-মোতওয়াল্লী চিলু ভূঁইয়া জালালী
: জালালী দর্শন বা উপাসনা :
ধর্মদর্শন বিশ্লেষকরা ধর্মগুলোকে মূলত উপরোল্লেখিত তিনটি স্তর বিশেষে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে প্রাচ্য তথা সর্বভারতীয় ধর্ম দার্শনিকগণ সর্বজনবিদিত আদি শঙ্কর আচার্য, আচার্য রামানুজ ও মাদব আচার্য এর মতবাদ বেশি জনপ্রিয়। আধুনিক জালালী দর্শন ইহাদেরকে অস্বীকার না করে বরং কিছুটা সংযোজন ও সংশোধন করে অধিকতর প্রচ্ছন্ন করে বলে।
বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মে দ্বৈতবাদের উগ্র-আপোসহীন প্রবাহ দেখা যায়। সাধারণে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানে ঈশ্বর ও সৃস্টিকে দ্বৈতজ্ঞান অর্থাৎ পৃথক করে ভাবে। দ্বৈতবাদের অনুসরণ রাষ্ট্রের ৯৯ শতাংশ লোকজন কর্তৃক স্বীকৃত।
আব্রাহামিক ধর্ম- ইহুদী, খ্রিস্ট, ইসলাম; বৈদিকধর্ম- সনাতন, জৈন, বৈষ্ণব ও অন্যান্য ধর্ম- গ্রীক পৌরাণিক, জোরথ্রুস্ত, বাহাই, শিখ ইত্যাদি প্রায় সকল ধর্মেই জীব-জগৎ এবং পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে দুইটা পৃথক সত্তা অর্থাৎ দ্বৈতজ্ঞান করে ভাবে। বৌদ্ধ ধর্মকে অনেকেই নাস্তিক্য বলে ইহা সঠিক নয়; বৌদ্ধ ধর্মে মানব কর্মফল প্রাপ্ত হইয়া বিভিন্ন লোকে পুনর্জন্ম নেয়।
দ্বৈতবাদ
জালালী দর্শনে মানব মন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অভিজ্ঞতা লব্দ জ্ঞান দিয়ে নিজেকে ও জগৎকে বোঝে; সেইদিক থেকে নিজেকে স্রষ্টা দ্বারা সৃস্ট হইয়াছে এই ধারণায় বিশ্বাস করে, এবং নিজেকে সৃষ্টজীব ও স্রষ্টা হইতে পৃথক বা বহুদূর জ্ঞান করে।
জীবাত্মা বা নিজেকে ও ব্রহ্ম দুইটি পৃথক, খণ্ড জ্ঞানে বিশ্বাসের এরূপ মতবাদকেই দ্বৈতবাদ বলে। জালালী দর্শন মতে প্রায় সর্বাধিক সংখ্যক মানব যে সকল ধর্মগুলোকে অনুসরণ করছে ঐ সকল ধর্ম ভাবসত্তা হইতে সৃজিত হইয়াছে।
‘ভাববাণী যাহা তাহাই স্বগুণ। ভাবসত্তা হইতে যে বাণী উদয় হইয়াছে তাহাই বেদ, কোরআন, হাদিস দলিলে পরিণত হইয়াছে। যাহা করিতে সুখ পায় তাহাই স্বগুণ। নির্গুণ নিষ্কাম নিরঞ্জন যিনি তিনি সুখ দুঃখের অতিত নির্গুণ ব্রহ্ম।’
অদ্বৈতবাদ
শঙ্কর আচার্যের মায়াবাদ বা অদ্বৈত অনুসারে সাধারণত ‘মায়া’ বলতে এমন একটি অনির্বচনীয় শক্তিকে বুঝায় যা রহস্যজনকভাবে জগৎ রূপে প্রতিভাত। মায়া সব রকম অবভাসিক সত্তার সমন্বয়। যখনই আমরা পরম সত্তার একত্বকে অনুভব করতে ব্যর্থ হই তখনই মায়ার উদ্ভব ঘটে।
কোনো বস্তু বা বিষয় প্রকৃতই যা নয় সেভাবে প্রতিভাত হবার নামই মায়া। যেমন অন্ধকারে একটি রজ্জুকে ভ্রমবশতঃ আমরা সাপ মনে করি। ভ্রম দূর হলে সাপের অস্তিত্ব রূপ নেয় বাস্তব রজ্জুর। এ জাতীয় ভ্রান্ত জ্ঞানকেই সাধারণত মায়া বলে আখ্যায়িত করা হয়।
শংকরাচার্যের মতে, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং এ জগৎ মিথ্যা। অজ্ঞতাবশতঃ রজ্জুতে সর্প ভ্রম হয় এবং সর্প দর্শনে আমরা আতঙ্কিত হই। ঠিক তেমনি ভাবে আমরা অজ্ঞতার কারণে ব্রহ্মের স্থূল জগৎ দর্শন করি এবং জগতের প্রতি আকৃষ্ট হই।
যথার্থ জ্ঞান লাভ করলে আমরা যেমন বুঝতে পারি, সর্প সত্য নয় এবং এর পেছনে সত্য হলো রজ্জু, ঠিক তেমনিভাবে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে, জগতের পেছনে পরম সত্য হলো ব্রহ্ম। রজ্জুর পরিবর্তে সর্প অথবা ব্রহ্মের পরিবর্তে জগৎ প্রত্যক্ষণই হলো মায়া।
আদি শঙ্করের অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে জালালী দর্শনে কোন মতের অমিল নেই। পণ্ডিত রামানুজ আদি শঙ্করের ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই বাক্যের বিরোধ ব্যাখ্যাটি করেছেন, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। জালালী মতে,
‘জ্ঞান দুই প্রকার- পাঠাগারের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা জ্ঞান।’
আদি শঙ্কর যে প্রজ্ঞাজ্ঞানী ছিলেন উহা অনেকেই জানেন, তিনি জনৈক রাজার মৃত শরীরে প্রবেশ করে যৌন তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ উদ্দেশ্যে রাণীর গৃহে কিছু সময় অতিবাহিত করেছেন। তিনি ব্রহ্মকে জানেন বা ব্রহ্মাণ্ড। ব্রহ্ম জ্ঞানীর চোখে জগৎ মিথ্যা হইতে পারে, কিন্তু পাঠাগারের জ্ঞানী ইন্দ্রিয় চোখে যাহা দেখেন তাহাই বলবেন ইহা স্বাভাবিক।
জালালী দর্শনে তিনি বলেন, ‘পরমাত্মা পরহিত কল্যাণকর নির্গুণ ব্রহ্ম। এই মহা-সৃস্টি তাহার রূপ মাত্র। এই রূপেতেই পরমাত্মা বিলীন। কীটপতঙ্গ, দানব-মানবাদি, গাছ-বৃক্ষ তরুলতা যাহা কিছু আছে, তাঁহারই রূপের বিকাশ। রূপ মায়া মাত্র। মায়াই নশ্বর, পরম অবিনশ্বর। মায়া হইতে বঞ্চিত হওয়ার পরই তাহার সাধারণ জ্ঞান জন্মে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরমসত্তার রূপ মহাসত্তা, মহাসত্তার রূপ ভাবসত্তা। ভাবসত্তাকে কেন্দ্র করে লীলা এবং নিত্য বিরাজমান। পরমসত্তা একটি বিন্দু মাত্র। পরমসত্তাকে কেন্দ্র করেই সকল সত্তার আবির্ভাব বা উদয়।’
হজরত শাহসুলতান জালালী বলেন যে, ‘যখন তোমার গুরুর উপরে অখণ্ডভাবে বিশ্বাস জন্মে অর্থাৎ গুরু যখন সম্পূর্ণ ভাবে পরমাত্মায় বা ব্রহ্মে বিলীন হন তখন তিনিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর; বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় যে সকল ভক্তগণ অখণ্ডভাবে তার উপাস্য প্রভুকে পরমব্রহ্ম জ্ঞানে বিশ্বাস ও ভজন-সাধন করেন ইহাদের অদ্বৈতবাদী বলা হয়।
বিশিষ্টাদ্বৈত
আচার্য রামানুজ এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের মতে জগৎ ও জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন হলেও ব্রহ্ম থেকেই উদ্ভূত এবং সূর্যের সঙ্গে সূর্যরশ্মির যে সম্পর্ক, ব্রহ্মের সঙ্গে জগৎ ও জীবাত্মারও সেই সম্পর্ক। সেই কারণ ব্রহ্ম এক হয়েও অনেক।
জালালী দর্শনে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ শব্দটি নেই; যেটি আছে তা বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ। অদ্বৈতবাদের সাথে জালালী দর্শনে কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই। নির্গুণ ব্রহ্মই মূল সত্তা। ব্রহ্মই জগৎ ও জীবাত্মা রূপে প্রতিভাত হয়। যিনি সম্পূর্ণ ভাবে ব্রহ্মকে জানেন ও ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত। তিনিই বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী বা উহাই বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ।
আমার মতে, যদিও প্রায় সকল ধর্মগুলোকে দ্বৈতবাদের শ্রেণীতে ভুক্ত করা হয়, কিন্তু বিশিষ্ট ধর্মগুলির নেতাদের বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু সাধারণ অনুসরণকারীদের দ্বারাই ধর্ম সংকলন কালে ইহাদের অদ্বৈতবাদী ভাবধারা, দ্বৈতবাদীদের হাতে অতিমাত্রায় নিষ্পিষ্ট হইয়া ইহাদের স্বকীয়তা হারাইয়া ফেলিয়াছে।
সামাজিক ধর্মগুলোর মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ লোক অদ্বৈতবাদী দর্শনের অনুসারী ভক্ত। মৃত্যকালে ইহারা বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী ব্রহ্মস্বরূপ/স্বরূপাদের কৃপায় ভক্তদের আত্মা তাহাদের অধীনে অমর ধামে থাকিবে; ইহা জালালী বা সূক্ষ্ম জ্ঞানের দর্শন।
………………………………….……………..
জালালী দর্শন সম্পর্কে জানতে আরো পড়ুন-
মৃত্যু ও পরকাল
সৃষ্টিতত্ত্ব
পুনর্জন্ম
স্বর্গ
নরক
দ্বৈত-অদ্বৈত-বিশিষ্ট অদ্বৈত
আত্মজ্ঞান সাধনায় চারটি ধাপ বা স্তর
স্থূল
স্থূল-২
………………………..
অন্যান্য তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া