ভবঘুরেকথা
দশ অবতার শ্রীরাম অবতারের কাহিনী

-প্রবাল চক্রবর্তী

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী মহামতি কার্ল মার্ক্স শত বিরোধিতা সত্ত্বেও অমর হয়ে আছেন তাঁর “সামাজিক বিবর্তনবাদ তত্ত্বের জন্য। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মনুষ্যজাতি এক দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে পৌঁছেছে বর্তমান সমাজব্যবস্থায়।

সভ্যতার ঊষাকালে মানুষ ছিল অন্যান্য বন্যজন্তুর মতোই যাযাবর, হিংস্র ও কাঁচাখেকো। ক্রমে সে সমাজবদ্ধ হয়, পাথরের যন্ত্র ও অস্ত্র ব্যবহার করতে শেখে এবং ক্রমোন্নতি হতে থাকে। এই সময়ে তারা ব্যাপক হারে বনভূমি কেটে বসতি ও কৃষিজমি সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়।

সমাজের সুশৃঙ্খল পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। এর ঠিক পরেই মানব সমাজে নৃপতি (রাজা) প্রথার উদ্ভব হয়। নৃপতি প্রথার প্রথম যুগে রাজারাও কিন্তু মূলত ছিলেন কৃষক ও যোদ্ধা। কৃষিকর্মের পাশাপাশি পশুপালনও ছিল একটি মুখ্য পেশা। এই অস্থির যুদ্ধবিগ্রহের যুগের সঙ্গেই কিন্তু চলছিল বিদ্যাচর্চার গভীর ও বিপুল আয়োজন।

ভারতভূমিতে আর্য্য রাজত্ব স্থায়িত্ব পেতেই, যুদ্ধবিগ্রহ কমে গিয়ে বুদ্ধিচর্চা ও শান্তিকামিতার বন্যা আসে। ভারতীয় সভ্যতা উন্নতির চরমসীমায় উন্নীত হয় এবং ইতিহাস তার আপন স্রোতে চলতে থাকে।

চতুর্থ অবতার ‘নৃসিংহ’ অর্থাৎ নর ও পশুর মিলিত রূপ। এই অবতারের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ এক ঐতিহাসিক যুগসদ্ধিক্ষণের ইঙ্গিত বহন করে।

পঞ্চম অবতার ‘বামন’, যার আভিধানিক অর্থ ‘খর্বকায় মানুষ’ বা সরল মৌখিক বাংলায় ছোট লোক। কিন্তু এখানে ভাবার বিষয়, ছোটোলোক বলতে আমরা বেঁটে মানুষ বোঝাই? না, সভ্যতায়, ভদ্রতায় খাটো যে তাকেই অমন সম্ভাষণে ভূষিত করা হয়।

আর মানবসভ্যতার আদি যুগের জনগণ যে আজকের মনুষ্যজাতির তুলনায় আচারে, ব্যবহারে, সামাজিক শৃঙ্খলায়, প্রযুক্তিতে ও কৃষ্টিতে বহুগুণ খর্ব ছিলেন, এ তো সহজেই অনুমেয়!!

ষষ্ঠ অবতার ‘শ্রী পরশুরাম’। লক্ষণীয়, এঁর হাতে রয়েছে কুঠার বা কুড়ুল, যা গাছকাটা বা বনভূমি পরিষ্করণের মুখ্য অস্ত্র!! অতএব, পরশুরাম সেই যুগের মানুষের প্রতিভূ, যে যুগে তারা বনভূমি পরিষ্কার করে বাস্তু ও কৃষিজমি সৃষ্টিতে রত ছিল।

সপ্তম অবতার ‘শ্রী রামচন্দ্র’ যিনি একাধারে আর্য্য সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ এবং কৃষিবিশারদ (মনে রাখতে হবে এঁর স্ত্রীর নাম সীতা অর্থাৎ ‘লাঙ্গলের দাগ’, এবং সীতার পিতা মহারাজ জনক, কৃষিকার্য করতে গিয়েই লাভ করেছিলেন তাঁর এই আদরের দুলালীকে এই নামকরণ করেছিলেন)।

শ্রী রামচন্দ্র উত্তর ভারতে সীমাবদ্ধ আর্য্যাবর্তকে এক ভারতব্যাপী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। এমনকি দাক্ষিণাত্য ছাড়িয়ে তাঁর সাম্রাজ্য শ্রীলংকা দ্বীপকেও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সৃষ্টি হয় বিভীষণ, সুগ্রীব, গুহকের মতন করদ রাজন্যবর্গের। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ জন্যই শ্রী রামচন্দ্র এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

এই কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্য স্থাপনের সাথে সাথেই ভারতীয় রাজনীতি হয়ে ওঠে জটিল ও যুদ্ধবহুল। আর এই সময়েই ‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম’ অবতীর্ন হলেন অষ্টম অবতার শ্রী কৃষ্ণ। তিনি পশুপালক ছিলেন বলেই তাঁর অপর নাম ‘গোপাল’।

অথচ তাঁর ভাই তথা বিভিন্ন পুরানে সহঅবতার হিসাবে বর্ণিত শ্রী বলভদ্র বা বলরাম ছিলেন ‘হলস্কন্ধ’ (লাঙলবাহী) অর্থাৎ কৃষক। শ্রী কৃষ্ণ মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী কূটনীতিতে আজও ভারত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসাবে পূজিত হবার অধিকারী।

নবম যুবতার ভগবান বুদ্ধ। রাজপুত্র গৌতমের বুদ্ধির বিকাশ এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে তিনি সনাতন ধর্মে এযাবৎ প্রচলিত দেব, দেবী, স্বর্গ, নরক ইত্যাদি ধারণার বাইরে গিয়ে স্বকীয় ধর্ম সৃষ্টিতে এবং তার বিপুল প্রচারে সফল হয়েছিলেন। এই চরম বৌদ্ধিক বিকাশ ভারত ইতিহাসের পরবর্তী হাজার বছরের মূল নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

দশম অবতার কল্কির আবির্ভাব সম্পর্কে বিবিধ মত ও অস্পষ্টতা থেকে তাঁর মাহাত্ম্য নিরূপনে বিরত থাকলাম। শেষে বলি, এইসব অর্বাচীন চিন্তা একান্তই আমার মস্তিষ্কপ্রসূত। কেউ যদি কোনোভাবে আমার লেখা থেকে কণামাত্র আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে আমি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। জয় নারায়ণ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!