কঠোর যৌগিক পন্থা অনুশীলন করার ফলে স্বর্গসুখ লাভ হতে পারে, এমন কি এই জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তিলাভও হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও সরল কোন পন্থা কি বেশি কিছু দিতে পারে ?
সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ ।
মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্ ॥ (গীঃ ৮/১২)
“ইন্দ্রিয়ের সমস্ত কার্যকলাপ স্তব্ধ করে, ইন্দ্রিয়ের সবকটি দ্বার সংযতপূর্বক মনকে হৃদয়ে নিবদ্ধ করে এবং প্রাণকে মস্তকের উপরিভাগে ধারণ করে যোগে স্থিত হতে হয়।”
বিভিন্ন রকমের পরমার্থবাদী বা যোগী রয়েছেন- জ্ঞান যোগী, ধ্যান যোগী এবং ভক্তি যোগী। তাঁরা সকলেই চিৎ-জগতে প্রবেশ করার যোগ্য, কারণ যোগ-পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হওয়া।
প্রকৃতপক্ষে, আমরা ভগবানের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু কোন না কোন কারণবশত জড় জগতের সংস্পর্শে এসে কলুষিত হয়ে পরেছি। তাই এখন আমাদের পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। সেই যুক্ত হওয়ার পন্থাকে বলা হয় যোগ।
পূর্ববর্তী যুগে পরমার্থবাদীরা গভীর জঙ্গলে কিংবা পর্বত-কন্দরে বসে তপস্যায় রত হতেন। ঋজুভাবে বসে এবং শ্বাস নিয়ন্ত্রন করে, সব রকমের জাগতিক কার্যকলাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে তাঁরা ক্রমে ক্রমে আহার এবং নিদ্রা পর্যন্ত বর্জন করতেন।
যতই তাঁরা সিদ্ধিলাভের পথে অগ্রসর হতেন, ততই তাঁদের আত্মিক উন্নতি সাধিত হত, এবং অবশেষে তাঁরা প্রাণবায়ুকে মস্তকে প্রেরণ করে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করার মাধ্যমে উচ্চতর কোন গ্রহলোকে কিংবা সরাসরি চিন্ময় ভগবদ্ধামে গমন করতেন। এই ধরনের যোগের পন্থা অবলম্বন করে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে হাজার হাজার বছর সময় লাগে এবং বিশেষ করে এই যুগে তা একেবারেই সম্ভব নয়।
যোগ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে “যুক্ত হওয়া” এখন আমরা ভগবানের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছি। কিন্তু আমরা যখন পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হই, তখন আমাদের এই মানব-জীবন সার্থক হয়।
মৃত্যুর সময় আমাদের এই দুর্লভ মানব-জন্মকে সার্থক করে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে হবে। যতদিন আমরা বেঁচে আছি, ততদিন আমাদের সেই স্বার্থকতা লাভের প্রয়াস করতে হবে, এবং মৃত্যুর সময়, যখন আমরা আমাদের জড় দেহ ত্যাগ করি, তখন অবশ্যই সেই সার্থকতা লাভ করতে হবে।
‘প্রয়াণকালে মনসাচলেন’ ; প্রয়াণকালে কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘মৃত্যুর সময়’। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, একটি ছাত্র যেমন দু’বছর, তিন বছর অথবা চার বছর ধরে কলেজে পড়াশুনা করে, অবশেষে তাকে পরীক্ষায় বসতে হয়। সে যদি পরীক্ষায় পাশ করে, তখন সে স্নাতক উপাধি পায়।
তেমনই, আমরা যদি আমাদের মৃত্যুর পরীক্ষার জন্য নিজেদের তৈরি করি এবং সেই পরীক্ষায় যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি, তা হলে আমরা চিৎ-জগতে প্রবেশ করতে পারি। আমাদের জীবদ্দশায় যা কিছু আমরা শিখেছি, তার পরীক্ষা আমাদের দিতে হয় মৃত্যুর সময়।
তাই এখানে ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন যে, মৃত্যুর সময়, আমাদের দেহত্যাগ করার সময় আসে, তখন আমাদের কি করা উচিত।
ধ্যানে যোগীদের পন্থা হচ্ছে- সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রত্যাহার। প্রত্যাহার শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘বিপরীত’। যেমন, আমাদের চোখ নিরন্তর জাগতিক সৌন্দর্য দর্শনে ব্যস্ত। তাই আমাদের সেই বাহ্যিক সৌন্দর্য দর্শন থেকে বিরত হতে হবে এবং তার পরিবর্তে আমাদের অন্তরের সৌন্দর্য দর্শনের জন্য ধ্যান করতে হবে। তাকে বলা হয় প্রত্যাহার।
তেমনই বহির্জগতের শব্দ শ্রবণ না করে আমাদের কর্ণ দ্বারা আমাদের অন্তর থেকে শব্দব্রহ্ম ওঁ-কার শ্রবণ করতে হবে। এইভাবে সবকটি ইন্দ্রিয়কে বাহ্যিক কার্য থেকে বিরত করে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যানে নিযুক্ত করতে হবে। সেটিই হচ্ছে ধ্যান-যোগের পূর্ণতা- মনকে পরমেশ্বর ভগবানের চিন্তায় একাগ্রীভূত করা। মন অত্যন্ত চঞ্চল।
তাই তাকে হৃদয়ে নিবদ্ধ করতে হবে- মনো হৃদি নিরুদ্ধ। তারপর প্রাণবায়ুকে মস্তকের উপরিভাগে বা মূর্ধ্ন্যায় স্থানান্তরিত করতে হবে- মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগ-ধারণাম। সেটিই হচ্ছে যোগের পূর্ণতা।
সিদ্ধ ধ্যান-যোগী দেহত্যাগের পর তাঁর গন্তব্যস্থল মনোনয়ন করতে পারেন। এই জড় জগতে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে, এবং এই জড় গ্রহগুলির উর্ধ্বে রয়েছে চিন্ময় জগৎ। যোগীরা বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে অবগত। তাঁরা সেই তথ্য পান কোথা থেকে? শাস্ত্র থেকে। বৈদিক শাস্ত্র থেকে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, তোমাদের এই দেশে আসার আগে, বইতে তোমাদের দেশের বর্ণনা পড়ে সেই সম্বন্ধে আমি জানতে পেরেছিলাম। তেমনই, উচ্চতর লোক এবং চিন্ময় জগতের বর্ণনা আমরা পাই শ্রীমদ্ভাগবতে।
যোগীরা সব কিছু জানেন, তাঁরা তাদের ইচ্ছা অনুসারে যে কোনও লোকে যেতে পারেন। তাঁদের সেই জন্য কোন মহাকাশ-যানের প্রয়োজন হয় না। বৈজ্ঞানিকেরা কত বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছে মহাকাশ-যানে চড়ে অন্য গ্রহে যাওয়ার জন্য এবং তারা শত শত বৎসর ধরে সেই চেষ্টা করে যাবে, কিন্তু তারা কোনদিনই সফল হবে না। সেই কথা আমি হলপ করে বলতে পারি।
কারণ অন্যান্য গ্রহে যাওয়ার পন্থা সেটি নয়। হয়ত বৈজ্ঞানিক উন্নতির মাধ্যমে একজন অথবা দু’জন সফল হবে, কিন্তু সেটি সাধারণ প্রক্রিয়া নয়। সাধারণ প্রক্রিয়া হচ্ছে তুমি যদি অন্য কোনও উচ্চতর লোকে যেতে চাও, তাহলে তোমাকে ধ্যান-যোগের পন্থা অনুশীলন করতে হবে- অথবা জ্ঞান-যোগের পন্থা অনুশীলন করতে হবে। কিন্তু ভক্তিযোগের পন্থা নয়।
ভক্তিযোগের পন্থা এই জড় জগতের কোন গ্রহে যাওয়ার জন্য নয়। যাঁরা ভক্তি-সহকারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তাঁরা এই জড় জগতের কোন গ্রহের প্রতি আগ্রহী নন। কেন? কারণ তাঁরা জানেন যে, যে-লোকেই আমরা উন্নীত হই না কেন, জড় অস্তিত্বের চারটি তত্ত্ব সেখানেও থাকবে।
সেই তত্ত্বগুলি কি? জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি। যে-লোকেই তুমি যাও না কেন, উচ্চতর কোন লোকের আয়ু এই জড় জগতের থেকে অনেক অনেক বেশি হতে পারে, কিন্তু তবুও, সেখানেও মৃত্যু রয়েছে। জড়জাগতিক জীবন মানেই হচ্ছে জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি।
আর পারমার্থিক জীবন মানে হচ্ছে এই সমস্ত দুর্দশাগুলি থেকে মুক্ত হওয়া। তখন আর জন্ম থাকে না, মৃত্যু থাকে না, অজ্ঞানতা থাকে না এবং দুঃখ-দুর্দশা থাকে না। তাই যাঁরা বুদ্ধিমান, তাঁরা এই জড় জগতের কোন উন্নত লোকে উন্নীত হতে চান না।
বৈজ্ঞানিকেরা এখন চাঁদে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা অত্যন্ত কঠিন, কারণ সেখানে বসবাসের উপযুক্ত শরীর তাদের নেই। কিন্তু আমরা যদি এই যোগ পদ্ধতির দ্বারা উচ্চতর লোকে প্রবেশ করি, তা হলে সেই গ্রহের উপযোগী শরীর আমরা প্রাপ্ত হব।
প্রতিটি গ্রহেরই বসবাসের উপযোগী এক-একটি শরীর রয়েছে। তা না হলে আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারি না। যেমন, যদিও এই শরীর নিয়ে আমরা জলে থাকতে পারি না, অক্সিজেনের ট্যাঙ্ক নিয়ে আমরা জলে থাকতে পারি-পনেরো অথবা ষোলো ঘণ্টার জন্য।
কিন্তু একটি জলচর প্রাণী, একটি মাছের জলে বাস করার উপযোগী শরীর রয়েছে- তারা সারাজীবন জলেই থাকছে। আর কেউ যদি জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুলে আনে, তা হলে তৎক্ষণাৎ মাছটি মারা যায়। সুতরাং আপনারা বুঝতে পারছেন, যেমন এই গ্রহের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করার উপযুক্ত শরীরের আপনার প্রয়োজন, তেমনই, আপনি যদি অন্য আর একটি গ্রহে যেতে চান, তা হলে সেই গ্রহের উপযোগী একটি শরীর প্রাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
স্বর্গলোকের এক দিন এবং রাত্রি হচ্ছে আমাদের এক বছরের সমান, এবং সেখানে আয়ু হচ্ছে দশ হাজার বছর। সেই কথা বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং সেখানে নিঃসন্দেহে অতি দীর্ঘ আয়ু লাভ করা যায়। কিন্তু তারপর মৃত্যু হয়। মৃত্যু সেখানেও রয়েছে। দশ হাজার বছর পর, অথবা কুড়ি হাজার বছর পর, অথবা দশ লক্ষ বছর পর- তাতে কিছু যায় আসে না।
তারপর মৃত্যু আসে। কিন্তু আমাদের স্বরূপে আমরা মৃত্যুহীন- সেই কথা ভগবদ্গীতার প্রথমেই বলা হয়েছে। ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে- শরীরকে হত্যা করা হলেও আমাদের মৃত্যু হয় না- কারণ আমাদের স্বরূপে আমরা হচ্ছি জন্মহীন, মৃত্যুহীন চিন্ময় আত্মা।
তা হলে কেন আমরা জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ হই? সেই প্রশ্নটি করাই হচ্ছে, যথার্থ বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। যে সমস্ত মানুষ কৃষ্ণভাবনামৃত অবলম্বন করছেন, তাঁরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তাঁরা এমন কোন লোকে উন্নীত হতে চান না, যেখানে মৃত্যু রয়েছে, তা সেখানকার আয়ু যত দীর্ঘই হোক্ না কেন।
তাঁরা ঠিক ভগবানের মতো একটি চিন্ময় শরীর লাভ করতে চান। ভগবানের দেহ হচ্ছে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ- ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ। সৎ মানে হচ্ছে ‘নিত্য’, চিৎ মানে হচ্ছে ‘পূর্ণ জ্ঞানময়’ এবং আনন্দ মানে হচ্ছে ‘আনন্দময়’।
আমরা যদি এই দেহ ত্যাগ করার পর চিৎ-জগতে স্থানান্তরিত হতে পারি, সেখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করতে পারি- সেখানে আমরাও তাঁর মতো সৎ, চিৎ এবং আনন্দময় দেহ লাভ করতে পারি। যে সমস্ত মানুষ এই জড় জগতে উচ্চতর সমস্ত লোকে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের থেকে কৃষ্ণভক্তের জীবনের উদ্দেশ্য ভিন্ন।
আমাদের স্বরূপে আমরা হচ্ছি অতি ক্ষুদ্র চিৎ-কণা যা আমাদের দেহাভ্যন্তরে রয়েছে, এবং তা ধারণ করে আছে প্রাণবায়ু। ধ্যান-যোগ পদ্ধতি, ষড়চক্র পদ্ধতির অনুশীলন করার মাধ্যমে আত্মাকে হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে মস্তকে সর্বোচ্চভাগে মূর্ধ্ন্যায় অধিষ্ঠিত করা হয়।
আর এই যোগের সিদ্ধি হচ্ছে আত্মাকে মস্তকের উপরিভাগে অধিষ্ঠিত করা এবং তারপর মস্তকের উপরিভাগে বিদীর্ণ করে নিজের ইচ্ছামত উচ্চতর কোন লোকে যাওয়া। ধ্যান-যোগী তাঁর ইচ্ছা অনুসারে যে কোন লোকে যেতে পারেন।
সুতরাং আপনারা যদি চান- যেমন আপনারা চন্দ্রলোকে যেতে চান-তা হলে যোগ অনুশীলন করে আপনারা সেখানে যেতে পারেন। যোগী মনে করেন, “আমি এখন একটু দেখে আসি চন্দ্রলোকটি কেমন, তারপর আমি উচ্চতর লোকে যাব।” একজন সাধারণ পর্যটকের মনোভাবও ঠিক তেমনই।
তারা নিউইয়র্কে আসে, তারপর ক্যালিফোর্নিয়ায় যায়, তারপর কানাডায় যায়। তেমনই, এই যোগ পদ্ধতি অনুশীলন করার ফলে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে যাওয়া যায়। কিন্তু আপনারা যেখানেই যান না কেন, সেখানে যাবার জন্য ‘ভিসা’ লাগে এবং সেখানে ‘কাস্টমস্’ রয়েছে।
যদি উপযুক্ত ‘ভিসা’ না থাকে, তা হলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর ‘ভিসা’র মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই দেশ ছেড়ে আপনাকে চলে যেতে হবে। তাই কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এই ধরণের ক্ষণস্থায়ী গ্রহগুলির প্রতি উৎসুক নন। সেখানকার জীবন অতি দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু তবুও তিনি সেই জীবনের প্রতি উৎসাহী নন।
যোগের একটি পন্থা হচ্ছে এই দেহটি কিভাবে ত্যাগ করতে হবে-
ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাাহরন্মামনুস্মরন্।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্ ॥
মৃত্যুর সময়- “ওঁ-ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম”। তিনি ওঁ-কার উচ্চারণ করতে পারেন। ওঁ-কার হচ্ছে চিৎ-জগতের শব্দতরঙ্গের সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। ওঁ-ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্- কেউ যদি এই শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন, এবং সেই সময় “মাম্ অনুস্মরন্,” শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে স্মরণ করতে পারেন, তা হলে তিনি চিন্ময় জগতে প্রবেশ করতে পারেন।
সমস্ত যৌগিক পন্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব-মনকে শ্রীবিষ্ণুর চিন্তায় একাগ্রীভূত করা; কিন্তু নির্বিশেষবাদীরা অনুমান করে যে, এই ওঁকার হচ্ছে বিষ্ণুর রূপ। যাঁরা সবিশেষবাদী, তাঁরা কোন অনুমান বা কল্পনা করেন না। তাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের প্রকৃত রূপ দর্শন করেন।
তা যাই হোক্, আপনি কল্পনার মাধ্যমে আপনার মনকে একাগ্রীভূত করতে চান অথবা বাস্তবিকভাবে দর্শন করেন, আপনার মনকে শ্রীবিষ্ণুর রূপে একাগ্রীভূত করতেই হবে। এখানে ‘মাম্’ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর প্রতি।” য প্রয়াতি ত্যজন্ দেহম্- যিনি শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন- স যাতি পরমাং গতিম্- তিনি চিন্ময় জগতে প্রবেশ করেন।
যাঁরা প্রকৃত যোগী, তাঁরা এই জড় জগতের কোন গ্রহে যেতে চান না। কেন না তাঁরা জানেন যে, সেখানকার জীবন ক্ষণস্থায়ী। সেটিই হচ্ছে যথার্থ বুদ্ধিমত্তা। যারা ক্ষণস্থায়ী সুখ ভোগ করে ক্ষণস্থায়ী জীবন লাভ করে এবং ক্ষণস্থায়ী সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে সন্তুষ্ট হতে চান, তারা বুদ্ধিমান নন। ভগবদ্গীতায় (৭/২৩) বর্ণনা করা হয়েছে- অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্। যারা নশ্বর ফল লাভের প্রয়াসী, তাদের বুদ্ধি অল্প। আমি চিরস্থায়ী। আমি নিত্য। অনিত্য অস্তিত্ব লাভ করতে কে চায়? কেউই চায় না।
যেমন মনে করুন, যে বাড়িটিতে আপনি থাকেন, সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা এসে একদিন আপনাকে বলল যে, এই বাড়িটি ছেড়ে আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন আপনার দুঃখ হবে। সেটিই হচ্ছে আমাদের প্রকৃতি- আমরা যেখানেই থাকি, যেহেতু আমরা হচ্ছি চিরস্থায়ী, তাই অমরা একটি চিরস্থায়ী আবাস চাই। সেটিই আমাদের প্রবণতা। আমরা মরতে চাই না। কেন? কারণ আমরা হচ্ছি নিত্য। আমরা রোগগ্রস্ত হতে চাই না। এই সব কিছুই হচ্ছে কৃত্রিম, বাহ্যিক বিষয়- রোগ, মৃত্যু, জন্ম, দুঃখ। এই সব হচ্ছে বাহ্যিক বিষয়।
যেমন মাঝে মাঝে আমাদের জ্বর হয়। জ্বরে ভুগে কষ্ট পেতে আমরা চাই না, কিন্তু তবুও কখনও তা হয়। আমাদের সাবধান থাকতে হয় যাতে জ্বর না হয়। তেমনই, এই চারটি বাহ্যিক দুঃখ- জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি- এইগুলি জড় দেহজাত। আমরা যদি এই জড় দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি, তা হলে আমরা এই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারি।
সুতরাং নির্বিশেষবাদী যোগীদের নির্দেশিত পন্থা হচ্ছে এই অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ ওঁ উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করা। কেউ যদি পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে পূর্ণরূপে চেতন হয়ে এই অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ ওঁ উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করতে পারেন, তা হলে তিনি অবশ্যই চিৎ-জগতে প্রবিষ্ট হবেন।
কিন্তু যাঁরা সবিশেষবাদী নন, তাঁরা চিন্ময় জগতে প্রবেশ করতে পারেন না। তাঁরা চিৎ-জগতের বাইরে থাকেন। ঠিক যেমন সূর্য গ্রহ এবং সূর্যমন্ডল। সূর্যকিরণ সূর্যগোলক থেকে ভিন্ন নয়। তবুও সূর্যকিরণ সূর্যগোলক নয়। তেমনই, যে সমস্ত নির্বিশেষবাদী চিৎ-জগতে প্রবেশ করেন, তাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা ব্রহ্মজ্যোতিতে লীন হয়ে যান।
আমরা সকলেই হচ্ছি অতি ক্ষুদ্র এক-একটি স্ফুলিঙ্গ, আর ব্রহ্মজ্যোতি এই ধরনের চিৎ-স্ফুলিঙ্গের দ্বারা পূর্ণ। সুতরাং তখন আপনি একটি চিৎ-স্ফুলিঙ্গে পরিণত হন। অর্থাৎ চিন্ময় অস্তিত্বে লীন হয়ে যান। আপনার স্বতন্ত্রতা থাকবে, কিন্তু যেহেতু আপনি কোন সবিশেষ রূপ চান না, তাই আপনাকে তখন নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতিতেই ধরে রাখা হবে।
সূর্যকিরণে যেমন উজ্জ্বল অণু দেখতে পাওয়া যায়- বৈজ্ঞানিকেরা সেই কথা জানেন, তেমনই আমরা হচ্ছি পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র এক-একটি চিৎ-কণিকা। আমাদের আয়তন হচ্ছে কেশাগ্র ভাগের দশ সহস্র ভাগের এক ভাগ। সুতরাং সেই চিৎ-কণাটি ব্রহ্মজ্যোতিতে অবস্থান করে।
জীবরূপে আমরা আনন্দ পেতে চাই। কেননা আমি কেবল যে বেঁচে আছি তা নয়, আমার আনন্দানুভূতি রয়েছে। যাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের নির্বিশেষ জ্যোতিতে প্রবেশ করেন, তাঁরা পূর্ণ জ্ঞান সহকারে নিত্যকাল সেই তত্ত্বে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁরা নিত্য আনন্দ লাভ করতে পারেন না, কেননা সেখানে সেটির অভাব রয়েছে।
আপনাকে যদি একলা একটি ঘরে আটকে রাখা হয়, তা হলে আপনি একটি বই পড়তে পারেন অথবা কোন কিছু সম্বন্ধে চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু আপনি সারাজীবন একলা সেখানে থাকতে পারেন না। সেটি সম্ভব নয়। আপনি তখন কারো সঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন, কোন রকম আনন্দ লাভের প্রত্যাশা করেন।
সেটিই হচ্ছে আমাদের স্বাভাবিক প্রকৃতি। তেমনি, আমরা যদি পরমেশ্বর ভগবানের নির্বিশেষ অঙ্গজ্যোতিতে লীন হয়ে যাই, তখন আবার এই জড় জগতে অধঃপতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই কথা শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে (১০/২/৩২)-
যেহন্যেহরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিন-
স্ত্বয্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ।
আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ
পতন্ত্যধোহনাদৃতযুষ্মদ ঙ্ঘ্রয়ঃ ॥
ঠিক যেমন একজন মহাকাশচারী অনেক অনেক উচুঁতে- পঁচিশ হাজার অথবা ত্রিশ হাজার অথবা একশ’ মাইল উপরে যেতে পারে। কিন্তু তাকে কোন না কোন গ্রহে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় খুঁজতে হয়। নির্বিশেষরূপে সেই আশ্রয়ের কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই শ্রীমদ্ভাগতে বলা হয়েছে, আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ।
বহু কষ্ট সাধন করে কৃচ্ছ্র সাধন করে নির্বিশেষবাদীরা যদি চিৎ-জগতে প্রবেশ করে, তবুও তাদের অধঃপতিত হওয়ার (পতন্তি অধঃ) সম্ভবনা থাকে। কেন? অনাদৃত যুষ্মদঙঘ্রয়ো- কারণ তিনি প্রেম এবং ভক্তি সহকারে পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করার অবহেলা করেছেন।
সুতরাং আমরা যতক্ষণ এখানে রয়েছি, ততক্ষণ আমাদের পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভালাবাসার অনুশীলন করতে হবে, তা হলে আমরা চিন্ময়লোকে প্রবেশ করতে পারব। এই অনুশীলন যদি আমরা না করি, তা হলে নির্বিশেষ প্রচেষ্টার দ্বারা চিৎ-জগতে প্রবেশ লাভ হলেও আবার অধঃপতিত হতে হবে। কারণ সেখানকার নিঃসঙ্গতার অতৃপ্তির ফলে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গ সুখের প্রত্যাশা হবে, এবং তখন পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গ না পাওয়ার ফলে আবার এই জগতে ফিরে আসতে হবে।
তাই আমাদের স্বরূপগত প্রবৃত্তি সম্বন্ধে অবগত হওয়া উচিত। আমাদের স্বরূপগত প্রবৃত্তি অনুসারে আমরা নিত্যত্ব, পূর্ণ জ্ঞান এবং আনন্দের প্রয়াসী। একা একা আমরা আনন্দ উপভোগ করতে পারি না। তখন আমরা অস্বস্তি অনুভব করি, এবং আনন্দ না পাওয়ার ফলে আমরা যে কোনও রকম জড় আনন্দের প্রত্যাশী হই- তাতে একটি মস্ত বড় বিপদের সম্ভাবনা তাকে।
কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় আমরা পূর্ণ আনন্দ লাভ করতে পারি। এই জড় জগতের সব চাইতে বড় সুখ হচ্ছে যৌন-জীবন এবং সেটি হচ্ছে অপ্রাকৃত আনন্দের বিকৃত প্রতিফলন- সেটি এক রকম ব্যাধি। অপ্রাকৃত জগতের সঙ্গসুখের আনন্দ রয়েছে, তবে তা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। কিন্তু আমাদের কখনই মনে করা উচিত নয় যে, সেই আনন্দ এই জগতের যৌন-জীবনের সুখের মতো। মৈথুনের সুখ হচ্ছে অপ্রাকৃত জগতের আনন্দের বিকৃত প্রতিফলন। তা কেবল বিকৃত প্রতিফলন। কিন্তু প্রকৃত আনন্দ রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আনন্দময়।
তাই আমাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়ার চেষ্টা করা। তা হলে এই জীবনে মৃত্যুর সময় আমরা অপ্রাকৃত জগতে কৃষ্ণলোকে প্রবিষ্ট হতে পারব এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দিব্য আনন্দ উপভোগ করতে পারব।
চিন্তামনিপ্রকরসদ্মসু কল্পবৃক্ষ
লক্ষাবৃতেষু সুরভীরভিপালয়ন্তম্।
লক্ষ্মীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং
গোবিন্দমাদিপুরুষং ত্বমহং ভজামি॥
এটি হচ্ছে কৃষ্ণলোকের বর্ণনা। চিন্তামণিপ্রকরসদ্মসু- সেখানকার গৃহগুলি চিন্তামণির দ্বারা তৈরী। আপনারা কি জানেন চিন্তামণি কি? এটি এক রকমের রত্ন। তা দিয়ে যদি লোহাকে স্পর্শ করা হয়, তা হলে লোহা তৎক্ষণাৎ স্বর্ণে পরিণত হয়। সেই চিন্তামণি অবশ্য আপনারা দেখেননি, কিন্তু তা রয়েছে। ভগবদ্ধামের সমস্ত গৃহগুলি চিন্তামণি দিয়ে তৈরি- চিন্তামণিপ্রকরসদ্মসু কল্পবৃক্ষ- সেখানকার বৃক্ষগুলি হচ্ছে কল্পবৃক্ষ।
সেই বৃক্ষের কাছে আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। এখানে একটি আমগাছ থেকে কেবল আমই পাওয়া যায় আর আপেল গাছ থেকে কেবল আপেল। কিন্তু এই কল্পবৃক্ষের কাছে আপনার ইচ্ছা অনুসারে যা আপনি চাইবেন, তাই আপনি পাবেন। সেটি হচ্ছে কৃষ্ণলোকের বর্ণনা।
সুতরাং এই জড় জগতের অন্য কোন গ্রহে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করাটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কারণ এই জড় জগতের যেলোকেই আমরা যাই না কেন, সেখানেই আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করতে হবে। এই দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করাটাই আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তা নিয়ে আমরা চিন্তা করি না।
আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা তাদের প্রগতির গর্বে অত্যন্ত গর্বিত, কিন্তু জড় জগতের সমস্ত অপ্রীতিকর ক্লেশগুলির নিবৃত্তি করার কোন উপায় তাদের জানা নেই। সেটি সম্ভবও নয়। মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার উপায় তারা উদ্ভাবন করছেন, কিন্তু মৃত্যুকে রোধ করার পন্থা তারা প্রদর্শণ করতে পারছেন না। তাদের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়।
সুতরাং যাঁরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তাঁরা জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি সম্পর্কে উৎসাহী নন। তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় দিব্য জীবন লাভ করা। আর তা সম্ভব তখনই হয়, যখন আমরা চিন্ময় লোকে প্রবেশ করতে পারি। সেই কথা ভগবদ্গীতায় (৮/১৪) বলা হয়েছে-
অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ ॥
যিনি নিত্যযুক্ত তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী- যিনি নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করেন এবং নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত, তিনিই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। এই ধরনের সিদ্ধযোগী কখনও অন্য কোন পন্থা বা অন্য কেন যোগ পদ্ধতির চিন্তায় তাঁর চিত্তকে বিক্ষিপ্ত হতে দেন না। তিনি কেবল একটি মাত্র পদ্ধতি- কৃষ্ণভক্তিতে যুক্ত। তিনি অনন্যচেতা- তিনি কোন কিছুর দ্বারাই বিচলিত হন না। তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের কথাই চিন্তা করেন; অনন্যচেতাঃ সততং। সততং শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘সর্ব অবস্থায় এবং সর্বক্ষণ।’
যেমন, আমার আবাস হচ্ছে বৃন্দাবনে। সেটি হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের ধাম, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু আমি যে এখন আমেরিকায় রয়েছি, আপনাদের দেশে রয়েছি, তার অর্থ এই নয় যে, আমি বৃন্দাবনের বাইরে রয়েছি। কারণ আমি সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করি, এবং তা বৃন্দাবনে থাকারই মতো। আমি বৃন্দাবনেই রয়েছি। আমি নিউ ইয়র্কের এই ঘরটিতে থাকলেও আমার চেতনা রয়েছে বৃন্দাবনে। কৃষ্ণভাবনামৃতের অর্থ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ধামে থাকা। তখন কেবল এই দেহটি ত্যাগ করার প্রতীক্ষা করতে হয়।
সুতরাং এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা- অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরন্তি। স্মরন্তি মানে হচ্ছে ‘স্মরণ করা’। নিত্যশঃ- ‘নিরন্তর’। শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন যে, যিনি নিরন্তর তাঁকে স্মরণ করেন, তাঁর কাছে তিনি অত্যন্ত সহজলভ্য হন। যিনি কৃষ্ণভাবনার পন্থা অবলম্বন করেছেন, তাঁর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু, সব চাইতে দুর্লভ বস্তু, অত্যন্ত সুলভ হয়ে যায়। তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ- “যেহেতু তিনি নিরন্তর এই ভক্তিযোগে যুক্ত, তাঁর কাছে আমি অত্যন্ত সুলভ হয়ে যাই। অত্যন্ত সহজলভ্য হয়ে যাই। ”
আমি কেন কোন কঠিন পন্থা অবলম্বন করতে যাব ? আমরা কেবল-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
কীর্তন করি। – এইভাবে আমরা দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘন্টাই কীর্তন করতে পারি। এই মহামন্ত্র উচ্চারণের কোন বিধিনিষেধ নেই। রাস্তার মাঝখোনেই হোক্, অথবা রেলের কামরাতেই হোক্, গৃহেই হোক্ অথবা অফিসেই হোক্, আমরা এই মহামন্ত্র কীর্তন করতে পারি এবং সেইজন্য কোন পয়সা খরচ করতে হয় না বা কোন রকম মূল্য দিতে হয় না। আপনারাও তা করুন না?