ভবঘুরেকথা
কৃষ্ণ রাধা ব্রজলীলা প্রেম কালা বৃন্দাবন

বিশারদ সর্ব বিষয়ে। বাঁশিতে, রথ চালনায়, চৌর্যকর্ম, কূটনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, ছলচাতুরি- সবকিছুতেই বিশারদ। আর প্রেমপিরিতে তো মহাবিশারদ। এবং কলহ বিতর্ক বাগযুদ্ধ যুক্তি জাদু, অপমান উপেক্ষা করতেও কম যায় না। অথচ পরমতম প্রেমিক পুরুষ।

হ্যাঁ, এমন প্রেম জানে ক’জনা! আর সেই প্রেমেও কত না কাণ্ড! ধরা যাক, কোনও যুবা প্রেমিকপুরুষ প্রেমিকার সঙ্গে নিভৃত মিলনের জন্যে একটি ডেট দিয়েছে। এবং নির্দিষ্ট দিনক্ষণে ঘর ছেড়ে নিভৃত স্থানে প্রেমিকা চলেও এল। তখন প্রেমিক কী করবে?

আবেগে রোমান্সে প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হবে নিশ্চয়। অবশ্যই কলহ বিতর্কে সুযোগটি মাটি করে দেবে না। কিন্তু উল্লিখিত পুরুষ বিশারদটি করে বসল উল্টোটাই। এই বিশারদ কে? পিরিতির শিরোমণি গোপীকান্ত রাধাকান্ত স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। মিলনের প্রাকরাস পর্বে একটি ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি করে ফেলল।

একরকম অবাঞ্ছিত ঘোর অশান্তি। কাত্যায়নী ব্রতদিনেই যমুনা পুলিনে হচ্ছে বস্ত্রহরণ। গোপীদের সেসময় কথা দিয়েছিল প্রেমিক কৃষ্ণ। শারদ পূর্ণিমার চাঁদিনী রাতে আমি তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব। এবং এই কথামতোই সেদিন যথাসময়ে বংশীধ্বনি করে আবাহনও করল কৃষ্ণ।

মোহিনী রাত, উজ্জ্বল নীলাকাশ, ফুলময় কুঞ্জবনে ভ্রমরার গুঞ্জন। রাসপূর্ণিমার বহু বাঞ্ছিত রাত্রি। এবং স্বামী স্বজন পরিজন আর সর্বস্ব ছেড়ে একমাত্র কৃষ্ণমুখী হয়ে গোপীরা নিকুঞ্জবনে উপস্থিত। ওরা তখন প্রেমে উন্মাদিনী। এবং হরিষে বিষাদ। অভাবনীয় সংকট শুরু। ভাবা যায় না।

এহেন পরিমণ্ডলে নাগর কানাইয়ের অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি বদলে গেল। গোপীকান্তর চিত্রটা পুরো বিপরীত। গোপীদের দর্শন মাত্রই বিস্ময়। নির্লিপ্ত নির্বিকার উদাসীন এবং বিরক্ত। পারদ চড়ছে ক্রমে। অবজ্ঞা অবমাননা অপমান। নেপথ্য থেকে সবই দেখছে যোগমায়া, দেখছে প্রকৃতি। কৃষ্ণ-মানসের কী আশ্চর্য বৈপরীত্য! হঠাৎ করেই শুষ্ক সম্বোধন-

‘স্বাগতং বো মহাভাগাঃ’

সৌজন্যসার নিষ্প্রাণ সম্বোধনের পরেই বলছে, ‘‘তোমরা কেন এসেছ? বলো? আমি তোমাদের কী উপকার করতে পারি? ব্রজের কোনও অমঙ্গল হয়েছে কি?’’ ইত্যাদি মামুলি কথায় প্রেমিকাকুল শুধু বিস্মিতই নয়, নৈরাশ্যে শীতল।

এ কী ব্যবহার প্রিয়তমের! অন্তর্যামী কৃষ্ণ, মনোবিদ কৃষ্ণ কিন্তু গোপীদের নৈরাশ্যটি ভালোই বুঝেছে। তারপরই বলছে, ‘‘তোমরা তো সুন্দরী যুবতী। তাতে আবার এখন রাত্রিকাল। নির্জন বন, পথঘাট বিপদ সংকুল। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি তো একজন পরপুরুষ। তাই বলছিলাম কী, তোমাদের আর এখানে থাকা ঠিক নয়। ব্রজে ঘরে ফিরে যাও।’’

গোপীরা ভেবে কুলকিনারা পায় না। এসব কী শব্দাবলি। পরপুরুষ, ঘরে ফিরে যাও, প্রিয়তমের মুখে এসব কী কথা! এদিকে কৃষ্ণ আরেকটি বাক্যবাণ ছুঁড়ল- ‘‘দেখো, আমি তো ব্রহ্মচারী, সবাই জানে লোকনিন্দা বলে তো একটা কথা আছে।’’

এত তীব্র উপেক্ষায় গোপীরা দিশাহারা। আবার বলছে কৃষ্ণ, ‘‘আমার ইচ্ছা ও নির্দেশ যদি তোমরা না মানো, তবে তোমরা থাকো। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। পরনারীর সঙ্গে এই নির্জন পরিবেশে থাকতে আমি রাজি নই। লোকনিন্দা লোকভয় আমার তো আছে। তোমরা চলে যাও।’’ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে গোপিকাদের। উপেক্ষা অপমানে তির বেঁধা হংসী ওরা।

তবু সংগ্রামী শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে ছাড়ছে না। ভাবছে, দেখা যাক না, কে হারে কে জেতে। কোমল কণ্ঠেই বলল গোপীরা, ‘‘প্রাণধন তোমার পাদপদ্মই তো আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ ঠাঁই। তবে কেন নিরাপত্তা পরপুরুষ লোকনিন্দার কথা বলছ। এ কী দুঃস্বপ্ন দেখছি আমরা!’’

চোখের জল ঝরিয়ে তারপর বলল, ‘‘না আমরা ঘরে ফিরব না। সর্বস্ব ত্যাগ করে যখন এসেছি, তখন ঘরে আর ফিরব না। বাঁশিতে ডেকে এনে এখন সাধু উপদেশ! তোমার চরণেই নিজেদের সঁপে দেব। এটা আমাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত।’’

কৃষ্ণের মন গলল না। বলছে, ‘‘তোমরা ঘরে গিয়ে পতিসেবা করো। শিশুদের দুগ্ধ পান করাও। জানি তোমরা আমাকে ভালোবাসো। ব্রজের পশুপাখিরাও আমাকে ভালোবাসে।’’ কৃষ্ণের এই যুক্তিতে হার মানল না গোপীকুল। অবাক হচ্ছে বরং।

ব্রজের সবার সঙ্গে আমাদের ভালোবাসার উপমা! হায় বিধি। এমনতরো মূল্যায়ন ভালোবাসার! তীর ছুঁড়ল আবার কৃষ্ণ- ‘‘আমার প্রতি আসক্ত হয়ো না। সতী-ধর্ম নষ্ট কোরো না। আমি তো পরপুরুষ।’’ বজ্রসম এই যুক্তি। অচলা গোপীরা বলছে উত্তরে, ‘‘আমাদের অন্তর তো তুমি নয়। তোমার সেবাই তো আমাদের পতিসেবা। তুমি তো গোপীকান্ত।’’

সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণের যুক্তি- ‘‘পতি ছাড়া অন্য পুরুষে প্রেম খুবই কুৎসিত। স্বর্গপ্রাপ্তির বড় বাধা। এটা ঔপপত্য অপরাধ। ঘরে ফিরে যাও।’’- ‘‘না, স্বর্গ চাহি না, পুণ্য চাই না, ঔপপত্য দোষ মানি না।’’ বাণ ফুরোয়নি কৃষ্ণের সহজে। বলছে, ‘‘তাই নাকি! কিন্তু এতে যে ভালোবাসা নেই, সেটা জানো না। আর এতে তো আমিও দোষী হয়ে যাব। তো আমার ক্ষতি করা কি তোমাদের ভালোবাসা? যদি তাই চাও, তবে সেই প্রেম আমি বুঝতে অক্ষম। বরং দূর থেকে আমার ধ্যান করো। কিন্তু অঙ্গস্পর্শে প্রেমকে এবং আমাকে কলঙ্কিত কোরো না। ঘরে গিয়ে গৃহধর্ম করো বরং।’’

যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েও কৃষ্ণপ্রেমে অবিচল গোপীরা। নিখাদ প্রেম এমনই। রবীন্দ্র ভাবনায় দেখি, ভালোবাসা কারে কয়। তাই তো কবির কথা, ‘‘আরো আরো প্রভু আরো, এমনি করে আমায় মারো।… যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।’

গোপীদের ভালোবাসা কি রবীন্দ্রকথাতে এমনি করেই প্রতিফলিত! সেই প্রতিফলিত আলোর অক্ষরেই দেখতে পাই,‘ও নিঠুর আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে। তুমি মনে আমায় মারবে।’ গোপীপ্রেম-কৃষ্ণপ্রেম- উপেক্ষা কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠছে। তবু আরও গভীরে যাওয়া যাক না।

গোপীদের বিরহ ও অন্তর্বেদনা প্রসঙ্গে একটি দৃষ্টান্তে শ্রীমদ্‌ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী কী বলেছেন, সেটা ভাবা যাক। চৈতন্য পারিষদ সনাতন গোস্বামী কৃষ্ণের গোপীদের উদ্দেশে বলা দশটি শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছেন।

মহানামব্রতজি ভাগবতের ১০ম স্কন্ধের ২য় খণ্ডের ফেলালবে ওই বিশেষ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বড় অন্তরস্পর্শী ইমেজ সৃষ্টি করেছেন। বলেছেন, ‘‘দশটি শ্লোক নয়, দশটি ইন্ধন- শুষ্ক কাষ্ঠ। তাতে সংযোগ করিয়াছেন ঔদাস্য বহ্নি।’’ অর্থাৎ কৃষ্ণের গোপীদের উদ্দেশে শ্লোক যেন গোপীদের বিরহের আগুনে ইন্ধন জুগিয়েছে।

মহানামব্রতজি ফেলালবে আরও বলেছেন ‘করাতিরা যখন করাত দিয়া কাঠ ফাড়ে, তখন আগে কালো রেখা টানিয়া লয়, তারপর সেই দাগে কাটে। গোপীর অঙ্গে কালো রেখা খবর দিতেছিল এখনই কৃষ্ণের বিরহ ক্রকচ (করাত) তাঁহাদের দেহ কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিবে।’’

গোপী বিরহের উদাহরণ অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। গোপীরা এই যন্ত্রণা ও কৃষ্ণের উপেক্ষার মধ্যেও বলল, কৃষ্ণচরণে আত্মসমর্পণের কথা। বলল, ‘‘তোমার পদে রাখো আমাদের।’’ কৃষ্ণগত একনিষ্ঠ প্রাণই পারে এমন কথা বলতে। ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিল এই ‘পদে রাখো’ মিনতির কথা। তুমুল যুদ্ধ চলছিল। সুতীব্র উপেক্ষা অবমাননা।

কিন্তু বিস্ময়ের এই যুদ্ধাগ্নিতে জল ঢেলে দিল গোপীদের ‘পদে রাখো’ কথাটি। এক মুহূর্তে। অমনি ভক্তের অবিচল প্রেম ভক্তির অন্তহীন নিষ্ঠায় বিগলিত হয়ে গেল যন্ত্রণাদাতা কৃষ্ণ। বলল, ‘‘চলো নিকুঞ্জে যাই। পূর্ণ হবে প্রেম তৃষ্ণা। স্বচ্ছন্দে বিহার করো। যাচ্ঞা করিয়াছ যাহা যাহা, লুটিয়া লও স্বচ্ছন্দে। খুলিয়া দিলাম অন্তরের কপাট।’’ তখন পদ্মপলাশ নয়নে কৃষ্ণের শুধু প্রেম আর করুণা।

কিন্তু, এই যে মিলনের সহৃদয় ডাক, তার আগে এত দীর্ঘকাল বিরহ যন্ত্রণায় গোপীদের দগ্ধ করার কী দরকার ছিল? বংশীধ্বনিতে আহ্বান করে কেন এত আঘাতের পর আঘাত। দরকার ছিল বইকি। কৃষ্ণ প্রেমভক্তির গভীরতার পরীক্ষা নিল যে। তাই পরীক্ষা, তাই বিরহ। বিরহ ছাড়া মিলন অপূর্ণ।

রাসলীলার পরিপূর্ণ সর্বাত্মক আস্বাদনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন বিরহের। আর এটাই ছিল ‘যোগমায়া’র একটি মূল্যবান কৌশল। সেই কৌশলে বিরহ পরীক্ষায় সমর্যাদায় উত্তীর্ণ গোপীগণ। গোপীপ্রেম যে কত নিখাদ, কত গভীর কত পরিপূর্ণ তা সর্বৈব প্রমাণিত হয়ে গেল যোগমায়ার কৌশলাত্মক মহাপরীক্ষায়। কঠিন বেদনার পরীক্ষায় প্রেমের উজ্জ্বল বার্তাটি প্রকাশিত। যার যোগ্যতর উদাহরণ দুর্লভ।

এবার গোপীদের সঙ্গে প্রেমের রাসলীলা শুরু। শ্রীরাধারমণ গোপিকাকান্ত কৃষ্ণচন্দ্র গোপীদের নিবিড় বেষ্টনে প্রেমলীলায় ডুবে গেল। এখন মধুময় প্রেমময় নিকুঞ্জবন। আনন্দলহরীতে বংশীধ্বনি মূর্ছনায় রাসবাসর এবার মুখরিত।

…………………………………………………….
চিদানন্দ গোস্বামী বর্তমান পত্রিকা থেকে সংকলিত

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে-
https://youtu.be/4Bwc0lvjU0M

পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!