সৌন্দর্যের কথা বলিতে গেলেই পূর্বে রসের কথা বলা আবশ্যক। জগৎটা রসের জন্য পাগল। কিসে রস পাইবে, কোথায় পাইবে, কোথায় রস আছে, তাহার সন্ধান কেহ জানে না, তবু সকলেই রস চায়। মধুকর গুঞ্জন করিতে করিতে পুষ্প হইতে পুষ্পান্তরে ভ্রমণ করে, সেও রসেরই আকাঙ্ক্ষায়, যোগী যোগমগ্ন, ভোগী ভোগবিলাসে বিভোর, স্ত্রীকে ভালবাসি, পুত্রকে ভালবাসি, যেখানে সৌন্দর্য দেখি, সেখানে ছুটিয়া যাই- সবই রসের পিপাসায়, রসের লোভে সকলেই চঞ্চল। রস ভিন্ন প্রাণী বাঁচিতে পারে না। “কো হ্যন্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদ্যেষ আকাশ আনন্দোন স্যাৎ”। রসই সার- রসই সত্ত্ব।
যাহার আস্বাদন হয় নাই, তাহার জন্য আকাঙ্ক্ষা হইতে পারে না। রসের জন্য জগৎ পাগল, সুতরাং তাহার অনুভূতি একদিন কোথাও অবশ্যই হইয়াছে। নিশ্চয়ই একদিন সমস্ত জগৎ সেই রসপানে মাতোয়ারা হইয়া আত্মহারা হইয়াছিল, পরে নিয়তির প্রেরণায় সে অবস্থা হইতে বিচ্যুতি হইয়া পড়িয়াছে।
যোগ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া জগৎ আজ তাহারই পুনঃপ্রাপ্তির আশায় মণিহারা ফণীর ন্যায় অশান্তভাবে ছুটিতেছে। যতদিন পুনরায় সেই যোগস্থাপনা না হইবে ততদিন এ অশান্তি ঘুচিবার সম্ভাবনা নাই।
যে বস্তুর স্বাদ যে পায় নাই, তাহার জন্য তাহার আকাঙ্ক্ষা হয় না। কিন্তু রসের স্বাদ আমরা কবে পাইলাম, কোথায় ও কিভাবে পাইলাম? কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, এ প্রশ্নের বিশেষ কোনই সার্থকতা নাই। কারণ, জীবনের অতীত অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, রসানুভূতি সকলেরই কখনও না কখনও অল্পবিস্তর অবশ্যই হইয়াছে।
ভাল লাগা, সুন্দর বোধ হওয়া, আনন্দ অনুভব করা- ইহা কাহারও কখন ঘটে নাই, এমন বলা যায় না। সুতরাং রসের জন্য আকাঙ্ক্ষা হওয়া কিছুই বিচিত্র নহে। কিন্তু এ উত্তর সমীচীন বলিয়া মনে হয় না। প্রধান কারণ, যাহা চাই আর যাহা অনুভব করিয়াছি, তাহা সজাতীয় নহে।
আস্বাদন করিয়াছি বেদানা, অথচ চাহিতেছি আঙ্গুর- এমনটা হইতে পারে না। যে রস অনুভব করিয়াছি তাহা পরিচ্ছন্ন, ঐকদেশিক, ক্ষণিক, মলিন- কিন্তু যাহা চাই তাহা ইহার বিপরীত। যদি পূর্ণ আনন্দ, পূর্ণ সৌন্দর্য, পূর্ণ প্রেম কখনও আস্বাদন না করিয়া থাকি, তবে উহার জন্য তৃষ্ণা জাগে কেন?
যে পরম সৌন্দর্য পশ্চাতে থাকিয়া এই তৃষ্ণা উদ্দীপন করিয়াছে, তাহাকেই আবার সম্মুখে উপলব্ধি না করিলে ইহার নিবৃত্তি হইবে না। সংসারে আনন্দ যতই পাই, সৌন্দর্য যতই দেখি, ততই প্রাণে অভাববোধ আরও বেশী করিয়া ফুটিয়া উঠে।
দেখিয়াও দেখিবার সাধ কিছুতেই মিটে না, মনে হয় ইহা অপূর্ণ। যখনই অপূর্ণ বলিয়া বুঝি, তখনই সীমা চোখে পড়ে, তখনই অজ্ঞাতসারে প্রাণ কাঁদিয়া উঠে। মনে হয় আরও- আরও এগিয়ে যাই, হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে কোন একদিন তাহাকে ধরিতে পারিব। কিন্তু হায় মোহ!
বুঝিতে পারি না যে কালপ্রবাহে এ আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি হইতে পারে না। আনন্দ যতই বাড়ুক, সৌন্দর্য যতই উজ্জ্বল হউক, তৃপ্তি তবুও সুদূরপরাহত, কারণ আরও বিকাশ সম্ভবপর এবং কখনই এই ক্রমবিকাশের সম্ভাবনীয়তা দূর হইবে না।
ইহা হইতে বুঝা যাইবে, হৃদয় যাহা আকাঙ্ক্ষা করে, তাহা সসীম সৌন্দর্য কিংবা পরিমিত আনন্দ নহে। যদি হইত, তাহা হইলে একদিন না একদিন ক্রমবিকাশের ফলে তাহার তৃপ্তি হইত। বস্তুতঃ ইহা অসীম সৌন্দর্য, অনন্ত প্রেম, নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ।
………………………….
গোপীনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্য চিন্তা’ বর্তমান পত্রিকা থেকে
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন