ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু
চারিদিকে ভক্তগণ মাঝে হরিচাঁদ।
তারা গণ্য মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।।
এইভাবে বসে আছে হরি দয়াময়।
হেন কালে শ্রী তারক আসিল তথায়।।
তারকেরে ডাক দিয়া কহিল তখন।
শুন শুন শুন বাছা আমার বচন।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
আমি আসিয়াছি তাই জানাতে সবারে।।
লয়ে নারী ব্রহ্মচারী সত্য কথা কবে।
আমার এ যুগ ধর্ম পালন করিবে।।
বিবাহ কর হে বাছা গৃহস্থ সাজিয়া।
গৃহ কর্ম শ্রেষ্ঠ হয় দেখরে ভাবিয়া।।
তারক বলিছে প্রভু বিয়া না করিব।
বিবাহ করিলে আমি পাশ বদ্ধ হব।।
নারী লোভে অর্থ লোভে কামাসক্ত হয়ে।
নষ্ট হবে এ জীবন তোমাকে ভুলিয়ে।।
তারকের কথা শুনে বলে দয়াময়।
বিবাহ করিলে বাছা আমার কথায়।।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি বলি তাই।
আমাকে পাইবি তোর কোন চিন্তা নাই।।
তারক বলেছে মোরা টাকা কড়ি নাই।
কেনা বেচা করে হাটে সংসার চালাই।।
ঠাকুর বলেছে বাচা মন ঠিক চাই।
আমি দিব সব টাকা কোন চিন্তা নাই।।
সূর্য্য নারায়ণ আর সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
দু’জনারে ডাক দিয়া হরিচাঁদ কয়।।
তোমরা দুজনে যাও ভাগুড়া গ্রামেতে।
তাই শুনে কয়জনে করিল গমন।।
বিয়ে দিল তারকের ঠাকুরের মতে।
চিন্তামণি নামে কন্যা হল তার সাথে।।
সে সব বৃত্তান্ত লীলামৃত লেখা আছে।
নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।।
এই ভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
দাম্পত্য জীবনে তারা অতি সুখি হল।।
ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়।
দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে মন বুঝে লয়।।
একদিন সে তারক ভাবে মনে মন।
টাকা কড়ি হাতে নাই কি করি এখন।।
গৃহেতে তণ্ডুল নাস্তি মনেতে জানিয়া।
কি করিবে কোথা যাবে, না পায় ভাবিয়া।।
মনে মনে সে তারক ভাবিল হৃদয়।
বাকি মাছ কিনে লভ্য হইবে নিশ্চয়।।
লোহাগড়া হাটে যায় ঝাকা ডালা লয়ে।
মাছ কিনে বেচিবে সে কাটিয়ে কাটিয়ে।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
উপনীত হইল গিয়ে মাছ হাটেতে।।
এক দোকানেতে দেখে বড় এক মাছ।
তাই দেখে মনে মনে ভাবে রসরাজ।।
বড় এক রুই মাছ দেখিয়া নয়নে।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা জাগে তার মনে।।
মনে মনে ভাবিতেছে কবি রসরাজ।
হরি যদি খাইতেন এই রুই মাছ।।
মনের বাসনা মোর হইতো সফল।
ভাবনার সাথে সাথে ঝরে আখি জল।।
যাহার দোকানে এই রুই মাছ ছিল।
তাহার পিছনে গিয়া তারক দাড়াইল।।
সে মাছের খরিদ্দার ছিল বহু জন।
নয় শিকা মূল্য তারা কহিল তখন।।
তারক তথন গিয়ে দাড়াইল পাশে।
সে মাছের খরিদ্দার কেহ নাহি আসে।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
মাছের দোকান দার তারকেরে কয়।।
মাছ তুমি নিবে নাকি শুন ওরে ভাই।
তারক বলেছে মোর কাছে টাকা নাই।।
বাকি যদি দাও ভাই তবে নিতে পারি।
হাট শেষে দিব টাকা মাছ বিক্রি করি।।
তাই শুনে সে বেচারা কহিল তখন।
মাছ বেচে দিও টাকা সময় মতন।।
তারক বলেছে তুমি কত মূল্য লবে।
সে বলেছে তুমি নিলে পাঁচ শিকা দিবে।।
তখনি তারক চন্দ্র সেই মাছে নিয়ে।
বটি দিয়ে অর্ধ অংশ ফেলিল কাটিয়ে।।
মাথা সহ সেই ভাগ ঝাকা মধ্যে রাখি।
সাবধানে রাখিলেন ডালা দিয়ে ঢাকি।।
বাকি অংশ কেটে কেটে ভাগ সাজাইল।
এমন সময় এক খরিদ্দার এল।।
সে বলেছে আমি তব সব মাছ লব।
এক কথা বল তুমি কত মূল্য দিব।।
তারক বলেছে যদি সব মাছ নিবে।
এ মাছের মূল্য মোরে পাঁচ শিকা দিবে।।
তাহা শুনি খরিদ্দার পাঁচ শিকা দিয়ে।
বিদায় হইল তিনি সেই মাছ নিয়ে।।
এমন সময় এল পূর্ব মহাজন।
তারকেরে ডেকে বলে মধুর বচন।।
শুন শুন ও তারক মোর দাম দাও।
আমি এবে ঘরে যাব দেনা শোধ হও।।
অমনি তারক চন্দ্র পাঁচ শিকা দিল।
মূল্য লয়ে সে বেচারা বিদায় হইল।।
অমনি তারক চন্দ্র ভাবিতে লাগিল।
হরিচাঁদ ছবি খানি মনেতে জাগিল।।
প্রেমে পুলকিত চিত্ত কবি রসরাজ।
মনে ভাবে এই বুঝি ঠাকুরের কাজ।।
ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু হরি দয়াময়।
জানিয়া ভক্তের মন এ খেলা খেলায়।।
আনন্দেতে আত্মহারা ভাবেতে বিভোলা।
মস্তকে করিল সে, সে মাছের ডালা।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
প্রেমে গদ গদ চিত্তে লাগিল হাটিতে।।
চলেছেন রসরাজ ওড়াকান্দি পথে।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি কেহ নাই সাথে।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
প্রেমে পুলকিত চিত্ত চলেছেন পথে।।
মনে ভাবে ওগো প্রভু তুমি দয়াময়।
কামনার ফল তুমি দিয়েছ আমায়।।
দয়া করে নিও প্রভু তোমার নিকটে।
হেন কালে উপনীত তারাইল ঘাটে।।
মধুমতি নদী তাহে খরস্রোত বয়।
খেয়াঘাটে খেয়া নাই কি হবে উপায়।।
রাত্রি কালে খেয়া নৌকা এপারে না থাকে।
সন্ধ্যা হলে নৌকা খানি ও পারেতে রাখে।।
পূর্ব পারে পাটনীর বাড়ী ঘর ছিল।
খেয়া তরী ঘাটে বেধে গৃহেতে রহিল।।
পশ্চিম কুলেতে বসে তারক রসনা।
ডাকি ডাকি কারিতেছে কেহ তা শোনে না।।
মনে মনে ভাবিতেছে ভক্ত চূড়ামণি।
নিরাশা পাথারে কেনে ভাসালে তরণী।।
মনে বড় আশা ছিল কামনার ফল।
তোমাকে খাওলে হবে জীবন সফল।।
সে বাসনা আজি মোর না হল পুরণ।
বুঝিলাম দয়াময় আমি অভাজন।।
আমি অতি মুঢ় মতি ওগো দয়াময়।
সে কারণে খেয়া ঘাটে ঠেকিলাম দায়।।
এত ভাবি সে তারক কান্দিতে লাগিল।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা হৃদয়ে জাগিল।।
চক্ষু যদি বসিলেন নদীর কিনারে।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি নীরে।।
খেয়া ঘাটে বসে আছে সমাধির প্রায়।
মন পাখি উড়ে গেল ঠাকুরের পায়।।
একে ভীষণ শীত তাহে নদী কুল।
তারকের গায়ে শীত নাহি এক চুল।।
ও দিকে তে হরিচাঁদ প্রভু দয়াময়।
শয়ন করিয়া আছে কোমল শয্যায়।।
আচম্বিত শয্যা হতে নিদ্রা ভঙ্গ হল।
থর থর মহাপ্রভু কাপিতে লাগিল।।
ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু দয়াময় হরি।
তারকের গাত্র শীত নিজ দেহে ধরি।।
ছট ফট করিতেছে শয্যার উপরে।
তাহা দেখি শান্তিদেবী কহে ধীরে ধীরে।।
ওগো প্রভু কি হইল বল গো আমায়।
ছট ফট কেন কর ওগো দয়াময়।।
তাহা শুনি বলেছেন দয়াময় হরি।
শীতে ভীষণ জ্বালা সহিতে না পারি।।
হস্ত পদ ঠান্ডা হয়ে গিয়াছে আমারি।
কহ কহ কহ প্রিয়ে কি করি এবার।।
তাহা শুনি শান্তি দেবী লেপ কাথা আনি।
ঠাকুরের দেহ পরে দিলেন তখনি।।
যত দেয় লেপ কাথা তত শীত বাড়ে।
তাহা দেখে শান্তি দেবী ডাকে গোলোকেরে।।
গোলক পাগল ছিল বাহির বাটিতে।
মায়ের ব্যাকুল স্বর শুনিল কানেতে।।
ব্যাস্ত হয়ে সে গোলক আসিল তথায়।
মহাপ্রভু কাপিতেছে দেখিবারে পায়।।
গোলোক বলেছে বাবা কি খেলা তোমার।
তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।।
তুচ্ছ শীত লাগি কেন কাঁপিতেছ তুমি।
সকল সহিতে পার ওগো বিশ্ব স্বামী।।
এত কেন উচাটন দেখি যে তোমায়।
কহ কহ কহ প্রভু ধরি তব পায়।।
গোলোকের বাক্য শুনে হরি চাঁদ বলে।
সকল সহিতে পারি নিজ অঙ্গে হলে।।
কিন্তু যদি ভক্ত অঙ্গে কোন কিছু হয়।
সে সব সহিতে নারি এই দুনিয়ায়।।
আমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি।
ভক্ত অঙ্গ যত কিছু নিজ দেহে ধরি।।
যদি কোন ভক্ত মোরে দেহ করে দান।
শীত গ্রীষ্ম সহ্য করি যদি যায় প্রাণ।।
আজি মোর প্রাণাধিক তারক রসনা।
মধুমতি কুলে বসে কান্দে মোর সোনা।।
পার হতে না পারিয়া রয়েছে বসিয়ে।
শীতের তাপেতে অঙ্গ গেছে ঠান্ডা হয়ে।।
তার দেহ মোর দেহ ভিন্ন কিছু নয়।
তার দেহে যত শীত আমাতে উদয়।।
শুনরে গোলোক তুমি মোর কথা লও।
তারকে আনিয়া মোর পরাণ বাঁচাও।।
সেই মোর প্রাণাধিক পোষা শুক পাখি।
জীবন চঞ্চল হয় তাহারে না দেখি।।
ঠাকুরর বাক্য শুনে গোলকে গোঁসাই।
বলে বাবা চলিলাম কোন চিন্তা নাই।।
জয় হরি বল মন গৌর হরি বলে।
অন্ধকার রাত্রি সেথা একা একা চলে।।
চলেছেন ভক্ত বীর অনুরাগ ভরে।
দেখিতে দেখিতে গেল মধুমতী তীরে।।
খেয়া তরী ঘাটে বাঁধা দেখিতে পাইয়া।
আপনি চলিল সেই তরণী বাহিয়া।।
ওপারেতে গিয়ে সেই গোঁসাই গোলোক।
বারে বারে ডাকিতেছে তারক তারক।।
তারক বসিয়া ছিল সমাধির প্রায়।
গোলোক চাঁদের ডাক শুনিবারে পায়।।
তখনি তারক চন্দ্র চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে কেন্দে বলিতেছে আধ আধ ভাস।
কি লাগিয়া এলে দাদা কর হে প্রকাশ।।
তারকের বাক্য শুনে গোলোক বলেছে।
এই মাত্র ছিনু আমি ঠাকুরের কাছে।।
ঠাকুরের আজ্ঞা নিয়া এসেছি রে ভাই।
তোর মত হরিভক্ত এ জগতে নাই।।
তোর লাগি বাবা আজি ওড়াকান্দি বসে।
ছট ফট করিতেছে আখি জলে ভেসে।।
তারক তারক বলে ছাড়িতেছে হাই।
তাই দেখে তোকে নিতে এসছিরে ভাই।।
হরিচাঁদ পোষা পাখি তুই মোর সোনা।
ভক্তাধীন ভগবান এবে গেল জানা।।
তোর দেহে যত শীত ধরে ভগবান।
তারক তারক বলে হতেছে অজ্ঞান।।
চল তোকে লয়ে যাই ঠাকুরের কাছে।
তুই গেলে ঠাকুরের সব জ্বালা ঘোচে।।
তারক বলিছে দাদা কি কথা কহিলে।
বলিতে বলিতে তথা মুর্ছিত হইলে।।
মুখেতে নাহিক ভাষা কান্দে ফুকারিয়ে।
অমনি গোলোক চন্দ্র ধরিল জড়ায়ে।।
কোলে করে তারকেরে নৌকায় তুলিল।
সে মাছের ডালা শেষে মস্তকে করিল।।
নিজ তাতে শ্রী গোলোক বাহিলেন দাড়।
মুহুর্তের মধ্যে নদী হইলেন পার।।
তারকের কোলে করি চলিল অমনি।
মস্তকে মাছের ঝাকা আশ্চর্য্য কাহিনী।।
চলেছেন ভক্তবীর অনুরাগ ভরে।
হরিচাঁদ ছবি খানি রাখিয়া অন্তরে।।
যেদিন গন্ধমাদন আনে হনুমান।
তেমনি গোলোক চন্দ্র চলেছে ধীমান।।
মুহেুর্তেকে উতরিল ওড়াকান্দি গাঁয়।
ঠাকুরের কাছে নিয়ে হইল উদয়।।
অমনি দয়াল হরি বাহু প্রসারিয়া।
তারকেরে বক্ষে ধরে কহিছে কান্দিয়া।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন।
তোরে না দেখিলে মোর বাঁচে না জীবন।।
তোরে বিনে এ জীবনে কোন শান্তি নাই।
তোর মত ভক্ত যেন যুগে যুগে পাই।।
পরশমণির স্পর্শ তারক পাইয়া।
চৈতন্য হইয়া কান্দে পদেতে পড়িয়া।।
এ দীন বিনোদ বলে ওপদ লাগিয়া।
জনম চলিয়া গেল কান্দিয়া কান্দিয়া।।