ভবঘুরেকথা
যীশু খ্রিস্ট ইশা খ্রিস্টান ঈশ্বরপুত্র

তোমরা ধরিত্রীর সার বা লবণস্বরূপ। লবণ যদি তার লবণত্ব হারিয়ে ফেলে তবে তা আর লবণ নয়। ঐ বস্তু তখন অসার, অগ্রাহ্য এবং মানুষের পদদলনের যোগ্য।

ভারতে যখন কোন শিষ্য গুরুর কাছে প্রথমে আসে, তখন তিনি তার মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস জাগিয়ে দিতে চেষ্টা করেন যে দুর্বলতা, কাপুরুষতা এবং পরাজয়- এদের সঙ্গে তার যথার্থ স্বরূপের কোনও সম্বন্ধ নেই। ভগবদ্‌গীতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে বলেছেনঃ ‘‘এ ক্লীবতা তোমার শোভা পায় না। এ কাপুরুষতা ঝেড়ে ফেলে দাও।’

যেমন কাঁচের পাল্লার ভেতর দিয়ে আলমারির ভেতরকার সব জিনিস দেখা যায়, তেমনি যিনি মহান আচার্য, তিনি আমাদের মনের সব কিছু দেখতে পান। কিন্তু তিনি আমাদের দোষ ও দুর্বলতা দেখে ভর্ৎসনা করেন না। তিনি মানব চরিত্র জানেন। যখন আমরা দুর্বল ও হতাশ হয়ে পরি তখন আমরা কিছুই লাভ করতে পারি না এবং তখন আধ্যাত্মিক উন্নতিও সম্ভব নয়। তাই আচার্য আমাদের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দেন।

গুরু কেবল আমাদের বর্তমান অবস্থা দেখেন না, ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও তাঁর জ্ঞাত। বহুবছর পূর্বে একজন তরুণ সন্ন্যাসী ভারত থেকে আমেরিকায় প্রচারে যাত্রার প্রাক্কালে স্বামী তুরীয়ানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। যখন শ্রীরামকৃষ্ণের এই মহান শিষ্য ঐ তরুণ সাধুকে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন, তখন তিনি প্রতিবাদ করে বললেনঃ ‘‘মহারাজ! আপনি যে আমার গুণের এত প্রশংসা করেছেন, আমার তো তা নেই।’’

স্বামী তুরীয়ানন্দ বলেন, ‘‘তুমি নিজের সম্বন্ধে কতটুকু জান? আমি দেখছি তোমার ভবিষ্যতের বিকাশ।’’ সুপ্ত দেবত্বকে জাগাবার শক্তি আমাদের আছে; গুরু কেবল আমাদের ক্ষমতাটির প্রতি বিশ্বাস এনে দেন।

আমাদের সর্বদা স্মরণ করতে হবে সেই দৈব সম্পদঃ ‘‘অহংকারশূন্য ব্যক্তিরাই ধন্য…।’ নিরভিমানতা ও আত্মবিশ্বাস যুগপৎ থাকা চাই। খ্রীষ্ট যে বিশ্বাস তার শিষ্যদের মধ্যে সঞ্চার করেন ‘তোমরা ধরিত্রীর সার’ এই কথা বলে, সে বিশ্বাসের সঙ্গে অহংকারের সম্বন্ধ নেই; তা হচ্ছে পরমাত্মা বা অন্তরস্থিত ভগবানে বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের ফলে আসে শরণাগতি এবং অহমিকা থেকে মুক্তি।

শ্রীরামকৃষ্ণ এ বিষয়ে হিন্দুদের পুরাণ থেকে একটা ঘটনা বলেছেন। রাধা ছিলেন গোপীদের মধ্যে প্রধান এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অধিক ভালবাসতেন। সৌজন্য আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে অহংকারী মনে হত। অন্যান্য গোপীরা তাই রাধার গর্বের কথা শ্রীকৃষ্ণকে জানালে তাদের তিনি কৌশলে রাধাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে বলেন। গোপীদের প্রশ্নের উত্তরে রাধা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আমার অহংকার আছে।

কিন্তু সে অহংকার? আমার নয়; আমার যা কিছু সব শ্রীকৃষ্ণের।’’ যে ব্যক্তি ভগবানে আত্মসমর্পন করেছেন, সাধারণভাবে তাঁর কোন অহংকার নেই। তিনি গর্বিত বা দাম্ভিক হতে পারেন না। নিজ অন্তরস্থ আত্মাতে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; সেই আত্মা ও ভগবান একই বস্তু।

‘‘তোমরা ধরিত্রীর সার’’-যীশুর এই বাণী আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় স্বামী ব্রহ্মানন্দের একটা উপদেশঃ ভগবানের কৃপা তোমরা পেয়েছ, গুরুর কৃপাও পেয়েছ, এবং ভক্তদের কৃপাও পেয়েছ। কিন্তু একটির কৃপা না পেলে তোমাদের সব কিছুই ব্যর্থ হবে। সেই কৃপাটি কি?

এটি হচ্ছে নিজের মনের কৃপা- মুক্ত হবার জন্য তীব্র সংগ্রামেচ্ছা। মনেপ্রাণে ভগবানে পূর্ণ শরণাগতি লাভের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে- যাতে আমাদের অন্তনির্হিত দেবত্ব প্রকাশ পায়। তোমরা পৃথিবীর আলোকবর্তিকা। পর্বতশীর্ষস্থ নগরীকে কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে না।

……………………………..
স্বামী প্রভানন্দের ‘বেদান্তের আলোকে খ্রীস্টের শৈলোপদেশ’ থেকে

পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!