ভবঘুরেকথা

কর্তা

যিনি এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় ঘটন অঘটন, সকল কার্য-কারণের কারণ ও সর্বময় কর্তা, তাকেই কর্তাভজন সত্যধর্মে কর্তা বলা হয়েছে। যিনি জগৎকর্তা তিনি নিরাকার-নিরঞ্জন, অব্যয়, অক্ষয়, অনন্ত-অসীম, তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই, তাঁর পিতা-মাতা নেই, তিনি নারী-পুরুষ, হিজড়ে-খোজা নন, তাঁর স্বামী কিম্বা স্ত্রী নেই এবং নির্দিষ্ট সংখ্যায়-পুত্র কন্যাও নেই। তিনি সুখ-দুঃখ, জ্বরা-ব্যধি, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, সদাচার-কদাচার, সর্বপ্রকার-বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তিতর্কের অতীত। ভাবেরগীত এ বলা হয়েছে-

কারো হন্ না গুরু, শিষ্য হন্ না কারো, সুচারু থাকেন সত্যপথে,
পাবেনা তত্ত্বে-অজ্ঞানেতে, ব্যভিচারী-সতীনারী দুয়ের কর্মনয়,
সহজ দেশের করণ করা দেশ আলাদা হয়।
নাই সদাচারে কদাচারে সারে, সুগোচর নাইকো বিচারেতে।
“মর্মটি হবে তার বুঝিতে” ‘ভাবেরগীত নং- ৪২১, কলি-২’

তার নির্দিষ্ট কোন নাম, রূপ নেই, রাম-শ্যাম, যাদব-মাধব এই রূপ নামবাচক বিশেষ্যপদ দিয়ে তাকে প্রমাণ করা যায় না, আমরা জগৎকর্তাকে যে নামেই ডাকি না কেন সব নামই মানুষের (ভক্তের) দেওয়া। কারণ- তার জন্ম-মৃত্যু নেই, পিতা-মাতা নেই, তাহলে এই-নাম গুলি কে রেখেছে? নিশ্চয় এগুলি মানুষের(ভক্তের) দেওয়া নাম। তাঁর নির্দিষ্ঠ কোন নাম ও নেই নির্দিষ্ট কোনও রূপও নেই, তাই জ্ঞান-বুদ্ধির তারতম্যহেতু মানুষ তাকে বিভিন্ন নামে ডাকছে এবং বিভিন্ন ভাবে ভাবছে। ভাবের গীত এ বলা হয়েছে-

আগম-নিগম ক্রমে কি বিধির বিধানে,
ব্রহ্ম নিরূপন হয়না কারো ধ্যানে কোনখানে,
সে অনির্বচ্চ-নির্বচ্চ কখনও তো নয়,
ভাবীজনার উপাসনায় থেকেছে প্রত্যয়।
(“ভাবলে কি… বলা যায়” ‘ভাবেরগীত নং- ৪১২, কলি-৪’)

ভাবার্থ: জ্ঞান-বুদ্ধি ও ধারণশক্তির তারতম্যহেতু জগৎকর্তা কারো কাছে সাকার আবার কারো কাছে নিরাকার, কারো কাছে সত্য, কারো কাছে মিথ্যা, তিনি কারো কাছে পরম পুরুষোত্তম (পুরুষ) আবার কারো কাছে পরমা প্রকৃতি (নারী) যেমন রাম, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, কালী ইত্যাদি। সাকার নিরাকার, সত্য-মিথ্যা, নারী-পুরুষ সবই তিনি, কারণঃ- মালিক সর্ব শক্তিমান তাতে সবই সম্ভব, যার মন যেমন তাঁর মালিকও তেমন, যুক্তি তর্ক দিয়ে এর বিচার করা যায় না।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেকটি পদার্থের অনু-পরমানুর মধ্যে তার অন্তর্নিহিত শক্তি বিদ্যমান এই সব খণ্ড খণ্ড শক্তি সমুহ এক মুল শক্তির অংশ মাত্র। এই মূল শক্তিই কর্তাভজা সত্যধর্মের মালিক বা কর্তা। জগৎ কর্তার খণ্ড খণ্ড শক্তি দ্বারা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। যেমন-

তাঁর সৃষ্টিশক্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে, -তাই তিনি সৃষ্টিকর্তা,
তাঁর ধারণ শক্তি দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণ করে রেখেছে, -তাই তিনি ধারণকর্তা।
তাঁর পালন শক্তি দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রতিপালন করছে, -তাই তিনি পালনকর্তা।
তাঁর সংহার শক্তি দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সংহার (ধ্বংস) করছে, -তাই তিনি সংহার কর্তা।

তাঁর ইচ্ছা শক্তিতে নিত্য নিত্য জীব জগৎ সৃজন, ধারণ, পালন ও সংহার থেকেছে তাই তিনি সর্বময় কর্তা, সকল কার্য কারণের আদি কারণ জগৎ কর্তা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই মূল শক্তি (ঝটচঅজ চঙডঊজ) বা জগৎ কর্তাকে বেদে বলা হয়েছে পরম ব্রহ্ম, বেদান্তে পরম ব্রহ্মকে নির্গুণব্রহ্ম ও স্বগুণ ব্রহ্ম বলা হয়েছে।

নির্গুণ ব্রহ্ম- তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় (স্বত্ত্ব, রজ, তম) এই ত্রিগুণের অতীত তাই তিনি ত্রিগুণাতীত, তাকে ধ্যান ধারণায় আনা যায় না তাই তিনি ধারণাতীত, তার রূপ কল্পনা করা যায় না তাই তিনি কল্পনাতীত, তার কোন রূপ নেই তাই তিনি নিরাকার, তাঁর কোন আদি নেই, তাই তিনি অনাদি, যারা জগৎ কর্তাকে নিরাকার ভাবে ভাবতে ভালোবাসে জগৎকর্তা তাদের কাছে নির্গুণ ব্রহ্ম।

স্বগুণ ব্রহ্ম- তার ইচ্ছায় নিত্য নিত্য সৃজন, পালন ও সংহার থেকেছে, বিশ্ব জগৎই ব্রহ্মময়, ভক্ত তাকে যে ভাবে ডাকে জগৎকর্তা তাকে সে ভাবেই ধরা দেন। যারা জগৎ কর্তাকে সাকার ভাবে ভাবতে ভালবাসে তাদের কাছে জগৎ কর্তা স্বগুণ ব্রহ্ম।

তবে কর্তাভজা সত্যধর্মের মতে জগৎকর্তা কোন দেব-দেবী নয় বা প্রকৃতির নিয়মের বশীভূত, পিতা-মাতার মাধ্যমে জগতে আসা কোন অবতার নয়, জগৎকর্তা হচ্ছে যার ইচ্ছায় নিত্য নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার হচ্ছে, যার মহিমায় জলে পাথর ভাসে, যার নামের মহিমায় জীবের মায়ামোহ দূর হয়, যার নামের গুণে সকল পাপ মুক্ত হয়ে, নিত্যধাম প্রাপ্ত হয়, তিনিই জগৎকর্তা।

সৃষ্টিতে তিনি পিতৃশক্তি পরম পুরুষ(শুক্র) তাই তিনি জগৎ পিতা। সৃষ্টিকে ধারণ করার জন্য তিনিই ধারণশক্তি, ধারণে প্রকৃতি বা নারী (শোণিত-ফুল) তাই তিনি জগৎ মাতা। পালনে মায়াশক্তি, জগৎ কর্তার মায়া শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে জীব সকল নিজ নিজ সন্তানের প্রতিপালন করছে, তাই তিনি পালন কর্তা। জগৎ কর্তার সংহার শক্তিতে নিত্য নিত্য জীবসকল ধ্বংস-ক্ষয়-মৃত্যু প্রাপ্ত হচ্ছে, তাই তিনি সংহার কর্তা। পরম ব্রহ্ম এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় অনু পরমানুতে বিদ্যমান। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যাকিছু আছে সব কিছু পরম ব্রহ্মের প্রতিছবি।

…………………………………..
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
১. ভবের গীত
২. কর্তাভজা সত্যধর্ম

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা সত্যধর্মের ৩০ ধারা
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষাগ্রহণ
সতী মা
কর্তাভজা সত্যধর্ম
কর্তাভজার দশ আজ্ঞা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
ডালিম তলার মাহাত্ম্য
বাইশ ফকিরের নাম
কর্তা
দুলালচাঁদ
কর্তাভজা সত্যধর্মের পাঁচ স্তম্ভ
সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
ভাবেরগীত এর মাহাত্ম্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!