অত্যন্ত সহজভাবে সকল দৃশ্যই বেশ পরিষ্কারভাবে দেখতে লাগলাম। কলকাতার এক ক্ষুদ্র অংশের কর্মচাঞ্চল্যের যাবতীয় দৃশ্য আমার চক্ষের সম্মুখে নিঃশব্দে ঘটে যেতে লাগল।
মিহি ছাইয়ের তলায় ঢাকা আগুনের মৃদু আলোকছটার মত একটা স্নিগ্ধ উজ্জ্বল আলো সেই সব পরিদৃশ্যের উপর যেন ছড়িয়ে পরছিল। আমার নিজের দেহও সেই সব ছায়ামূর্তিদের একটির চেয়ে বেশি কিছু বোধ হচ্ছিল না- যদিও সেটা একেবারে নিশ্চল আর অন্যসকল ইতস্ততঃ নিঃশব্দ গতিতে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে।
কতগুলো ছেলে, আমারই সব বন্ধুবান্ধব- তারা কাছে এল বা চলেও গেল। আমার দিকে সরাসরি তাকালেও তারা আমায় মোটেই চিনতে পারল না।
এই অপূর্ব মূকদৃশ্য মনের মধ্যে এক অবর্ণনীয় হর্ষোচ্ছ্বাস এনে দিল। যেন কোন এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দের ধারা গভীরভাবে পান করছি। হঠাৎ মাস্টার মহাশয় আমার বুকে আবার সেইরকম মৃদুভাবে আঘাত করলেন। আবার আমার অনিচ্ছুক কর্ণদ্বয়ের মধ্যে রাজ্যের যত সব হট্টগোল হুড়মুড় করে এসে ঢুকে পড়ল।
হঠাৎ আমার মধুর আর সূক্ষ্ম স্বপ্নজাল একটা রূঢ় আঘাতে ছিঁড়ে যেতে, আচমকা জেগে উঠলাম। সেই অতীন্দ্রিয় ভাবমদিরা আমার নাগালের বাইরে চলে গেল। “এবার দেখছি যে, দ্বিতীয় বায়োস্কোপটি তোমার বেশ ভালই লেগেছে, তাই না?” মাস্টার মহাশয় হাসছিলেন।
কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে নতজানু হয়ে পায়ের উপর পড়তে যাচ্ছি দেখে, তাড়াতাড়ি আমায় ধরে ফেলে বললেন, “আরে, আরে করো কি, করো কি- এখন আর তুমি আমায় ওটি করতে পারবে না। তুমি ত’ জান যে, ভগবান তোমার মন্দিরেও রয়েছেন। আমি তো আর জগজ্জজননীকে তোমার হাত দিয়ে আমার পা ছুঁতে দিতে পারিনে।”
সেই জনবহুল ফুটপাথ থেকে বিনয়নম্র সরল মাস্টার মশায় আর আমাকে ধীরে ধীরে চলে আসবার সময় কেউ যদি লক্ষ্য করতো, তাহলে নিশ্চয়ই সন্দেহ হতে যে আমরা অবশ্যই নেশা করেছি। মনে হল, সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারও বুঝিবা সহানুভুতিতে ভগবৎপ্রেমমদিরা পান করেছে!
তাঁর এই সদাশয়তার প্রতি দুর্বল ভাষায় সুবিচারের চেষ্টা করতে গিয়ে আমি এই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি যে, মাস্টার মহাশয় আর অন্যান্য যেসব তত্ত্বদর্শী সাধুগণের সঙ্গ আমি জীবনে লাভ করেছি, তাঁরা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন যে, বহু বৎসর পরে পাশ্চাত্যের কোন এক দেশে বসে আমি তাঁদের দিব্য ভক্তজীবনের কাহিনী লিখব।
তাঁদের ভবিষ্যজ্ঞানের ক্ষমতার কথায় আজ আমি যেমন আশ্চর্য হই না, তেমনি আশা করি আমার পাঠকবর্গ, যাঁরা এতদূর পর্যন্ত আমার এ কাহিনীটি পড়েছেন, তাঁরাও বিস্মিত হবেন না।
ঈশ্বরের ভগবতীরূপের সরল ধারণার মাধ্যমেই সর্বধর্মের মুণিঋষিগণ ঈশ্বরানুভূতি লাভ করেছেন। যেহেতু পরব্রহ্ম হচ্ছেন ‘নির্গুণ’ এবং ‘অচিন্ত্য’, তাই মানবিকচিন্তা আর আকাঙ্ক্ষা এই সত্তাকে জগজ্জননীরূপে কল্পনা করে একটা প্রাতিস্বিক রূপদান করেছে।
প্রাতিস্বিক আস্তিক্যবাদ আর অদ্বৈতবাদ- এই দুয়ের সংযোগসাধন, হিন্দুর ঈশ্বরসাধনার একটা প্রাচীন বৈশিষ্ট্য- বেদ ও ভগবদ্ গীতায় যার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই দুটি ‘বৈপরীত্যে’র সমন্বয়, যুক্তি ও ভাবের সামঞ্জস্য ঘটায়। ‘ভক্তি’ ও ‘জ্ঞান’ মূলতঃ এক। ‘প্রপত্তি’ বা ঈশ্বরে আশ্রয় গ্ৰহণ, আর “শরণাগতি”- ঈশ্বরানুকম্পায় পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ- বস্তুতঃ সর্বোচ্চ জ্ঞানেরই মার্গ।
ঈশ্বরই যে একমাত্র প্রাণ, তিনিই যে একমাত্র বিচারক- এই ভাবের উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা হতেই মাস্টার মহাশয় আর অন্যান্য সাধুসন্তদের নম্রতাভাবের উদ্ভব। কারণ ঈশ্বরের স্বরূপই হচ্ছে আনন্দ; তাই তাঁর সঙ্গে একাত্মবোধে মানুষ সহজাত অসীম আনন্দলাভ করে থাকে।
“আত্মা ও সংকল্পের প্রথম ভাবাবেশ হচ্ছে আনন্দ।” সকল যুগে যেসব ভক্ত জগন্মাতার কাছে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন, তাঁরাই উপলব্ধি করেছেন যে মা তাঁদের সঙ্গে সদাই লীলা করে চলেছেন। মাস্টার মহাশয়ের জীবনেও এই দৈবলীলার প্রকাশ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা সময়েই ঘটত। ঈশ্বরের চোখে বড়-ছোট বলে কিছুই নেই।
তিনি যদিনা সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুপরমানু রচনা করতেন, তাহলে কি আর আজ আকাশ অভিজিৎ ও স্বাতীনক্ষত্রের মত বিরাট দেহ বুকে ধারণ করে থাকতে পারত? সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘প্রয়োজন’ ‘অপ্রয়োজনের’ কোন ভেদাভেদ নিশ্চয়ই অজ্ঞাত ছিল, নচেৎ একটা আলপিনের অভাবে সারা বিশ্বসৃষ্টিটাই লোপ পেয়ে যেত!
……………………………..
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন
সূত্র:
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi)
**শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।
**মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। -শ্রী শ্রীপরমহংস যোগানন্দ