গুরু শিষ্য অভেদ
মধু আর দীননাথ শ্রীহরি ভজন।
হরি বোলে হইল যবে এই তিন জন।।
তারকেরে গুরু করি খেল তার ভাত।
তিনজনে জয়পুর করে যাতায়াত।।
তাই শুনে গ্রাম্য লোকে কহিতে লাগিল।
কাড়ারের ভাত খেয়ে জাতি মান গেল।।
গ্রামবাসী যত লোক বসি এক ঠাই।
তিন জনে ডাকি আনি কহিল সবাই।।
বে-জাতির ভাত কেন খেলে তিন জন।
সামাজিক প্রথা কেন করিলে বর্জন।।
মধু কহে জোড় হাতে সবার স্বাক্ষাতে।
গুরু প্রসাদ খেলে ক্ষতি কি তাহাতে।।
তিনজন গুরু করি খাইলাম অন্ন।
ইহাতে কি হইয়াছি এতই জঘন্য।।
জাতি হিংসা দলাদলি মোটেই কর না।
জাতি হিংসা করে মোর এহেন যাতনা।।
তাই শুনি গ্রাম্য লোক রুষিয়া উঠিল।
যাহা আসে তাহা মুখে কহিতে লাগিল।।
একজনে বলে ভাই সবাকে জানাই।
ইহাদের সঙ্গে কোন মেলামেশা নাই।।
এক ঘরে করে রেখ এই তিন জনে।
সামাজিকতা করিব না ইহাদের সনে।।
তাহা শুনি গ্রাম্য লোক করিলেন তাই।
তিন জন বাদ প’ল জানিল সবাই।।
তাই শুনে তিন জন জয়পুর যায়।
তারকের কাছে গিয়ে এসব জানায়।।
তারক বলেছে বাছা মন ঠিক চাই।
হরিচাঁদের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।।
গুরুর আদেশ বাণী শুনিয়া কর্ণেতে।
তুষ্ট হয়ে তিন জন আসিল বাটিতে।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
সমাজের মধ্যে তারা স্থান নাহি পায়।।
দৈব যোগে একদিন ঝড় বযে যায়।
প্রলয় ঝড়েতে সব গ্রাম উজাড়য়।।
মধুসুদনের এক বড় এক ঘর ছিল।
সেই ঝড়ে ঘরখানি মাটিতে পড়িল।
কি করিবে কোথা যাব ভাবিয়া না পায়।
ঘর উঠাইবে বলে গ্রামেতে জানায়।।
গ্রামের লোক বলে মোরা পারিব না।
ঘর উঠাইয়া লহ সেই তিন জনা।।
গালাগালি দিয়ে সবে এই কথা কয়।
দেখি তোর কোন বাবা ঘর তুলে দেয়।।
এ কথা শুনিয়া মধু পদ্মডাঙ্গা যায়।
দীননাথ আর হরি ভজনে জানায়।।
ঘর পরে গেছে ভাই কি হবে উপায়।
গ্রামবাসী সব লোকে বলেছে আমায়।।
গালাগালি দিয়ে বলে মোরা পারিব না।
ঘর উঠাইয়া লহ সেই তিন জনা।।
তাহা শুনে দীননাথ কহিতে লাগিল।
তিনজনে ঘর ধরে উঠাইব চল।।
এই বলি তিনজন করিল গমন।
ঘরের নিকটে গিয়ে দিল দরশন।।
ঘুটিপুতি আড়াগুলি সকল বাঁধিল।
তারক তারক বলে কান্দিতে লাগিল।।
যেই চাল উঠাইতে লাগে বিশজন।
তারকে স্মরণ করি ধরিল তখন।।
তিন জনে চাল ধরি উঠাইয়া দিল।
কিছুদূর উঠে চাল নামিতে লাগিল।।
তিন জনে চাল ধরি ঠেলিছে উপরে।
তবু সেই চাল খানি নিচে সরে পড়ে।।
ওদিকেতে জয়পুর তার গোঁসাই।
ছটফট করিতেছে মন সুস্থ নাই।।
চারিদিকে বসে আছে দোঁহারের গণ।
তার মধ্যে বসে আছে সূর্য্য নারায়ণ।।
অমনি তারক চন্দ্র উঠে দাড়াইল।
উপরের চাল ধরি ঠেলিতে লাগিল।।
তাহা দেখি কহিতেছে সূর্য্য নারায়ণ।
ঘর ধরি ঠেল তুমি কিসের কারণ।।
তারক কহিছে আমি সহিতে না পারি।
আমাকে ডেকেছে মধু থেকে ঝুটিশ্বরী।।
প্রচন্ড ঝড়েতে তার ঘর পড়ে গেছে।
ঘর উঠাইবে বলে আমাকে ডেকেছে।।
মধু আর দীননাথ শ্রীহরি ভজন।
স্বকাতরে ডাকিতেছে করিয়া স্মরণ।।
মনপ্রাণ সপে দিয়ে ডাকিতেছে তারা।
সেই জন্য প্রাণে মোর জাগিতেছে সাড়া।।
এত বলি শ্রীতারক মৌন হয়ে রয়।
মহাভাব উথলিয়া বক্ষ ভেসে যায়।।
তাই দেখে মনে ভাবে সূর্য্য নারায়ণ।
ঝুটশ্বরী যাবে বলে করিলেন মন।।
পর দিন চলিলেন কাঙ্গালীকে নিয়ে।
দুইজনে পথে চরে শ্রীহরি স্মরিয়ে।।
পথে যেতে কত কিছু ভাবিতে লাগিল।
সন্ধ্যা বেলা ঝুটিশ্বরী উপনীত হল।।
দু’জনারে দেখে মধু আনন্দ হৃদয়।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।।
স্বভক্তি প্রণাম করি জিজ্ঞাসে তখন।
বল ভাই কোথা হতে তব আগমন।।
সূর্য্য নারায়ণ বলে বলি তব ঠাই।
জয়পুর হতে মোরা এসেছিরে ভাই।।
দু’টি কথা জিজ্ঞাসিব বলহে এখন।
ঝড় হয়ে ঘর প’ল কবে এ ঘটন।।
সেই ঘর কবে তুমি উঠাইলে ভাই।
কহ কহ কহ ভাই পরাণ জুড়াই।।
মধু কহে গত কাল ঘর তুলিলাম।
তিন জনে ঘর তুলি ল’য়ে গুরু নাম।।
তারকের নাম ল’য়ে তুলি এই ঘর।
তারক তারক বলে কান্দিছে অন্তর।।
সেই হতে মন পাখি জয়পুর গেছে।
জয়পুর যাব বলে মনে জাগিতেছে।।
তাই শুনে কেন্দে বলে সূর্য্যনারায়ণ।
মধুকে ধরিয়া শেষে করে আলিঙ্গন।।
শুন শুন শুন মধু তোমাকে জানাই।
বাড়ী বসে ঘর ঠেলে তারক গোঁসাই।।
কেন্দুয়ার বিল পাশে যখনেতে গেল।
দযার সাগর মোর কহিতে লাগিল।।
শুন শুন ওগো সর্প বলিয়ে তোমায়।
বিল মধ্যে চলে যাও নাহি কোন ভয়।।
এই বিলে আছে কত বড় বড় ধাপ।
সেই খানে আছে তব স্বজাতির সাপ।।
ভয় নাই চলে যাও সুখে কর বাস।
সাপুড়িয়া ধরিবে না দিলাম আশ্বাস।।
এই বাক্য শ্রী তারক যখন বলিল।
সাপের চোখের জল দিগুণ বাড়িল।।
মনে মনে ভাবে সর্প আর কোথা যাব।
হেন সঙ্গ আমি আর কোথা গিয়া পাব।।
আমার জীবন ধন্য হেন সঙ্গ পেয়ে।
তাই ভেবে মুখ পানে রহিলেন চেয়ে।।
তাই দেখে শ্রী তারক ভাবে মনে মন।
যাদবেরে ডেকে ডেকে কহিল তখন।।
দুই জনে সাপ ধরে ছাড়াইয়া দাও।
ভয় নাই ছাড়াইয়া জঙ্গলে ফেলাও।।
তাই শুন দুই জন সর্পকে ধরিল।
ধরে নিয়ে সেই সাপ জঙ্গলে ফেলিল।।
জঙ্গলে পড়িয়া সর্প ভাবে মনে মন।
তীর বেগে ছুটে গিয়ে ধরিল চরণ।।
তারকের দু’টি পদ জড়াযে ধরিল।
ফণা বিস্তারিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
তাই দেখে সে যাদব কহিল তখন।
শুন বাবা বলি তোমা আমার বচন।।
ভাষাহীন সর্প জাতি কান্দিয়া বুঝায়।
তোমার চরণে সাপ কি যেন কি চায়।।
তাই শুনে তারকের দয়া উপজিল।
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিতে লাগিল।।
এরপর জন্মে তুমি মনুষ্য হইবে।
হরি ভক্ত হয়ে সদা হরি গুণ গাবে।।
এই বাক্য যখনেতে তারক বলিল।
চরণ ছাড়িয়া সর্প প্রণাম করিল।।
প্রণাম করিয়া সর্প জঙ্গলেতে যায়।
বিনোদ কহিছে হরি বল রসনায়।।
হেনকালে উপনীত সেই তিনজন।
অগ্র ভাগে চলিতেছে তারক সুজন।।
বৃক্ষতলে যখনেতে উপনীত হল।
বৃক্ষমূলে থেকে সর্প দেখিতে পাইল।।
সর্প রাজ মনে ভাবে এইত সময়।
লাফ দিয়ে পড়িলেন তারকের গায়।।
বুকে পিঠে জড়াইয়া গলেতে জড়ায়।
ফণা বিস্তারিয়া শেষে মুখ পানে চায়।।
তারক ভাবিছে মনে একি হল দায়।
সর্পের চোখের জল দেখিবার পায়।।
তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।
সর্পের মাথায় হাত বুলাতে লাগিল।।
বলে শুন ওগো সর্প বলিয়ে তোমায়।
তোমাকে অভয় দিনু নাহি কোন ভয়।।
এদিকেতে সাপুড়িয়া তারা দুইজন।
সর্পটিকে ধরে নিতে আসিল তখন।।
তাই দেখে শ্রীতারক করিতেছে মানা।
কোন মতে এই সর্প দিতে পারব না।।
তাই শুনি সে যাদব গর্জিয়া উঠিল।
সাপুড়িয়াগণে ধরে গলা ধক্কা দিল।।
ধাক্কা মেরে তাহাদের দেয় তাড়াইয়া।
মার খেয়ে দুই জন গেলেন চলিয়া।।
তারপর চেয়ে দেখে যাদব দুজন।
সাপের আশ্চর্য্য লীলা করি দরশন।।
অমনি সে দুই জন চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা ঠেলিও না পায়।
মানুষ হইয়া মোরা চিনি না তোমায়।।
ভাষাহীন সর্প আজি তোমাকে চিনিল।
তোমার পরশ পেয়ে প্রেমেতে ভাসিল।।
এই ভাবে দুই জন করিছে ক্রন্দন।
তাহাদের ধরে তোলে তারক সুজন।।
তার পর কয় জন করিল গমন।
প্রেমে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
তারকের গলদেশে সাপ ঝুলিতেছে।
সাপের জনম ধন্য আনন্দে ভেসেছে।।
তারক জিজ্ঞাসা করে যাদবের ঠাই।
তোমারা কেমন আছ বল শুনি ভাই।।
যাদব বলেছে গুরু তোমার কৃপায়।
সকলে কুশলে আছে আনন্দ হৃদয়।।
তারক বলেছে শুন আমার বচন।
আমার সঙ্গেতে চল তোমারা দু’জন।।
কাতলী গ্রামেতে যাব করিয়াছি মন।
সেই গ্রামে বাস করে ভক্ত নিবারণ।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদে সদা তার মতি।
তথায় যাইতে হবে চল শীঘ্রগতি।।
যাদব মল্লিক বলে শুন দিয়া মন।
এই খানে করিয়াছি সেবা আয়োজন।।
তারক বলেছে তুমি শীঘ্র দাও খেতে।
হেথা হতে বহু পথ হইবে যাইতে।।
ব্যাস্ত হয়ে সবে মিলে করিয়া ভোজন।
তথা হতে তিন জন করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুণকথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত লাগিল হাটিতে।।
খুলনা জেলা আছে মোল্লাহাট থানা।
গাওনা সে বড় গ্রাম সকলের জানা।।
তাহার উত্তর পাশে এক ভিটা আছে।
সাপুড়িয়া এসে তথা সাপ ধরিতেছে।।
বহু সাপ ধরে তারা হাড়িতে পুরিল।
বড় এক সাপ শেষে ছুটিয়া পালাল।।
রাস্তার পাশে এক বড় গাছ ছিল।
সে গাছের মূলে গিয়ে ঝুলিতে লাগিল।।
সাপুড়িয়া দুই জনে গাছে উঠিয়াছে।
সাপ ধরিবারে তারা তাড়া করিয়াছে।।
সর্প রাজ ভাবিতেছে উপায় কি করি।
মনে মনে ডাকিতেছে তোমায় শ্রী হরি।।
এ বিপদে আজি মোরে রক্ষা কর তুমি।
ভাষাহীন অপরাধী সর্প জাতি আমি।।
কিবা কর্ম ফলে আমি হইয়াছি সাপ।
মনে হয় পূর্ব জন্মে করিয়াছি পাপ।।
বিপদে পড়িয়া ডাকি ওগো দয়াময়।
রক্ষা কর আমি করে আসিয়া হেথায়।।
তাহা শুনি সেই মধু ধুলাতে লুটায়।
কাঙ্গালী পড়িল গিয়ে সে মধুর পায়।।
মধুর চোখের জলে ধরা ভেসে যায়।
পরিবার সহ এসে পড়িল ধরায়।।
এই ভাবে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে প্রেম সম্বরিল।।
সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালীকে লয়ে।
ভোজন করায় শেষে কান্দিয়ে কান্দিয়ে।।
সেই হতে সেই মধু প্রেমিক হইল।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
তারকর প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।