-প্রণয় সেন
যে যোগী এই সমস্ত নাড়ীগুলোকে জানেন তিনি যোগ লক্ষণ যুক্ত হয়ে যান এবং জ্ঞাননাড়ী হতেই যোগীগণ সিদ্ধিলাভ করে থাকেন। আমাদের শরীরের মধ্যে আবার অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী।
কূহূ : কুহূনাড়ি জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে। এর অবস্থান সুষম্নার বাম দিকে।
বিশ্বোদরা : ইড়া ও সুষম্নার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই নাড়ী অবস্থিত। এই নাড়ি উভয় নাড়ীর সমান্তরলা ভাবে বিস্তৃত।
গান্ধারী : সুষম্নার বাম দিককার সহযোগী স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে এই নাড়ী অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তের তলদেশ থেকে বাম পা পর্যন্ত এই নাড়ী অবস্থিত।
হস্তীজীহ্বা : সুষম্নার সম্মুখভাগে এই নাড়ী অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তভাগ থেকে বাম পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত এই নাড়ী অবস্থিত।
শঙ্খিনী : আর আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে।
জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন।
গুহ্যদেশে মূলাধার চতুর্দল (Muladhara Chakra) – Root Chakra – (Red-লাল)
লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান ষড়দল (Svadhishthana Chakra) – Sacral chakra – (Orange-কমলা)
নাভিতে মণিপুর দশদল (Manipura Chakra) – Solar Plexus chakra (Yellow-হলুদ)
হৃদয়ে অনাহত দ্বাদশদল (Anahata Chakra) – Heart chakra – (Green-সবুজ)
কণ্ঠে বিশুদ্ধ ষোড়শদল (Vishuddha Chakra) – Throat Chakra – (Blue-নীল)
ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা দ্বিদল (Ajna Chakra) – Third Eye chakra (indigo-নীলাভ)
মস্তকে সংস্রার সহস্রদল (Sahasrara Chakra) – Crown chakra (violet-বেগুনী)
যোগশাস্ত্র মতে কুলকুণ্ডলিনী হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে মত অনুসরণ করেই যুগে যুগে সাধকপুরুষরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভের অন্বিষ্ট খুঁজেছেন।
বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষটচক্রান্তু ক্রমাদিতি।।
অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষটচক্র বিরাজ করেন।
মূলাধার চক্র
এই চক্রে রয়েছে সকল নাড়ীর মূলবিন্দু। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত স্থানকে বলা হয় কুন্দস্থান। এই কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান প্রধান নাড়ীগুলো উৎপন্ন হয়েছে। এই চক্রে সকল শক্তির আধার বিদ্যমান থাকে। এই শক্তিকে বলা হয় কুলকুণ্ডলিনী।
কুন্দস্থানে এই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করে। শরীরের পদ্মসূত্রের মতো সূক্ষ্ম আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি কুন্দস্থানে ঘুমিয়ে আছেন। সেই মত অনুসরণ করে যোগীরা এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করার চেষ্টা করে থাকেন।
এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান। এখানকার বীজমন্ত্র হলো ‘লং’।এই বীজের ঠিক নীচে একটি ত্রিকোণ আছে। সেখানেই সুপ্তভাবে কুণ্ডলিনী বিরাজ করেন। একটি ধুসর লিঙ্গকে সাড়ে তিন পাকে জড়িয়ে তিনি সুপ্তভাবে থাকেন নিদ্রিতরূপে।
এই শক্তি যতক্ষণ নিদ্রিত থাকে ততক্ষণ মানুষও পশুর মত থাকে। তার উত্তরণের শুরু হয় এই শক্তি জাগ্রত হলে। এখান থেকেই সুষুম্না নাড়ীর উদ্ভব ঘটে। এর বাঁ দিক থেকে ওঠে ইড়া নাড়ী এবং ডানদিক থেকে পিঙ্গলা নাড়ী।ইড়া নাড়ী চন্দ্র্স্বরূপা, পিঙ্গলা নাড়ী সূর্যস্বরূপা এবং সুষুম্না নাড়ী চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি স্বরূপা।
এই চক্রের চারটি পাঁপড়িনির্দেশ করে ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ। এখান থেকেই সবার সাধনার শুরু। এর তত্ত্ব হলো পৃথিবী এবং এর ইন্দ্রিয় ঘ্রানেন্দ্রিয়।
সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়।
কুণ্ডলিনীর অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজনন শক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই কুণ্ডলিনী। এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের একটিমাত্র লক্ষ্য।’
মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি কুণ্ডলিনী শক্তি সব শক্তির আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষটচক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে।
প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।
প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে।
এই ‘ওজস’ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব। যাঁর ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হন।
যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।
আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া, মধ্যে সুষুম্না ও ডানদিকে পিঙ্গলা নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে।
সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয় স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষটচক্র বলা হয়। এগুলি হলো-
স্বাধিষ্ঠান চক্র
এর অবস্থান নাভিচক্রের নিচে।
মণিপুর চক্র
নাভিদেশের কেন্দ্রে এই চক্রের অবস্থান। গোতময়ী তন্ত্রের মতে এই স্থানে অসীম এবং শক্তিশালী তেজ অবস্থান করে। এই তেজকে মণির সাথে কল্পনা করে এর নামকরণ করা হয়েছে মণিপূরকচক্র।
অনাহত চক্র
হৃদপিণ্ড বরাবর নাভিপদ্মের উপরে মেরুদণ্ড সংলগ্ন অঞ্চলে এই চক্রটি অবস্থিত। তান্ত্রিকদের মতে, এই চক্রের মাধ্যমে সাধকরা অনাহত নাদ শুনতে পারেন।
বিশুদ্ধিচক্র
এর অবস্থান মেরদণ্ড সংলগ্ন কণ্ঠ মূল বরাবর। যোগীরা মনে করেন, এই চক্রের মাধ্যমে মানুষ শুদ্ধ হয়।
আজ্ঞাচক্র
এই চক্রটি দুই ভ্রূরুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যোগীদের মতে, এই চক্র থেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এই চক্রের খুব কাছেই আজ্ঞা চক্রের উপরেই রয়েছে মনস ও সোম নামক দুটি ক্ষুদ্র চক্র। যোগীদের মতে এই চক্রের মাধ্যমে গুরু আজ্ঞা বা নির্দেশ আসে। এই কারণে এর নাম আজ্ঞাচক্র।
সহস্রার পদ্ম
সেখানে কুণ্ডলিনী গেলে সমাধি হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব আছেন- তিনি শক্তির সহিত মিলিত হন। শিব-শক্তির মিলন!
সহস্রারে মন এসে সমাধিস্থ হয়ে আর বাহ্য থাকে না।মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় থাকলে একুশদিনে মৃত্যু হয়। – ইহাই দেবত্ব অবস্থা।
………………………..
রাজযোগ – স্বামী বিবেকানন্দ
প্রাণায়াম রহস্য – স্বামী রামদেব
পরমার্থ প্রসঙ্গ – স্বামী বিরজানন্দ
মন ও তার নিয়ন্ত্রণ – স্বামী বুধানন্দ
ধ্যান ও মনের শক্তি – স্বামী বিবেকানন্দ
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন
………………………………..
আরো পড়ুন:
দিব্য-আলোক ধ্যান ওঁ স্বং ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার : এক
দিব্য-আলোক ধ্যান ওঁ স্বং ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার : দুই