ভবঘুরেকথা
নৃসিংহদেব দেবতা নারায়ণ

শ্রীনৃসিংহদেব বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই এই তিথিতে ব্রতপালন পূর্বক তাঁর পূজা ও উৎসব পালন করা হয়। শ্রীনৃসিংহদেব বলেছেন, আমার ব্রতদিন জেনেও যে ব্যক্তি লঙ্ঘন করে, চন্দ্র-সূর্য যতদিন থাকবে ততদিবসে নরক যাতনা ভোগ করবে।

নৃসিংহের পূর্ববর্তী অবতার বরাহ হিরণ্যাক্ষ নামে এক রাক্ষসকে বধ করেন। হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপু এই কারণে প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। দাদা হত্যার প্রতিশোধের মানোবাসনায় তিনি বিষ্ণুকে হত্যা করার পথ খুঁজতে বহু বছর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেন। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বর দিতে চান।

হিরণ্যকশিপু বলেন, হে প্রভু! আপনি যদি আমাকে সত্যই বর দিতে চান, তবে এমন বর দিন যে বরে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হাতে আমার মৃত্যু ঘটবে না। যে বরে বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে, দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে; শস্ত্রাঘাতে, মানুষ বা পশুর হাতে, কোনো জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে, কোনো উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ, যুদ্ধক্ষেত্রে আমার মৃত্যু হবে না।

এমন বর দিন যাতে আমার কোনো প্রতিযোগী না থাকে। এমন বর যাতে সকল জীবসত্তা ও প্রভুত্বকারী দেবতার উপর আমার একাধিপত্য স্থাপিত হয় এবং আমাকে সেই পদমর্যাদার উপযুক্ত সকল গৌরব প্রদান করুন। এছাড়া আমাকে তপস্যা ও যোগসাধনার প্রাপ্ত সকল সিদ্ধাই প্রদান করুন, যা কোনোদিনও আমাকে ত্যাগ করবে না।

হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিলেন, তখন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করে। দেবর্ষি নারদ হিরণ্যকশিপু স্ত্রী কায়াদুকে রক্ষা করেন। নারদ কায়াদুকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে কায়াদু প্রহ্লাদ নামে একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেন। নারদের প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত।

এতে তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ক্রমে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিতে হিরণ্যকশিপু এতটাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন যে তিনি নিজ পুত্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়।

হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলেন তাঁকে ত্রিভুবনের অধিপতি রূপে স্বীকার করে নিতে। প্রহ্লাদ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা।

প্রহ্লাদ বলেন, তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম যষ্টিটিতেও আছেন। হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন। তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে প্রহ্লাদের সাহায্যার্থে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু।

ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন। হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর মধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাঁকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাঁকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাঁকে বধ করেন তাঁরই গৃহদ্বারে।

ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর সকল দেবতাই নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হন। নৃসিংহকে শান্ত করতে শিব প্রথমে বীরভদ্রকে প্রেরণ করেন। বীরভদ্র ব্যর্থ হল। বিফল হন স্বয়ং শিবও। সকল দেবগণ তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে ডাকেন; কিন্তু লক্ষ্মীও স্বামীর ক্রোধ নিবারণে অক্ষম হন।

তখন ব্রহ্মার অনুরোধে প্রহ্লাদ এগিয়ে আসেন। ভক্ত প্রহ্লাদের স্তবগানে অবশেষে নৃসিংহদেব শান্ত হন। প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নৃসিংহদেব প্রহ্লাদকে রাজা করে দেন।

প্রহ্লাদ মহারাজ শ্রীনৃসিংহদেবের কাছে প্রার্থনা করে বললেন, হে নৃসিংহদেব! তোমার প্রতি আমার ভক্তি কিরূপে উৎপন্ন হল? কিরূপে আমি আপনার প্রিয় ভক্ত হলাম?

শ্রীনৃসিংদেব বললেন, হে বুদ্ধিমান একান্ত মনে শোনো। প্রাচীনকালে তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, কিন্তু বেদপাঠ করোনি। তোমার নাম ছিল বসুদেব এবং তুমি ছিলে বেশ্যাসক্ত। তোমার কোন সুকর্ম ছিল না, কেবল একটি মাত্র আমার ব্রত করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তোমার এরকম আমার প্রতি ভক্তি হয়েছে।

প্রহ্লাদ বললেন, হে নৃসিংহদেব! আমি কার পুত্র ছিলাম এবং কি করতাম? বেশ্যাসক্ত অবস্থায় কিভাবে আপনার ব্রত পালন করলাম? দয়া করে বলুন।

শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, পুরাকালে অবন্তীপুরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল। তার নাম ছিল বসুশর্মা। ধর্মপরায়ণ ও বৈদিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে তৎপর ছিলেন। এবং তাঁর স্ত্রী জগৎপ্রসিদ্ধা সুশীলা পতিব্রতা সদাচারিণী ছিলেন। তাদের পাঁচপুত্র ছিল। চারজন ছিল সদাচারী, বিদ্বান, পিতৃভক্ত।

কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিল অসদাচারী, সর্বদা বেশ্যাসক্ত, সুরাপায়ী। সেই কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিলে তুমি। নিত্য বেশ্যাগৃহেই তুমি বসবাস করতে। এক বনের মধ্যে তুমি ও তোমার সেই বান্ধবী বেড়াতে গিয়েছিলে। তোমরা মনে করেছিলে দিনটা বেশ ভালোই কাটবে।

কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে চরিত্র বিষয়ে বিশেষ রকমের কলহ বেধে যায়। তোমাদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে মৌনভাবে তোমরা আলাদাভাবে একটি স্থানে এসে বসেছিলে। সেখানে তুমি অতি পুরনো ধ্বংসাবশেষ গৃহ নিদর্শন স্বরূপ কিছু ইট পাথর দেখেছিলে।

সেই নির্জন স্থানে আলাদাভাবে উপবেশন করে তোমরা দুইজন কাঁদছিলে আপন আপনভাবে। সারাদিন তোমরা অনাহারী ছিলে, এমনকি জল পর্যন্ত পান করোনি। সারারাতও তোমরা জেগেছিলে। ক্লান্ত শরীরে দুঃখিত অন্তরে মনোমালিন্যভাবে তুমি সেখানে শুয়ে পড়ে প্রার্থনা করছিলে, হে ভগবান! এই জগতের কত লোক সুন্দর! আমার মা-বাবা কত সুন্দর ধর্মপ্রাণ।

আমার ভাইয়েরা কত সুন্দর! তারা নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান। কিন্তু আমি অধঃপতিত। আমি মহা মন্দমতি। আমি চরিত্রহীন। পথের পাগলের চেয়েও অধম। হে ভগবান! ভালো লোকেরা তোমার শরণাগত। আমি মূর্খ কারও শরণাগত নই। আমি অতি নিঃসঙ্গ। আমি বড় অসহায় অবস্থায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমাকে বিশুদ্ধ জীবন দান করো। এভাবে তুমি ক্রন্দন করছিলে।

আর তোমার বান্ধবী, সেও একান্ত মনে প্রার্থনা করছিল, হে ভগবান! আমি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য স্তরের জীব। সভ্য সমাজ থেকে আমি বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী স্বাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। আর আমি মহাপাপী গণিকাবৃত্তি করেই জীবন নষ্ট করেছি।

প্রতিদিনই কেবল পাপের বোঝা বাড়িয়েছি। নরকযাতনা কতই না এই পোড়া কপালে অপেক্ষা করছে। ভদ্র সমাজে কেউ কোনদিনও আমার দিকে তাকাতেও চায় না। আমিও এই জগতের কোনও পথ খুঁজে পাই না। হে পরম করুনাময় ভগবান, যদি তোমার অহৈতুকী কৃপাদৃষ্টি আমার প্রতি থাকে তবে দয়া করে আমার এই জীবন পরিবর্তন করে দাও! এভাবে সে আকুল অন্তরে কাঁদতে লাগলো।

শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে প্রহ্লাদ! সেই স্থানটি ছিল আমার প্রাচীন মন্দির। সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশী আমার আবির্ভাবের দিন। তোমারা উপবাসী ছিলে, রাত্রি জাগরণ করছিলে, জীবনের কল্যাণ প্রার্থনা করছিলে।

অর্থাৎ অজ্ঞাতসারেই তোমরা আমার পরম-মঙ্গলময় চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তুমি এ জন্মে আমার প্রিয় ভক্তরুপে জন্মগ্রহণ করেছ। আর সেই বেশ্যাও স্বর্গলোকে অস্পরা জীবন লাভ করে ত্রিভুবনে সুখচারিনী হয়েছে।

হে প্রহ্লাদ! আমার ব্রতের প্রভাব শোনো। সৃষ্টিশক্তি লাভের জন্য ব্রহ্মা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলেন। ত্রিপুরাসুরকে বধের উদ্দেশ্যে মহাদেব এই ব্রত করেছিলেন। স্বর্গসুখ লাভের জন্যই দেবতারা আগের জন্মে আমার ব্রত করেছিলেন। বেশ্যাও এই ব্রত প্রভাবে ত্রিলোকে সুখচারিনী হয়েছে।

যে সমস্ত মানুষ আমার এই ব্রতশ্রেষ্ঠ পালন করবে, শতকোটি কল্পেও তাদের সংসারে পুনরাগমন নেই। আমার ব্রত প্রভাবে অপুত্রক ভক্তপুত্র লাভ করে, দরিদ্র ধনশালী হয়, তেজস্কামী তেজঃলাভ করে, রাজ্যকামী রাজ্য পায়, আয়ুস্কামী দীর্ঘায়ু লাভ করে।

স্ত্রীলোকেরা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করলে ভাগ্যবতী হয়,এই ব্রত সৎপুত্র প্রদ, অবৈধব্যকর ও পুত্রশোক বিনাশন, দিব্য সুখপদ। স্ত্রী-পুরুষ যারা এই উত্তমব্রত পালন করে, তাদের আমি সুখ ও ভুক্তি-মুক্তি ফল দান করি।

হে প্রহ্লাদ, দুরাত্মাদের আমার ব্রত পালনে মতি হয় না। পাপকর্মেই সর্বদা তাদের মতি।

…………………………………………
আরো পড়ুন:
নৃসিংহদেবের আবির্ভাব তিথি
নৃসিংহদেবের চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য
শ্রীনৃসিংহ স্তব ও প্রার্থনা ও নাম
শনিদেবকৃত শ্রীনৃসিংহদেবের স্তুতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!